আশি এবং নব্বই দশকে একদল মেধাবী কবির আগমন ঘটে বাংলাদেশে। তাঁরা মেজাজী এবং স্বল্পমাত্রায় গোপন অহংকারীও ছিলেন। বাংলা কবিতার কিছুটা বাঁক বদল হয়ে থাকলে সেটা তাঁদের দ্বারাই ঘটেছে। তাঁদের অধিকাংশই লিখেছেন লিটল ম্যাগাজিনে। সেই সময়ের লিটল ম্যাগাজিনগুলো ছিল উন্নতমানের। কোন বাজারী কাগজ তার ধারেকাছে ঘেষতে পারেনি। সেই মেধাবী কবিদের একজন শাহেদ শাফায়েত। তিনি লিটল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন।
১৯৬৯ সালে পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায় জন্ম হয় শাহেদ শাফায়েতের। প্রশস্ত করতোয়া নদী সংলগ্ন সবুজ দেবীগঞ্জ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ। শহেদ শাফায়েত এবং এখানকার প্রকৃতি আমাকে আপ্লুত করেছে সব সময়। তাই আমার পছন্দের তালিকায় দেবীগঞ্জ শীর্ষে। আমাকে এখানকার লেখক এবং অন্যান্য মানুষের সাথে ব্যাপক পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছে শাহেদ শাফায়েত। দেবীগঞ্জের মানুষেরা অতিথিপরায়ন, সরল এবং মিশুক। এর ভূপ্রকৃতি সমতল কিন্তু কোথায় যেন একটা মায়া, একটা আকর্ষণ লুকিয়ে আছে। তাই বারবার ফিরে ফিরে যাই দেবীগঞ্জ। শাহেদ শাফায়েতের দেবীগঞ্জ। অকাল প্রয়াত চালচিত্রের লেখক দুলাল রায়ের স্মরণ সভায় বলেছিলাম- এই দেবীগঞ্জে জন্ম যাদের, তারা কবি-লেখক হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুব কষ্টের, অস্বাভাবিকও বটে, শাহেদ শাফায়েত কাউকে কিছু না বলে অবেলায় জাগতিক ঘুমের ভেতর দিয়ে চলে গেছে অনন্ত ঘুমের দেশে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ হয়ে থাকলো শাহেদ শাফায়েতকে হারানোর তারিখ।
অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। সম্ভবত ১৯৮৭ সালে তার সাথে পরিচয়। ঠাকুরগাঁওয়ের আলপনা সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ পাক্ষিক সাহিত্য সভা আয়োজন করতো। সেই সূত্রে এবং আমি সাহিত্য সভার পরিচালক থাকার কারণে ঘনিষ্ঠতা আরও বেশি হয়। সাহিত্যালোচনা, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, অনেক স্মৃতি। শিশুর মতো সরল কিন্তু অপূর্ব প্রাণশক্তি। কবিতা ছিল তার রক্ত-মজ্জা। সে উপস্থিত কবিতা বলতে পারতো। অনেক শুনেছি তার উপস্থিত কবিতা। একটা কবিতার সাথে আর একটা কবিতার মিল থাকতো না। এটা দেখে আমি সেই চর্চা শুরু করেছিলাম। তার সম্মোহন ক্ষমতা ছিল। একবার যে মানুষ তার সাথে মিশবে সে তাকে ভুলতে পারবে না। তার কবিতা পড়বার ধরণটাও ছিল ভিন্ন। শব্দ প্রক্ষেপণ, ভঙ্গিমা অনেকের চেয়ে আলাদা। যখন সে কবিতা পড়তো, মনে হতো কবিতার দেশের এক রাজকুমার, ঘোড়ায় চড়ে এসেছে আমাদের কবিতা শোনাতে।
১৯৮৯ সালে তার ২১ বছর বয়সে ১৫ টি কবিতা নিয়ে ৮ পৃষ্ঠার পুস্তিকা ‘কোরপাটেলিক’ প্রকাশ হয়। এই পুস্তিকা আমাদের চমকে দেয়। সে সময় কোরপাটেলিক শব্দটি অনেকের কাছে অচেনা। উৎসর্গ ভিন্ন রকম- এই অহংকারের উৎসর্গ থাক শত্রুর তূণে। কভারের উল্টো দিকে লেখা-
করতল উথলে ওঠেফেনায় ফেনায়নাচে বোধের বিদ্যুৎদেহত্ব সংক্রম দাহপ্রিজম সম্পাতেপীত তুষার অদ্ভুত
যারা কবিতা লেখেন, পড়েন তাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠলেন শাহেদ শাফায়েত। ওদিকে ‘চালচিত্র’র একটি সংখ্যায় তিনজন আলোচক ভিন্ন ভিন্ আলোচনা লিখলেন। এই আট পৃষ্ঠা এতখানি প্রভাব ফেলেছিল পাঠক মনে। উৎপলকুমার বসু সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ অনেক কথার মাঝে বলেছেন- এ রকম কৃশ একটা বই পরবর্তী কবিদের উপর এত দূর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এর তুলনীয় নজির খুব কমই আছে। শাহেদ শাফায়েতের ‘কোরপাটেলিক’ তার অবস্থানকে শক্ত করেছে, তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করেছে। এবং আজ ৩৩ বছর পরেও সেই কবিতাগুলো পুরনো হয়ে যায়নি। অভাব-অস্বচ্ছলতা-ত্রাণ, ব্যাক্তিগত ঋণ, আন্তর্জাতিক ঋণ, অতীতে ছিল, মাঝামাঝিতে ছিল, বর্তমানেও আছে-
ঐতো উড়ছে ত্রাণত্রাসের আঙুলচুলের অতীত-দিনঋণের প্রশাখা-বাকলপাঁজরের ছাইভ্রুণের পোষাকজ্বর-জ্বরের ত্রিপলবেরিবেরিখোয়ার-বাগানঐতো কাঁপছে জলপ্রশ্নবোধক তাঁবু!
সভ্যতা যতদিন থাকবে, দেশ ততোদিন থাকবে। দেশ থাকলে অভাব-অনটন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকবে। উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন থাকবে। তাই ‘ত্র্ণ’ কবিতাটি চিরকালীন একটি কবিতা।
কবিতাকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে শাহেদ শাফায়েত লিখে চললেন কবিতা। একটার পর একটা কবিতা, নিজেকেই অতিক্রম করে চলেছেন তিনি। প্রকাশ হলো- তোমার জৌলুশ মাখা প্রতিটি ভোরের গান, বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান এবং চরকা কাটার গান।
বিষয়ের সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্য আর বাস্তবতা মিলেমিশে এক অন্য রূপ পেতো তার কবিতা। বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান বইয়ের ‘শস্যগাথা’ কবিতা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে-
অই অন্ধ বালকের জন্য বসে থাকিও গেছে বনের ভেতর থেকে ফেরাতেঘোড়াগুলো আরআনবে সঙ্গে করে অনেক নরম শিকড়গাছিবন্য কীটের তৃণধ্বনি সহকারেলোকালয় ছেড়ে অনেক অনেক দূর এইপথতুমি ঢেকেছ নিজ মুখচ্ছবি সূর্য সবুজে ঘাসে ঘাসেআমি থাকি পাহাড়চূড়ার অই পাশে একাতবু শোনাও খুরধ্বনি বিচূর্ণ গাথা?স্বাধীনতায় তোমার আবাসে।. . .তখন বলছে ডেকে এক বনমোরগ--শোনরে সঙ্গিনী রাখালিয়া সুরওগো একাকিনী বিষণ্ন গায়িকা কাস্তে চালিকাতোমারই মানব বন্ধু ও যেন হারায়নি তো স্বপথ ফসল ফসিলচতুর্দিকে প্রাণজ কণ্ঠ ঘেরা চৌপথে কালিকা তমালিকা...।
শাহেদ শাফায়েত ছড়াপত্র ‘রংতুলি’, কবিতাপত্র ‘করাত’ এবং নতুনদের জন্য কবিতাপত্র ‘বৈশাখে’ সম্পাদনা করেছেন। এ সব করেছেন দেবীগঞ্জ থেকে। তিনি শিক্ষাজনিত কারণে ঢাকা যান। সেখানে বেশ কয়েক বছর অবস্থান করেন। সে সময় ‘পূর্ণদৈর্ঘ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। প্রথম তিনটি সংখ্যা তার সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। এর পরিকল্পনা, বিষয় এবং লেখকদের লেখার মান এত উন্নত ছিল যে বাংলাদেশে নতুন স্বাদে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল এবং এটি ছিল প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন। শুধু কবিতা নয় লিটল ম্যাগাজিনের পরিশ্রমী সম্পাদক ও কর্মী হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য। মোটা দাগে একটা কথা বলা যায়- শাহেদ শাফায়েতের কবিতা সাহিত্যে নতুনত্ব দিয়েছে।
ওইপারে ভালো থেকো শাফায়েত। সীমাবদ্ধ আমি। তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
মন্তব্য