কবিতা যদি তাঁর সূঁচের ফাঁক দিয়ে সূর্যকে দেখা হয়, তাহলে নাটক হলো মানুষের যাপিত জীবন, বুহুমুখীতা এবং মুখোশ উন্মোচনে শেকড়ের সন্ধান। প্রতিদিন আমরা বহু মানুষকে দেখি কিন্তু সৌন্দর্য্য এবং অন্ধকার দিকের সংঘর্ষে উচ্চারিত শব্দগুলো আমাদের কানে পৌঁছায় না। কখনও কখনও সাদা চোখে যা দেখি তা সত্য নয়, আবার যা দেখা যায় না সেখানেই সত্য লুকিয়ে থাকে। এই সত্যের বিপরীতে প্রচলিত বিশ্বাস ও মূল্যবোধের আবর্তে ধ্যান-জ্ঞানে আমাদের যে বেড়ে ওঠা দেয়াল, তা ভেঙ্গে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন এবং প্রত্যয় নিয়ে যে মানুষটি গড়ে তুলেছিলেন ‘নদীমাতৃক থিয়েটার’ সেই শাহেদ শাফায়েত আজ আর আমাদের মাঝে নেই। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রি. তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
নব্বই দশকের কথা। সম্ভবত: ৮৫ বা ৮৬ সাল হবে। আমাদের পাড়ার ক্লাব মিলন ক্রীড়া সংঘের উদ্যোগে ক্লাব প্রাঙ্গণে একটি নাটক মঞ্চস্থ হবে। নাটকের নাম ‘শত্রু তুমি, বন্ধু তুমি’। রচনা ও নির্দেশক: শাহেদ শাফায়েত। ক্লাব সভাপতি মজিবর রহমান বাবুল (বর্তমানে সহশিক্ষক টি জেড হাইস্কুল, দেবীগঞ্জ) ও সহ-সভাপতি রেদোয়ানুল হক বসুনিয়া বাবু একটি সাংগঠনিক প্লাটফর্মে নাটকটি মঞ্চায়ন এবং ভবিষ্যতে নিয়মিতভাবে যেন নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা যায় সেই উপায় খুঁজছিলেন। তখন ‘নদীমাতৃক থিয়েটার’ নামকরণের মাধ্যমে একটি নিয়মিত নাট্য সংগঠনের গোঁড়াপত্তন করেন শাহেদ শাফায়েত। সত্যি বলতে কী, সেই সময়ে নাটক করার জন্য আনুষঙ্গিক যে খরচ হবে, তা বহন করার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের ক্লাবের ছিল না। তাই চাঁদা তুলে এবং পাড়ার প্রত্যেকটি বাড়ি নগদ অর্থের পরিবর্তে চাল দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। সেই চাল বিক্রি করে হ্যাজাকের তেলসহ অন্যান্য খরচ মেটানো হয়। সেটা ছিল দেবীগঞ্জে আমার জানা মতে মঞ্চস্থ হওয়া প্রথম আঞ্চলিক ভাষার নাটক। অবশ্য সে নাটক গুণগত মানের দিক থেকে তেমন ছিল না। তবু তাঁর প্রথম অভিযাত্রীক প্রবাস দেবীগঞ্জের নাট্য আন্দোলনকে বেগবান করেছিল এবং নাট্য চর্চা বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল। সেই থেকে শুরু।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘একজন মীর জাফরের গল্প’। স্থান ছিল পুরাতন শিশু পার্ক সংলগ্ন লিচু তালার পশ্চিম দিকের পরিত্যক্ত বিল্ডিং প্রাঙ্গণ। এ নাটকটি ভীষণ দর্শক প্রিয়তা পায় এবং আলোচানা ও মুল্যবোধ জাগরণে একজন গ্রামীণ যুবকের সাহসী উচ্চারণ যেন তাবৎ পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এটাই ছিল নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে যারা অভিনয় করেছিলেন: আশিক-উর-রহমান (দেবীগঞ্জ হাসপাতালের স্টাফ ছিলেন), মোফাজ্জল হোসেন, লেমন ওয়াহিদ, জাহাঙ্গীর আলম সাবু, আশরাফ হোসেন, আনোয়ারুল হক, বারিক হোসেন, আয়নাল হক, আব্দুল বাসেদ, আলাল হোসেন, তাইবুল ইসলাম (অনেকের নাম এই মুহূতে মনে নেই)। নারী চরিত্রে: কালামণি। এটিও আঞ্চলিক ভাষার নাটক। এই নাটকেও বিভিন্ন ভাবে চাঁদা আদায়ের পর তহবিল ঘাটতি থাকায়-মরহুম লতিফ স্যার, ডাক্তার আনোয়ারুল করিম (আনু), আব্দুল মালেক চিশতী, ননো বাবু, পরিমল দে সরকার, প্রবীর কুমার এ্যাপোলো আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁদের সেই সহানুভূতিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
বর্তমানে পুষ্পিতা ড্রাগ হাউস এর সামনে দেবীগঞ্জে প্রথম মঞ্চ নাটক ‘নাটের গুরু’ মঞ্চস্থ হয়। রচনা ও নির্দেশনা: শাহেদ শাফায়েত। সামাজিক বৈষম্য, সময়ের যন্ত্রণা, তথাকথিত সমাজপতিদের সততার ভেল্কি ও নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ ‘নাটের গুরু’ মঞ্চ নাটকের অত্যন্ত সাবলীলভাবে শৈল্পিক পন্থায় উপস্থাপিত হয়েছে। গণমানুষের মুখের ভাষা আঞ্চলিক ভাষায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
অতঃপর শাহেদ শাফায়েত ও দেবীগঞ্জে সাহিত্য অঙ্গনের আরেক দিকপাল রাজ্জাক দুলাল-এর যৌথ রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘হবু রাজার গবু মন্ত্রী’। স্থান ছিল পুরাতন শিশু পার্ক সংলগ্ন পরিত্যক্ত বিল্ডিং প্রাঙ্গণ। এটা হাস্যরসের উপর রচিত আঞ্চলিক ভাষার নাটক। এই নাটকের একটি দৃশ্যে গানের দুটি চরিত্রের সংলাপ উপস্থাপন করা হলো:
প্রথম ব্যক্তি:মাকলা ফাটার বেটা,মিচ্ছাকাথা এতই জানিসনাগাইস খালি নেঠা. . .।দ্বিতীয় ব্যাক্তি:চুপ চুপ চুপঐ জন্য তোর ভাকুরা মুখা,পেঁচার মতন রুপ,এ্যাক থাপ্পড়ে ফেলাম মতেফেদেলা পারিস খুব . . .।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সেই নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে পঁচানব্বই সাল অবধি সৃষ্টির উদ্ভাবনায় বিভোর হয়ে অনেকেই সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করছিলেন। শাহেদ শাফায়েত, রাজ্জাক দুলাল, শাহ আনিছুর রহমান, রবিউল ইসলাম বিলাসী, লেমন ওয়াহিদ, রওশন আরা মনি, অমরেন্দ্রনাথ টিটু, আব্দুল হালিম, প্রয়াত দুলাল রায়, কবির হোসেনসহ অনেকেই নিয়মিত লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন।
‘নদীমাতৃক থিয়েটার’ ও শাহেদ শাফাযেত আঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। যদিও বর্তমানে এই থিয়েটারের কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এক সময়ে মানবতার জয়ের জন্য লড়াকু ভূমিকায় তাঁর লেখনীকে অবতীর্ণ করেছেন, সমাজ বদলের যুদ্ধে পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছেন, প্রত্যাশার চোরাবালি পার হয়েও থেকে গেছেন কষ্টের কিনারায়। তুব তাঁর সৃষ্টির আলোকরশ্মি দেখবে পথ বিশ্বে, অতি বিশ্বেও। এই বোধটুকু চির জাগরুক থাক আমাদের হৃদয়ে, আমাদের নিশ্বাসে, আমাদের বিশ্বাসে...
মন্তব্য