ক
শাহবাগের দিনগুলো ছিলো আমার জীবনের স্বর্ণযুগ! আজিজ মার্কেটের তিন তলায় ৮৭- এ আমার ছোট্ট অফিস। প্রতিদিনই সেখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির লোকজন আসতেন। একদিন মলিন পোশাক আর মলিন চেহারায় একটি ছিপছিপে লম্বা তরুণ এলো। উসকোখুসকো চুল, এলোমেলো ভাবনা। কিন্তু ধীরস্থির এবং শান্ত। প্রতিভাবান। ভদ্র। বিনীত। তবে চোখে-মুখে নেশার ঘোর লেগে আছে। যেন পোড়ামাটির মানুষ। এসেই বললো, আমি শাহেদ শাফায়েত পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় এসেছি কবি হবার জন্য। আপনার পরামর্শ চাই! তার কথায় কোনো সংকোচ নেই, জড়তা নেই। ওকে দেখে নিজের কথা মনে পড়লো। একদিন আমিও ওর মতো এভাবে শূন্য হাতে এই শহরে এসেছিলাম। যে শহর আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। শাহেদ শাফায়েতকে ঢাকা শহর ফিরিয়ে দিয়ে ছিলো। সে কি এই নগরের নাগরিক হতে পেরেছিল! আমি মুগ্ধ হয়ে ছিলাম তার উচ্চারণে। বললাম, কি পরামর্শ? ও বললো, আপনি অনেক অভিজ্ঞ। এখানকার সাহিত্যের ধরণ ও ধারা সম্পর্কে একটা ধারণা দেন। আমি বলেছিলাম একটা আলোকি ধারা। অন্যটি ভিন্ন অর্থাৎ আবছায়া। শাফায়েত বললো- জানি; আপনি আলোকিত ধারায় ভালো মানুষ। কিন্তু আমার ভালো লাগে আলো আঁধারী জীবন। আমাকে টানে ঘোর তৈরি করা পথ। ওর ভালো লাগলো-সুব্রত-কাজল পরবর্তীতে রিফাত- মারজুকদের যাপিত জীবনের কষ্ট মিশ্রিত আনন্দন। ওর এই সারল্য, স্বচ্ছতা এবং গভীর পর্যবেক্ষণে আমি অবাক হই। চা-টা খেয়ে যাবার সময় বললো-দুলাল ভাই, আমি ঐ পথের পথিক। আমার পা সেই পথই টানছে। আমি যাই। তাঁর সেই দিনের অদ্ভূত উপস্থিতি এবং নাটকীয় প্রস্থান আমি তিন দশকেও ভুলতে পারিনি।
খ
আমরা এক সময় প্রথা বিরোধী সাহিত্য আন্দোলন করেছি। পশ্চিমবঙ্গে আনন্দ বাজার গ্রুপের বিপক্ষে ‘শতদল ঝর্ণা’র অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি; ঢাকায় গঠন করেছি-‘এই সব স্রোতের বিরুদ্ধে’। প্রতিষ্ঠিত করেছি লিটল ম্যাগের গ্রুপ- ছোটকাগজ। তখন শাহেদ ‘স্বল্পদৈর্ঘ’ নামে লিটিল ম্যাগ বের করতো। আবার এসেছিলো ‘শতদল ঝর্ণা’ আর ‘ এই সব স্রোতের বিরুদ্ধে’ নিয়ে একটি গদ্যের জন্য। কিন্তু সেই লেখাটা লিখতে পারিনি। সেজন্য শাহেদ মনে হয় মনক্ষুন্ন হয়েছিলো। আরেকবার এসেছিলো- বিটিভতে প্রচারিত আমার যেকোনো নাটকের স্ক্রিপ্টের জন্য। কারণ, সে একটি কাব্য নাটক লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আমি শামসুর রাহমানের ‘সাযযাদ আমিনের কথা’র স্ক্রিপ্ট দিয়েছিলাম। পরে শাহেদ বেশ ক’টি নাটক লিখছে। সেগুলো কোথায় প্রচার হয়েছে, জানিনা!
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, স্নাতকোত্তর, চিরকুমার শাহেদ এক পর্যায়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান এবং মৃত্যু অব্দি সেখানেই ছিলেন। ঢাকার জীবন যাপন ছিলো- প্রায় উদ্বাস্তু, ভবঘুরে, এলোমেলো। ঘরের চেয়ে গৃহহীনতাই ছিলো তাঁর ভালো লাগা। তাঁর এক বন্ধুর স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন- ‘বদরুল হায়দারের সাথে পদব্রজে তারা রওয়ানা দিত তালতলা মার্কেটের দিকে। সেখানে একটা রুম ছিলো বদরুলের মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ডে, সবাই মিলে থাকত তারা। শাহেদও যেত মাঝেমাঝে। মাঝেমাঝে আমার মালিবাগের বাসাটায় থাকত। মাঝেমাঝে হয়তো নকীবের বাসায়। কিংবা কফিল ভাইয়ের সাথে। কখনো কখনো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে রাত কাটিয়েছেন। কখনো ঘুমিয়েছেন নজরুলের মাজারে। পাবলিক লাইব্রেরির সাইকেল স্ট্যান্ডে। পিজির পেছনে। আর্ট কলেজের ছাদে। বাবুপুরা বস্তিতে। কোনো পিছুটান নাই কোনো ধরণের দ্রব্যে অরুচি নাই। কোনো ধরণের খাদ্যে অনীহা নাই। ক্ষুধায় কাতরতা নাই। সারাক্ষণ হাতের মধ্যে ধরা ঠোঙার কাগজ বা ছোট নোট বইয়ে নিবিষ্ট। লিখছে’। ও লিখতো রুল করা বাংলা খাতায়। ওর আরেক বন্ধু মন্জুরুল আহসান ওলী। ওলী লিখেছে একটি মজার ঘটনা। তা ধার করে এখানে যুক্ত করছি।
‘একদিন আমি শাহেদ ভাইকে বললাম, সাহস কইরা, যে, শাহেদ ভাই একটা কবিতা শুনান আপনার খাতা থেকে। উনি বললেন, ওহ কবিতা? শুনবেন? আচ্ছা পড়ি। পড়তে পড়তে একখানে গিয়া উনি আটকাইলেন। কী হইছে? শব্দটা নাকি কী লিখছেন উনি নিজেই এখন বুঝতেছেন না। শেষে আমার দিকে বাড়ায়ে দিলেন খাতা। বললেন, দেখেন তো ওলী আপনি বুঝতে পারেন কিনা। অতিক্ষুদ্র উদ্ভট হস্তাক্ষর। একদম কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। যথারীতি আমিও ফেইল মারলাম। ৪ বর্ণের ঐ শব্দটা যে কী তা এখন আল্লাই জানেন শুধু। দুইজন মিলে অনেক গবেষণা করেও কোনোভাবেই অনুমান করা গেল না। শেষে আমি হাসতে হাসতে বিরক্ত গলায় বললাম, ধুর ভাই কী যে একটা বিখাউজ জিনিস লেইখা রাখছেন এইটা এখন কেমনে কী উদ্ধার হবে। শাহেদ ভাই সাথে সাথে হাইসা উইঠা বলেলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ ওলী, এইটা বিখাউজই লিখছি। ঠিক, ঠিক, মনে পড়ছে। আমি বললাম, মানে? বইলা খোলা খাতাটার উপর আবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম, ঐ শব্দটার উপর। আরে হ্যাঁ, সত্যিই এইবার পাড়া যাচ্ছে শব্দটা। একজ্যাক্টলি ‘বিখাউজ’ শব্দটাই ঐখানে লেখা আছে। হা হা।
গ
মাত্র আট পাতার তার প্রথম কাব্য পুস্তিকা ‘কোরপাটেলিক’ বের হয়েছিল ছাত্রাবস্থায় ১৯৮৯ সালে শিল্পতরু থেকে। তারপর বের হয়- কোরপাটেলিক’, ‘বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান’, ‘তোমার ‘ জৌলুশমাখা প্রতিটি ভোরের গান’, এবং ‘চরকা কাটার গান’। গ্রন্থের নামকরণ থেকেও তাঁর স্বাতন্ত্রতা অনুমেয়। নির্লোভী শাহেদ খুবই অন্তর্মুখি ছিলো। ছিলো শিশুর মতো সারল্যতা। চতুরতা জানতো না, তরুণ্যের উশৃংখলা-উচ্ছাস ছিলো না। ধান্ধাবাজি ছিলো না। অর্থ কষ্টে থাকতো, তবু কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করেনি। নিভৃতচারী শাহেদের সাথে আজিজ মার্কেটের কোনার সিঁড়িতে হঠাত দেখা হলেই উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ে সাথে বলতো-‘দুলাল ভাই, বাসায় যাচ্ছেন। চাখান’। এই বিনয়-ভদ্রতায় আমি অবাক হতাম, চকমে যেতাম। আমি সারাদিন অফিস করে যখন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতাম, তখন মাঝে মধ্যে দেখা হলে সন্ধ্যার স্বন্ধিঃক্ষণে। আমার হলো সারা, তোমার হলো শুরুর মতো শাহেদেরা শুরু করতো অন্য এক আশ্চার্য রাত্রি যাপন- আড্ডা, আসক্তি, নেশা। আমাদের অগ্রজ কবি বন্ধু ভবঘুরে সাবদার সিদ্দিকীর জীবন যাপনের উত্তর সূরী ছিলো এই অনুজ বন্ধু কবি শাহেদ শাফায়েত। আমাদের পরবর্তী দশকে বেশ ক’জন কবি এই ধারায় ধাবিত। মনে পড়ছে যাদের নাম, তারা হলেন- কাজল শাহনেওয়াজ, বদরুল হায়দার, কফিল আহমেদ, সুনীল সাইফুল্লাহ, বিষ্ণু বিশ্বাস, শোয়েব শাদাব, শামীম কবির, সঞ্চয় প্রথম, সুমন প্রবাহন প্রমুখ। এদের মধ্য সুনীল-শামীম-সুমন বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছা মৃত্যু। দু’ একজন বাদে বাকিদের কেউ মৃত, কেউ নিখোঁজ, কেউ শেকলবন্দী, কেউবা স্রেফ ভবঘুরে। আর শাহেদ তাঁর ‘স্বল্পদৈর্ঘ’ জীবন রেখে চলে গেলেন পূর্ণদৈর্ঘ জীবনে!
মন্তব্য