মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েই জানতে পারলাম মেডিকেলে পড়তে হলে হোস্টেলে সিট থাকতে হবে। ডিসকাস মানে আলোচনা করে পড়তে হবে। আর সিট পেতে হলে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। আমি আশৈশব সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও তা ছিল বই পড়া চেতনা। চট্টগ্রাম কলেজে মজিদ খাঁনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম কালে সব ছাত্রের সাথে মিলেই মিছিলে গিয়েছি। তাই দলাদলির রাজনীতি কিংবা বাংলাদেশে সেসময়ে বিদ্যমান দলীয় রাজনীতির হালচাল সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। চট্টগ্রাম কলেজের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় ষাট জন একই সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি। সবাই একসাথে থাকতে ভালবাসতাম। তাই কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলো, আমরা সবাই এক সাথেই থাকবো। এর মধ্যে আমাদের এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় সূত্রে গৌতম দা আমাদের দেখভাল করতে লাগলেন। তিনি জানালেন, ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সবচেয়ে বড় দল এবং ছাত্রসংসদে তারাই ক্ষমতাসীন। সে কারণে হোস্টেলে তাদের সিটই বেশি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বললো, ক্ষমতাসীন পার্টির সাথে থাকলে ভাল হবে। সিটও মিলবে। সবাই একসাথে থাকতে পারবো। অতএব গৌতম দা, রাশেদ ভাই এবং মোস্তফা ভাই আমাদের নিয়ে গিয়ে তুলে দিলেন মেইন হোস্টেলে তাদের নিয়ন্ত্রিত বা দখলীকৃত বিভিন্ন কক্ষে। আমার রুম হলো ৪এ। অর্থাৎ এ ব্লকের ৪ নম্বর কক্ষ। রুমমেট সাহেদ, আলী, ধীমান ও আমি। পাশের রুমে কে কে ছিল সবার নাম মনে নেই। তবে অংসুই প্রু ছিল এটা নিশ্চিত। হঠাৎ হঠাৎ সে আমাদের রুমে ঢুকে কারাতে কুংফুর হাত পা ছোঁড়ার কসরত করে আমাদের সকলকে বিছানায় মেরে ধরাশায়ী করে রাখতো। আমি অবশ্য প্রায় সময়ই বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে হোস্টেলে এসে সিটের দাবী বজায় রাখার প্রয়াস পেতাম। বিশেষত ফিস্ট খাওয়ার দিন, গুলজার সিনেমা হলে দল বেঁধে সিনেমা দেখার রাত, কঠিন আইটেম পরীক্ষার পূর্বরাত অথবা রাত জেগে কার্ডে ২৯ কিংবা অকশন ব্রিজ খেলার রাতে আমি হোস্টেলে থেকে যেতাম। এর মধ্যে জেনে গেলাম, আমরা যাঁদের তত্ত্বাবধানে আছি তারা ছাত্রলীগ বটে, তবে তা জাসদ ছাত্রলীগ, যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আমি সমাজতন্ত্র পড়েছিলাম বটে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। যাই হোক, ভাবলাম, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দল যখন, সঠিক দলের সিটেই উঠেছি। তার ওপর ছাত্র সংসদে এরাই রয়েছে। মনে মনে ভাবলাম বিপ্লব তাহলে বেশি দূরে নয়! বড় ভাইয়েরা খুব আন্তরিক। সকাল বিকাল ক্যান্টিনে চা সিঙাড়া ফ্রি চলছে। সিনিয়রদের মধ্যে খসরু ভাইকে দেখতাম কালো চাদর গায়ে হালকা পাতলা গড়নের লম্বা কিন্তু চুপচাপ ব্যক্তিত্ব। তিনি সম্ভবত তখন সবার বড় নেতা। সবাই মান্যগণ্য করেন। আমাদের স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, কিন্তু বেশি কথা বলতেন না। সবচেয়ে বেশি আপন হয়ে দেখা দিলেন তখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্রনেতা আহমদ শরীফ শুভ এবং আমিনুর রহমান। আমি এঁদের খুব ভালবেসে ফেলি। দুজন দু’রকম চরিত্রের মানুষ হলেও দুজনেই কবি। শুভ ভাই ছাত্রসংসদের একটা রুমেই লম্বা বেঞ্চিতে ঘুমাতেন। ওনার এই সার্বক্ষণিক নেতাসুলভ কর্মকাণ্ড অবাক হয়ে দেখতাম। শুভ ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম যে শিক্ষা পেয়েছিলাম, তা হলো, সিনিয়র ভাই সহ খেতে বসলে বিল দেওয়ার চিন্তা যেন মাথায় না আসে। বিল সবসময় সিনিয়র ভাই দেবেন। এই চিন্তাধারা আমাকে আজীবন আকীর্ণ রেখেছে। আর আমিন ভাই ছিলেন উদাসী প্রেমিক মানুষ। আমাকে দুজনেই লেখালেখির ব্যাপারে প্রচুর উৎসাহ জোগান। সেই সময় ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে কিংবা ১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে এই দুই কবির যৌথ কবিতা সন্ধ্যা আয়োজিত হয়েছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে। হল ভর্তি শ্রোতা দর্শক দর্শনীর বিনিময়ে সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আমি অভ্যর্থনার কর্তব্য পালন করেছিলাম। তাঁদেরই আরেক বন্ধু সাইফুল্লাহ ভাই আমাদের সাথে আড্ডায় বসে পড়লেন কলেজ ক্যান্টিনে। তিনি ছিলেন চাটগাঁইয়া বড়ভাই। প্রথম দফায় তিনি বললেন, চাটগাঁইয়া ভাষার উপরে আর কোন ভাষা নেই। তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এই ভাষায় যে কোন জীব বা জড় পদার্থকেই মনের সাধ মিটিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা যায়। গালিকে চাটগাঁইয়া ভাষা একটা শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছে। আমরাও প্রায় সব চাটগাঁইয়ারা ওনার স্বরে স্বর মিলিয়ে একথা একবাক্যে স্বীকার করে নিলাম।
এদিকে যে বন্ধুটি ২ বছরের সিনিয়র এক ভাইকে আমাদের সাথে পরিচয় করানোর ফলশ্রুতিতে আমরা ছাত্রলীগের সিটে উঠেছিলাম, ক’দিন পরে লক্ষ করলাম সেই বন্ধুটি নিজে উঠেছে ছাত্র ইউনিয়নের সিটে। এ কারণে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটু ক্ষোভও দেখা গেল। একদিন বন্ধুদের কয়েকজন মিলে ওয়ার সেমেট্রিতে যাচ্ছিল। আমিও সঙ্গী হলাম তাদের। যেতে যেতে প্রশ্ন করলাম, ওখানে কেন যাচ্ছি। একজন বললো মৃত্যু বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে। ভাবলাম, মন্দ না। দেখা যাক কার কি ভাবনা। পরে অবশ্য মৃত্যু ভাবনার পরিবর্তে আলোচনা গড়িয়ে গেল ক্যাম্পাস রাজনীতির দলাদলির দিকে। দেখলাম, সবার মধ্যেই ঐ বন্ধুটির বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে একজন বললো ওকে মার লাগাতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। ফিরে এসে ক্যাম্পাসে তাকে দেখা মাত্র কিল চড় থাপ্পড় শুরু হয়ে গেল। সেই প্রথম মারপিট দেখলাম খুব কাছাকাছির মধ্যে। অন্যদিকে আরও একটি ছাত্রলীগের অবস্থান টের পেলাম, যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং তারাও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই দলের সিটে আমার যে সহপাঠীরা উঠেছে, লক্ষ করলাম, তারা আমাদের প্রতি ধীরে ধীরে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। বড় ভাইদের কেউ কেউ বাণী দিতে থাকলো, পলিটিক্যাল ফ্রেন্ডই সত্যিকার ফ্রেন্ড। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে আমি যখন এই বন্ধুদের দলীয় চিন্তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুটি আমাকে পিস্তল দেখাতেও কুন্ঠা বোধ করেনি।
কেবল দলাদলি নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম তা কিন্তু নয়। যথা সময়েই ক্লাস শুরু হয়েছিল। আমাদের এনাটমির ব্যাচ টিচার ছিলেন রেজা স্যার। পরিপাটি সিঁথি করে চুল আঁচড়ে ফিটফাট হয়ে আসতেন। সুন্দর বাচনভঙ্গি ছিল, তবু কেন যেন একটু মেয়েলিপনার আভাস ছিল। এ নিয়েও আমাদের গোপন পরিহাস কম ছিল না। পরে শুনেছি, স্যার রেডিও টিভিতে স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান করে থাকেন। প্রথম দিনেই স্যার আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন হার্ট মানে হৃৎপিণ্ড - মানুষের শরীরের অঙ্গ এভাবে হাতে তুলে নাচাতে গিয়ে মনের ওপর যে ধাক্কা লেগেছিলো, তা কাটতে বেশ সময় লেগেছিল। পরে দেখি, ডিসেকশন টেবিলের ওপর শুয়ে আছে সারি সারি মৃতদেহ, যাদের কাছে গেলে ফরমালিনের তীব্র ঝাঁঝে নাকচোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। তাদের কারও কারও মুখের একপাশ কাটাছেঁড়া করা, কারও হাত-পা, আবার কারও কারও পেট কেটে ভেতরের নাড়িভুড়ি বের করে ফেলেছে। এসবের নাম ডিসেকশন। আর মৃতদের বলা হলো ক্যাডাভার। আমাদের শেখানো হলো এই মৃতদের যেন যথাযথ সম্মান আমরা দেখাই। এই দেহগুলোই আমাদের শিখতে সাহায্য করবে শরীরবিদ্যা তথা এনাটমি। প্রথম দিনেই খটোমটো শব্দগুলো উচ্চারিত হলো যা আমাদের চিরকাল প্রয়োজন হবে, কিন্তু সেদিন anterior, posterior, lateral, medial ইত্যাদি মনে হলো জটিল কঠিন হিব্রু শুনছি। প্রথম দিনেই জানিয়ে দেওয়া হলো পরের দিন পরীক্ষা হবে, যার ব্যবহারিক নাম আইটেম। আর হোস্টেলে গিয়ে বড় ভাইদের কাছে শুনলাম, এখানে স্কুল কলেজের মতো প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিভাগ নেই, আছে কেবল পাশ আর ফেল। শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার দশা — বলে কি! জীবনে পাশফেলের কথা ভাবিনি, ভেবেছি কত ভাল করবো সেই কথা। আর আজ বসেছি যেন পুলসেরাতের তারে। অগত্যা সারাজীবনের মুখস্তহীন মগজ গড়গড় করে হার্টের এনাটমিক্যাল পজিশনের ৬টি পয়েন্ট মুখস্ত করে নিল। এনাটমি বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ডি পি বড়ুয়া স্যার। তিনি কি দ্বিজেন্দ্র প্রসাদ না কি ধুর্জটি প্রসাদ না কি অন্য কিছু জানার চেষ্টা করার মতো বুদ্ধি বা সাহস আমাদের ছিল না। এত গম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সে সময় ক্যাম্পাসে আর কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। স্যার কখনও তাঁর রুমের বাইরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে কলেজের পুরো করিডর ফাঁকা হয়ে যেতো। আর তাঁর পরেই ছিলেন ফারুক স্যার। ফারুক স্যার প্রতিটা কথা বলার ফাঁকে নিজ মুদ্রা দোষে বারবার উচ্চারণ করতেন “মানে কি?” বায়োকেমিস্ট্রির নাম যদিও রসায়ন, এই বিষয়ের স্যারদের পাঠদানে কোন রসকষ ছিল বলে মনে হয়নি। আমাদের অধিকাংশ বন্ধুই কাদের স্যারের ক্লাসে কোন মজা পেতো না, আমিও না। তবে পরের দিকে মেটাবলিজম পড়ার সময় আমি বেশ আগ্রহ পেয়েছিলাম। এদিকে আমাদের এক মেয়ে সহপাঠীকে হঠাৎ শাদাপোষাকধারী পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি, জাল মার্কশীট দিয়ে ভর্তি হয়েছিল সে। সে ছিল এক বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীর ছোট বোন। বহুবছর পরে আমাদের আরেক বন্ধু লন্ডনে বিবিসি’র সংবাদ কক্ষে তার দেখা পেয়েছিল, কিন্তু সে চিনতে অস্বীকার করায় তার সাথে আমাদের আর সংযোগ ঘটেনি কোনদিন। আমাদের আরেক সহপাঠী এদিকে ৫ম বর্ষের এক বড় ভাইয়ের সাথে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কিন্তু ক’দিন পরে সম্ভবত বড় ভাইটিকে তার আর ভাল লাগেনি। তাই সে তার সাথে ঘোরাঘুরির পাট চুকিয়ে দেয়। কিন্তু বড় ভাইটি এক রাতে ছাত্রীনিবাসে ঢুকে পড়ে এবং আমাদের সহপাঠিনীর কক্ষে পৌঁছে যায়। হৈচৈয়ের মধ্যে পার্শ্ববর্তী রুমগুলোর মেয়েরা দা-বটি নিয়ে এগিয়ে এলে আগন্তুক পালিয়ে যায়। এ খবর আমাদের ছেলেদের ছাত্রাবাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সকালে ৮টার ক্লাসে আমাদের পৌরুষ জেগে ওঠে। সহপাঠিনীর ওপর হামলার প্রতিবাদে আমরা মিছিল করে অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে অবস্থান গ্রহণ করি। এদিকে অসময়ের আগন্তুক বড় ভাইয়ের বোধোদয় হলে ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপকের শরণাপন্ন হন এবং তাঁর পরামর্শে ভূতাপেক্ষ তারিখে নিজেকে সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে ভর্তি দেখান। আমাদের ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক ছিলেন বিখ্যাত নুরুল ইসলাম স্যার। আর অধ্যক্ষ হিসেবে নতুন যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক কে এম ফরিদউদ্দিন যিনি পরবর্তীতে জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। আমাদের উচ্চকিত মিছিল শ্লোগানের প্রতিক্রিয়ায় অধ্যক্ষ বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের জোর ধমক দিয়ে বলেন, সে মানসিক রোগী, তার ব্যাপারে ওনার কিছুই করণীয় নেই। আমাদের জেগে ওঠা পৌরুষ যুক্তি ও বাস্তবতার কাছে নেতিয়ে পড়ে সুড়সুড় করে শ্রেণীকক্ষের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।
১২-৫-২০২৩, পূর্বাহ্ণ ২:২৮ চট্টগ্রাম
কোরাকাগজের খেরেখাতা-২৪
জিললুর রহমান
জিললুর রহমান
মন্তব্য