[পরিবর্তন পত্রিকার ভূমিকা: অমিয়ভূষণ মজুমদার (মার্চ ২২, ১৯১৮—জুলাই ৮, ২০০১) বাংলা সাহিত্যে এক বিরল ব্যক্তিত্ব৷ একসময় প্রবাসী, চতুরঙ্গ, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হত।
যে কারণে সতীনাথ ভাদুড়ী অথবা কমলকুমার মজুমদারের নাম সাধারণ বাঙালি পাঠক সমাজে অশ্রুত ঠিক সেই কারণেই প্রায় ১৪-১৫টি উপন্যাস এবং অজস্র ছোটগল্প লিখেও অমিয়ভূষণ সাধারণ বাঙালি পাঠক সমাজের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। নিজের অজান্তেই হয়ে গেছেন ভাবী প্রজন্মের গবেষণার বিষয়।
অমিয়ভূষণের লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে গড় শ্রীখণ্ড, মহিষকুরার উপকথা, নীল ভুঁইয়া, বিলাস বিনয় বন্দনা, ফ্রাইডে আইল্যান্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ, নয়নতারা এবং ছোটগল্পের মধ্যে প্রমিলার বিয়ে, দীপিতার ঘরে রাত্রি এক শ্রেণির পাঠক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
এর আগে তিনি ‘ত্রিবৃত্ত’ ও ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ সাহিত্য’ পুরস্কার পেয়েছেন। এবছর রাজনগর উপন্যাসটির জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ পেলেন।
সম্প্রতি পরিবর্তন-এর পক্ষ থেকে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছে। (পরিবর্তন পত্রিকা, ১৯৮৬)]
প্রশ্ন: এই পুরস্কার কি আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে?
অমিয়ভূষণ: লেখকের মর্যাদা পাঠকের কাছে। আমার যে মর্যাদা বিশেষ এক শ্রেণির পাঠকের কাছে চিরদিনই ছিল ও আছে তার কোন তারতম্য এই পুরস্কারে হয়নি।
প্রশ্ন: এই পুরস্কার প্রাপ্তি কি আপনাকে আরও ভালো লিখতে প্রেরণা জোগাবে?
অমিয়ভূষণ: লেখাটা হয় নিভৃতে। সেখানে লেখা আর লেখক ছাড়া আর কিছু থাকে বা প্রবেশ করতে পারে এমন মনে করি না। সুতরাং পুরস্কার অথবা অবহেলা কিছুই সেখানে ঢুকতে পারে না। এই পুরস্কার কি করে আমার লেখায় ছাপ ফেলবে? পুরস্কার লেখাকে ভালও করে না মন্দও করে না।
প্রশ্ন: লেখকের প্রকৃত স্বীকৃতি কী?
অমিয়ভূষণ: একসময়ে এই স্বীকৃতি অত্যন্ত মুল্যবান ছিল, সভাকবি বা চারণকবিদের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখনও এই রকম স্বীকৃতি কাজে লাগছে বলে শুনেছি৷ যেমন, বছরে লাখ টাকা উপার্জন হয় আমাদের দেশেই এমন পাঠক স্বীকৃতি পেয়েছেন কেউ কেউ। আবার অন্য রকমও আছে। মিল্টন তাঁর জীবদ্দশায় প্যারাডাইস লস্টের জন্য মোট ছয় পাউন্ড পেয়েছিলেন। হপকিন্সকে কেউ কবি বলেই স্বীকার করেনি। তাঁর মৃত্যুর ত্রিশ বছর পরে কবিতাগুলো বই হয়ে বেরুলে তাঁকে আধুনিক যুগের অন্যতম বড় কবি বলা হল। চিত্রকরদের বেলায় এটা প্রায়শই হয় যে জীবদ্দশায় তাঁরা স্বীকৃতি পান না। তাতে ছবি আঁকা বন্ধ হয় না। তেমন লেখকের লেখাও স্বীকৃতির অভাবে বন্ধ হয় না যদি তাঁর সত্যি লেখার মত কিছু থাকে, যদি লেখাকে সে জীবিকা করতে না চায়। আমি চল্লিশের দশক থেকে লিখছি, পুরস্কার জাতীয় স্বীকৃতি ছিল না এই আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, তাতে আমার লেখা বন্ধ হয়নি। কিন্তু মানুষ যেহেতু সমাজে বাস করে এবং লেখক যেহেতু গজ দন্তের টাওয়ারে বাস করে না, বয়স বেশি হলে নিভৃত পরিশ্রমে ক্লান্তি আসে, লেখক দার্শনিক হয়ে যেতে পারে –এমন ভয় আছে। সুতরাং আমি তরুণদের এরকম করতে পরামর্শ দিই না। নিজের মনে নিভৃত সাধনা নিশ্চয়ই সর্বোত্তম কিন্তু সামাজিক মানুষ হিসাবে তাকে সঠিক বলা যায় কি? মনে করুন, কবিকে রাজসভায় পাঠিয়েছিলেন কবিললনা। হয়ত কবি একগাছা রাজকন্ঠের মালা নিয়েই খুশিতে ডগমগ হয়ে ফেরে, তা হলেও কবিকে তো স্বীকৃতির জন্য মহেন্দ্র রায়ের রাজসভায় যেতে হয়।
প্রশ্ন: লেখককে কখনও আধুনিক বা রক্ষণশীল এই সংজ্ঞায় নিরূপিত করা যায় কি? করলে তা কতটা ঠিক?
অমিয়ভূষণ: এই বিষয়ে অনেকদিন আগে ম্যাথু আর্নল্ড যা বলেছিলেন তাঁর অনেকটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য। তাঁর কালে ও আমার কালে সময়ের অনেক তফাত। সুতরাং আধুনিক কালের আমি এবং সে কালের আর্নল্ড কোন কোন ব্যাপারে এক। সুতরাং আর্নল্ড কোন কোন ব্যাপারে আধুনিক। আমাদের মধ্যেকার একশ বছর তাঁকে রক্ষণশীল করতে পারেনি। একইরকমভাবে সোফোক্লিস বিংশ শতাব্দীর শেষে এসেও আধুনিক। শেক্সপিয়ার আধুনিক। বললে চমকে উঠবে না, মহাভারতকার আধুনিক। কেন বললাম শোন। অর্জুন, ভীষ্ম এঁদের কাছে এমন অস্ত্র ছিল যা দিয়ে ৭ দিনে, ৩ দিনে, ১ দিনে সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করা যেত। ভীষ্ম নিজে প্রাণ দিলেন কিন্তু সে অস্ত্র ব্যবহার করলেন না, জয়দ্রথ বধে নিজেকে নিধন করতে হবে জেনেও অর্জুন চক্রব্যূহ ধ্বংস করতে তাঁর পাশুপাত অস্ত্র ব্যবহার করেননি। ব্যক্তির নিজের কল্যাণের চাইতেও মানব কল্যাণ বড় এই কল্পনা কবি ব্যস করেছিলেন। আমরা মাত্র কয়েক মেগাটোনের মালিক হয়ে এখন পর্যন্ত পৃথিবীকে পারমাণবিক বোমার ভয় থেকে আশ্বস্ত করতে পারিনি। এইজন্য ব্যসকে আমরা রেগন বা গোরবাচেভ থেকে অনেক বেশি আধুনিক বলতে পারি।
প্রশ্ন: কি সাহিত্যে কি জীবনে বাংলা মানেই কলকাতা নয় এটা আপনার কথা, একটু পরিষ্কার করুন।
অমিয়ভূষণ: ম্যাপ খুললেই দেখতে পাবে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের একটা শহর। পশ্চিমবাংলা কলকাতার অন্তর্গত কোন পাড়া নয়। কলকাতার লোকসংখ্যা যদি এক কোটিও হয় কলকাতার বাইরে আমরা চার কোটি থাকি। আমরাও বাঙালি। মজা দেখ রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ছেলে, তাঁর লেখায় কলকাতা প্রায় অনুপস্থিত। তিনি যেন কোন এক অদ্ভুত উপায়ে বুঝতে পেরেছিলেন জীবন ও মন কলকাতায় যতটুকু কলকাতার বাইরেও তাঁর চাইতে কম নয়। এই অদ্ভুত উপায়টিই হচ্ছে মনীষা বা প্রতিভা। তাই কলকাতাকে বাংলার চাইতে বড় করে দেখা উচিত নয়৷
[অমিয়ভূষণ মজুমদার ১৯৮৬-এ ‘রাজনগর’ উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম পুরস্কারে ভূষিত হন৷ পুরস্কৃত হওয়ার পর সাংবাদিক অরবিন্দ ভট্টাচার্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন৷ সেই সাক্ষাৎকার পুনঃপ্রকাশ করা হল৷
আমরা কৃতজ্ঞ প্রবীণ সাংবাদিক শ্রী ভট্টাচার্যের কাছে ‘পরিবর্তন’ পত্রিকার সেই পৃষ্ঠাগুলির আলোকচিত্র পাঠানোর জন্য৷ এবং, অতি অবশ্যই কৃতজ্ঞ তরুণ শিক্ষক শ্রী সঞ্জয় বিষ্ণুর কাছে৷ তিনি বহু ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নতুন করে টাইপ করে দিয়েছেন৷]
আনমনা হয়ে পড়লাম। একজন সত্যিকারের কবির কথা। হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
উত্তরমুছুনআহা অমিয়ভূষণ! প্রিয় লেখক
উত্তরমুছুনবিন্দুকে ধন্যবাদ জন্মদিনে এই সাক্ষাৎকার পাঠের সুযোগ করে দেয়ার জন্য
উত্তরমুছুনJust wow
উত্তরমুছুন