আশির শেষের দিকে বাংলামোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করতাম, যদিও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই-পড়া কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলাম না। কেন্দ্রের গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এগিয়ে গেলে ঝাকড়া আমগাছের নিচে একটা চত্বর ছিলো, ওখানে আমরা অনেকেই বসে আড্ডা দিতাম। ১৯৮৭ কি ১৯৮৮ সালের সেই চত্বরে কোনো এক সন্ধ্যায় শাহেদ শাফায়েত-এর সাথে পরিচয়। সাথে ছিলেন কবি কফিল আহমেদ। তখনো কফিল ভাই সংগীতের সাথে জড়িত হন নি।
ইতিমধ্যে সংবেদ, অনিন্দ্য, চর্যাপদ আর গান্ডীব এই লিটল ম্যাগাজিনগুলি বেরিয়ে গেছে। সময়টি ছিলো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন দানা বাধার সময়। আমরা বাংলামোটরে জহুরা মার্কেটের পেছনের দিকটায় একটা রেস্টুরেন্টেও আড্ডা দিতাম। আর মাঝেমধ্যে পায়ে হেঁটে জহুরা মার্কেট কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে শাহবাগ এসে সেই আড্ডাটাকে জীবন্ত ক’রে রাখার উত্তাপ বয়ে বেড়াতাম কমবেশি প্রত্যেকেই।
ধীরেধীরে আশি ও আশি’র পরবর্তী প্রজম্মের লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের মহামিলন কেন্দ্রে পরিণত হলো শাহবাগ। পিজির পেছনে বটতলায়, পিজির মার্কেটের রেস্টুরেন্টগুলিতে কবি-লেখকদের আলাপচারিতায় মুখরিত হয়ে উঠলো। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত জেলাগুলো থেকে নূতন নূতন কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদকদের আনাগোনায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠলো। শাহেদ শাফায়েতও সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় ক'রে এই মহামিলনমেলায় সামিল হলো। তার সদ্য-প্রকাশিত কাব্য-পুস্তিক ‘কোরপাটেলিক’-এর (১৯৮৯) কবিতাগুলি অন্যান্য কবিদের প্রকাশিত কবিতার পাশাপাশি পাঠক প্রিয়তা পেলো খুব দ্রুতই। তাৎক্ষণিকভাবে আমাকেও আলোড়িত করেছিলো পুস্তিকা’র কবিতাগুলো। আর এক-ই সাথে শাহেদ একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করার পরিকল্পনার কথা জানালো আমাদেরকে। শাহেদকে আমরা কবি হিসেবে যেভাবে বরণ ক’রে নিয়েছিলাম, পাশাপাশি সম্পাদক হিসেবে তার সাংগঠনিক তৎপরাও বিশেষভাবে নন্দিত হলো।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আর শাহবাগে যাওয়া-আসার মধ্যে দিয়ে আমার সাথে মাসুদ খান, সেলিম মোরশেদ, সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব, তপন বড়ুয়া (তপন দা), তারেক মাসুদ, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, মুহম্মদ খসরু, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, আন্ওয়ার আহমদ, বাহার রহমান, বদরুল হায়দার, আজাদ নোমান, বিষ্ণু বিশ্বাস, ইচক দুয়েন্দে (শামসুল কবির) কচি ভাই, সৈয়দ তারিক, জুয়েল মাজহার, কাজল শাহনেওয়াজ, রিফাত চৌধুরী, আহমেদ মুজিব, সুমন রহমান, মাহবুব পিয়াল, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু (র. রাইসু), আদিত্য কবির, আয়েশা ঝর্ণা, হাবিব ওয়াহিদ, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, কামরুল হুদা পথিক, রোকন রহমান, শাহীনুর রহমান, আরো অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সম্পাদকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হলো। পরবর্তীতে শাহেদের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই ঠাকুরগাঁওয়ের চালচিত্র সম্পাদক রাজা সহিদুল আসলাম এবং কবি-অনুবাদক হোসেন মোতাহারের সাথে যোগাযোগ তৈরি হয়েছিলো।
উপরে যে-সকল কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদক-এর নাম উল্লেখ করলাম, প্রায় প্রত্যেকের সাথেই শাহেদ শাফায়েত-এর ঘনিষ্ঠতা ছিলো। আর গত ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ বছরের মধ্যে যে সাহিত্যিক সমাজ গড়ে উঠলো, এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যদি আমরা বিচার করি তবে শাহেদ শাফায়েত-এর কাব্য-পুস্তিকাটি'র কবিতাগুলো এবং পরবর্তীতে তার সম্পাদিত ‘পূর্ণদৈর্ঘ’ লিটল ম্যাগাজিনটি'র প্রকাশনা নূতন-ধারার সাহিত্য বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো।
শাহেদের কবিতার বই ‘বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান’ (২০১১) যখন উলুখড় থেকে বেরুলে, সেটিতে তার কবিতা নিয়ে আমার কিছু অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলাম:
“প্রারম্ভে ওঁর কবিতা ছিলো নান্দনিক সৌকর্যে লালিত, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তার শ্বাশত রূপকে কাব্যসুষমায় সৃজিত করেছেন তিনি; কবিতার সে ভাষায় 'মাছের ডানায় কাঁপে নীল জল গুঢ় পিদিম জ্বলে পরীনাচ জলের বিন্যাসে'; আর সেই কাব্য-স্থাপনায় কোথাও জারিত হয়েছে ব্যক্তিগত প্রেমের গূঢ়ৈষা, যেখানে শাফায়েত ‘দেহের প্রখর ভাঁজে রেখেছে জড়িয়ে একফালি গাঢ় লাল স্রোতের চিঠি’, ব্যাপক অন্বেষার মতো; আর শিশু সারল্যের এক স্বাপ্নিক মুগ্ধতায় শাহেদ শাফায়েত পৃথিবীর চোখে চোখ রেখেছেন; যিনি প্রত্ন-বোধের প্রাচীন লিপিমালা তুলে এনে বুনে তুলেছেন রূপকথার নূতন চাদর। আর তা আমাদের পাঠক সত্তায় জড়িয়ে নিয়ে পেয়ে যাই তার কবিতার উষ্ণ স্পর্শ। আকাক্সক্ষা কিংবা স্বপ্ন যাই বলি, কবিতায় তিনি এক হারানো-আদিম সাম্যাবস্থা আর সেই শক্তির বন্দনায়, মানবিক চৈতন্যের মুক্তি ঘটাতে চান, শিকড়ে পৌঁছে। প্রকৃতির মৌল-শক্তির সমাবেশ, পাশাপাশি মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম এক-ই স্রোতে এসে বড়ো কোনো শক্তিতে রূপান্তরিত হবে, শাহেদের কবিতা এসব-ই চাইছে।
স্বপ্ন ও বাস্তবতার প্রগাঢ় মিশ্রণের দ্যুতি তাঁর কবিতার লয়ে তার-ই উচ্চারিত কথায় 'প্রিজমিক সম্পাত' গড়ে তুলেছে। যা শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে, পাশবিক জগতের ওপরে ‘টাঙানো বাঘ, জ্যান্ত শৃগাল, কাঁচা রঙ' উন্মোচিত ক'রে মুক্ত পৃথিবীর সৌন্দর্যে বিভোর হতে চেয়েছে।”
শাহেদ ছিলো বন্ধনহীন এক মুক্ত মানুষ। কবিতার জন্য সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়েছিলো সে। আমার সাথে সাহিত্যিক সম্পর্ক ছাড়িয়ে একটা ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো ওর। রাতের পর রাত পর, দিনের পর দিন আমাদের গ্রীনরোডের বাসায় কবিতা ও লেখালেখি নিয়ে কতো সময় পার করেছি তার কোনো হিসেব নেই।
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে শরিক হতে গিয়ে, সাহিত্যের প্রতি তার নিঃশর্ত ভালোবাসা'র জন্য পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিলো শাহেদ। আজ শারীরিকভাবে সে আমাদের মাঝে নেই, তবুও ধুমকেতুর মতো তার উপস্থিতি আমাদের হৃদয়ে যে রেখাপাত করে গেছে, সেই স্মৃতিভরাতুর দিনগুলির ভার আমরা বয়ে বেড়াবো আমৃত্যু।
১৩/০২/২০২৩
শাহেদ শাফায়েত, ‘তুমি গোলাকার এক নুড়ি পাথরের রূপে বর্ণমান’!
আহমেদ নকীব
আহমেদ নকীব
মন্তব্য