দৃশ্যটা ছিলো নিশ্চিত নিরাপদ আর সংক্ষিপ্ত। বহেরা তলার বেদীতে বসেছিলাম মাসুমুল আলম আর আমি। হঠাৎ দেখি সাগর নীল খান এগিয়ে আসছে, সঙ্গে সুদীর্ঘ একজন ছিপছিপে মানুষ। দীপ খুব আগ্রহ নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলো,— ইনি হচ্ছেন কবি শাহেদ শাফায়েত। আমরা সানন্দে হাত মেলালাম। তিনি ছিলেন এতোটাই মেটে মানুষ, হ্যান্ডশেকের সময় হাতের তালুতে যেন একটু মাটি লেগে গেলো। নামটা তো আগেই জানা ছিলো। এই প্রথম তার সাথে দেখা। খুব স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও মুহূর্তটি ছিলো ঘন আর বিরল। বললেন,— আমি দেবীগঞ্জে থাকি; বারো বছর পর ঢাকায় এলাম; বইমেলার বাকী দিনগুলো ঢাকায় থাকবো। —তারপর কী বাড়ি ফিরবেন না অন্য কোথাও যাবেন? মৃদু হেসে জানালেন — বাড়িই ফিরবো। —দেবীগঞ্জ জায়গাটা যেন কোথায়? —দিনাজপুরের ভিতরে। এসব কুশল বিনিময়ের নরম কথাগুলো চলছিলো; এমন সময় পাশ থেকে কেউ একজন কবি’র হাতটি ধরে টান দিলেন আর সাথে সাথে শাহেদ শাফায়েতও তার সঙ্গে হাঁটা শুরু করলেন। সম্ভবত: দীর্ঘ বারো বছর পর দেখা পেয়ে পুরনো পরিচিতরা সবাই আবেগ প্রকাশে নতুন হয়ে উঠছিলো। তখন ফেসবুক আজকের দিনের মতো হাতে হাতে ছিলো না।
প্রকৃত মনোযোগে তার কবিতা আগেও খুব একটা পড়েছিলাম তা’ কিন্তু নয়। ‘বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান’— এই কাব্যগ্রন্থটিই মূলত আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিলো যা উলুখড় ঐ বছরই মানে ২০১১ সালের বইমেলায় প্রকাশ করেছিলো। তাঁর কবিতারা তাঁরই দেহের সমান ছয় ফুট গভীর উচ্চতায় সুঠাম। তথাকথিত নব্বই দশকীয় কাব্যগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁর কবিতার বৈভিন্ন্য লক্ষ্য করা যায়। শাহেদ শাফায়েতের কবিতার সঙ্গে গড়ন ও বলনগত আলাদাত্ব রয়েছে তার সমসাময়িক প্রচার সর্বস্ব সব নামকরা কবিদের। লিটল ম্যাগাজিনের এই কবি’র যে সীমিত সংখ্যক আগ্রহী পাঠককূল আছেন সেটাই বা কম কী! এই নিম্নরুচির যুগে অতো বৃহত্তর পাঠক সমাজের কথা বলো নাতো! ওসব চাটাচাটি মার্কেটিং- এর ব্যাপার। শাহেদ শাফায়েত ভীষণ নিবিড় আর নিরব স্বাতন্ত্র্যে ভরপুর। কবিতায় তাঁর অমোঘ পদক্ষেপ মাঠে, আয়নায়, ট্রেনে, চারাগাছে, কাকতাড়ুয়ায়, পানশি ও বালিঘরে।
দেখা হয়েছিল শুকনো গাছের সাথেগাছেরা কেবলি ঝরায় তাদের পাতাকথা হয়েছিল নগ্ন নারীর সাথেগাছেরা খাদ্য চেয়েছে পদক্ষেপেকবিতা: আয়না/ বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান
দেখো, এই কবিতাটির চরণে চরণে রয়েছে বৈদ্যুতিক প্রবাহ আর অন্তশীল গমন। একটি সহজ পায়ে হেঁটে হেঁটে গাছের অন্তর্গত ক্ষুধার দিকে ধাবমান। খুব অথচ পাঠকের নাড়িতে গিয়ে টোকা মারে। মনে হতে পারে খুব কমন কাব্য তো! এ আর নতুন কী! আমার মনে হয়েছে ছাব্বিশ লাইনের ‘আয়না’ কবিতাটিতে টোটাল শাহেদ শাফায়েতের কাব্য বিশিষ্টতা নিহিত। এমন আপন আর দূরগামী উচ্চারণ — ফের পুনরায় পাঠে আগ্রহ আসে। কতো সিম্পল আর গভীরতার ভিতর দিয়ে সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে পৌঁছে গেছে কাব্যদেহের অভ্যন্তরে। ভাবা যায়? বিশ্বাস করো, কোনো চুদুর বুদুর নেই। আধুনিক, উত্তরাধুনিক — এইসব টেডি টারমোলজি যেথায় অপ্রাসঙ্গিক। এবং আরো আরো লক্ষ্যণীয় কবি শাহেদ শাফায়েত লিটল ম্যাগাজিনের একজন প্রকৃত লেখক যেমন সত্য ফলে তেমনি তিনি তার প্রবণতায় ছোটকাগজের ফেন্সিমার্কা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কখনো ন্যাকড়া কবিতার চর্চা করেননি। আসলে কবির জীবনে এটা কীভাবে ঘটে? হাজার বছরের কোড অব ল্যাঙ্গুয়েজ বাহিত হয়ে কবির দেহে জেগে ওঠে অরণ্য — তার মর্মরধ্বনি। ল্যাঙ্গুয়েজের গাঢ় রসে আপক্ক হয়ে ওঠে সেই ধ্বনিটুকু যা কাব্যের ভুবন। এই ভাষা রূপান্তর সবার ক্ষেত্রে ঘটে — এটা বললে গলাবাজি হয়ে যাবে। সিঁড়ির ভিতরে সময়ের সারিবদ্ধ ধাপ — ‘আয়না’ কবিতাটির তলায় রয়েছে ভাষার গুপ্ত লিরিক্যাল বাস্তবতা আর ম্যাজিক্যাল টোন। কবিতার ভিতরগত বিষয়-টিষয় গৌণ ভঙ্গিতে নির্লিপ্ত থেকে কাব্যভাষার দূর পথে তার অভিযাত্রা। ‘আয়না’ কবিতাটি পাঠকের অবচেতনকে বিধৌত করিয়ে দেয়।
তোমার গ্রীবার নিচে আমি একটি রক্তাক্ত তিলকতোমার উরু একটি গন্ধমবৃক্ষের ছায়াছন্ন মগডালকবিতা: ঈশ্বরী/ বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান
জোড়া পংক্তির ভিত্তিতে ’ঈশ্বরী’ কবিতাটি এগিয়েছে। পাঁচ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ কবিতাটিতে মনে হবে একটি কবিতায় এক সাথে অনেকগুলো কবিতা ঢুকে গেছে। এক একটি জোড়া পংক্তি এক একটি জোড়া আস্বাদন। ভেরী টেস্টি। এবং অদ্ভুত রকমের মতো সকল নদী সমুদ্রের দিকে আর সকল পংক্তি ঈশ্বরীর দিকে ধাবিত। খণ্ড অথচ অখণ্ড। বিনিসুতোর কাব্যমালা। শাহেদের কবিতা আপন যন্ত্রণার মতো শক্তিমান। নব প্রকৃতিধারার কাব্য চর্চায় তিনি অনেকখানি পথ পেরিয়ে চলেছেন। তার সমুদয় কাব্য জগতে জীবন্ত কবিতার দেশ পাওয়া যায়। ভাষার ভিতরে অন্য এক ভাষা নিজেকে গুপ্ত রেখে রেখে সাড়া দেয়।
সেখানে শিশুর বমি এবং বমির ভেলায়/ শিশু পিঁপড়ের বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা... উষ্ণতাকবিতা: ফটোগ্রাফ
সূক্ষ্ম অলিগলির ভিতরে শব্দ ক্রসিং করে পার্শ্ববর্তী শব্দের গায় লেগে থাকা মৃদু মর্মর আমাদের মোহিত করে। বিশ্বসাহিত্যের সমগ্র ফিল্ডে যে বিশ্ববীক্ষণ ধাবমান, তাঁর কবিতাচর্চার নেপথ্যে সেই বীক্ষণ কাজ করেছে বলে মনে হয়। “চাষের যন্ত্র নেই। তবু/ তার ক্ষেত ভরেছে শস্যে/ সামান্য বৃষ্টির পরে/ পাখি গুলো ফিরে এলে/ আমিই প্রথম মাথা নেড়ে/ জানাই অভিবাদন/ অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে/ মাথা নেড়ে নেড়ে।”— কাকতাড়ুয়া নামধারী এই কবিতাটি দেবীগঞ্জে বসেই তো লেখার কথা। যেহেতু সমগ্র বিশ্বই তখন দেবীগঞ্জ। এটা তো পরিস্কার তিনি কোনো চেচামেচিতে খরচ করেননি তার কলম। কখনোই উচ্চকিত নন। উচ্চকিত না-কবিতায়, না-জীবনে এবং না-প্রচারে। ভীষণ নিমগ্ন আর নিসঙ্গ। তার নিঃসঙ্গতায় কোনো হা-হুতাশ নেই আছে অভিযাত্রা। বহির্জগতে নানা রকম ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে — আবার তা’ ট্রাজেকটাইল স্টাইলে ল্যান্ডিং করেছে তাঁর অন্তর্জগতে।
শাহেদ শাফায়েত তাঁর কাব্যজগতের কেন্দ্রিয় ঘাঁটিতে একটি সুক্ষ্ম ও শান্ত ভুবন চয়ন করেছেন বটে তবু দ্রোহী মনোভাব তাকে ছেড়ে চলে যায়নি। কাব্য নির্মাণের পাশাপাশি তিনি কাব্য স্থাপত্য ভেঙে দিতেও প্রস্তুত। এই ভাঙন চিহ্নটুকু ফের কাব্য বিস্তির্ণের দিকেই ধাওয়া করে। কবিতায় চিত্রকল্প একটি বড়ো রকমের বিস্ফোরণ ঘটায় ঠিকই— একটু মনোযোগী হলে দেখা যাবে চিত্রকল্প প্রয়োগের স্টাইলেই কবির নিজস্ব ব্যঞ্জনা পরিদৃষ্ট। শাহেদের কবিতায় চিত্রকল্পরা আপন ভঙ্গিমায় বিস্তির্ণি নিয়ে কবির ভাবলোকের প্রতিনিধিত্ব করেছে।
বালিঘর — বাংলাসাহিত্যের একটি অমর কাব্যনাট্য। কাব্যের ভিতরে নাট্যশৈলী আর নাট্যের ভিতরে কীভাবে কাব্যের নিবাস গড়ে ওঠে — সেই সিক্রেনাইজেশন পরতে পরতে বালিঘর কাব্যনাট্যে পরিস্ফুট। লক্ষ্যণীয়, কাব্যনাট্যটি উপস্থাপিত হচ্ছে একটি গ্রামীণ হাটের শাকসব্জীর সাজানো দোকানগুলোর সমুখে। যদিও এই নাট্যটি প্রসেনিয়াম মঞ্চেও পরিবেশন করা সম্ভব । আবার এনভায়ার্নমেন্ট থিয়েটারের কথাও মনে পড়ে যেতে পারে। চরিত্রদের পারস্পরিক ভাবউক্তি বিনিময়ের যে মাধুর্য তা অতুলনীয়। সাধারণ নাটকের মতো কেবল তা সংলাপ সর্বস্ব নয়। আপাত:ভাবে মনে হতে পারে বাজিকর প্রধান চরিত্র । কিন্তু ক্রমশ উদ্ভাসিত হবে এখানে প্রধান চরিত্র বলে কেউ নেই। প্রত্যেকের অবস্থা ও অবস্থান কেন্দ্রিয় মনোজগতের উৎসবিন্দু। থলের ছোট্ট খরগোশ ক্যারেক্টারটিও ছোট্ট থাকে না। যদিও অদ্ভুত পোশাকপরা বাজিকরের আবির্ভাবে ‘শিশুরা’ ও ‘বালিকা’ নামধারী চরিত্ররা উন্নয়নশীলতা প্রাপ্ত হয়। এবং সর্বশেষে ছোট্ট খরগোশের হাই হাই হেই হেই চিহ্নিত ধ্বনি সমূহ শোনা যায়। বালিকার পিতা হারিয়ে গেছেন, যিনি পক্ষীভাষা জানতেন আর শিশুরা আজ মাতৃহারা। রাজার কোটাল স্তব্ধ করে দিয়েছে বন্দী মাতার আয়ু। ‘বালিকা’ ও ‘শিশুরা’ তাদের নিজ নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশের পর বাজিকর উচ্চারণ করে:
তালি দাও করতালি, ও সোনা, শিশুরাখরগোশ ঘুমিয়ে গেছে, জাগাও তাকেতালি দাও করতালি, ও সোনামণিরা
[ধীরে ধীরে থলে থেকে খরগোশটি বেরিয়ে আসে। বাতাশে কান খাড়া করে। ছোট ঘাসের চত্বরে অদ্ভুত এক নরম ভঙ্গিমায় খেলা করে। বাজিকর থলে থেকে বের করে আনে করোটি।]
স্বল্প পরিসরের এই লেখায় শাহেদ শাফায়েতের মতো বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী কবিকে বিনীতভাবে স্মরণ করার চেষ্টা করেছি। আরো আরো বিস্তির্ণ আলোচনা ক্রমশ নিবিড় হবে বলে আশা রাখি। তিনি কবিতার গুঢ় অনুশীলনে নিমগ্ন ছিলেন, বাণিজ্য জগতের দুষণ থেকে দূরে ছিলেন। অনন্ত দেবীগঞ্জের মৃত্তিকায় তিনি মাটি হয়ে বেঁচে আছেন। সেই মাটির নিজস্ব অন্ধকার দূরের অচেনা তারা জেগে ওঠার জন্যে যথেষ্ট সক্ষম। আর যেহেতু তিনি বহু পূর্বেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কবিতার অদেখা অঙ্গের সম্ভ্রমে।
মন্তব্য