গ্রামের ঘর। মাটির দেওয়াল। দেওয়ালে আঁকা আছে নানা কারুকার্য। বর্ষার জলে,গরমের রোদে পুড়ে যায় আর শক্ত হয়ে থেকে যায় বছরের পর বছর। এভাবেই কালের নিয়ম প্রত্যাবর্তন হয়ে যায় কেমন নিঃশব্দে। দেখি বালি ঘর আর প্রতিটি ভোরের গান। খুব ছোটবেলায় একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে এই লেখা লিখতে। কবিতার নাম ভোরাই। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।ভোরের গান। হাতে এসেছে শায়েদ শাফায়েত এর একটি অপূর্ব কবিতার বই। Romanticism এর মধ্যে দিয়ে Naturalism এর আস্বাদ গ্রহণ করার মতো এই বই। শুধুমাত্র জীবনে বাঁচার তাগিদ মানুষের চিন্তাকে ঠিক কতখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেটা এই কবিতার বইটি না পড়লে চলবে না। যদিও আমি এই বইটি যখন হতে পেলাম তখন এই বই নিয়ে লেখা অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তাই সারা বইটা পড়া আমার কাছে যে শেষ মুহূর্তে অনেকটা ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে সেটা স্বীকার করব। যাক সে কথা, বইটিতে আছে প্রায় ৪২টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাতেই আছে একটা অদৃশ্য সুতো,যেটা একে ওপরকে বেঁধে রেখেছে কবিতার ভেতর দিয়ে। আমরা যখন গায়ে জামা পড়ি আর জামার গায়ে থাকে বোতাম। অদ্ভুত সেই বোতাম গুলো ভেতর থেকে সেলাই করা। অথচ বাইরে থেকে দেখে বেশ পরিপাটি ভাবে বসানো মনে হয়, যেন মনে হয় তেমন কিছুই না। সেই রকমই প্রেমের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি আবার প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে প্রেম- ‘এক হাড়ভাঙা ব্রিজের নিচে, দিনান্তের জলে ভাসাই তোমাকে যদি নৌকা বানিয়ে।’
আমি মনে করি এবং বিশেষ ভাবে দাবি রাখি, একটা কবিতা কখন কবিতা হয়ে উঠবে বা কখন কবিতা হয়ে উঠতে পারবে না, সেটা সম্পূর্ণই পাঠক সময়ের পর ঠিক নির্ধারণ করবে। একজন নিবিড় পাঠক তৈরি করে দেবে সেই লেখার বা বইয়ের বা শিল্পের প্রকৃত চিন্তা এবং সেই চিন্তায় থাকা দর্শন। আমি এই বই পড়তে পড়তে অনেক ছবি দেখেছি। সবই আমার গ্রাম জীবনের ছবি। আম বাগান, জাম বাগান, পুকুর ঘাট, ঝলসানো রোদে মাটি পুড়ে যাওয়া মাঠ, পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো হালকা হয়ে এলে টিলাই বসে সূর্যাস্ত দেখা।আমাদের গ্রামে এইরকম একটি টিলার নাম ছিল পীর বাবার পাহাড়। সেখানে প্রতিদিন বিকেলে যেতাম। গ্রামের রাস্তায় ধুলো মাখতে মাখতে আমরা সেই টিলাই যেতাম। অনেকটা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমাদের সারা গায়ে ধুলো লাগত, ধুলো জমতো। সেই পাহাড়ের ওপরে থাকত ছোট ছোট মাটির পুতুলের ঘোড়া। কারোর পা ভাঙা, কারোর আবার হাত। আমরা দু’-একটা কুড়োতাম। আবার কোনোটা লুকিয়ে লুকিয়ে প্যান্টে ভরে নিতাম। সামনেই ছিল একটা পরিষ্কার জলের পুকুর। মাটির তলায় সাঁতরে যাওয়া মাছ খুব ভালো দেখা যেত। আমরা দু’-একটা ইট বা পাথর ছুঁড়তাম জলে। সন্ধ্যেতে জলের ঢেউয়ে আকাশের ছবি ঢেউ খেয়ে খেয়ে মিলিয়ে যেত। এটুকুই আনন্দ। ভালো লাগতো যে আকাশকে সকাল থেকে দেখি এই বিরাট আকাশের নিশ্চুপ ও নিঃশব্দতা, সেই আকাশ কেমন জলের ঢেউ হয়ে হাতের কাছে ধরা দিয়েছে। এই ধরার কথায় কবি এই কবিতায় দেখিয়েছেন যেন। আমি পড়তে পড়তে দেখি, ‘...গতি ও বিশ্রাম আর অফুরন্ত সূর্যের বয়স ভেঙে ভেঙে বীর্য থেকে বানিয়েছে তার ডানা হলুদ ও উজ্জ্বল।’
একটু পুরো কবিতাটা এখানে তুলে আনি--
হাজার জন্ম শেষে তবে এই বৃক্ষকে পেয়েছি। পতঙ্গের বুকের মতোই শীতল ও ছোট্ট প্রাণ যদিও পাথর তাকে দিয়েছে আশ্রয়, গতি ও বিশ্রাম আর অফুরন্ত সূর্যের বয়স ভেঙে ভেঙে বীর্য থেকে বানিয়েছে তার ডানা হলুদ ও উজ্জ্বলএক হাড়ভাঙা ব্রিজের নিচে, দিনান্তের জলে ভাসাই তোমাকে যদি নৌকা বানিয়ে, কালো কারুকাজে অথবা পুড়িয়ে বানাই কারো চিতাছাই, জন্ম তবুও ঘটে কৃষকের চন্দ্র সূর্য নিয়ে জীবনের ঘাই; কোনো এক ভোরবেলা; স্বচ্ছ এক মাছের উদ্ভবে! ঘটছে জন্ম তোমার নীরব পাহাড় ঘেরা এই সমতলে ভূতলে অনেক আলো, সুষুপ্ত নদী, তারও নিচে হরপ্পার নথি; আর পত্রাবলি কালো যুবকের।আমাদের জন্মগুলো লোমশব্দে ঢাকাদূরের বন্দরে; জাহাজডুবির মতোই ঘটে যায় যার সমাপ্তি নেই সমুদ্রতরঙ্গের ভেতর এক-একটি শঙ্খের আত্মায় এক-একটি সূর্যপতনের কথা।
আসলে এই পুরো কবিতায় কবি একটা জন্ম থেকে জন্মান্তরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ে আমাদের বলছেন। ‘হলুদ ডানা সফলতা। এবং এই সফলতা ‘যৌবন’ পেরিয়ে বার্ধক্যে আসার। সারাটা দিন কৃষক মাঠে চাষ করেন। রোদে-জলে-মাটিতে কাদা মেখে চলে ফসল বোনার পালা। আর এই সামাজিক জীবনের কাজ হয়ে থাকে এই ব্রহ্মের সামনেই। নিরন্তর ও নির্দিষ্ট সময়ে একটি কবিতায় উঠে আসছে যেন কবির প্রেমিকার বার্তা। তাই তোমার নীরব পাহাড় ঘেরা এই সমতলে ভূতলে অনেক আলো, সুষুপ্ত নদী, তারও নিচে হরপ্পার নথি;... আসলে তিনি যখন লেখেন এবং এই লেখার মধ্যেই তাঁর আনুসঙ্গিক জীবনের নানা কাজে প্রতিনিয়ত লেগে থাকা অর্থাৎ তিনি নিজেই যেন সেই সাদা চামড়া গায়ের লোম হয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
জীবন যে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে যাতে চায়, সে তো একমাত্র মন খুব সহজে জানতে পারে। অথৈ সাগরে ভেসে যায় আর কিছু করার জন্য অনেক অনেক সময় যেন পাড়ি দেয় একটা সঠিক ও সদর্থক পদক্ষেপ। কিন্তু কবি তো এতো মাপকাঠি বোঝেন না। বোঝেন একটা নেশাগ্রস্থ তমসা। সেখানে সব দিকের রাস্তায় এক জাগায় এসে মিশেছে অনায়াসে। কোনও দিকে কোনও বাঁধা নেই। সব রাস্তায় যেন উন্মুক্ত। তাই কবি নিজেই হয়েছেন জাহাজ। লিখছেন- ‘জাহাজডুবির মতোই ঘটে যায় যার সমাপ্তি নেই সমুদ্রতরঙ্গের ভেতর এক-একটি শঙ্খের আত্মায় এক-একটি সূর্যপতনের কথা।’ সূর্য পতনের কথা তো সবার জানার কথা নয়। কারণ এই সূর্যের বৈজ্ঞানিক পতনের যে সময় সেই ধরনের সময় মাপার ক্যালকুলেটর আমাদের নেই।আমাদের আছে এক একটা শঙ্খ। অর্থাৎ শামুকের জীবনের ঘটনা যা পরিবর্তনের এক স্বাভাবিক ঘটনা। যা আমরা হয়তো আজকের সোশ্যাল মিডিয়া যুগে অনায়াসে বুঝে নিতে পারি। কিন্তু এক আকাশের বুকে চেয়ে থাকা মাঠের ঘাস, মাঠের ফসল অপেক্ষা করে শীতের জ্যোৎস্না মাখা রাতের হিমেল হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করতে,যা কবির কাছে এক ‘পতঙ্গের বুকের মতোই শীতল’।
ভালো লাগলো। বরাবরই ভালো লাগে।
উত্তরমুছুনঅসামান্য প্রকাশ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনঅপূর্ব
উত্তরমুছুনভালো লেখা
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ। সকলের ভালো লেগেছে, এইটিই ভালোলাগা আর প্রাপ্তি।(ধীমান ব্রহ্মচারী)
উত্তরমুছুন