গোধুলির লগ্নে দক্ষিণা বাতাসে এলোকেশে ফিরছি দেবীগঞ্জ থিয়েটার হতে। ষোড়শী হৃদয় আমার চঞ্চলা, চপলা, দুরন্তপনা। সাহিত্য প্রেমিক হৃদয়ের গন্ধ পেলেই থমকে হারিয়ে যেতাম। দেবীগঞ্জের এন.এন. বালক বিদ্যালয়ের সুবিশাল মাঠ। হৃদয়ের প্রেম বীণায় সুর তোলে আপন মনে হাঁটছি তো হাঁটছিই। হঠাৎ দেখলাম এক হাত দূরত্ব রেখে এলোমেলো উসকো-খুশকো চুল, আধো ময়লা শার্ট ও প্যান্ট ইন করা, পায়ে দুই ফিতার চটি উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার এক লোক আপন ভাবনায় নিজেকে বিলিয়ে হাঁটছে। এই লোকটির সম্পর্কে অনেক গুণগান শুনেছি, এটাও শুনেছি তিনি কবিতা লেখেন। তাই নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না, মৃদুস্বরে বললাম, “ভাইয়া আসসালামু আলাইকুম।”
শুনলেন না! উনি আপন মনে হেঁটেই যাচ্ছেন।
তড়িঘড়ি কণ্ঠস্বর একটু বাড়িয়ে চঞ্চলা মনে বললাম, “আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?”
উনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে তুমি?”
আমি আনন্দচিত্তে ঝর্ণার মতো আমার পরিচয় ঝরাতে লাগলাম। বললাম, “ভাই আপনি কবিতা লেখেন! আমি কবিতা লিখতে অনেক ভালোবাসি। আপনার কবিতা আবৃত্তি আমি শুনেছি, আমার অনেক ভালো লেগেছে।
উনি গম্ভীর চঞ্চলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কী কর?”
আমি বললাম, “ইন্টারে পড়ি। থিয়েটারে গিয়েছিলাম নাটক রিহার্সেল করতে।”
উনি বললেন, “ও! ধরো, এটা তোমার জন্য।”
আমি আবেগাপ্লুত হয়ে কাগজটা হাত বাড়িয়ে নিলাম। এই জ্ঞানীর জ্ঞানবিদ্যার কাগজটি ছিল একটি কবিতার ফটোকপি। কবিতাটি পেয়ে আমার মনে হয়েছিল সাত রাজার ধন পেয়েছি। আমি বললাম, “ধন্যবাদ ভাইয়া।”
উনি গম্ভীর মুখে মাথা নিচু করে শুধু উচ্চারণ করলেন “হু।” এই “হু” বাক্যটি উচ্চারণ করেই তিনি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আপন মনে হাঁটতে শুরু করলেন। আমিও উনার কবিতার ফটোকপিতে চোখ বুলিয়ে পশ্চিম-উত্তর মুখী হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
বাড়ি গিয়ে এই গুণী কবির কবিতাটি মনোযোগ সহকারে পড়তে শুরু করলাম। কি কঠিন শব্দ চয়ন রে বাবা! এই বুঝি তো এই বুঝি না! তারপর সময়ের ব্যবধানে পথচলা। জীবন চলার পথে মাঝে মধ্যে দেখা হলে এই গুণী কবির সাথে সম্মানের সঙ্গে, ভালবাসা মিশিয়ে কথা হতো। উনাকে আমি তো সম্মান করতাম যে অতিরিক্ত কথা বলতে ভয় পেতাম। এইভাবে দুই কবির আপন গতিতে পথচলা। সাহিত্যের অঙ্গনে বিচরণ।
বহুদিন পর, ২০২০ সালে “দেবীগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ” এর মাধ্যমে আবার সেই গুণীর সাথে দেখা হল। আসলে আমি তো ঢাকামুখী ছিলাম। তাই দেবীগঞ্জে অবস্থান করা কম হতো। “দেবীগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ” এ অনেক গুণীজনের মধ্যে নিজেকে পেয়ে খুব ভালো লাগতো। সবার মাঝে কবি শাহেদ শাফায়েত ভাইকে দেখে আমি তো বেজায় আনন্দিত। “দেবীগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ” এ উনি যখন কোন বক্তৃতা, আলোচনা বা কবিতা আবৃত্তি করতেন, আমি গভীর মনোযোগ সহকারে তা শুনতাম। আমার এই ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর কাছ থেকে অনেক শেখার ও জানার ছিল। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে শাফায়েত ভাইয়ের সাহিত্য ভাবনায় নিরেট সাহিত্য ছাড়া কিছু নেই।
একদিন উনার কাছ থেকে আমি “চরকা কাটার গান” কাব্যগ্রন্থটি ক্রয় করে পড়লাম। পড়তেছি আর মুগ্ধতায় ডুবে হারিয়ে যাচ্ছি। নতুন নতুন শব্দ আর বাহারি আল্পনায় আঁকা বাক্য অলংকার। কি চমৎকার সাবলীল ভাষায় তিনি লিখেছেন, যদি জানতাম কখন যে ঝরে যাবো আমি...। কি আর বলবো! শাফায়েত ভাই ছিলেন বই পাগল। একদিন আমি আবু ভাইয়ের জন্য “অনুর গল্পে রবীন্দ্রনাথ” বইটি উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য তাঁর কার্যালয়ে নিয়ে আসি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কবি শাহেদ শাফায়েত। উনি সেখানেই বইটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। আমি তো খুব অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম “মানুষ এতো বই পাগল হয় কীভাবে?” উনি আমাকে বললেন, “অনামিকা, তোমার বইটা অনেক ভালো লেগেছে।” আমার কাছে তাঁর সরল উক্তিটি যুগ হতে যুগান্তরে ইতিহাস হয়ে রবে।
মন্তব্য