ঐ যে বাড়িটি দেখছ, ত্রিবিদ্যাপিঠ। চাচা কলেজে, বড় বোন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মেঝ বোন, ছোট বোন আর চাচাতো ভাই বোনেরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী। সে কারণে শিক্ষক লাগতো না। বড়রা ছোটদের দেখত। আর ঐ যে ছবিটা দেখছ, সে ঐ বাড়ির একজন। প্রাথমিকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছে। হ্যাঁ, প্রতিটি ক্লাসের বাংলা বইয়ের পাঠ চুকিয়েছে। ভাবতে পার। নদী মানচিত্র বোঝে না, কবিও তাই। পুরো পৃথিবী কবির দেশ। পাখি যেমন ঋতু পরিবর্তনে অতিথি হয় আবার ফেরে স্বদেশে, কবিও তেমনি বিচরণ করে। অখণ্ড সময়কে ধারণ করে কবি অনন্তকালের জীবন পায়। কবি হয়তো এক সময় দীর্ঘ ঘুমে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ঘুমের ভেতরে ঘুম রচনা করে শূন্যে পাখনা ম্যালে কবির ধ্যানী ক্যামেরা। এতোসব কথা একান্ত আলাপচারিতায় মুখ্য হয়ে উঠতো। সে ধ্বংসের বিভৎস্য অবয়ব থেকে সুর তুলে জীবন সঙ্গীতের। তাই তার কাব্য শিরোনামে স্থান পায় “তোমার জৌলুস মাখা প্রতিটি ভোরের গান”, “বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান”, “চরকা কাটার গান”। সে ছিল তুখোড় মেধাবী। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় কোথায় হয় জানো? ময়নামতি চরে। স্বপ্নজয়ী লিকলিকে পাতলা মায়াবী ছেলেটি কাছে এসে শিশুতোষ হাসি হেসে বলল, কেমন আছেন? বললাম, ভালো। বয়স আনুমান করে বললাম, তুমি?
-হ্যাঁ, ভালো আছি। লেখালেখির খবর বলেন।
আমি “বৃন্ত” নামে একটি কাগজ বের করেছিলাম। প্রতিবেদন, গল্প, কবিতা নিয়ে প্রথম সংখ্যা। একটি সংখ্যাই বের করেছিলাম।
-এখন কি লিখছেন।
কবিতা।
- শিশুদের জন্য কিছু লিখছেন না?
না, পারি না। মানে লিখিনি কখনো।
-আপনি পারবেন। শিশুদের নিয়ে অনেক গল্প হলো। তার কয়েকটি ছড়া আর পদ্য শুনলাম। আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। সে খুশি হলো। রবিউল ইসলাম বিলাসি ছড়া লিখে, ভালো লিখে। রেদওয়ানুল হক বসুনিয়া বাবু’র অনেক পাণ্ডিত্যের কথা বলল।
-শিশুদের জন্য একটি কাগজ করতে চাই।
করেন। ভালো হয়।
-আপনি থাকলে করতে পারি। তার শিশু সুলভ আবদার। না করতে পারলাম না।
-“রঙতুলি” নামটি কেমন হয়।
সুন্দর।
-এই নামে হোক। শিশুদের মনোজগতে রং আর তুলি খেলা করে।
পরদিন রবিউল ইসলাম বিলাসি, শাহ আনিস, আজিজ, রেদওয়ানুল হক বসুনিয়া বাবু পাবলিক ক্লাব মাঠে দীর্ঘ আড্ডা। আমাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। “রঙতুলি” বের করতে হবে। লেখা সংগ্রহ সেই করলো। (মান্নান ফকির সে সময়ের গ্রাজুয়েট। চাকরি করতেন না। কয়েকবার ইন্টারভিউতে টিকেছিলেন, যোগদান করেন নি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি তিনি পছন্দ করতেন না। কাঠ খোদাই করে প্রচ্ছদ তৈরিতে ওস্তাদ।
-চলেন।
কোথায়?
-ফকিরের কাছে।
মানে?
-মান্নান ফকির। নীলফামারী। তাঁর কাছে প্রচ্ছদ ব্লক করে নিয়ে লতিফ প্রিন্টিং প্রেসে বসব।
পায়ে হেঁটে হেঁটে ডোমার। তখন ডোমার থেকে গাড়ি চলত মানে বাস ও ট্রেন। দুজনের পকেটে সর্বমোট একশত ত্রিশ। বাস ভাড়া আর ফকিরকে দিয়ে যা থাকলো প্রেসের পকেটে গুজিয়ে রাত ৯:৩০ টায় পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেরা। ভাবছ পেটে কিছু পড়েছে কিনা। জ্বী না। এক সপ্তাহ পর বের হবে “রঙতুলি” সেই আনন্দে নেচে নেচে চল্লিশ কিলোমিটারের পদক্ষেপ। সম্পাদক তাকেই করলাম আমরা। “রঙতুলি” বের হলো। চার/পাঁচটি সংখ্যা বের হলো। কবিতাপত্র “হৃদয়”(ভাজপত্র) আট/দশটি সংখ্যা বের হলো। সম্পাদক সেই-ই থাকলো। তার হাত ধরে উত্তরাঞ্চলীয় সাহিত্য পরিষদ গঠন করা হলো। সদস্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো। রওশন মনি, মিজানুর রহমান মাজু, লেমন ওয়াহিদ আরও অনেকে। আড্ডায় শুধু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। আমাদের অগ্রজ ডা. আনোয়ারুল করিম আনু, আনোয়ারুল হক বাবুল কমরেড আ ক ম মনিরুল ইসলাম, আ স ম নুরুজ্জামান অনুষ্ঠানে আসতেন। সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দিতেন। তুমি জানো, সিংহ ভাগ টাকা দিতেন রেদওয়ানুল হক বসুনিয়া বাবু। হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে ভর্তির সুবাদে সে ঢাকা চলে যায়। নদীর স্রোতে আর প্রতিভা বাধা মানে না। কবিতার রাজধানী ঢাকায় প্রতিভাধররা তাকে চিনতে ভুল করেননি। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে এক ফর্মার “কোরপাটেলিক” কবিতাপুস্তিকায়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কবি ভাবনা মুদ্রিত ঐ এক ফর্মার কবিতা পুস্তিকায় বিচরণ করে। দীর্ঘ সময় পর প্রিয় জন্মস্থানে ফিরে এসে দ্যাখে যা কিছু রেখে গেছে তার কোন চিহ্ন নেই। কবি আহত হয়। হঠাৎ একদিন দেখা হয় কবির সঙ্গে। এলোমেলো উসখোখুসকো লম্বা লম্বা চুল, হাত-পায়ের নখ অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরনে মলিন প্যান্ট, শার্ট। গলায় ঝুলছে টাই। পায়ে স্যান্ডেল। একটি সিগারেটের শেষ অংশটুকু পুড়ে দিতে চায় ঠোঁট। কবি এতদিন কোথায় ছিলেন?
-জীবনানন্দের কবিতার লাইন।
কোথও বসি?
-বসা যায়। অনেক কথা আছে। আগে কিছু মুখে দেই।
খাওয়া শেষে ফার্মের দিকে রওনা হলাম। আমাদের সমাজে সাধক অনেকের কাছে পাগল। আমি বুঝতে পারি তাকে নিয়ে যখন পথ চলি। কয়টি বই বেড়িয়েছে?
-দুটি। কাল এলে দিতে পারব। আপনি দুই কপি করে নিবেন।
আচ্ছা। টাই কেন?
-টাই? ফায়ার সার্ভিসে উচ্চ পদে আছি।
নখ এতো বড় বড় কেন?
-কাটতে পারিনা।
তোমার বিশ্বাস নাও হতে পারে আমি তাকে বাসায় নিয়ে আসি। দশ আঙুলের বাড়ন্ত নখগুলো কেটে দেই। পরনের কাপড় ধুয়ে দেই। অতঃপর স্যালুনে যাই। খাওয়ার টেবিলে কবি। আমি পরিবেশনে ব্যস্ত। বাড়িতে ঘরণী নেই। সে গ্রামের বাড়িতে। মাংস সবজিতে তার আপত্তি নেই যদিও মাছ খাওয়াতে ব্যর্থ হই। কাঁটার ভয়ে মাছ ছেড়েছে সেই শৈশবে। রাতভর কথা হয়। কথা হয় ব্ল্যাক হোল নিয়ে। তার দৃষ্টি সেদিকে। এখন কী পড়ছেন?
-বুখারি শরিফ। বিভিন্ন সুরার তাফসিরও পড়ছি। রহস্যের শেষ নেই। বাইবেল এবং গীতা কিছুটা আগেই পড়েছি। আরও পড়তে হবে। এতো ধৈর্য? এবার একটু জোর দিয়ে বলে,
-আপনার কাছে তো ঐশী বানী আসবে না। লিখতে হলে পড়তে হবে।
এবার ব্যক্তি জীবনে আসা যাক।
-সংসার? লেখাই আমার সংসার। অর্থ আমাকে টানে না। নারীও না। আমি লিখতে ভালোবাসি। লেখা আমার প্রিয়, আমার কোন প্রিয়া নেই।
ভবিষ্যত বংশধরের কথা একবারও মনে আসে না? “বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান” বইটি তুলে ধরে বলল, এই তো।
এখন মা-বাবা আছেন কিন্তু যখন থাকবেন না বা বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ হলে দেখবে কে?
কবি মৃদু হাসলেন।
কবি মৃদু হাসলেন
রাজ্জাক দুলাল
রাজ্জাক দুলাল
মন্তব্য