সেবার মাঝের হাট নিবাসী আফতাবউদ্দিন শহর থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে পাড়ি দেয় এক দীর্ঘ নৌপথ। দীর্ঘ, কারণ, আফতাবের মনে হয়েছিল বারবার যে ওই পরিচিত পথটি কেন যেন শেষ হতে চাচ্ছে না। দীর্ঘ, কারণ, আফতাব বাস্তবে অতিক্রম করেছিল যে পথটুকু, তার মনের ভ্রমণ ছিল সে তুলনায় অনেক বেশি লম্বা। বাংলা সাহিত্যের এই অনন্যসাধারণ মানসযাত্রা কিন্তু অনেকাংশে অচেনাই থেকে গেছে অদ্যাবধি। লেখক নিজে গল্পটিকে গ্রন্থভূক্ত করেননি, যদিও গল্পটি ছাপা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে আর তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘দুই তীর’ বেরিয়েছিল ১৯৬৫ সালে। বাংলা সাহিত্যের সমালোচকেরাও গল্পটিকে যথেষ্ট মূল্য দিয়ে গ্রহণ করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবদুল মান্নান সৈয়দ একবার এক পরিচিতিমূলক ছোট নিবন্ধ লিখেছিলেন। এ ধরনের উদ্যোগও আর বিশেষ দেখা যায়নি। অথচ ওয়ালীউল্লাহ্ স্বাভাবিক ঠাস-বুননের গল্প-চরিত্র থেকে খানিকটা আলাদা ঘরানার এ গল্প ভাবের দিক থেকে লেখকের মূল প্রবণতারই পরিচয় বহন করে; আর উল্লেখ থাকা বাঞ্ছনীয়, কী শরীরে কী মনে গল্পটি পুরো বাংলা গল্পপ্রবাহে আলাদা মর্যাদায় শনাক্তযোগ্য।
আফতাব, তার পথ অতিক্রমণ আর মানসভ্রমণসহ নাতিদীর্ঘ গল্পটির গরিষ্ঠাংশের সক্রিয়তা সত্ত্বেও, গল্পের মূল চরিত্র নয়। যে উচ্চাভিলাষী নিরীক্ষায় ওয়ালীউল্লাহ্ দৈহিক সামর্থ্য ও বয়স-নিরপেক্ষ এক মর্মান্তিক মৃত্যুর বিমূর্ততা গোচরে এনেছেন, তার অবলম্বন ‘কাবেল ছেলে’ আফতাব নয়, তার বৃদ্ধ পিতা নুনা মিঞাও নয়, বরং আফতাবের ক্রন্দসী বুবু। খুবই প্রান্তীয়, অশিক্ষিত এবং ব্যক্তিত্বের ধারণায় অনবহিত অছিমন বেওয়া হয়েছে জটিলতম এক মানসিক অস্তিত্বের পরীক্ষাক্ষেত্র।
২
মানুষের অস্তিত্বের গভীরে, অতি নিরালায়, অস্তিত্বভীতি আর আশাবাদের যে জোয়ার-ভাটা চলে প্রতিনিয়ত, তা আকারে-প্রকারে এতটাই অস্থিতিশীল যে তার প্রকৃত হদিশ পাওয়া কার্যত অসম্ভব। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে এ দুইয়ের বিপুল ফারাক এই অনুসন্ধানের একমাত্র প্রতিবন্ধক নয়, বরং একই ব্যক্তির যে কোনো দুটি যাপিত সময়ে তার অন্তস্থিত ভীতিবোধ এবং আশাবাদের সীমাহীন উত্থান-পতনই বিষয়টির জটিলতার মূল কারণ। মানুষ নামের মন-নির্ভর প্রাণীটির প্রকৃতি উদঘাটন করতে চাইলে এ জটিলতার মুখোমুখি না হলেও চলে না; কারণ, মনের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত হয় ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ায়, আর প্রতিক্রিয়া ব্যাপারটি প্রায় পুরোটাই ঘটনাসৃষ্ট আশা বা নিরাশার প্রকাশ।
প্রায় একশ বছরের বাংলা সাহিত্যে মূলত পশ্চিমা সাহিত্যের অনুকরণে ব্যক্তি-অস্তিত্বের এই গোপন অন্ধকার আলোকিত করার চেষ্টা বিস্তর হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগে সাফল্যের পাল্লাটিও যথেষ্ট ভারি। ওয়ালীউল্লাহ্ সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম থেকে যদি বেছে নেয়া হয় প্রধান কয়েকটি বিবেচ্য, তবে অন্তত গল্পের ক্ষেত্রে তাঁর নিরীক্ষার অন্যতম প্রধান বিষয় হিসাবে ব্যক্তি-অস্তিত্বের ওই গোপন সূত্র এবং সূত্রের অনুকূলে তার ধরন উদঘাটনকে অনায়াসেই শনাক্ত করা সম্ভব। এই বহুল চর্চিত বিষয়ে ওয়ালীউল্লাহ্’র কৃতিত্ব কোথায়? এক বাক্যে বলা যায়, নিখুঁত পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ করে তাতে বাস্তবের মানুষকে স্থাপন করতে পারাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ। বলা দরকার, গ্রাম-বাংলার জীবনধর্মের সাথে নিবিড় পরিচয় না থাকলে বাস্তবতার এরূপ অভিব্যক্তি নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।
তাঁর মানুষগুলো এদেশীয় বাস্তবতারই নির্ভেজাল উৎসারণ। তাই পশ্চিমা কেতার একাকিত্ব তাদের কারুরই মূল সমস্যা নয়। অধিকন্তু, তাদের ব্যক্তি-অস্তিত্ব প্রায় সর্বক্ষেত্রেই পরস্পর-সম্পর্কিত। বাংলার, বিশেষত গ্রাম-বাংলার, নারী যতটা ব্যক্তি তারচেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মা, বোন বা স্ত্রী। পুরুষদের ক্ষেত্রেও কমবেশি অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। ওয়ালীউল্লাহ্’র গল্পে পাই এ ধরনের সাপেক্ষ অস্তিত্বের অসংখ্য মানুষ, প্রায়শই জীবনের একেবারে প্রাথমিক চাহিদাগুলোর নিবৃত্তির জন্য যারা অন্যের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু তাদেরও তো রয়েছে জীবন সম্পর্কে নিজস্ব ধরনের শঙ্কার ভার কিংবা সম্ভাবনার ঝিলিক। বলতে কী, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যদি নির্মাণ করতে হয় খাঁটি অন্তর্বাস্তবতা, তাহলে ভালো হয় নদীর ধারের, বিলের পাড়ের কিংবা খেতের কিনারার বহির্বাস্তবতায় জীবনযাপন করছে যেসব বাবা অথবা বোনেরা, তাদের বেছে নিলে। ‘না কান্দে বুবু’ গল্পে ওয়ালীউল্লাহ্ তাই করেছেন। এবং করেছেন আফতাবউদ্দিনের উপর নির্ভরশীল একজন পিতা আর একজন বুবুর আশ্রয়ে। আফতাবের বিচিত্রগামী মনোনাট্যে খোলাসা হয়েছে এদের পূর্বপট। সেখানে নুনা মিঞাকে আমরা দেখি মৃত্যুর কাছে থেকেও জীবনের প্রতি অনিঃশেষ আকর্ষণে জীবন্ত; আর অছিমনকে পাই সুখ-দুঃখ নির্বিশেষে ক্রন্দনরত। ক্রন্দনরত; কিন্তু জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর অছিমন কেঁদেছিল- নীরবে। ভবিষ্যত সম্পর্কে তার শঙ্কা ছিল, সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ ছিল- বুবু কেঁদেছিল। এ কান্না স্বাভাবিক। পরবর্তীতে আমরা বুবুকে নিষ্প্রাণ জীবনযাপনে আবিষ্কার করি। আফতাব জানিয়েছে আমাদের, সুখ এবং দুঃখ দুয়েরই প্রতিক্রিয়া কান্নায় ব্যক্ত করার যে রীতি আকৈশোর অভ্যস্ততায় ছিল তার বুবুর, শেষবার তার বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এবার দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরার পথে আফতাব বুবুকে ক্রন্দনরত ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় দেখবে বলেই ভেবেছিল। কিন্তু বুবু কাঁদে না। সোনা ভাইকে অনেকদিন পরে কাছে পাবার উচ্ছ্বাসে কাঁদে না, শাড়ি দেখে কাঁদে না, শাড়ির জমিন দেখে কাঁদে না। ‘যে-বুবু কাঁদত, সুখেও কাঁদত দুঃখেও কাঁদত, সে বুবু কাঁদে না।’
আফতাবের পিতা কিন্তু কাঁদে। পিতারও বিবর্তন ঘটে গেছে; সে রেগে ওঠে না, কাঁদে; কিন্তু বুবুর ঘটে গেছে মর্মান্তিক পরিবর্তন। কান্নাই ছিল যার অনুভব প্রকাশের প্রায় একমাত্র উপায়, সে বুবু আজ পাথর। এ কি আত্মিক মৃত্যু? পিতা কাঁদে; কেননা যদিও তার জন্য অপেক্ষা করছে ‘গাব গাছের তলা’, তবু তার জাগতিক কামনা-বাসনা অবসিত হয়ে যায়নি আজও, লুপ্ত হয়ে যায়নি আশার ভেলা। চোখের ছানি কাটিয়ে দুনিয়ার রং-রূপ-গন্ধ আরো ভোগ করে যাবার ইচ্ছা তার নির্বাপিত হয়নি। তাই ‘নুনা মিঞার চোখ চকচক করে। নুনা মিঞা কাঁদে।’ কিন্তু বুবুর জীবন থেকে চাওয়া-পাওয়ার সমস্ত ইচ্ছার নিবৃত্তি ঘটে গেছে। জীবন সম্পর্কে যে ন্যূনতম আশা মানুষের মধ্যে অপ্রাপ্তিজনিত ক্রন্দন জাগাতে পারে, বুবু চলে গেছে তার সীমানার বাইরে। হৃদয়ে জেগেছে চড়া। কার্যত তার মৃত্যু হয়ে গেছে। চার বছর সময় কীভাবে কুরে কুরে একজন ক্রন্দসী বুবুকে ‘না কান্দে বুবু’-তে পরিণত করল, তার হদিস আফতাব কোথায় পাবে?
৩
পাইনি আমরাও। অছিমন বেওয়ার বিবর্তনের ইতিহাসটি লেখক রেখে দিয়েছেন আড়ালেই; আমাদের জানিয়েছেন কেবল তার পরিবর্তনের সংবাদ। কিন্তু এ পরিবর্তন যে আশাবাদীতা থেকে এক গভীর গহন ও সর্বাত্মক আশাহীনতায় পরিবর্তন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। নুনা মিঞার অবস্থার সাথে বিপরীতার্থক অবস্থার চিত্র তৈয়ার করে লেখক আলোকিত করেছেন এ দিকটি, যেখানে নুনা মিঞাকে পুত্রের সঙ্গে বৈষয়িক আলাপে লোভাতুর আর আশাবাদী দেখি, এবং পরক্ষণেই নৈঃশব্দ্যের জমাট অন্ধকারে আবিষ্কার করি অছিমনকে। এই বৈপরীত্যের আলোয় অছিমন বেওয়ার মনের অন্ধকার দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু লেখক যে আমাদের জানাচ্ছেন না এই রূপান্তরের ব্যাকরণটি, হঠাৎ করে প্রায় উল্লম্ফনধর্মী নাটকীয়তায় খোলাসা করে দিচ্ছেন অছিমনের হৃদয়-নদীর চড়া, সে বিষয়ে তিনি নিজে প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলেন। তাই নানা কুশলতায়, বর্ণনার বিচিত্র বিভঙ্গে, আর রূপক-প্রতীক-সংকেতের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের সামনে হাজির করেছেন জীবনের বিচিত্রগামীতার প্রতিবেদন; আমাদের প্রস্তুত করে রেখেছেন এরূপ বিশ্বাসে যে, মানুষের জীবনে এমনটা ঘটা খুবই সম্ভব। সে অর্থে ‘না কান্দে বুবু’ অছিমনের গল্প নয় শেষ পর্যন্ত; এটি জীবনের গল্প- মানব জীবনের।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনকে নদীর সঙ্গে তুলনা করে জীবনের চাঞ্চল্য ও কল্লোলময়তা এবং আক্ষেপ ও অসহায়তাকে বিচিত্র চাতুর্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ওই উপন্যাসে বিচিত্রগতি মানবজীবনকে নদীর রূপকে উপস্থাপন করলেও আলোচ্য গল্পে কিন্তু জীবনের উপমা নদী নয়। বরং নদীর সাথে একটি বিপ্রতীপতা তৈরির মধ্য দিয়েই মানব জীবনের ধারণাটি এখানে অবয়ব পেয়েছে: ‘ধ্যামড়া নদী, তারপর কলতা। নদী-খাল-নালা বদলায় না; বাড়ির পথ বদলায় না। যদি বুবু না কাঁদে?’
নদী-নালা-খাল কিংবা বাড়ির পথ থেকে যায় একই রকম, যেমনটি দেখা গিয়েছিল আগেরবার, কিংবা তারও আগে; কিন্তু কান্না যে বুবুর প্রায় পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্ন সে বুবু, আফতাব হঠাৎ আক্রান্ত হয় অকারণ সংশয়ে, না-ও-তো কাঁদতে পারে। এক অর্থে এ সন্দেহ লেখকেরও। কারণ, আফতাব কোনো প্রত্যক্ষ সংবাদের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়নি। বলতে পারি, আফতাব সন্দেহটি করেছে লেখকের পক্ষ থেকে। আর সন্দেহই বা বলি কেন? একটি না-জ্ঞাপক বাক্যের [‘বাড়ির পথ বদলায় না’ পরিবর্তনহীনতার কথা বলে] পরপরই হ্যাঁ-জ্ঞাপক সংশয় [‘যদি বুবু না কাঁদে’ বুবুর পরিবর্তনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়] স্থাপন করে পূর্বোক্ত সন্দেহকেই লেখক প্রতিষ্ঠিত করেছেন গল্পের প্রতিপাদ্য হিসাবে।]
আর প্রায় পুরো গল্পে বিশেষভাবে নজরে আসার মতো অন্তত তিনটি উপকরণ বারবার ব্যবহৃত হয়ে গল্পটির জন্য একটি কার্যকর অনুসরণ-রেখা প্রণয়ন করেছে। প্রথমটি লোকশ্রুতি, দ্বিতীয়টি ধর্মোপদেশ, এবং তৃতীয়টি রূপকথার আদলে তৈরি করা অণুকাহিনি। এই তিনটি উপকরণের পরিকল্পিত কোলাজ কোনোরূপ বিস্মৃতির অবকাশ না দিয়ে আমাদের বিরামহীন ভাবতে দিয়েছে যে মানবজীবন এক সূক্ষ্ম-জটিল অনুধ্যানের বিষয়, যার নাগাল পাওয়া মোটেই সহজ কর্ম নয়।
প্রথমে লোকশ্রুতির কথা বলা যাক। কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে লোকের সামষ্টিক ধারণা গভীর বা প্রকৃত বাস্তবতা থেকে অনেক দূরবর্তী। যেমন, আফতাব সম্পর্কে গ্রামে প্রচলিত ধারণা :
আফতাব মিঞা দ্যাশে থাকে না, দ্যাশে আসে না। আফতাব মিঞা চাইর বছর দ্যাশে থাকে না, দ্যাশে আসে না। শহরে থাকে। হেই বড় শহরে। আফতাব মিঞা গাড়ি-ঘোড়ায় চলে। আফতাব মিঞা সিদ্ধভাত খায়, বরফের মাছ খায়। আফতাব মিঞা রঙে আছে।
এই ধারণা- আফতাবের নিজের এবং লেখক-সমর্থিত বয়ানে পরিষ্কার বোঝা যায়- শহরে আফতাবের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গল্পের শেষদিকে অছিমন সম্পর্কে পাই অন্য এক লোকশ্রুতি : ‘সোনা ভাইরে পাইয়া অছিমন আর কী করে, থ হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। মাথায় ঘোমটা, চক্ষে নাই পানি।’
ততদিনে অছিমনের মনের দুনিয়ায় ঘটে গেছে যে অভাবিত বিপ্লব, তার চিহ্নও নাই এ বর্ণনায়। ধর্ম বা ধর্মোপদেশ জীবন সম্পর্কে যে ধারণা দেয় তা সামাজিক জীবনে, বিশেষত সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবনে প্রতাপশালী, কিন্তু কোনোক্রমেই জীবনের প্রকৃত রূপের বিবরণী নয়। পুরানা পুঁথির সুরে, অনেকটা ওয়াজ-মাহফিলে ব্যবহৃত ভঙ্গির অনুকরণে লেখক লোকমনে ক্রিয়াশীল ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের ছায়া নির্মাণ করেছেন। যেমন :
ভাই সকল, কাতারে দাঁড়াইয়া যান। ভাই সকল, লাইন বাঁধেন, খোদার সামনে কাতার হইয়া দাঁড়াইয়া যান। আসুক হাতি, আসুক বাঘ, আসুক শয়তান। শোন ভাই বন্ধুভাই মন দিয়ে শোন, হেনতেন মুখে রা করিও না কোনো। আর গুরুজনে মানিবে সদা, সম্মুখে না কহিবে কথা। দেখিলাম কী দেখিলাম, শুনিলাম কী শুনিলাম। দেখিলাম শুনিলাম আর পাইলাম খাইলাম। মানিলাম কীর্তি-কুদরত তোমার, লহ লক্ষ কোটি সালাম শোকর। আর গুরুজনে মানিবে সদা, তাতে যেন না হয় অন্যথা।
এ অনুচ্ছেদে জীবনের যে রূপ প্রতিফলিত হয়েছে, তা কেবল একরৈখিক নয়, অতি সারল্য এবং তারল্যে জীবনের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে উপলব্ধির কোনো চেষ্টারও পরিপন্থি। বস্তুত এ ধরনের অতি প্রচলিত অজস্র বয়ান জীবনের অতি সাধারণ কাঠামো প্রকাশ করে, যার আওতায় কার্যত ব্যক্তির অতি সামান্য অংশই পাঠ করা যায়।
অনুরূপভাবে রূপকথার জীবনও সরল। সেখানে নেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বহুরূপতা, নেই ভেতর-বাস্তবতার কোনো পরিচয়, কিংবা জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী জীবনভাগের কোনোরূপ উত্থান-পতন। এমনটিই দেখা গেছে শ্যামলপুরের বাদশার ছেলে আর মেয়ের ক্ষেত্রে :
শ্যামলপুরের বাদশার ছেলের কী হল আর কীই-বা হল তার মেয়ের যে দুধের মতো সাদা ঝালরওয়ালা পালঙ্কে শুয়ে আর কাঁদত না?
ছেলেটা মণিমাণিক্যখচিত অত্যাশ্চর্য লেবাস পরে শাদি করল, রাজত্ব করল, তারপর মরে গেল। গুম্বজওয়ালা সুদৃশ্য একটি ইমারত উঠল তার কবরের ওপর। আর মৃত্যুর দিনে এক সহস্র কবুতর ছাড়া হল। শাহজাদীরও শাদি হল আর স্বামীর ঘরে গোসা-ঘর পেল। শোয়ার ঘরে আর গোসা-ঘরে দিন কাটিয়ে সেও মরল। সেদিন এক সহস্র লোক দিনমোহর পেল।
এবং এই বর্ণনার অব্যবহিত পরেই পাচ্ছি বাস্তবের নিন্মোক্ত পরিচিতি : ‘বুড়ো বাপ নুনা মিঞা বোঝে না, বুবুও বোঝে না। একজন রাগে, আরেকজন কাঁদে।’ বাস্তবে একই ক্রিয়ায় ব্যক্তিভেদে প্রতিক্রিয়ার এই ভিন্নতা স্মরণ করিয়ে দেয় রূপকথার জীবনের অতি সারল্য, এবং মর্মত বাস্তব জীবনের জটিল সমীকরণ।
লক্ষণবিচারে মনে হয়, লেখকের লক্ষ্য ছিল, নানা অনুষঙ্গের পৌনঃপুনিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবনের জটিলতা, গভীরতা আর রহস্যময়তার একটা বোধ ওই জীবনের মতোই বিমূর্ত অথচ কার্যকরভাবে সামনে নিয়ে আসা। তিনি-যে নগ্ন ভাষণে না করে ইশারা-ইঙ্গিতে কাজটি করতে চেয়েছেন তার কারণ হয়তো এই যে কেবল ওইভাবেই কাজটি করার কথা ভাবা যায়। এই অনুভব এর চেয়ে মূর্তরূপ হয়তো পেতেই পারে না। কোনো জনাকীর্ণ স্থানে এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ শুনতে চাইলে যেমন একসঙ্গে পাওয়া যায় অনেক বর্ণনাকারী, যাদের সবাই বলতে চায় অনেক কিছু, কিন্তু একটি সম্মিলিত কলতানে তার কোনোটিই স্পষ্ট ও বিশেষ হয়ে ওঠে না, অথচ সংঘটিত ঘটনাটির সংঘটন-সত্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে ওঠা যায়, ঠিক তেমনি একটি কৌশলে ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর এই বক্তব্য পেশ করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।
আবার, এ গল্পে ফুটে ওঠা জীবন জীবমাত্রেরই জীবন নয়; নয় কচুরিপানা, গরু বা শ্যামলপুরের উন্নাসিক রাজকন্যার জীবন। এ জীবন মানুষের; গতিশীল, আশাবাদী বা আশাহত মানুষের; ভাবনা, চিন্তা আর দুঃখের ব্যাকরণহীন কুণ্ডুলিতে বারবার নিহত হওয়া এবং বারবার জেগে ওঠা মানুষের। একটি অনুচ্ছেদে অত্যন্ত সচেতনভাবে গল্পকার মানবজন্মের উৎকর্ষ এবং কারুণ্যের যুগল সংকেত রেখে গেছেন :
এই যে কচুরিপানা বুবু, এই কচুরিপানার কথা ভাব। এই কচুরিপানার মূল নাই, শিকড় নাই জমিতে। এই কচুরিপানা ভেসে যায় আপন মনে। তার দুঃখ নাই, ভাবনা নাই, চিন্তা নাই। কত নদী কত খাল কত নালা আর কত কচুরিপানা। তুমি জান বুবু গরুর কথা। গরুকে কচুরিপানা খেতে দিতে নাই। বন্যার সময় গরু ঘাস-বিচালি খেতে না পেয়ে পানিতে দাঁড়িয়ে পেটের দায়ে কচুরিপানা খায়। জানে না কচুরিপানা খাওয়া তার নিষেধ। কিন্তু কচুরিপানা নির্ভাবনায় ভেসে চলে। তার ভাবনা নাই, চিন্তা নাই, দুঃখ নাই।
শেষ বিচারে মানুষের জন্য ট্র্যাজিকই বলতে হবে একে যে, তাকে পোহাতে হয় নিজস্ব শঙ্কার ভার, বর্তমানকে চলতে হয় সমঝে, আর ভবিষ্যতের জন্য খুঁড়তে হয় অনুকূল সিঁড়ি। আবার একই সাথে পোষা গরুটির কথাও ভাবতে হয় তাকেই। [গরুটি কিন্তু আশ্চর্য উদাসীনতায় নিঃশঙ্ক।] তাকে কখনো মনোযোগী হয়ে উঠতে হয় একটি তুলসী গাছের প্রতি, আবার কখনো নির্মম অবহেলায় অমনোযোগের অন্ধকারে চালান করতে হয় তাকে। পরিহাসটি এখানে যে, এই দ্বি-ধারা আচরণের কোনোটিই তুলসীগাছের ধর্তব্য নয়। ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পের সেই আশ্চর্য কথামালা সে কথাই বলে: ‘সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয় নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়ে নি। কেন পড়ে নি সে-কথা তুলসীগাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা।’
ইচ্ছা করলেই মানুষ হতে পারে না ইতর প্রাণীর মতো সরলরৈখিক; হতে পারে না গরু দোয়েল কিংবা ফড়িঙের মতো বাঁচার ইচ্ছায়-চেষ্টায় বিরামহীন: ‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’
আর অকারণ শঙ্কায়, অতল আশাহীনতায় পতিত হওয়াও সম্ভব এই রহস্যময় মানবমনের পক্ষেই। অছিমন একবার কেঁদেছিল বেলতলায়। অকারণে। বেল পড়েছিল একটি; শরীরে নয়, পায়ের কাছে। কিন্তু যে বেল শরীরে না পড়ে পায়ের কাছে পড়ল, যে বেল কোনো ক্ষতিই করেনি অছিমনের, সে বেলের ভয়েই কেঁদেছিল সে- অঝোর কান্না। প্রত্যক্ষ কারণ ছাড়াই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ কেবল মানুষের পক্ষেই বুঝি সম্ভব। যুক্তির শাসনে নয়, বরং ইঙ্গিতের আপাত-অসংলগ্ন প্রশ্রয়ে মানবজীবনের এরূপ জটিলতা আর আমূল-বিবর্তন-সম্ভব অস্থিতিস্থাপকতার বোধই নির্মাণ করেছেন লেখক। এর ফলেই অছিমনের ওই আত্মিক বিবর্তন পেয়েছে সম্যক বৈধতা।
৪.১
প্রকরণবাদীরা যেমন বলেছিলেন, সাহিত্যিকের অন্যতম প্রধান কাজ অপরিচিতকরণ সেকথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি আরেক সত্য হলো, সাহিত্যিকের কাজ পরিচিত করাও বটে- যে অভিজ্ঞতাটি পাঠকের সঞ্চয়ে ছিল না, তাকে তার পরিচিতির গণ্ডিতে নিয়ে আসা; যে মানুষ ও প্রতিবেশকে সে দেখেছে ইতিপূর্বে তাকে দেখার সম্পূর্ণ নতুন কোনো চোখ এঁকে দেয়া। বস্তুত কোনো সফল শিল্পকর্মের জন্য দেখার একটি নতুন চোখ অতি জরুরি। আবার জীবনকে দেখার নতুনতর দৃষ্টিকোণই কোনো একটি রচনাকর্মের জন্য বিশেষ ধরনের রচনারীতিকে বিকল্পহীন করে দেয়। আর এ কারণেই যদি বলা হয়, ‘না কান্দে বুবু’ বহন করছে একটি ভয়াবহ আত্মিক মৃত্যুর ফিরিস্তি, তাহলে গল্পটি সম্পর্কে সামান্যই বলা হয়। সেই মৃত্যুর স্বরূপ বুঝতে হলে চাই গল্পের অন্দি-সন্ধির খবর, চাই লেখকের বলার ভঙ্গিটির বিশিষ্টতা অন্বেষণ, যে ভঙ্গির নিপুণ দাওয়াই প্রয়োগে লেখক আমাদের উপনীত করতে পেরেছেন এই বিশ্বাসে যে, এমনটি হওয়া শুধু সম্ভবই নয়, বরং প্রায়শই হয়ে থাকে।
ওয়ালীউল্লাহ্ সাবালক রচনাবলিতে তিনি আক্ষরিক অর্থেই সাংবাদিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে চেয়েছিলেন। প্রায় কখনোই তিনি জীবনের বাহ্যিক পরিচয় নির্মাণ করতে চাননি, চেয়েছেন জীবন সম্পর্কে তাঁর গভীর ও বিশেষ বোধসমূহকে পরীক্ষা করতে। মূলত এসব কারণেই তাঁর রচনায় একটি প্রাজ্ঞ লেখক-দৃষ্টিকোণ প্রায় সর্বত্রই সক্রিয় থেকেছে। আলোচ্য গল্পেও এর অন্যথা ঘটেনি। তবে অন্তত বাহ্যত এ গল্পের অধিকাংশ অংশ বিবৃত হয়েছে আফতাবের দৃষ্টিকোণ থেকে। এই কেন্দ্রীয় দৃষ্টিকোণের সঙ্গে মিশেছে লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ, আর তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সাধারণ মানুষের সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ। একটি ঘটনা বা বর্ণনা পুরোপুরি কোনো একক দৃষ্টির প্রক্ষেপ থেকে আমাদের গোচরে আসেনি। বস্তুত এ গল্পে তার অবকাশই ছিল সামান্য। লেখকের লক্ষ্য ছিল কোনো বিশেষ মুহূর্তকে বিভিন্ন দৃষ্টির আলোক-নিক্ষেপে একটি বহুকৌণিক তাৎপর্য দেয়া, যাতে করে তার মর্মলোকের অনালোকিত দেশটি আলোকোদ্ভাসিত হয়। লেখক নিজে সাংকেতিক পরিচর্যার কারিগরিতে এই বহুকৌণিক দৃষ্টির সামঞ্জস্য বিধান করেছেন। গল্প থেকে একটি অংশ উদ্ধার করা যাক :
বুবু কাঁদলে তার বলার কিছু নাই।
- আফতাব মিঞা দ্যাশে থাকে না দ্যাশে আসে না।...
- টেকা পাঠায়। মানিওডার কইরা টেকা পাঠায়।
- আরো টাকা চাই। জমি বন্ধক হল, মান-সম্মান গেল।...
অছিমনকে কে খাওয়ায়? অছিমনের ছেলেমেয়েদের কে খাওয়ায়? নুনা মিঞা বোঝে না।...
বুবু কাঁদে কিন্তু বোঝে না।
কেঁদে-কেটে যে-বাদশাহ্জাদী ঝালর-দেয়া পালঙ্কে গিয়ে শুয়ে আর কাঁদে না। ঘি-মাছ-দুধ-সরে পোষা শরীর। আল্লাহু-আকবর।
উদ্ধৃত অংশে দেখা যাবে আফতাব, সামষ্টিক জনতা এবং লেখকের দৃষ্টিকোণ একাকার হয়ে গিয়ে একটি আপাত-বিশৃঙ্খল বর্ণনাধারা তৈরি হয়েছে।
গল্পটি এক অর্থে আফতাবের মনোকথনের গল্প। ওয়ালীউল্লাহ্ নিজস্ব ধরনের চেতনাপ্রবাহরীতিতে লেখা গল্পটিতে আফতাব তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে এক সুতায় গেঁথে নিয়েছে। মনের বিচিত্র গতির মতোই তা চঞ্চল ও অবিন্যস্ত। মাঝি এবং মাঝির ছেলেকে নিঃশব্দ রেখে ওই দীর্ঘ জটিল নৌযাত্রায় আফতাবের মনোকথনকে লেখক পাঠকের কাছে সশব্দ করেছেন। কিন্তু আফতাব গল্পের মূল উপজীব্য নয় বলে [প্রধান চরিত্র অছিমনের দৃষ্টিকোণ প্রত্যক্ষভাবে অব্যবহৃতই থেকে গেছে গল্পে], তার ভাবনা লেখকের কাঙ্ক্ষিত গভীরতায় পৌঁছানো যৌক্তিক হবে না বলে, সর্বজ্ঞ লেখকের দৃষ্টিকোণটি এ গল্পের জন্য আবশ্যিক ছিল।
৪.২
বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা ধরে দোদুল্যমান অস্তিত্বে অগ্রসর হলেও গল্পটির আবহে আশ্চর্য বাস্তববাদিতা কাজ করে গেছে। ওয়ালীউল্লাহ্র কথাসাহিত্যে সবসময়েই এমন হয়- বর্হিবাস্তব ও অন্তঃসত্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আদর্শবাদিতা, তত্ত্ব বা মনোবিশ্লেষণের প্রতি পক্ষপাত; কিন্তু বাস্তবতার প্রত্যক্ষ সত্য কখনোই গৌণ হয়ে ওঠে না। হবেই বা কেন? জানতেন ওয়ালীউল্লাহ্, মানুষের মনের জগতই বৃহত্তর জগৎ, যেমনটি বলেছিলেন ফ্রয়েড ও অন্যরা; কিন্তু ওই বড় জগতের বৈধতা কিছুতেই অর্জিত হয় না ক্ষুদ্রতর বহির্জগতের ঠেক ব্যতীত। তাঁকে কিছুতেই বলা যাবে না পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবের শিল্পী; অথচ সত্য এই, তাঁর রচনারই কোনো কোনো অংশ বাস্তবতার স্নায়ুছেঁড়া সূক্ষ্মতায় ও স্পষ্টতায় ভাস্বর।
‘না কান্দে বুবু’ গল্পের শুরুতে নৌকা, নৌপথ এবং যাত্রা সংশ্লিষ্ট কিঞ্চিৎ বর্ণনা আছে। আরো পরে আছে ছড়ানো-ছিটানোভাবে বুবুর সংসার, পিতার ঘর-গেরস্থালি কিংবা আফতাবের কর্মপরিচয়জ্ঞাপক বর্ণনাংশ। কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করা যাক :
ক. এ-নদী সে-নদী; এ-খাল সে-নালা। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ পানির আর মাছের, কচুরিপানার আর ধানের; নৌকায় ভরাট গন্ধ ভেজা কাঠের, ডহরের পানির আর খাম্বুরি তামাকের। আকাশের বর্ষাশেষের শ্রান্ত মেঘ নিস্তেজভাবে ঘোরে।
খ. বুবুর ঘোমটা খুলল, বুবু সংসার গড়ল আরেক মানুষের ঘরে, বুবুর ছেলেমেয়ে হল। বুবু মাছ ছাড়াল পুকুরে, আমগাছে আম গুনল। সন্ধ্যার পরেও বুবু কুপি হাতে খড়ম পরে গোয়ালে গরু দেখল; মুরগির খোঁয়াড়ে ঝাপ আছে কি-না দেখল।
গ. ঘরের মেয়ের পটলচেরা চোখও ছাপিয়ে আসে অশ্রুতে।
ঘ. হঠাৎ একটু হাওয়া আসে পানিতে চুড়ির মতো মিহি ঢেউ তুলে।
উদ্ধৃত অংশগুলোতে টের পাওয়া যায় ওয়ালীউল্লাহ্-সুলভ সংযম, ন্যূনতম আর অবিকল্প শব্দ ব্যবহারের প্রয়াস এবং বাস্তবতার যথার্থ ধারণা তৈরির সাফল্য। ক্ষুদ্রায়তন এসব বর্ণনাংশ আসলে অনেক অকথিত বাস্তবতার প্রতিনিধি। ধ্যামড়া ও কলতা নদী পেরিয়ে যে বাস্তবতায় বাস করে অছিমন আর নুনা মিঞা- সম্ভাব্য স্বল্পতম পরিসরে তাকে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন লেখক। অবশ্য এ বাস্তবতা বাহ্য। এ গল্পে গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বাস্তবতা তৈরি করেছে সংলাপে দৃষ্টিকোণের সুচারু বিন্যাস এবং বহুস্বরতা-সম্পর্কিত সচেতনতা।
বর্ণনা ও বিশ্লেষণকুশল ওয়ালীউল্লাহ্ আলোচ্য গল্পে বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যা কিন্তু একেবারেই নেই, বর্ণনাংশও সীমিত। গল্পটির মূল অবয়ব তৈরি হয়েছে সংলাপ-যোজনায়। আফতাব তার মনোকথনে লোকশ্রুতি, ধর্মোপদেশ কিংবা রূপকথার টুকরো টুকরো কোলাজ যেমন হুবহু অঙ্গীভূত করে নিয়েছে, ঠিক তেমনি উদ্ধৃত করেছে অন্যের সংলাপও। কোলাজগুলো কাজ করেছে লেখকের অসামান্য বর্ণনাকুশলতার বিশ্বস্ত বিকল্প হিসেবে। আর সংলাপগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থানগত বাস্তবতাকে পুরোপুরি অক্ষুণ্ন রেখেই স্থান করে নিয়েছে আফতাবের চেতনাপ্রবাহে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফতাবের বাড়ি ফেরা ‘পুঁথির কাহিনীর মতো দেশময় ছড়িয়ে পড়ার মতো অসাধারণ’- এ বর্ণনা তার দৃষ্টিকোণ থেকেই কেবল ওই পরিমাণ বৈধতা পায়, যা সাহিত্যের ন্যূনতম বাস্তবতা রক্ষার জন্য আবশ্যিক। আফতাবের শহরজীবন বিষয়ক দুটি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা নিম্নরূপ:
ক. আফতাব মিঞা সিদ্ধভাত খায়, বরফের মাছ খায়। আফতাব মিয়া রঙে আছে।
খ. আফতাব মিঞার পেটে জোর নেই সিদ্ধভাত খেয়ে। একটু নুন, একটু মরিচ, একটু মাছ। গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে না। সে রঙে নাই। রনকদার শহরে রঙে নাই।
এ দুই বর্ণনা প্রমাণ করে লেখকের দৃষ্টিকোণ-বিষয়ক কুশলতা আর বহুস্বরতা-বিষয়ক সচেতনতা। অছিমন, নুনা মিঞা, আফতাব এবং সামষ্টিক বাস্তবতাকে পুরোপুরি মূল্য দিয়েই লেখক এসব সংলাপ বা সংলাপধর্মী বিবরণী তৈরি করেছেন।
৪.৩
চেতনাপ্রবাহরীতির পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়ালীউল্লাহ্ ‘না কান্দে বুবু’ গল্পে বাংলা গদ্যের শিল্পগত সহনশীলতা নিয়ে এক জটিল নিরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সংলাপ কিংবা বর্ণিতব্য বিষয়ের ক্রম লঙ্ঘন করে এবং এমনকি একই বাক্যের মধ্যে চিন্তার আপাত-অসামঞ্জস্য নির্মাণ করে তিনি গদ্যে একটি হোঁচট খাওয়ার মতো ভঙ্গি এনেছেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল বর্ণনার বিস্তৃতিতে না গিয়ে সীমিত শব্দগুচ্ছকে প্রতীকী তাৎপর্য দান করা, যাতে ভাষার প্রকাশক্ষমতা বেড়ে যায়। এজন্য তিনি শব্দ, বাক্য ও চিন্তার উল্লম্ফনধর্মীতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এই বৈশিষ্ট্যটি মূলত কবিতার। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্ আশ্চর্য কুশলতায় গদ্যে তাকে সম্ভবপর করতে পেরেছেন। নিচের দৃষ্টান্তটি পরীক্ষা করা যাক :
বুবু স্বামীর মৃত্যুর পর বিলাপ করে নি। কেঁদেছে নীরবে। ফিরতি পথে নদী দেখে নাই, তীর দেখে নাই, মেঘ দেখে নাই। কোনোদিন দেখে নাই, সেদিনও দেখে নাই। কাদের মুনশির তিন ছেলের এক ছেলে সিতাব জন্ম নিল, বড় হল সেয়ান জোয়ান। হল তার চওড়া ছাতি। হল তার দীর্ঘ দাড়ি, দিল জন্ম সন্তানসন্ততির। দিয়ে একজন হল লোক, অতিশয় তেজবান। তারপর একদিন অতবড় জোয়ান-মর্দ ধড়াস করে পড়ে মারা গেল। ডাক শুনে দাঁড়াক লোক হাজার-হাজার লাখে-লাখে কাতারে-কাতারে, আর নাই লোক। কিলবিল করা অসংখ্য অগুন্তি লোকের মাঝে আর একটিও লোক নাই।
গদ্যাংশটিতে দেখা যায়, হ্রস্ব আকৃতির বাক্য, শব্দের বিশিষ্ট বিন্যাস এবং অন্তমিলের সমবায়ে কবিতার একটি ভঙ্গি এসেছে। অছিমনের স্বামীকে বিশেষায়িত রূপে প্রকাশ করে তার এককালীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আভাস দিয়েছেন লেখক, এবং এর পর-পরই তার স্বামীর মৃত্যু-সংবাদ। অতঃপর রূপকথার একটি ইমেজের [লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার...] অপভ্রংশ বানিয়ে নিয়ে অছিমনের সর্বাত্মক আশাহীনতার সাথে তার সামঞ্জস্যবিধান। সংকেত তৈরি করা এবং পাঠকের জন্য শূন্যস্থান রেখে যাওয়ার এরকম কাব্যকৌশল এ গল্পে চমৎকার খাপ খেয়ে গেছে। বাহ্য-বৈশিষ্ট্য হিসাবে পুঁথির ঢং আমদানি এবং অন্তমিলের ব্যাপক ব্যবহার পুরো গল্পটিকে দিয়েছে এক মিহি সুরের সম্মোহন।
৫
‘না কান্দে বুবু’র অসাধারণ শৈলী কিন্তু উত্তরকালীন বাংলা গল্পে অব্যবহৃতই থেকে গেছে। সম্ভবত এর আধার-আধেয়ের সম্মতির মধ্যেই আছে সে বিশিষ্টতা, যা কোনো একটি রচনাকৌশলকে করে রাখে অননুকরণীয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র গল্প ‘না কান্দে বুবু’
মোহাম্মদ আজম
মোহাম্মদ আজম
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। পিএচডি গবেষণার বিষয় বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও বি-উপনিবেশায়ন।
মন্তব্য