শাহেদকে প্রথম দর্শনেই বড় আপনার মনে হয়েছিল। পরে এটা নিয়ে ভেবেছিলাম তাকে এতো ভাল লাগার কারণগুলি নিয়ে। শাহেদ বুকের ভেতরের অসম্ভব প্রাণশক্তি, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি, অবৈষয়িক মনন, শান্ত প্রগতিশীল ও ভড়ংহীন একটি তেজী আত্মা নিয়ে আমার সামনে হাজির। প্রথম দেখাতেই মনে ধরেছিল! যতদুর স্মৃতিতে আসে, খুব দ্রুত না বরং ধীরে ধীরেই শাহেদের সাথে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল। কবি শাহেদ শাফায়েত এর সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৯৫ সালে গরম কালে। মাসটা সম্ভবতঃ জুলাই/আগস্ট হবে। আমাকে রংপুরের স্থানীয় কিছু কবি, লেখক, সাংবাদিক বড় ভাইরা জানালেন যে, একজন তরুণ প্রতিভাবান কবির রাত্রি যাপনের সেমি পাকা বন্দোবস্ত করতে হবে। বাড়তি টোপ হিসাবে আমাকে তাঁরা জানালেন, ছেলেটির বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলায়। আমি তখন ইন্টার্নশীপের আগুন ব্যস্ত সময়ে। তড়িৎ মাথায় আসলো যে, আমার ইন্টার্ন হোস্টেলের রুমের তিনটি বেডের একটি খালি থাকে। খালি সিটটি যার নামে বরাদ্দ সে রংপুর শহরের। সে বাড়ি থেকেই ডিউটি করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। তোষক, বেডকভার, মশারী, পৌরমার্কেট থেকে কিনে জানালাম যে লজিং প্রস্তুত। আমাকে আরও বিস্তারিত জানানো হলো যে, আমার কাজ শুধু তরুন কবিটিকে থাকার জায়গা দেয়া। ওর পকেট মানি, প্রত্যহ খাবার টাকা হিসেবে প্রতি মাস বাবদ ১০০০/= (এক হাজার) টাকার ব্যবস্থা আগে থেকেই বলবৎ আছে। ১৯৯৫ সালে সেই সময়ে এক হাজার টাকা অনেক টাকা। এই মহৎ কাজটি করেছিলেন আরেক হৃদয়বান শামীমফারুক ভাই। উনি তখন পার্বতীপুরে ইংল্যান্ডের একটি বড় ফিশারিজ প্রকল্পে কাজ করছিলেন।
আমরা দুজনে প্রায়শই হাসপাতালের ডক্টরস টি রুমে নাস্তা করতাম। পূর্ব গেটের নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার এক সাথে খেতাম। আর সারাদিনের দুজনের দিনের বিস্তারিত কাহিনী একে অপরকে শুনাতাম। সাহিত্য, জীবন, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি সকল বিষয়ে কথা বলতাম। এখানে উল্লেখ্য যে, শাহেদের সাথে আমার রংপুরের একসাথে থাকাটা একাধারে আধুনিক ধারায় ছিল। আবার দুজনের বয়সের পার্থক্য ২/৩ বৎসরের হলেও (শাহেদ ছোট) আমাদের উত্তরবঙ্গের সনাতনি বড়-ছোট মেজাজটা রেখেই আড্ডা চলতো। হাসপাতালে ইন্টার্নশীপের কঠিন ব্যস্ত কাজের ফাঁকেই শাহেদের সাথে ওর কবিতা বিষয়ের ভাবনা, সমকালীন (১৯৯৫) কবি ও কবিতা, কথা সাহিত্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, মৌলিক নাটক, মফস্বলে তরুনদের সাহিত্য চর্চা, ছোট কাগজ ও চলচিত্র নিয়ে কথা হতো। সে সময়ের দেবীগঞ্জের আধা সামন্তিক জনপদের প্রান্তিক মানুষ, করতোয়া নদী-প্রান্তর যে কবিতায় কীরকম প্রভাব ফেলতো সেসবও আলোচনায় আসতো। বিশেষ করে আমি কবি আবুল হাসানের কবিতার উপর শাহেদের মনোভাব জানতে চাইতাম। আমাকে বিস্মিত করেছিল কবি আবুল হাসানের কবিতার উপর তাঁর দখল দেখে! ষাট এর দশকের স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নি সময় ও রক্তক্ষয়ী মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী এক আত্মপ্রত্যয়ী জাতির উদয় কবি আবুল হাসানকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা শাহেদ নিমিষে জানিয়ে দিল। বুঝতাম শাহেদ কবি ও কবিতার উপর প্রখর মেধা রাখে। একটানা শাহেদ আমার সাথে পাঁচ মাস থাকলো।
শাহেদকে সকালে রংপুর পৌরবাজারে ঐদিনের মাছের দরটা জেনে নিয়ে ল্যান্ড ফোনে কোথায় যেন জানাতে হতো। ব্যাস, প্রতিদিন এই ১০ মিনিটের কাজের বিনিময়ে শাহেদ পেতো মূল্যবান এক হাজার টাকা। মনে মনে শামীম ফারুক generosity এর প্রতি সম্মান জানাতাম। শাহেদের বাকী সময়ে ঐঅর্থে কাজ ছিল না। রংপুর প্রেসক্লাবের সেই সময়ের কবি, লেখক, রাজনীতি কর্মীদের সাথে আড্ডা মেরেই তার দিন কাটছিল। শাহেদের ‘কোরপাটেলিক’! তাঁর ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট জীবনের গোটা রূপটা ধরবার চেষ্টা করতাম। সে বিস্তারিত বলতো না বলেই বেশি কিছু জানতে পারিনি। আজিজ সুপার মার্কেটের দিনগুলি নিয়ে শাহেদের কোথায় যেন একটা বেদনা কাজ করতো। আমি ওসব ভুলে যেয়ে নূতনভাবে তাঁকে ভাবতে বলতাম। সে কেনো যেন এখানে বড় নিশ্চুপ থাকতো। তাঁর ঢাকার কবিতা চর্চার উপর সেসময়কার কবি-সাহিত্যিকরা হয়তো আরও কিছু জানাতে পারবেন। শাহেদের সাথে কবিতা নিয়ে কথা হতো। কবিতার উপর আমার প্রাথমিক যে পাঠ তাতে শাহেদের সাথে জমতো। তবে সে বেশি বলতো না, শুনতো বেশি। এর মধ্যে মেডিক্যালের ছোট ভাই চন্দনের বড় ভাই তারেক ভাই এর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কনে পক্ষ হারাগাছের বিখ্যাত ধনী পরিবার। বিয়ে বাড়িতে শাহেদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমার আরেক লোকাল বন্ধু টিংকুর দৃষ্টি এড়ায়নি। ভালবেসেই টিংকু আমাকে আংশিক ক্রেজী হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলছিল “চেংরাটা কায় রে? এতো অন্যরকম চ্যাংরা!”...ইত্যাদি। টিংকুর সেই বিশেষণ “অন্যরকম” এর আসল রূপটা যারা শাহেদকে দেখেছেন ও মিশেছেন তারা বুঝতে পারবেন। শৃঙ্খল মুক্ত স্বাধীন এক তরুন। নিসঙ্কচিত্ত সবার পরম কাম্য। সেটাই শাহেদ ধারণ করতো। এরকম তাজা মানুষটি এভাবে অকালে চলে যাবে তখন আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। ধীরে ধীরে ডিসেম্বর ১৯৯৫ এ শেষ হলো আমার রংপুর মেডিক্যাল কলেজের পাঠ। চিকিৎসা সেবার মতো মহান গুরুত্বপূর্ণ কাজে পরবর্তী পড়ালেখার জন্য ঢাকায় চলে আসলাম। শাহেদ ঢাকা ফিরতে চাইলো না। আমিও বেশী চাপাপাপি করলাম না। কারণ সে দেবীগঞ্জেই ফিরবে বলে জানালো। ভাবলাম বাবা, মা ও ভাই-বোনের কাছে ফিরে যেতে চাইছে, সেটা তাঁর জন্য মন্দ হবে না। শাহেদের একটি কবিতার কিছু অংশ-
শস্যগাঁথাঅই অন্ধ বালকের জন্য বসে থাকিও গেছে বনের ভেতর থেকে ফেরাতেঘোড়াগুলো আরআনবে সঙ্গে করে অনেক নরম শিকড়গাছিপন্যকীটের তৃণধ্বনি সহকারেলোকালয় ছেড়ে অনেক অনেক দুর এই পথতুমি ঢেকেছ নিজ মুখচ্ছবি সুর্য সবুজে ঘাসে ঘাসেআমি থাকি পাহাড় চূড়ার অই পাশে একাতবু শোনাও খুরধ্বনি বিচূর্ণ গাঁথা?স্বাধনীতায় তোমার আবাসে।...আমি চলব তাই সোনালী পাহাড় চূড়ায় অই পাশ।
শাহেদের সাথে রংপুর জীবনের শেষের দিকটি তাড়াহুড়ার মধ্যেই ঘটলো। সে ফিরে গেল দেবীগঞ্জে। আমি ঢাকার পথে। চিকিৎসকদের কাজের ধারায় আমি মনোনিবেশ করলাম। পরের জীবনে ১৯৯৭ সাল হতে আমি আমার জেলা শহর নীলফামারীতে ফিরে আসলাম। তখন থেকেই শাহেদকে এক নজর দেখার ইচ্ছা প্রবল হতো। কিন্তু ওর কোন হদিস পেতাম না। শুনতাম সে রংপুরে কিছু দিন যাতায়াত করেছিল। ২০১১ সালে শাহেদের আর একটি কাব্যগ্রন্থ “বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান” প্রকাশিত হলো। বইটি পাঠকের মাঝে জয়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে “বালিঘর” কাব্য নাটক ভবিষৎ এর সাহিত্য ও নাট্যকর্মীদের জন্য একটি বড় উপহার হিসেবে থাকলো। আমার দীর্ঘ বিশ্বাস “বালিঘর” নিয়ে আরও কেউ কাজ করবেন। রাজা ভাইয়ের সাথে শাহেদের কবিতা নিয়ে কথা বলতাম। কারণ রাজা ভাই কবিতা বোঝেন। লিটলম্যাগ “চালচিত্র” দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা করছেন। সেখানেও শাহেদের কবিতা প্রকাশ করেছেন। রাজা ভাই একবার বলেই ফেললেন যে, শাহেদের কবিতা পড়ার পর আর কারো কবিতা কিছু সময়ের জন্য ভালো লাগতো না। বন্ধুবর হজরত আলীও একই রকম শাহেদের কবিতার নান্দনিকতা ও ভাবনা ভীষণ রকম পছন্দ করতো। শাহেদের কবিতায় ভাবনা ও ভাবনার গতি এতো চিরায়ত যে, একটু নড়েচড়ে বসতেই হয়।
সত্যিকারে শিল্পের (Arts) কোনো ধোকাবাজি থাকে না। সেখানে কোনো ব্যর্থতা থাকে না। সার্থকতা ও মানব মনের উৎকর্ষণ কবিতা শিল্পের দায়িত্ব। সঠিক চর্চার মধ্যেই কবিতা সঠিক শিল্পে রুপ নেবে। অবচেতনে মানব উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। না হলে এটা বড় শিল্প মাধ্যম হতো না। শাহেদের কবিতা এখানেই সার্থক। কবি-সম্পাদক রাজা সহিদুল আসলামের সাথে শাহেদকে ঘিরেই সখ্যতা গড়ে উঠলো। রাজা ভাইও সাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ। তাই শাহেদকে বুঝতে পারতো। শাহেদের সাথে দেখা করার ইচ্ছা দুজনেই প্রকাশ করলাম। এর মধ্যে নীলফামারীর বাল্যবন্ধু হজরত আলীও শাহেদের কবিতার সংস্পর্শে এসে ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। হজরত আলী তার কিছু সময় পর থেকে নিয়মিত শাহেদের সাথে দেবীগঞ্জে গিয়ে দেখা করে আসতো। ২০১৮ সেপ্টেম্বরে আমি ও রাজা সহিদুল আসলাম বের হলাম দেবীগঞ্জে শাহেদের সাথে মোলাকাত করার জন্য। পথে সোনাহারে ছড়াকার সাহিত্যিক রাজ্জাক দুলাল এর স্কুলেই শাহেদের সাথে ২৩ বৎসর বাদে দেখা। কুশল বিনিময়ের পরেই জানতে চাইলো আমার শিশুতোষ সিনেমা ও চিত্রনাট্য কিরুপ অবস্থায় আছে। অবাক হলাম তাঁর স্মৃতির প্রখরতায়! “চালচিত্রে” আমার একটি ছোট সাহিত্য সমালোচনা “শিল্পঘর” এর প্রশংসা করলো। ১৯৯৫ সালে রংপুরে অবস্থানকালে আমার শিশুদের উপযোগী সিনেমায় আগ্রহ সে ভোলে নাই। শাহেদ সব সময় সৃষ্টিশীলতার মাঝেই থাকতে চেয়েছে এবং অন্যের কাজে দিকেও তাঁর নজর সমান। কিন্তু আমি যে, এ সবের আর কোনো অগ্রগতি করতে পারি নাই সেটা জানালাম। যৌবনে স্বপ্নগুলি বাস্তবের কষাঘাতে কিভাবে ধ্বংস হয় তা আমাদের মতো বেশির ভাগ মধ্যবিত্তের হৃদয়ে ভালোভাবেই জানা আছে। তাছাড়া চিকিৎসকের কাজটাতেও একধরণে চাপ থাকে যে, আর কোনো কিছুতে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ থাকে না। রাজ্জাক দুলালের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলাম কারণ সে বেশি কিছুদিন থেকে আন্তরিকতার সাথে শাহেদের দেখা শুনা করে চলেছে। করোনার আগ পর্যন্ত শাহেদ বেশ কয়েকবার নীলফামারীতে এসে ছিলো। প্রতিবারই ৩/৪দিন ধরে থাকতো। উঠতো রাজা ভাইয়ের বাসায়। সেই বাসায় সাহিত্যের আড্ডা জমতো।
যথারীতি হজরত আলী, খবির, রাজ্জাক দুলাল, রাজা ভাইসহ সবাই শাহেদের জন্য ভাল কি কি করা যায় সেসবের কথা হতো। এরমধ্যে এক শনিবার ঠাকুরগাঁও এর সাহিত্যিপ্রেমী হোসেন মোতাহার একা শাহেদ শাফায়েতকে দেবীগঞ্জ থেকে পাকড়াও করে নীলফামারীতে রাজা ভাইয়ের বাসায় হাজির। হোসেন মোতাহারেরও শাহেদ শাফায়েতের কবিতা ও ব্যক্তি শাহেদের প্রতি ভালো লাগা ছিলো। রাজা ভাই শাহেদকে বারবার তাগাদা দিত যেন নিয়মিত তিন বেলা খাবারটা খায়, প্রতিদিনের গোসল ইত্যাদি। শাহেদ শিশুর মতো চলতো। জীবনের জন্য জরুরী কিছু Instruments এর প্রয়োজন। না হলে জীবন মন তাজা থাকে না। তিনবেলা খাবার, গোসল, শারীরিক যত্ন, ঘুম ইত্যাদি। কেনো জানি না, শাহেদ এ সবের প্রতি শিশুর মতো উদাসীন থাকতো। এ সব থেকে তাঁকে উত্তরণের জন্য শেষমেষ ক্লিনিকাল সাহায্য নেবার পরিকল্পনা ছিলো। করোনা এসে আমাদের সেসব শেষ হলো। তারপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বুধবার আমাদেরকে শাহেদ শাফায়েত চির বিদায় জানালো। বাংলা কবিতায় শাহেদ যা কিছু রেখে গেলো তা সামনের দিনের পাঠকরা বিবেচনা করবেন। এখন আপসোস ও অনুতাপ হয় যে, আরেকটু চেষ্টা করলে একজন কবির জন্য আরও কিছু করা যেত। এটাই চরম বেদনা দিয়ে যাচ্ছে।
স্মৃতির মণিকোঠায় শাহেদ
ডা. হাসান হাবিবুর রহমান হাবিব
ডা. হাসান হাবিবুর রহমান হাবিব
মন্তব্য