একটার পর একটা বিড়ি ধরিয়ে, কাগজে কাটাকুটি করে কিংবা কবিতার মাষ্টারের জঘন্য ক্লাসের মতো করে একটা গদ্য লিখতে হবে এইসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে কবিতাকে দৃশ্যে নিয়ে এসে দেখতে থাকি। ডুবে যাই। রঙে তুলি চুবিয়ে ক্যানভাসে আঁকতে থাকি শাহেদ শাফায়েতের মুখ।
এই যেমন একটি দৃশ্যকে পড়ুন—
এক রাজ্যেমদগেলাশের উপশিরা বেয়ে বেয়েজিপসি রানীর উড়ে চলে বুনোহাঁসপাহাড়শ্রেণীর স্তন ছুঁয়ে ছুঁয়েঝরে যায় নীল পালকের নেশাগ্রস্ত ইন্দ্রজালপাহাড়ের নিচে ঝুলছিল এক দৈবরাজের নদীনদী খেলা করে জুমচাষিদের কন্যা কুমারী নিয়েহঠাৎ যেখানে জেগেছিল কোনকালেঅন্ধকারের সার সার ঘন কবরের তলদেশসেখানে হলুদ ঘাসগুলো খেয়েছিলআমার শার্টের দুঃখবোধক একটি মাত্র বোতাম
এবার চোখ বন্ধ করুন। হারানো বোতামের সন্ধানে পান করুন বর্নীল দৃশ্যসমগ্র। দৃশ্যের ভেতরের দৃশ্য পার হয়ে— গভীরে— আরও গভীরে তলিয়ে যান। বোতামের সন্ধানে আকণ্ঠ পান করুন কবিতার মদ।
অথবা আরেকটি দৃশ্য :
তড়িৎহাত রাখি জলে,—জলজ অবতলেঅবতল নেই। শুধু বালিরাশি—কাঁকরের ফাঁকে ফাঁকেকয়েকটি কাঁকড়ার নাচ;নেচে ওঠা আঙুলের ফাঁকেসম্পর্ক গড়ে তোলে তারা।টুকরা পাথর সব বালির ঘর্ষণেস্রোতের ভিতর ভাসেনূতন নূতন ফুল ও ফুলকি।
আর্টিস্ট: হিম ঋতব্রত |
কখনও কখনও কোনও মন্তব্য না করে চুপ থাকাই শ্রেয়। কেবলই দৃশ্যের মাঝে অনুভবের অতলে সহজ ডুবে যাওয়াটাই শান্তির।
দৃশ্যে ডুবে গিয়ে এবার নিজেই নির্মাণ করি আরেক দৃশ্য :
ঈভের সিঁড়িছায়ার দোলক হয়ে আড়াল করো মুখপানগেলাশের বৃত্তে আঙুল কাঁপেজলকোরাসের দৃশ্যে তোমার পীঠফোটাও সবুজ আলোর দ্রোহে খইনেচে নেচে যায় উপছায়া উপবনসেখানে তোমার সিঁড়িগুলো ঘুমিয়েছেসেখানে তোমার সিঁড়িগুলো দাঁড়িয়েছে
গেলাসে আরেক চুমুক দিয়েই উঠতে থাকি, টলতে টলতে একধাপ, দুইধাপ, তিনধাপ... পাড় হয়ে হয়ে আসি। ওদিকে পাড় করা ধাপেরা সংখ্যায় ক্রমাগত বাড়তেই থাকে সামনের দিকে। শূন্যে দোদুল্যমান দেয়ালহীন সীমানাহীন এক অদ্ভুৎ সিঁড়ি! সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে যাই। হাপাতে হাপাতে হাত বাড়িয়ে ডাকি— ‘তুলে নাও!’
তারপর অনুভব করতে পারি দাঁড়িয়ে থাকা ঘুমন্ত মাদী ঘোড়ার পিঠ হয়ে গেছে সিঁড়িটি। একটি যুবতী ঘোড়ার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকি। এক অদৃশ্য হাওয়া এসে ভাসিয়ে নেয় স্বর্গের অতি নিকটে।
.
আহা এমন একটি আহবানে তুমিও একবার প্রেমিকার বুকে হাত ছুঁয়ে দ্যাখো—
জন্মান্তরের পাঠনম্র পাখির ছানাতোমার জলবিন্দু চোখে আমাকে গ্রহণ করোএই মর্মমূল ছিঁড়ে খুঁড়ে চৈত্রে ঘষছি মুখঠুক ঠুক খোদাইয়ের শব্দস্রোতে অন্ধ কুঠুরিপ্রিয়তম চোখ, নম্র পাখির ছানাআমাকে গ্রহণ করো লিবিডো প্রমাণেএখানে অধিক শিশুতোষ যৌনতা, বিরুদ্ধ সঞ্চারপিতৃকণ্ঠের মতো নিচু ছাদ, তীব্রতাখোদাইয়ের প্রহসন গাঁথা গৃহগামী ঋণনম্র পাখির ছানা, প্রিয়তম চোখআমাকে গ্রহণ করো লিবিডো ঘামেআমাকে জড়িয়ে রাখোখাদ্য-বিকাশ-স্মৃতি ঋতুতে ঋতুতে
কবিতার এই আহবান শেষে দুই জোড়া চোখ একসাথে হওয়া মাত্রই— আমার ঘর যেন গভীর রাত্রির একটি গহীন বন হয়ে ওঠে, পাতার ফাঁকফোকরের গলি পার হয়ে চাঁদের টুকরো টুকরো আলোকন্যারা এসে জালিকার মতো ছড়িয়ে যায় ঘাস বিছানায়। এরই মধ্যে যখন ঘামের ঘ্রাণের তীব্রতা আরও বেড়ে যায় তখন আলোকন্যারাও দোঁহার দেহের মতো ভেজা নিশ্বাস ফ্যালে, দোলে মৃদু হাওয়ার তালে তালে।
হাওয়ার তুমুল দুলুনি, দুলতে দুলতে একের পর এক রূপান্তর হয় সমস্ত জীবজগত। বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্যজাল পাঠ করে ইতিহাস শিখে নেয় পৃথিবীর সমস্ত সংসার।
এমন একেকটি দৃশ্য পড়তে পড়তে নতুন নতুন দৃশ্য তৈরি করি আমিও। তারপর এক ঘোর— মহাঘোরে মনের ভেতর আঁকতে থাকি শাহেদ শাফায়েতের দৃশ্যমুখ।
মন্তব্য