অবহেলায় অনাদরে অভিমানী কবি চলে গেলেন অনন্তপুরে। মুক্তমনা সাদা মনের মানুষ “কবিতার রাজকুমার” কবি শাহেদ শাফায়েত-চির ঘুমের দেশে আজ বড্ড একা।
জন্ম: বাংলাদেশের উত্তর জনপদের হিমালয় কন্যা পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদীর পাড়ে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি কবি শাহেদ শাফায়েতের জন্ম। ‘চরকা কাটার গান’ গেয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তিনি চলে গেলেন দিগন্তের ওপারে।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ:কোরপাটেলিক-১৯৮৯তোমার জৌলুসমাখা প্রতিটি ভোরের গান-২০০১বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান-২০১১চরকা কাটার গান-২০২১।তাঁর সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ-‘পূর্ণদৈর্ঘ’‘রঙতুলি’‘হৃদয়’‘করাত’ ও‘বৈশাখে’।
কখনো চুপচাপ বসে থেকে, কখনোবা একা একা দাঁড়িয়ে কবিতার ভুবনে নিমগ্নচিত্তে সৃষ্টির উল্লাসে জাগতিক কোলাহল বেমালুম ভুলে গিয়ে শব্দ নিয়ে খেলা করতেন তিঁনি। তাঁর এই আবিষ্কারের চিত্র তিনি লুকাতে পারেননি। সেকারণে সমাজের কিছুসংখ্যক লোক তাঁকে অস্বাভাবিক ভাবতো।
কবি কখনো পকেটে টুকরো টুকরো কাগজ গাছের তলে, স্টেশনে, পথে প্রান্তরে বের করে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আপন মনে লিখে যেতো তাঁর কবিতার পংক্তিমালা। উদাসীন কবি কত যে কবিতার এই টুকরো টুকরো কাগজ মনের অজান্তে ফেলে দিয়েছেন কিংবা হারিয়ে ফেলেছেন তার হদিস নেই। তিনি প্রত্যন্ত লোকালয়ে ছুটে যেতেন কে যেন ডাকছে তাঁকে তাঁর কণ্ঠে কবিতা শুনবে বলে। শব্দ চাষীদের খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো কখনো একটি কবিতার জন্যে কত যে রাত সূর্যের মুখ দেখেছিল সেদিকে তাঁর খেয়াল থাকতো না।
৯০’র দশকে যে ক’জন কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্য জগতে পদচারণা ছিল কবি শাহেদ শাফায়েত তাঁদের অন্যতম।
তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় নীলফামারী জেলা সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত ২০১৮ সালের মাসিক সাহিত্য আড্ডায়। উক্ত আড্ডায় কবি ও ছড়াকার রাজ্জাক দুলাল’র আমন্ত্রণে মাসিক সাহিত্য আড্ডায় তিনি আসেন নীলফামারী জেলা গণসাধারণ গ্রন্থাগারে। আনুমানিক ছ’ফুট লম্বা মানুষটি যখন উঠে দাঁড়ালেন, দেখি উচ্চতায় তিঁনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁকে কবিতা শোনাতে বললে, তিনি স্মৃতি থেকে অনর্গল উচ্চারণ শোনালেন কবিতা। কি অসাধারণ তাঁর প্রতিভা! উপস্থিত সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আরও কয়েকবার কবির সাথেদেখা হয় দেবীগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ ও দেবীগঞ্জ পাবলিক ক্লাব পাঠাগারে। এরপর দেখা হলেই বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় শেষে তিঁনি বলতেন, কবিতা নিয়ে নানা কথা। কেমন আছেন? লিখছেন তো? আর হবে না দেখা? হবে না কথা? তিঁনি কবিদের কথা সব সময়ই ভাবতেন আর নিজের ব্যক্তি জীবনের কথা রাখতেন সঙ্গগোপনে। নিয়ম মেনে চলার প্রতি তাঁর ছিলো চরম অনীহা। যাপিত জীবন ছিল একেবারেই সাদামাটা। সাহিত্যের আলো-আঁধারির কথা ভাবতে ভাবতেই নৈঃসঙ্গ্যের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে তিঁনি থেকে গেছেন চিরকুমার। সবাই তো বলেন, আলোর কথা কিন্তু তিঁনি তাঁর তীক্ষè ভাবনায় কবিতা, গল্প, গান, নাটকে তুলে এনেছেন অন্ধকার থেকে মানুষের আলোর গান। তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, গান, নাটকে ঠাঁই পায়নি আত্মজীবনীর বিন্দুমাত্র ছোঁয়া। না জানি কত কথা, কত ব্যথা তাঁর বুকে ছিল জমা। হঠাৎ করেই সবাইকে কাঁদিয়ে, বুকভরা অভিমান নিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ চলে গেলেন “কবিতার রাজকুমার” কবি শাহেদ শাফায়েত। বাংলা সাহিত্য অঙ্গন হারালো এক নক্ষত্রকে, আমরা হারালাম কবি শাহেদ শাফায়েতকে। যদিও তিনি আজ চির ঘুমের দেশ অনন্তপুরে! বাচিক শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর কবিতা, কণ্ঠ যোদ্ধার গলায় তাঁর গান, নাট্যশিল্পীর অভিনয়ে তাঁর নাটক সাহিত্য জগতে চির অমর হয়ে থাকবে যুগে-যুগে। তাঁর অকাল প্রয়াণে গভীর শ্রদ্ধা। ভালো থেকো “কবিতার রাজকুমার”, ভালো থেকো বাংলা সাহিত্যের আলোর সারথি। ভালো থেকো তুমি অনন্ত জীবনে।
মন্তব্য