বাংলা কথাসাহিত্য যাদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এক উজ্জ্বল সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব। তার সৃষ্টিসম্ভার অল্প হলেও বৈচিত্র্য ও গভীরতায় বিশালত্বের দাবী রাখে। ছোটোগল্প, উপন্যাস ও নাটকে তিনি যে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন বাংলা কথাসাহিত্য বিকাশের কালে তা অনন্য তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। তাঁর জীবিতাবস্থায় যে কয়টি রচনা প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো পাঠকের কাছে বহুল পঠিত ও আলোচিত। ইংরেজিতে রচিত‘ দি আগলি এশিয়ান ’ উপন্যাসটি অনেক পরে আবিষ্কৃত হয় যা কদর্য এশীয় নামে বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার রচনায় সমাজ ও সময়কে খুব নিবিড়ভাবে দেখেছেন। ফলে তার কথাসাহিত্যে সমাজের নানা অসঙ্গতি, ধর্মন্ধতা ইত্যাদি খুব স্বাভাবিকভাবে এসেছে। তার রচনাভঙ্গী এবং বিষয় নির্বাচন পাঠককে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কদর্য এশীয় উপন্যাসটিতেও এর ছাপ রয়েছে। তবে এ উপন্যাস তার অন্যান্য রচনার চেয়ে ব্যতিক্রমীও বটে। মার্কিন আধিপত্যবাদ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি কীভাবে প্রভাবিত করে তার দৃশ্যায়ন করেছেন এ উপন্যাসে।
এ উপন্যাসটি এমন এক সময়ে রচিত, যখন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তুমুল স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। এ দুই বিরোধী শিবিরের প্রভাব পড়েছে বলতে গেলে গোটা বিশ্বে। উভয় পক্ষ নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেছে অন্যান্য দেশকে। এ উপন্যাসের পটভূমি রচিত হয়েছে এশিয়ার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র শক্তভাবে তার প্রভাববলয় বিস্তার করে রেখেছে। এ দেশের দুই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয়ভাজন হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান।
এশিয়ার কোন দেশের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে তার ঔপন্যাসিক কোনো ইঙ্গিত দেননি। তবে এ দেশটিকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। তথাকথিত তৃতীয়বিশ্বের যে কোনা দেশকে এ উপন্যাসের দেশ হেসেবে বিবেচনা করা যাবে। লেখকের বক্তব্য এখানে পরিষ্কার। কোনো নির্দিষ্ট ভূগোলের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লিখেননি। কল্পিত যে দেশের চিত্র তিনি এঁকেছেন তা এ জাতীয় সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। উপন্যাসের যে দুইটি দিক স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় তা হলো এসব দেশের নোংরা রাজনীতি ও কমিউনিস্ট দমনের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য।
পাঠক হিসাবে আমরা যদি এ সময়ের প্রেক্ষাপটেও এ উপন্যাসটি পাঠ করি তাহলেও এর বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারবো। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী বৈশ্বিক রাজনীতি এখনও বহাল আছে। যদিও এখন আর তাদের প্রধান শত্রু কমিউনিজম নয়। তবু এ উপন্যাসের কল্পিত দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় তা এরূপ দেশের ক্ষেত্রে এখনও চলছে। আর এর বিভিন্ন কারণের মধ্যে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিস্বার্থ অন্যতম কারণ হিসাবে কাজ করে। এ উপন্যাসের ‘নানাভী’ ও ‘আবদুল কাদের’ চরিত্রদ্বয়ের মধ্যেও এমন প্রবণতা লক্ষ্যনীয়। একজন ক্ষমতায় থাকতে মার্কিন স্বার্থের দিকটা দেখেছে। অপরজন এ অবস্থার পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এসে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের তাবেদারী করা শুরু করেন এবং তাদেরকে আশ্বস্ত করেন যে তাদেও স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ তিনি করবেন না। সাংবাদিক জনসনের সাথে কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেই ফেলেন-‘যা হোক, একটা বিষয়ে সন্দেহ রাখবেন না: আপনাদের দেশের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব অটুট।’
আবদুল কাদের যে মনোভাব পালন করেন তা কেবল তা একার মনোভাব হিসেবে বিবেচনা না করে এ রকম সকল দেশের শাসকের মনোভাব হিসেবেই দেখবো। আর এ সুযোগে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে তাদের হাতের মুঠোয় রাখতে চায়। এর অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো শক্তির ভারসাম্য চাওয়ার বদলে নিজেকে আরও শক্তিশালী হিসেবে দেখতে চায়। এ জন্য তারা বিভিন্ন দেশে এমন সরকার চায় যে সরকার তাদের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করবে। কদর্য এশিয়া’র কল্পিত দেশকে যদি তৎকালীন পাকিস্তান হিসেবে ধরে নেয়া হয় তাহলে যে বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে তার সাথে উপন্যাসের বাস্তবতার বেশ মিল দেখতে পাওয়া যায়।
এ উপন্যাস থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণের গভীরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তার সমকালের যে বাস্তবতাকে তিনি অনুপঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন এ উপন্যাসে। যে চরিত্রগুলো আমরা দেখতে পাই সেগুলো বাস্তবতাকে এমনভাবে ধারণ করে আছে, এদেরকে অপরিচিত বলে মনে হয় না। মার্কিন সরকারের প্রতিনিধি অফিসের কর্মকর্তাগণ, এদেশের রাজনীতিবিদ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ-এদেরকে যথাযথ ভূমিকায় উপস্থাপনের কারণে পাঠকের কাছে এরা আর অপরিচিত থাকে না।
এ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমে কাহিনী এগিয়ে গেলেও শেষপর্যন্ত একটা প্রসেস বা প্রক্রিয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। স্থানীয় সরকার, মার্কিন সরকারের প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও মার্কিন সরকার বিরোধী কমিউনিজম ঘেঁষা দল- তিনটা পক্ষই নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে। মার্কিন সরকার যেখানেই কমিউনিজমের গন্ধ পায় সেখানেই সে তার দানবীয় হাত বাড়িয়ে দেয়। অধ্যপক আহসানের নেতৃত্বে যে দলটিকে এ উপন্যাসে দেখা যায় তার ভিত্তি এ দেশে দুর্বল হলেও তারাও নজরের বাইরে থাকে না। আহসান সাহেবের সাথে ‘অপিনিয়ন ‘ পত্রিকার প্রতিনিধি জনসনের একটা লম্বা বৈঠক হয়। যদিও জনসন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নয়। তবু সে এ দেশে পত্রিকার পক্ষ থেকে যে মিশন নিয়ে এসেছে তা পেছনের কারণ রাজনৈতিক। এ কারণে তীব্রভাবে মার্কিনবিরোধী আহসানের সাথে তার সাক্ষাৎকারও অনিবার্য হিসেবেই এসেছে।
কদর্য এশীয় উপন্যাসে যে চিত্রটি আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক। যেসব ঘটনা এ উপন্যাসে ঘটেছে তা তৃতীয় বিশ্বের সাথে একটি প্রভাবশালী দেশের আধিপত্যবাদী মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। আর এ দেশটি হয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহলে তো কথা নেই। তাদের সে সময়ের প্রধান শত্রু কমিউনিজমের পরাজয় ঘটাতে দুর্বল দেশগুলোকে সে ব্যবহার করেছে। তাদের অর্থনৈতিক সহায়তার আড়ালে যে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে তা গোপন থাকে না কোনভাবেই। মার্কিন সাংবাদিক জনসনের সাথে এখানকার প্রধানমন্ত্রীসহ যেসব ব্যক্তির কথাবার্তা হয়েছে তাতে এ বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে এসেছে। যদিও জনসনের ভূমিকা নিরপেক্ষ এবং কাহিনির প্রয়োজনে এরকম একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দরকারও ছিল। এক্ষেত্রে লেখকের দক্ষতার দিকটি লক্ষ্যণীয়। সে যেমন মার্কিনপন্থী সরকারের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছে তেমনি যাদেরকে তারা শত্রু মনে করে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শেও সংগঠনের নেতার সাথেও কথা বলেছে।
এ উপন্যাসে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির কিছু নোংরা দিক স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতি যে মানুষকে বিবেকশূন্য করে তুলতে পারে তার দেখা পাওয়া যায় এখানে। আব্দুল কাদের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে দ্বিধা করে না। আবার এক রাজনৈতিক নেতাকে কৌশলগত কারণে মুক্তি দিতে নানা শর্ত আরোপ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে এমনকি পত্রিকা অফিসে হামলা চালাতে দ্বিধা করেনি পুলিশ প্রশাসন। এমনকি মার্কিন সহায়তায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের স্থলে স্থানীয় মানুষ মারা গেলে এর এতে মার্কিন নাগরিকের সম্পৃক্ততা অনুমান করা হলেও শেষ পর্যন্ত তার কোন সুরাহা হয় না। এ ঘটনার সময়েই কথা প্রসঙ্গে আসে যে ওদের সাহায্য ব্যতীত চলা, এমনকি মাসের ১ তারিখে বেতন পাওয়াও সম্ভব না। তখনকার প্রেক্ষাপটে অবশ্য কথাটা অতিরঞ্জিত মনে হবে না।
এ উপন্যাসে ছোটো কিন্তু ইঙ্গিতপূর্ণ একটি চরিত্র রয়েছে ‘করিম’ নামে। বিদেশ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভালোলাগায় সে নিজের নামটিকেই বদলে ফেলে ‘ক্রিম’ নামে। যে ভূখণ্ড তার জন্ম সে ভূখণ্ড সম্পর্ক সে ইতিবাচক মনোভাব লালন করে না জনসনের এক জিজ্ঞাসার বদলে তার জবাবটি লক্ষ্য করা যাক-
হ্যাঁ, দুর্ভ্যগ্যবশত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কিছু গ্রাম্য গবেট সর্বত্র তাণ্ডব শুরু করে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিলেও আমি এখানে পড়ে থাকবো। আমি তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাব।
এ ধরনের মানুষ অনুন্নত দেশসমূহে অনেক। স্বাতন্ত্র্য ভুলে গিয়ে এরা পশ্চিমা হতে চায়। নিজেদের দেশের সবকিছুকেই এরা হীন মনে করে। এ উপন্যাসের একটি চরিত্র অ্যান্ডারসন যে আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি সে-ও এ ধরনের মানসিকতা লালনকারী লোকদের ঘৃণা করে ।
‘কদর্য এশীয়’ উপন্যাসটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘র রাজনীতি সচেতনতার পরিচয়বাহী। যে সমাজ তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন তার বিশ্লেষন করেছেন নির্মোহভাবে। এ উপন্যাস যেমন তার সমকালে প্রাসঙ্গিক ছিল তেমনি বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এখনও যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিরাজমান, তেমনি তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতেও নোংরামি বহাল তবিয়তে আছে। তার জীবিতকালে প্রকাশিত যে তিনটি উপন্যাস পাঠে আমার অভ্যস্ত, এ উপন্যাসটি সেগুলোর থেকে কিছুটা ভিন্নধর্মী হলেও রচনার কুশলতা ও চিন্তার গভীরতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
কদর্য এশীয়: আধিপত্য ও নোংরা রাজনীতির নির্মোহ পাঠ
শামসুল কিবরিয়া
শামসুল কিবরিয়া
মন্তব্য