.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

শতবর্ষে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র বিশিষ্টতা পর্যালোচনা

শতবর্ষে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র বিশিষ্টতা পর্যালোচনা
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের পাঠক্রমে তাঁর লেখা অর্ন্তভুক্ত থাকায় সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের অঙ্গনে তিনি বহুচর্চিত নাম। গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছেন সেও দেখতে দেখতে অনেক বছর হয়ে গেল। যেমন- বন্ধু অধ্যাপক ড. উৎপল মন্ডলের তত্ত্বাবধানে কামনা মজুমদার পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র কথাসাহিত্যঃ বিষয় ও প্রকরণ”১ শীর্ষক একটি পূর্ণাংগ গবেষণা শেষ করেছেন ২০১৬ সালে । আগ্রহী পাঠক চাইলে ঘরে বসে ইন্টারনেটেই ৩০০ পাতার অধিক সেই গবেষণাপত্রের আস্বাদ গ্রহণ করতেই পারেন। তাঁকে নিয়ে চর্চার প্রসার বিস্তৃত এনিয়ে সন্দেহ নেই। শতবর্ষে এসে তাকে ঘিরে সাহিত্যের আঙ্গিনায় আয়োজন, চর্চা বাড়বে এটাই প্রত্যাশিত। আমার মত ‘আদার ব্যাপারী যখন জাহাজের খোঁজ’ নেবার চেষ্টায় মেতেছি, তাহলে শতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অবশ্যই আগ্রহের, চর্চার ও মূল্যায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আসার সম্ভাবনা কতটা সিরিয়াস পাঠক নিশ্চয় সেটা উপলব্ধিতে আনতে পারবেন। আমার এই লেখা নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের দিকপালদের কাছে পৌঁছানোর দুঃসাহস নয়, তবে এইটুকু বলতে পারি শতবর্ষের আবেগে আমি এই প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে সাহিত্যে ওয়ালীউল্লাহ্‌র অবদানের এলাকায় উঁকিঝুঁকি মেরে যৎকিঞ্চিত হলেও আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি দুই বাংলার নতুন প্রজন্মের পাঠকের সামনে ।

ছেলেবেলার জীবন

১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর জন্ম। তাঁদের পরিবারের আদি বসবাস ছিল চট্টগ্রামে। তাঁর বাবা নোয়াখালিতে থাকতেন । মা নাসিম আরা খাতুন চট্টগ্রামের মেয়ে ছিলেন। বদলি চাকরির সূত্রে তাঁর বাবাকে ময়মনসিংহ, ফেনী, ঢাকা, হুগলী, চুঁচুরা, কৃষ্ণনগর, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ কাটাতে হয়েছে। ফলে বাবার সাথে সাথে তাঁর ছেলেবেলা ও শিক্ষাজীবন কেটেছে নানান জায়গায়। তাঁর খুব অল্প বয়েসে তাঁর মা মারা যান। তার বাবা আবার বিয়ে করেন। সব মিলিয়ে তাঁরা চার ভাই আর তিন বোন ছিলেন। বিমাতার পরিবারে সকলের আস্থা অর্জন করে ও সবার সাথে মধুর সম্পর্ক রেখেই তিনি নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

কর্মজীবন

১৯৪৫ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়েসে কলকাতায় ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে কাজ করতে করতে পাশাপাশি ‘কমরেড পাবলিশার্স’ নামে প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন। দেশভাগের পরে তিনি পাকিস্থানে চলে যান ও সেখানে ‘রেডিও পাকিস্থান’-এর নিউজ এডিটর হিসাবে কাজ শুরু করেন। কয়েক বছর এখানে কাজ করার পর তিনি পাকিস্থান দূতাবাসে ‘প্রেস এটাশে’ পদে যোগ দেন ও ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স আর ভারতে কাজ করেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ‘প্রেস এটাশে’ হিসাবে কাজ করার পর তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত প্যারিসে পাকিস্থান দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনেস্কোতেও প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট হিসাবে কাজ করেছেন।

সমাজমনষ্ক মনের মানুষ

তিনি সমাজমনষ্ক মনের মানুষ ছিলেন, তাঁর সৃষ্টির ছত্রে ছত্রে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের চোখে।  “ওয়ালীউল্লাহর কৈশোর ও যৌবন অতিবাহিত হয় এক উত্তাল ও উষ্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে।…রাজনীতিতে সরাসরি অংশ না নিলেও ওয়ালীউল্লাহ চিরদিনই ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির স্বপক্ষে ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিপক্ষে। সমাজতন্ত্রীদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই তিনি ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী।…বাঙালি মুসলমানকে তিনি একটি অবহেলিত ও পশ্চাতপদ শ্রেণী হিসেবে তিনি দেখতেন, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে নয়। তাদের রাজনৈতিক অধিকারের আদায়ে তিনি সচেতন ছিলেন। তবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। …১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশক দুটি ছিল আশার দশক বা Decades of Hopes । এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ এই সময় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এই নতুন যুগ ওয়ালীউল্লাহকে ভীষণভাবে আশান্বিত করেছিল। মার্কিনী ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকার তিনি প্রশংসা করতেন। …ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্যে বলেছেন মানুষের কথা। …তার লেখাতে এসেছে ধর্মীয় গোঁড়ামির বেড়াজালে জড়ানো অধঃপতিত সামাজিক জীবন, এসেছে মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা, এসেছে কঠিন সময়ের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক মানব জীবন ও মানবীয় আবেগের কথা”২। তাঁর একটা বিশেষ বৈশিষ্টের কথা অবশ্যই আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন। তিনি কোন রকম ধর্মীয় আচার-আচরণ মেনে চলতেন না। তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন সমাজের ভন্ডামি, মৌলবাদীদের অত্যাচার, শোষণের কথা, মেয়েদের প্রতি অবহেলার ছবি, পুরুষদের বহুবিবাহে তার আপত্তির কথা, মেয়েদের বঞ্চনার কথা, মোল্লাদের শঠতার বিবরণ, লিখেছেন অমানবিক আচার-বিচারের কথা ও সেগুলোর অন্তঃসারশূন্যতার কথা। তাঁর বেশির ভাগ লেখাতেই মুসলিম সমাজের কথা লিখেছেন। সেটা ঠিকই। তবে সেই সমাজকে নিয়ে শুধু ভালো ভালো গালগল্প লেখেন নি, লিখেছেন সমাজের ভালো-মন্দ সমস্ত দিকটাই। লিখেছেন গ্রামের মানুষের কথা, মাঝি-মাল্লা, চাষির কথা, শ্রমিকের কথা, মজুরের কথা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের প্রায় সব গল্পেই খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, “মূলত মৃত্যু-তাড়িত ক্ষুধা, রুগ্নতা, দারিদ্র্য ও জীবনযাপনের চূড়ান্ত শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক দীনতা এই গল্পগুলোর উপজীব্য । …অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখক খুব সংযত সহানুভূতি নিয়ে চরিত্রগুলোর খুব কাছে থেকে তাদের আর্তি লক্ষ্য করেছেন। কোথাও তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন নয়। কিন্তু চরিত্রগুলির মনের মধ্যে ঢুকে তাদের কাতর কল্পনার সরণীটি তিনি গ্রহণ করেন,…। …সব গল্পেই তিনি ব্যবহার করেছেন নিজস্ব সমাজ –পরিমন্ডল, বাস্তব সমস্যায় প্রতিনিয়ত জর্জরিত থাকা কিছু সাধারণ মানুষ, তাদের হাসি-কান্না, দুঃখ বেদনা, আনন্দ-আকাংখ্যা, তাদের বেঁচে থাকার জীবন কাহিনী”৩। ঔপন্যাসিক হিসাবেও তিনি সমাজ ও কাল সচেতন ছিলেন। “প্রধানত সমকালীন, অর্থনৈতিক-ধর্মীয় অসাম্য, জীবনের অপূর্ণতা, গ্লানি ও কদর্যতাকে রূপ দিতে তিনি কলম ধরেছিলেন। বিশেষ করে তিনি নিজের অভিজ্ঞতাময় মুসলমান সমাজের সমস্যা, ধর্মান্ধতা, অশিক্ষা, কুসংস্কারচ্ছন্নতাকে তিনি প্রগতিশীল চেতনার আলোকে সাহিত্যিক রূপ দিয়েছিলেন কথা সাহিত্যে। তাই বাঙালি মুসলমান সমাজের একান্ত নিজস্ব সংকট তাঁর কথাসাহিত্যে বিশেষভাবে রূপ পেয়েছে”৪।

সাহিত্য জীবন

প্রায় গোটা কর্মজীবনটাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন, পাশাপাশি সাহিত্য সাধনায় নিজেকে ব্রতী রেখেছেন। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার হিসাবে তিনি বেঁচে থাকতেই প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। প্রধানত ছোটগল্পের হাত ধরেই তাঁর সাহিত্য পথে যাত্রা শুরু। তাঁর লেখা গল্প বইয়ের স্ংখ্যা মাত্র দুই- ‘নয়নচারা’ ও ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’। তিনি চারটি নাটক লিখেছেন- ১৯৬০ সালে ‘বহিপির’, ১৯৬৪তে ‘উজানে মৃত্যু’ ও ‘সুড়ঙ্গ’ এবং ১৯৬৫তে ‘ত্রঙ্গবঙ্গ’। কলকাতা থেকে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লাল সালু’ ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাস তাকে দেশে ও দেশের বাইরেও পরিচিতি ঘটায়। যদিও ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশের পর এটি পাঠকের আদর পায় নি। ১২ বছর পর ১৯৬০ সালে ঢাকা ‘কথাবিতান’ থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হবার পর উপন্যাসটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছায় । এমনকি ১৯৬১ সালে এটি ফরাসি ভাষায় ও ১৯৬৭তে এটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক খ্যাতি পেতে শুরু করে। লালসালু “উপন্যাসটি ধর্মীয় ভন্ডামির বিরুদ্ধে এক কালজয়ী সৃষ্টি। টুপি, খৎনা, মাজার-ব্যবসা, পীরগিরি কিংবা আম-মৌলবির দাড়ি, ধর্মের যা কিছু বাহ্যিক রূপ তার কোন কিছুকেই তিনি রেহাই দেন নি”৫। সমাজের শোষণ ও অত্যাচারের পটভূমিতে ব্যক্তির জীবনজিজ্ঞাসার রূপায়ণ এই উপন্যাস। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪, তৃতীয় উপন্যাস ‘কাদো নদী কাঁদো’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ তে। ইংরেজিতে রচনা করেছেন দুটি বই- (i)The Ugly Asian (ii)How does one cook beans । তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী উপন্যাস ‘দ্য আগলি আমেরিকান’ উপন্যাসের মুখোমুখি তাঁর লেখা ‘দ্য আগলি এশিয়ান’ উপন্যাসটি ছিল একটা মোক্ষম জবাব। “এর মধ্যে একদিকে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে দুর্বল ও ছোট দেশগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্রীড়াভূমি বানিয়ে তোলে, আর অন্যদিকে তুলে ধরেছেন তাদের বিরুদ্ধে মানুষের ছক ভাঙ্গা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের কাহিনী। উপন্যাসে আমরা দেখি দেশের সুবিধাবাদী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমেরিকা এশীয় দেশটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং নিজেরাই সাজানো ঘটনা ঘটিয়ে দোষ চাপাতে চায় কমিউনিস্টদের ওপর”৬। সাধারণত ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা হেয় জ্ঞান করেন এশীয়দের, যাদের তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষণ ও লুন্ঠন করেছে। তিনি স্যাটায়ারের মাধ্যমে এশীয়বাসীদের আবেগ ও বঞ্চনার কথা ‘হাও ডাস ওয়ান কুক বিনস’ লিখেছিলেন। বুলবুল, সওগাত, মোহাম্মদী, অরণি, পূর্বাশা, চতুরঙ্গ, পরিচয় ইত্যাদি প্রখ্যাত পত্রিকায় ও সাময়িকীতে তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন ধারাবাহিক ভাবে। বেশ কয়েকটি চিত্র সমালোচনার লেখক ছিলেন। “সাহিত্য বিচারে তার রচনাবলী আপন স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। বিশালায়তন ভল্যুমের সাহিত্য সৃষ্টি না করেও পাঠক চিত্ত জয় করা খুব কম সংখ্যক লেখনীর মাধ্যমেও যে খ্যাতির পাল্লা ভারী করা যায়, তার প্রমাণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ”৭ ।

সাহিত্যিক হিসাবে বিশিষ্টতা

তিনি ছিলেন এমন এক কথাসাহিত্যিক যিনি ছিলেন আপাদমস্তক দেশ-কাল সচেতন । তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক চাহিদায় সুন্দর মিশেল ঘটিয়ে উপন্যাসের দুটো শক্ত খুঁটি স্থাপন করেছেন। এই কারণেই অনেকে বলেন শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যে নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জন্য নিজের স্থান করে নিয়েছেন। নাট্যকার হিসাবে রচনা মাত্রই চার, কিন্তু তিনি সবকটি নাটকের ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার সাধনা করেছেন, চেষ্টা করেছেন আর্ন্তজাতিক নাট্য পরিধিকে ছোঁয়ার। “সব মিলিয়ে ওয়ালীউল্লাহ্‌ একজন নিবিড় গদ্যশিল্পী; কিছু কিছু প্রবন্ধ লিখলেও তিনি প্রাবন্ধিক নন। আবার গল্প ও নাটক লিখলেও গদ্যশিল্পী হিসাবে তিনি গহন পথের যাত্রি। ভাষা শিল্পী হিসাবে তাঁকে কোন ছকে ফেলে মাপা যায় না। পরীক্ষাশীলতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের রচনাকর্মের এক প্রধান চারিত্রলক্ষণ”৮। মাত্র ৫০ বছর আয়ু পেয়েছেন, তার মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি তাঁর রচনার সংখ্যায় নয়, উৎকর্ষতার গুণে চিরন্তন স্থান করে নিয়েছেন। তিনি পূর্ব বাংলার গ্রামের সমাজ ও সেই সমাজের হতদরিদ্র, পড়াশোনা না জানা মুসলিম জনসমাজকে তাঁর লেখার বিষয় ও পটভূমি হিসাবে বেছে নিয়েছেন। নামের জন্যে লিখতেন না, লেখাটা তাঁর কাছে ছিল জীবনের কাছে ও সমাজের কাছে একটা দায়বদ্ধতার মত। অনেকের মতে, অন্ত্যেবাসী মুসলমানের মর্যাদা দিতে তিনি সাহিত্য রচনায় অনুপ্রাণিত হন। তিনি যে সময়ে লিখেছেন সেই সময়ে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে পাশে সরিয়ে রেখে সাধারণ শ্রমজীবী, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের জীবন সংগ্রামকে উপজীব্য করা ছিল খুবই কঠিন কাজ- এটাও তাঁর একটা বিশেষত্ব বলা যেতেই পারে। তিনি নিখুঁত ও বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের লেখনী একটা ঘরানা যেখানে “নিরন্তর সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে তিনি তার লেখনীতে ব্যক্তি বিশিষ্টতা নির্মাণ করতেন। …তবে তিনি যা লিখতেন প্রাণের তাগিদেই লিখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বতঃস্ফূর্ততাই লেখকের মূল সম্পদ। যে-লেখায়  স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, তা লেখাই নয়”৯।

গান নিয়ে তাঁর গভীর পড়াশোনা ছিল। মামুনুর রশীদ গান নিয়ে তাঁর পান্ডিত্য প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে তাঁর তথ্যের ও ভাবনার কথা পড়ে নতুন করে কৌতূহল জাগল। তাঁর জানাশোনার মাত্রা যে কত দিগন্তব্যাপী, তা আমাদের জানার বাইরে। …তিনি অনুভব করেছিলেন ধর্মের রাজনীতির শক্তি এত বেশি যে সারা উপমহাদেশকে খন্ড-বিখন্ড করেই সে থেমে থাকেনি, মানুষের রক্তের গভীরে তা এমনভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে সে একটি পাষাণপ্রতিম অচলায়তন গড়ে তুলেছে”১০।

স্বীকৃতি

তিনি ১৯৫৫ সালে পিইএন পুরষ্কার, ১৯৬১ সালে  বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পান। তিনি ১৯৬৫ সালে আদমজী পুরষ্কার, ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর একুশে পদক, ২০০১ সালে ‘লালসালু’ সিনেমার গল্পের জন্য মরণোত্তর বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পান।

উপসংহার

লেখার শুরুতেই উল্লেখিত গবেষণাপত্রের সারসংক্ষেপ অংশে গবেষক লিখেছেন “একজন সাহিত্যিক হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া মুসলমান জনজাতিকে তুলে ধরা”১১। তাঁর অবদানকে লেখার সংখ্যা দিয়ে বিচারের চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। কেউবা বিচারের চেষ্টা করেছেন প্রাপ্ত পুরষ্কারের সংখ্যা দিয়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজের মূল্যায়ন করেছেন এইভাবে “সাহিত্যিক হতে হবে বলে লেখা- সে আমি ঘৃণা করি। প্রাণের উৎস থেকে না বেরুলে সে আবার লেখা! আপনা থেকে যা বেরুবে তাই খাঁটি’১২।

তথ্যসূত্রঃ
১) https://ir.nbu.ac.in
২) Rubayet Amin, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জানা সাহিত্যিকের অজানা জীবন, https://roar.media/bangla/main/biography/syed-waliullah, মে ১৯, ২০১৯
৩) http://14.139.211.59>bitstream , পৃ-২৩৮-২৩৯
৪) http://14.139.211.59>bitstream , পৃ-২৩৮-২৩৯
৫) http://14.139.211.59>bitstream , পৃ-২১২
৬) http://14.139.211.59>bitstream , পৃ-২৪৩
৭) তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহঃ জীবনের সমগ্রতা-সন্ধানী বুননশিল্পী, https://dainikazadi.net/ , ২৬ আগস্ট, ২০২২
৮) http://14.139.211.59>bitstream , পৃ-২১৫
৯) তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহঃ জীবনের সমগ্রতা-সন্ধানী বুননশিল্পী, https://dainikazadi.net/ , ২৬ আগস্ট, ২০২২
১০) মামুনুর রশীদ, শতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহঃ উদ্‌যাপন ও প্রাসঙ্গিক কথা, https://www.ajkerpatrika.com/ , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১১) https://ir.nbu.ac.in , পৃ-iii
১২) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, প্রথম খন্ড- সৈয়দ আবুল মকসুদ, মিনার্ভা বুকস, ঢাকা, ডিসেম্বর, ১৯৮১, পৃ-৩৩৯
 
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাণিজ্য বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত

শতবর্ষে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র বিশিষ্টতা পর্যালোচনা
ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: শতবর্ষে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র বিশিষ্টতা পর্যালোচনা
শতবর্ষে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র বিশিষ্টতা পর্যালোচনা
জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। শতবর্ষে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র বিশিষ্টতা পর্যালোচনা
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/w320-h160/syed-waliullah(bindu).png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/s72-w320-c-h160/syed-waliullah(bindu).png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/01/syed-waliullah-in-the-centenary.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/01/syed-waliullah-in-the-centenary.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy