মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সমাজে নিরন্তর ভাঙাগড়া চলছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্মিত হচ্ছিল নতুন নতুন আখ্যান। এক স্থূল জীবনযাত্রার দিকহীন কল্লোলে বাংলাদেশের সামাজিক স্রোত গন্তব্য খুঁজে ফিরছিল। সমাজের এই ফ্যাকাসে বাস্তবতা সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বহিরাবরণে প্রকট রূপেই দৃশ্যমান। পরিপার্শ্বের কলরবকে উপেক্ষা করে সামাজিক যন্ত্রণাকে যারা নিমগ্ন হয়ে স্পর্শ করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে শাহেদ শাফায়েত অন্যতম।
তার কবিতার পংক্তিতে অবগাহন মূলত এক অনাবিল অন্তর্যাত্রা। বোধের প্রতিটি পদক্ষেপ আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে, পরিচিত বাস্তবতার সংজ্ঞায় ফাটল ধরে। সময়ের ত্রিমাত্রিক অবয়ব রূপ পায় মাত্রাতীত কাঠামোয়। 'সময়' কবিতা এর এক অতিবাস্তব উদাহরণ। এর প্রথম পংক্তি শুরু হয়েছে এভাবে-
মানুষের ছন্দ নাচ অই মানুষের বিজয় পতাকাঅইতো আন্দোলিত জনতা সংকেতধেয়ে আসা প্রস্রবণ বাহুদেবে ভূমি অধিকার।
সে এক অদ্ভুত পথ। আটপৌরে আবেগের আড়ালে দীপ্ত প্রাণ আন্দোলিত হয়। একপেশে মৌনতা নয়, আহ্বান জানায় যৌথ পদক্ষেপের-
শুভ পরিণয় সূত্রে গাঁথো একা ও উত্থিত হ্রদমুক্ত করো রাহুগ্রাস, ছিটাও হাতে হাতে ধানধন্যপ্রাণগাছে গাছ শিহরিত ডালপালা হ'তে এই বাণীউচ্চারিল তারা আজ;
আদিম বৈষম্য আর উদাসীনতার প্রহর পেরিয়ে জন্ম হোক নতুন প্রভাতের। কবির তন্ময় চৈতন্যে সেই উচ্চারণ যেন নিরন্তর ধ্বনিত হতে থাকে-
সকল সৈনিক ও যোদ্ধৃবৃন্দ, দাঁড়াও হুমকিমুখোযেখানে স্তুপগুলো শুধু কি পাথরে তৈরি,তার স্তম্ভ হ'তে হাড় জিরজির বিজ্ঞানগড়বে নোতুন সভ্যতা, নিরন্তর সূর্যোদয় তার।
ইতিহাস সচেতন কবি জানেন সময়ের অভিঘাত অপৌরুষেয় নয়। যাবতীয় দুর্মর পরিব্যপ্তিগুলি আসলে একপাক্ষিক, একরৈখিক। ব্যপ্তসময়ের সূচনা থেকে হেঁটে আসা ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটুক- এই উচ্চারণ কবির কণ্ঠে অনেকটা স্বগতোক্তির মতো শোনায়। তিনি অবলীলায় বলে যান-
বিদায় পুরুষ-শাসিত এই ত্রাস, রাজস্ব-খাসবিদায় রক্তপুঞ্জ, দলিত শবাধারযেন এই উদ্দেশ্য হয় জনতাহ্যাঁ, দেবী ও জনতাএক মিলিত স্রোতধারা।
আত্মানুসন্ধানেও তার আপত্তি নেই। বরং অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে উন্মোচন করেন অন্তর্লীন উপাদানসমূহ। বোধের গভীরে চাপা পড়া অব্যক্ত ইতিহাসকে ডাকতে থাকেন আকুল হয়ে-
উত্থিত মনোরথ, উদিত ঢেউ-এ বাষ্পাকুলসরঞ্জাম-স্বপ্ন-সমাবেশওঠো, ওঠো-- শৈশবগাড়ি, আমার চাকায় চাকায় পিষ্ট, পিণ্ডহোক তাবৎ জুয়ারি রাজপুরীতন্ত্র।
মানুষের আদিম অনুভূতি ক্ষুধার রূপ নিয়ে ঝুলে থাকে সময়ের দেয়ালে। হৃদয়বান কবি সে ব্যথাকে অবদমন করেন কীভাবে? তাই বোধহয় আর্তনাদ হয়ে ধ্বনিত হয়, উপমেয় হয়ে ফুটে ওঠে চিত্ররূপ-
হায় শাদা ভাত, হায় নিরন্ন কান্নাধ্বনি!দাও ছুড়ে ফেলে রাজকাজ, দূর বাণিজ্য বহর হ’তেআগুন সমান দাম-- মানব অধিকার
সময়ের এইসব নানাবিধ রূপময়তা নিয়েই তো জীবন। সময়ের দিগন্তে তাকিয়ে খুঁজে পাওয়া ব্যথিত পর্যবেক্ষণ খুলে দেয় স্বপ্নের জানালা, ভেসে আসে আলোছায়াময় এক অনিকেত প্রকৃতি। আর এসবের অকপট বিবরণে কবি প্রাণখুলে বলেন-
তাথৈ তাথৈ ধিনতা তালে তালে গহন খুঁড়েখুঁড়ে এইভাবে পাই আজ যেন কোমল গান্ধারজেগে আর্দ্র অনুসন্ধান তোমার।
কবিচিন্তার গতিপথ যে ভঙ্গির, তাতে ভাষার শক্তি পাঠকের অচেনা থাকে না। নিবিষ্ট পাঠক ধীরে ধীরে কবির কাব্যধারণার অবয়ব ও ব্যপ্তির পরিধিতে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। অনুধাবন করতে পারেন স্বপ্নের রহস্যময় কথকতা। 'সময়' কবিতা তারই যেন এক বাঙ্ময় প্রতিধ্বনি।
মন্তব্য