কবি শাহেদ শাফায়েত (১৯৬৯–২০২৩) থাকতেন দেবীগঞ্জে৷ ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে তিনি কিছুদিন ঢাকায় থাকেন। ১৯৮৯ সালে প্রথম কবিতা পুস্তিকা ‘কোরপাটেলিক’ প্রকাশের পরপরই স্বকীয় কাব্যবৈশিষ্ট্যের গুণে তিনি বোদ্ধা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। প্রথম কাব্যের দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৯ সালে ‘তোমার জৌলুশমাখা প্রতিটি ভোরের গান’, ২০১১ সালে ‘বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান’, ২০২১ সালে ‘চরকা কাটার গান’ প্রকাশিত হয়। তিনি লেখালিখির পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছিলেন; যেমন— শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘পূর্ণদৈর্ঘ’, ছাড়পত্র ‘রংতুলি’, কবিতাপত্র ‘করাত’, নতুনদের কবিতাপত্র ‘বৈশাখে’। কবিতার পাশাপাশি তিনি নাটকও রচনা করেছেন, গড়ে তুলেছেন ‘নদীমাতৃক’ নাট্যদল। তাঁর নতুন কবিতা আর নতুন চিত্রকল্প পাঠককে বুঁদ করে রাখতে সক্ষম। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সাথে বাঙলা সাহিত্যেরও রূপ-বদল ঘটেছে। অল্পসংখ্যক সাহিত্যিকেরই প্রভাব আছে তাতে। বাকীসব তো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো; এখনো লিখে চলেছে পুরনো আমলের ট্র্যাশ। কিন্তু নব্বইয়ের প্রারম্ভেই শাহেদ শাফায়েতের প্রজন্মের গুটিকতক কবি বাঙলা কবিতার গতিমুখ পরিবর্তনে চাপসৃষ্টিকারীর ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। শাফায়েতের কবিতায় যেমন উঠে আসে নিশিকান্ত রাজপুত্র, তেমনি উঠে আসে শহর, গঞ্জ-গ্রাম! প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তার শাশ্বত রূপ আর মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম যেন একই মোহনায় মিলিত হয়ে ভাষা পেয়েছে তাঁর কবিতায়। এখানেই তিনি তাঁর সময়ের প্রচলিত ধরনের চেয়ে একদমই আলাদা। তার কবিতায় উঠে এসেছে বাঙালি সংস্কৃতি-সংগ্রামের নানা অনুষঙ্গ…। কখনো বাঙলার রূপকথা, কখনো মহাভারত থেকে চরিত্রেরা এসে ঠাঁই পেয়েছে তাঁর কবিতায়। তাঁর নান্দনিক শিল্পকুশলতা হৃদয়গহীনে স্পর্শ করে। যা শুধু আবেগ বা অনুভূতি দিয়ে কিংবা মেধা বা ভাষার সৌন্দর্য দিয়ে কিংবা শুধুই দায়বদ্ধতা দিয়ে হয় না। সাহিত্য তো এসব ছাড়িয়েও অন্যকিছু।
এবছর ফেব্রুয়ারিতে কবি শাহেদ শাফায়েত প্রয়াত হলেন। তাঁর সাথে একবারই দেখা-কথা হয়েছিলো, ২০১১-র বইমেলায়। দেখা হবার আগে থেকেই তাঁর কবিতার সাথে পরিচিত; শুধু পরিচিতই না, বরং এভাবে বলা ভালো— পছন্দের কবিদের একজন। তাঁর বইগুলো— ‘কোরপাটেলিক’, ‘বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান’, ‘চরকা কাটার গান’; মুগ্ধ করেছে দিনের পর দিন। সেই কবির প্রয়াণ হৃদয়ে হাহাকার তৈরি করলো। ৭ই এপ্রিল ‘বিন্দু’র আয়োজনে তাঁর স্মরণসভা করলাম কুড়িগ্রামে। তার আগে মার্চ ২০২৩-এ প্রকাশিত বিন্দু পত্রিকার ২৬ তম প্রিন্ট সংখ্যায় ঘোষণা দিয়েছিলাম ‘শাহেদ শাফায়েত সংখ্যা’ প্রকাশের। সেই ঘোষণা দেবার সময়ও জানতাম না কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেই সংখ্যা; কে বা কারা লিখবেন, আদৌ তাঁর মতো আড়ালে থাকা কবিকে নিয়ে কেউ কলম ধরবেন কী না! সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে কয়েকদিন আগে ঘোষণা দিলাম যে, ১৩ই জুন সংখ্যাটি অনলাইনে প্রকাশ হবে। জ্বি, শেষমেশ প্রকাশিত হলো ‘কবি শাহেদ শাফায়েত সংখ্যা’। বরাবরের মতোই লেখকগণ শ্রমলব্ধ প্রবন্ধ দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গপ্রাপ্ত কয়েকজন লিখেছেন স্মৃতিকথা, চিত্রশিল্পী রাজীব দত্ত অসামান্য প্রচ্ছদ এঁকেছেন; রাজা সহিদুল আসলাম, সাগর নীল খান দ্বীপ অসামান্য সহযোগিতা করেছেন; এরকম আরো অনেকে, কতভাবে যে পাশে দাঁড়িয়েছেন, বিন্দু কৃতজ্ঞ সকলের প্রতি। একটি সংগঠনের কথা না বললেই নয়— দেবীগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ; নির্মোহভাবে এই উদ্যোগ সফল করতে বিপুল সহযোগীতা করেছেন। সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত এ আয়োজন সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। বিন্দুর ক্ষুদ্র সামর্থে কবি শাহেদ শাফায়েতের প্রতি শ্রদ্ধা-নিবেদন উদ্যোগে আমাদের ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না, তবুও অগোচরে যদি কোনো ত্রুটি রয়ে যায়, পাঠকগণ যদি আমাদের নজরে আনেন, ত্রুটি উৎরে যাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। হ্যাপী রিডিং।
প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, বর্তমান সংখ্যার নির্বাচিত লেখা বিন্দুর পরবর্তী প্রিন্ট সংখ্যায় ছাপানো হবে। পরবর্তী প্রিন্ট সংখ্যাটি সুবিমল মিশ্র, সন্দীপ দত্ত ও শাহেদ শাফায়েত স্মরণ সংখ্যা হিসেবে শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।
সাম্য রাইয়ান
সম্পাদক, বিন্দু
অসাধারণ একটি সংখ্যা, পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো গোছানো। বিন্দুর প্রতিটা কাজই মুগ্ধ করে
উত্তরমুছুন