.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

পাণ্ডুলিপিপাঠ/ শিল্পের শৈলী : সিমোন দ্য বোভোয়ার

শিল্পের শৈলী : সিমোন দ্য বোভোয়ার

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা: ম্যাডেলিন গোবেল
ইংরেজি অনুবাদ: বার্নার্ড ফ্রেখটম্যান
বাঙলা অনুবাদ: সুশান্ত বর্মণ
প্রকাশ: প্যারিস রিভিউ, বসন্ত-গ্রীষ্ম ১৯৬৫, সংখ্যা ৩৪

সিমোন দ্য বোভোয়ার আমাকে জ্যাঁ জেনেট এবং জ্যাঁ পল সার্ত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কিন্তু সিমোন নিজে সাক্ষাৎকার দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিলেন। “আমরা আমাকে নিয়ে আলোচনা করব কেন? আমি আমার স্মৃতিকথা তিনটিতে কি এ বিষয়ে যথেষ্ট লিখিনি?” বেশ কয়েকটি চিঠি বিনিময় ও মুখোমুখি কথা বলার পর তিনি রাজি হলেন। তাও একটা শর্ত ছিল- ‘এটা খুব দীর্ঘ হবে না।’
সার্ত্রের এপার্টমেন্ট থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে মন্টপারনেসে অবস্থিত রু স্কয়ার -এ সিমোন দ্য বোভোয়ার এর ঘরে সাক্ষাৎকারটি অনুষ্ঠিত হয়। তার পড়া ও বসার জন্য ব্যবহৃত হয় এমন একটি বিশাল আলোকিত কক্ষে আমরা বসি। আকর্ষণহীন কিছু বই দিয়ে বইয়ের তাকগুলো ঠাসা ছিল। তিনি আমাকে বললেন- ভালগুলো বন্ধুদের হাতে রয়ে গেছে, আর সেগুলো কখনও ফিরে আসে নি। বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে গিয়ে কেনা  মনোহারী দ্রব্যাদি দিয়ে টেবিলটি ভর্তি ছিল। কক্ষের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটি হল তার জন্য গিয়েকোমেট্টি’র (এরধপড়সবঃঃর) নিজের বানানো একটি ল্যাম্প। ডজন ডজন কিছু ফোনোগ্রাফ রেকর্ড ঘরের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিল। নিজে যে কটি বিলাসিতা করতেন তার মধ্যে ফোনোগ্রাফ রেকর্ড সংগ্রহ করা একটি।
ধ্রুপদী মুখাবয়বের অসাধারণ রূপ আর স্বচ্ছ নীল চোখে সিমোন দ্য বোভোয়ারকে বেশ তরুণ ও প্রাণবন্ত লাগছিল। তিনি সবকিছু জানেন এবং দেখছেন এরকম অনুভূতি যে কারও মনে জেগে উঠবে। কিছুটা নার্ভাস হয়েছিলাম। তিনি বেশ দ্রুত কথা বলেন। কোনোরকম অশিষ্টতা প্রকাশ না করে সরাসরি কথা বলেন। বরং তিনি বেশ হাস্যোজ্জ্বল ও আন্তরিক।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনি গত সাত বৎসর ধরে স্মৃতিকথা লিখছেন। এগুলোতে আপনার নিজের কাজ ও পেশা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আমার মনে হয় আপনার লেখালেখি শুরু করার প্রধান কারণ ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারানো।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: কিছুটা চাতুরী না করে কারও অতীত নিয়ে সমালোচনা করা কঠিন। অনেক আগে থেকেই আমার লেখালেখি করার আগ্রহ ছিল। আমি আট বৎসর বয়সে গল্প লিখতাম। অবশ্য অনেক শিশুই এমন করে। এর মানে এই নয় যে লেখালেখি করার ঝোঁক তাদের মধ্যে রয়েছে। আমার ক্ষেত্রে যা হতে পারে... তা হলো বইপত্র পড়াকালীন সময়ে আমি বইয়ের অনেক গভীরে প্রবেশ করি। যেমন ধরুন জর্জ এলিয়টের লেখা ‘দ্যা মিল অন দ্যা ফ্লস’ পড়ার পর এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে আমি প্রবলভাবে সেই চরিত্রটার মত হতে চেয়েছি। এমন কেউ যার বই মানুষ পড়বে, যার বই পাঠককে পাল্টাবে।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনি কি ইংরেজি সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আমার আশৈশব আসক্তি আছে। ফরাসী ভাষার চাইতে ইংরেজি ভাষার শিশু সাহিত্য একটু অন্যরকম আকর্ষণীয় ছিল। আমি এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, পিটার প্যান, জর্জ এলিয়ট এমনকি রোসামন্ড লেহম্যান পড়তে ভালবাসতাম।

ম্যাডেলিন গোবেল: রোসামন্ড লেহম্যানের ডাস্টি এনসার?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: এই বইয়ের প্রতি আমার সত্যিকার আসক্তি ছিল। আর, এটা কিছুটা মাঝারি মানের অবশ্য। আমার বয়সের মেয়েরা এই বইতে নিমগ্ন ছিল। রচয়িতার বয়স অল্প, তরুণ বয়স, আর প্রত্যেক মেয়ে নিজেকে 'জুডি' হিসেবে কল্পনা করত। বইটা বেশ চাতুর্যপূর্ণ দুর্বোধ্য ছিল। আমার ক্ষেত্রে আমি ইংলিশ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলাম। আমি বাড়িতে থাকতাম। নিজের জন্য কোন কক্ষ আমার ছিল না। আসলে, আমার কিছুই ছিল না। আর, যদিও জীবন স্বাধীন ছিল না কিন্তু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা পেত, আর আমার কাছে এটাই বেশ রাজসিক মনে হত। লেখক কিশোরী জীবনের নানা রহস্য জানতেন। বায়বীয় কল্পকথায় মোড়ানো সুদর্শন হ্যান্ডসাম ছেলে এবং এইসব কিছু। পরে আমি অবশ্যই ব্রন্টি এবং ভার্জিনিয়া উলফের বই, অরলান্ডো, মিসেস ডালোয়ে পড়েছি। ‘দ্যা ওয়েভস্’ নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই, কিন্তু এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিংকে নিয়ে লেখা তার বইটা আমার খুব, খুব প্রিয় ছিল।

ম্যাডেলিন গোবেল: তার জার্নালগুলো বিষয়ে কী মনে করেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: এগুলো আমাকে কম আকর্ষণ করেছে। এগুলো খুব বেশি সাহিত্যশৈলীর। এগুলো আকর্ষণীয় মনোমুগ্ধকর কিন্তু আমার কাছে একান্ত মনে হয় নি। তিনি তার নিজের প্রকাশনা এবং মানুষের মন্তব্য নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন। আমি ‘এ রুম অফ ওয়ানস ওন’ বইটিকে, যেখানে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ খুব পছন্দ করেছিলাম। এটা একটা ছোট প্রবন্ধ কিন্তু চেতনায় আঘাত হানে। নারীরা কেন লিখতে পারে না তা তিনি ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে এমন লেখকদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উলফ অন্যতম। তার কোন ছবি আপনি দেখেছেন কি? এক অনন্য সাধারণ একাকী মুখাবয়ব। এভাবে তিনি কোলেট -এর চেয়ে আমাকে বেশি টেনেছেন। কোলেট আসলে তার ছোটখাট ভালবাসার সম্পর্ক, গৃহস্থালী কাজকর্ম, কাপড় ধোয়া, পোষা প্রাণীদের নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত ছিলেন। ভার্জিনিয়া উলফ তার চাইতে অনেক ব্যাপক।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনি কি তার বইয়ের অনুবাদ পড়েছেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না ইংরেজিতে। আমি যেমন ইংরেজি বলি, তার চাইতে ভাল পড়তে পারি।

ম্যাডেলিন গোবেল: লেখকদের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সম্পর্কে আপনি কি মনে করেন? আপনি সরবোনের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মানুষ আপনাকে শিক্ষকতার মত গৌরবজ্জ্বোল মহান পেশায় দেখার আশা করত।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমার শিক্ষা দর্শনশাস্ত্রের উপরে আমাকে ভাসা ভাসা জ্ঞান দিয়েছিল, কিন্তু বিষয়টির প্রতি বেশ আগ্রহ তৈরি করেছিল। আমি শিক্ষক হওয়ার কারণে অনেক দিক থেকে উপকৃত হয়েছি। এটা ঠিক। পড়াশোনা করার জন্য অনেক সময়, লেখালেখি এবং কিছু শেখার জন্য অনেক সুবিধা পেয়েছি। আগেকার দিনে শিক্ষকদের উপর খুব বেশি কাজের চাপ ছিল না। জাতীয় পরীক্ষা পাশের জন্য করা পড়াশোনা দর্শনের উপরে আমাকে এমন এক শক্ত ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল যে, সাধারণ সংস্কৃতি নিয়ে সচেতন থাকলে আপনাকে যা নিয়ে ভাবতে হত না, দর্শনের পাঠ আপনার সামনে সেসব বিষয়ে গভীর অনুসন্ধানের দ্বার খুলে দেয়।
তারা আমাকে কাজে লাগার মত কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি শিখিয়েছিল। যখন ‘দ্যা সেকেন্ড সেক্স’ লিখছিলাম তখন এসব শিক্ষা বেশ কাজে লেগেছিল; সব ধরনের কাজে উপকার পেয়েছিলাম। বই দ্রুত পড়া, বাছাই করা, গুরুত্ব অনুসারে শ্রেণীবিভাগ করা, বাদ দেয়া, সারসংক্ষেপ করা, ঘাটাঘাঁটি করা।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনি কি একজন ভাল শিক্ষক ছিলেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: তা মনে করি না। আমি শুধুমাত্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি আগ্রহী ছিলাম, বাকীদের নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না। অথচ একজন ভাল শিক্ষকের সকল ছাত্রের প্রতি সমান মনোযোগ থাকা উচিত। কিন্তু যদি দর্শন পড়ান, তাহলে কোন উপায় থাকে না। সবসময় চার কি পাঁচজনের মত শিক্ষার্থীকে পাই যারা কথা বলে। বাকীরা কোন কিছু সম্পর্কে আগ্রহী নয়। আমি তাদের নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি।

ম্যাডেলিন গোবেল: পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে প্রকাশিত হওয়ার আগে আপনি দশ বৎসর ধরে লিখছেন। হতাশ হননি?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না আমাদের সময়ে তরুণ বয়সে প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারটা সাধারণত ঘটত না। অবশ্যই দুই একটা উদাহরণ ছিল যেমন র‌্যাদিগেঁ,  তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল। সার্ত্রে নিজেও পয়ত্রিশ বৎসর হবার আগে নিজেকে প্রকাশ করেন নি। সমসাময়িক সময়ে ‘ল্য ন্যসিয়া’ আর ‘দ্য ওয়াল’ বের হয়েছিল; সেই সময়ে যখন আমার প্রথম প্রকাশ হবার মত বইকে ফেরত দেয়া হল, তখন আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন ‘শী কেম টু স্টে’ এর প্রথম সংস্করণ প্রত্যাখ্যাত হল, তখন আমি ভাবলাম, আমার আরও সময় নেয়া উচিত। আমি অনেক লেখকের উদাহরণ জানি যারা শুরু করার জন্য দেরী করেছেন। লোকে স্তাদাল এর কথা বলাবলি করত যিনি চল্লিশ বৎসর বয়স হবার আগে লেখালেখি শুরুই করেন নি।

ম্যাডেলিন গোবেল: প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো লেখার সময় কোন আমেরিকান লেখকের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কি?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: ‘শী কেম টু স্টে’ লেখার সময় অবশ্যই হেমিংওয়ে দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি আমাদেরকে সংলাপের সাদামাটা দিক আর জীবনের ছোটখাট কোন কিছুর গুরুত্ব শিখিয়েছেন।

ম্যাডেলিন গোবেল: উপন্যাস লেখার সময় কোন বিশেষ পরিকল্পনা দাঁড় করান কী?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না আমার তা থাকে না। স্মৃতিকথাগুলোর উপর কাজ করার পাশাপাশি দশ বৎসর ধরে উপন্যাস লেখার কাহিনী আপনি জানেন। যখন ‘দ্যা ম্যান্ডারিনস’ লিখি, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি তখন প্রাপ্ত বিষয়কে ঘিরে এর মত করে পরিবেশ ও চরিত্র সৃষ্টি করেছিলাম। অল্প অল্প করে গল্পটি পূর্ণাঙ্গ হচ্ছিল। তবে সাধারণভাবে পরিকল্পনা করার অনেক আগে থেকেই আমি উপন্যাস লিখতে শুরু করি।

ম্যাডেলিন গোবেল: লোকে বলে যে আপনার মধ্যে বেশ নিয়মনিষ্ঠা আছে। এতটাই যে আপনি একটি দিনও কাজবিহীন যেতে দেন না। আপনি কোন সময়ে শুরু করেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমি সবসময় কাজের তাড়ায় থাকি, যদিও সাধারণত দিনের শুরুতে কাজ করা অপছন্দ করি। প্রথমে আমি চা খাই আর তারপর সকাল দশটার দিকে নিচে নামি এবং দুপুর একটা পর্যন্ত কাজ করি। তারপর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। বিকেল পাঁচটার দিকে কাজে ফিরে যাই এবং রাত নয়টা পর্যন্ত নিমগ্ন থাকি। বিকেলবেলায় কাজটি পুনরায় হাতে নিতে অবশ্য আমার সমস্যা হয়না। আপনি চলে গেলে আমি খবরের কাগজ হাতে তুলে নিব অথবা কিছু কিনতে বের হব। বেশিরভাগ সময় কাজ করতে ভাল লাগে।

ম্যাডেলিন গোবেল: সার্ত্রের সাথে কখন দেখা হয়?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: প্রত্যেক সন্ধ্যায় এবং প্রায়ই মধ্যাহ্নভোজে। আমি সাধারণত তার ওখানে বিকেলবেলা কাজ করি।

ম্যাডেলিন গোবেল: এক এপার্টমেন্ট থেকে আরেক এপার্টমেন্টে এই যে আসা যাওয়া এটা আপনাকে বিরক্ত করে না?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না। যেহেতু আমি কোনো পা-িত্যপূর্ণ বই লিখছি না, সেহেতু সব কাগজপত্র আমার সাথেই রাখি। আর এটা বেশ কার্যকরী ।

ম্যাডেলিন গোবেল:  আপনি কি খুব তাড়াতাড়ি কাজে ডুবে যান?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: যা লিখছি তার পরিসরের উপর এটা নির্ভর করে। যদি কাজ ভাল আগায়, তাহলে গত দিনের লেখা পড়ার জন্য পনেরো মিনিট কি আধা ঘন্টার মত সময় ব্যয় করি। কিছু সংশোধন করি। তারপর সেখান থেকে আবার শুরু করি। যোগসূত্র পাওয়ার জন্য যা লিখেছি, তা আমাকে পড়তেই হয়।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার লেখক বন্ধুদেরও কী আপনার মত একইরকম অভ্যাস আছে?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না। এসব ব্যক্তিগত বিষয়। উদাহরণ হিসেবে জেনেট এর কথা বলি। তিনি সম্পূর্ণ অন্যভাবে কাজ করেন। যখন কাজ করেন তখন ছয়মাস ধরে দিনে বার ঘন্টা তিনি ব্যস্ত থাকেন। যখন কাজ শেষ হয় তখন আবার ছয় মাসের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকেন। যেমনটা বলেছি- ছুটিতে ভ্রমণরত অবস্থায় দুই-তিন মাস নিস্ক্রিয় থাকার সময়টুকু বাদে আমি প্রতিদিন কাজ করি। আমি ছুটির সময়কালে যখন ভ্রমণ করি, তখন সাধারণত কোন কাজ করি না। আমি সারা বছর ধরে কম পড়াশোনা করি। যখন বেড়াতে যাই তখন সাথে একটি বইভর্তি বড় হাতব্যাগ নেই। যে বইগুলো পড়ার সময় পাইনি, সেগুলো সাথে নেই। কিন্তু যদি ভ্রমণকাল একমাস বা ছয় সপ্তাহের মত ছোট হয়, তখন আমার অস্বস্তি হয়। বিশেষ করে যদি সেই সময়ে দুইটা বইয়ের মাঝখানে থাকি। যদি কাজ না থাকে, তাহলে একঘেয়েমি পেয়ে বসে।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার মূল পা-ুলিপি কি সবসময়ই হাতে লেখা? পাঠোদ্ধার কে করে? নেলসন অ্যালগ্রেন বলেন যে, আপনার হাতের লেখা পড়তে পারে এমন অল্প কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে তিনি একজন।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: টাইপ করতে জানি না। কিন্তু যা লিখেছি তা পড়তে পারে এমন দুইজন টাইপিস্ট রেখেছি। যখন কোন বইয়ের শেষ সংস্করণের উপর কাজ করি, তখন আমি পা-ুলিপির একটা অনুলিপি তৈরি করি। খুব সাবধানে মনেযোগের সাথে এই বিশাল কর্মটি সাধন করি। আমার হস্তলিপি অনেকটাই সহজবোধ্য।

ম্যাডেলিন গোবেল: ‘দ্যা ব্লাড অব আদারস’ এবং ‘অল মেন আর মরটাল’ বইদুটো লেখাকালীন সময়ের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছিলেন। এই বিষয়ে জয়েস বা ফকনারের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন কী?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না। এটা ব্যক্তিগত চেষ্টার জায়গা। বহমান সময় সম্পর্কে আমি আগ্রহের সাথে সচেতন ছিলাম। আমি নিজেকে সবসময় বয়স্ক ভেবেছি। যখন বার বৎসর ছিল, তখন ভেবেছিলাম তিরিশ বৎসর বয়স হওয়া বিব্রতকর। কিছু হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা বুঝতাম। সেই সঙ্গে আমি কি অর্জন করতে পারতাম; আর জীবনের কোন অধ্যায় আমাকে মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে সে সম্পর্কে সজাগ ছিলাম। এসব কিছু ছাড়াও, সময়ের চলে যাওয়া ও এর সাথে মৃত্যুর এগিয়ে আসা আমাকে সবসময় তাড়িত করত। আমার ক্ষেত্রে সময়জনিত জটিলতাটি মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত ছিল। এই চিন্তাও করতাম যে আমরা প্রতিনিয়ত অনিবার্য মৃত্যুর দিকে আরও কাছাকাছি হচ্ছি, আর ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ভয় তো ছিলই। বাস্তব থেকে বিচ্যুত হওয়া, ভালবাসার ঘাটতি হওয়ার চেয়েও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুব ভয়ঙ্কর। অবশ্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সম্পর্কিত কোন সমস্যায় পড়িনি। আমার জীবন মসৃণভাবে কেটে যাচ্ছে। আমি সবসময় প্যারিসেই থেকেছি। কমবেশি একই মানুষদের প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছি। সার্ত্রের সাথে আমার সম্পর্ক অনেকদিন থেকে টিকে আছে। দেখাসাক্ষাৎ হয় এমন পুরনো বন্ধুও আমার আছে। সময় সবকিছু ভেঙে ফেলে- আমি যে এমন ভেবেছিলাম, তা নয়। বরং সবসময় নিজের ভার নিজেই বহন করি। আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি, তা হল আমি পিছনে অনেকগুলো বৎসর ফেলে এসেছি আর, সামনে অনেকগুলো আসছে। আমি তাদেরকে মূল্য দেই।

ম্যাডেলিন গোবেল: সার্ত্রে যখন ‘ল্য ন্যসিয়া’ লিখছিলেন, তার সেই সময়ের একটা ছবি আপনার স্মৃতিকথার দ্বিতীয় ভাগে এঁকেছিলেন। আপনি তাকে এমন এক বিষয়ে বিষাদগ্রস্থ করে এঁকেছেন যাকে তিনি নিজের যন্ত্রণাদগ্ধ কাঁকড়া বলেছিলেন। আপনাদের জুটির মধ্যে আপনাকে সবচেয়ে হাসিখুশি দেখা যায়। অথচ আপনার উপন্যাসে মৃত্যু নিয়ে এক ধরনের পূর্বধারণা থাকে যা আমরা সার্ত্রের মধ্যে পাইনি।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: কিন্তু মনে করুন তো, ‘দ্যা ওয়ার্ডস’ এ তিনি কী বলেছিলেন? তিনি কখনও মৃত্যুর নৈকট্য পাননি। কিন্তু তার ছাত্রদের কথা ধরুন, যেমন নিজান, ‘আদেন’, ‘অরাবি’র লেখক- সে মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল। এক দিক থেকে সার্ত্রে নিজেকে অমর ভাবত। তিনি তার সবকিছুকে সাহিত্যকর্মের উপরে রেখেছিলেন এই আশাতে যে হয়ত তার কাজগুলো টিকে যাবে। অথচ আমার ক্ষেত্রে জানতাম যে আমার ব্যক্তিগত জীবন শেষ হয়ে যাবে, আর আমার লেখাগুলো টিকে থাকবে কিনা সে বিষয়ে আমি সামান্যতম চিন্তিত নই। আমি জানি যে জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো যেমন কারও প্রাত্যাহিক কাজকর্ম, কারও কল্পনা, কারও অতীত অভিজ্ঞতা মুছে যায়। সার্ত্রে মনে করতেন শব্দজাল দিয়ে জীবনকে ধরে ফেলা যায়। আর আমি অবশ্য সবসময় মনে করতাম যে শব্দগুলো কখনও নিজে জীবন হতে পারে না, বরং এভাবে বলা যায় যে শব্দরা হল জীবনের পুনরুত্থান।

ম্যাডেলিন গোবেল: এটা একটা আসল পয়েন্ট। কেউ কেউ বলেন যে, উপন্যাসে জীবনকে প্রতিফলিত করার শক্তি আপনার নেই। আপনার চরিত্রগুলো চারপাশের মানুষগুলোর হুবহু প্রতিফলন বলে অনেকে কটাক্ষ করে।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: তা জানি না। কল্পনা কী? যেটা সত্যি সেটা এবং  কারও সত্যিকার জীবনযাত্রা সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সাধারণত্বকে আয়ত্ব করা। বাস্তবতার ছোঁয়াহীন কাজগুলো আমাকে টানে না। যতক্ষণ না এগুলো অসংযত ধরনের না হয়। যেমন আলেকজান্ডার দ্যুমা ও ভিক্টর হুগোর উপন্যাসগুলোর কথা ধরুন, এগুলো একধরনের মহাকাব্য। কিন্তু আমি কল্পনাশ্রিত কাজগুলোকে ‘বানানো’ বলব না, বরং কল্পশৈলীর কারুকাজ বলব। নিজের স্বপক্ষে আমি লিও টলস্টয় এর ‘ওয়ার এন্ড পীস’ এর উদাহরণ টানব। এখানে সব চরিত্রগুলো বাস্তব জীবন থেকে নেয়া হয়েছে।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার চরিত্রগুলোর কাছে ফিরে আসা যাক। কীভাবে তাদের নামগুলো পছন্দ করেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমার কাছে, এসব অতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনা। আমি ‘শী কেম টু স্টে’তে জেভিয়ার নামটি পছন্দ করেছিলাম কারণ এই নামে শুধুমাত্র একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। নাম খোঁজার জন্য অতীতের পরিচিত মানুষদের স্মরণ করার চেষ্টা করি অথবা টেলিফোন ডাইরেক্টরি ব্যবহার করি।

ম্যাডেলিন গোবেল: নিজের কোন চরিত্রের সাথে নৈকট্য বোধ করেন।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: তা জানি না। আমি চরিত্রগুলো সম্পর্কে চিন্তার চাইতে চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বেশি আগ্রহী।  তা সে বন্ধুত্ব বা প্রেম যাই হোক না কেন। সমালোচক ক্লডি রয় এই বিষয়টা আগেই চিহ্নিত করেছিলেন।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার প্রত্যেক উপন্যাসে একজন বিপথগামী, মিথ্যা বিশ্বাস চালিত, মানসিক ভারসাম্য তাড়িত একজন নারী চরিত্র থাকে।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: অনেক আধুনিক নারী এরকম। নিজেরা যা নয় সেই ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নারীরা বাধ্য হচ্ছে। বারবণিতা হবার জন্য; নিজের মূল ব্যক্তিত্ব নিয়ে মিথ্যাচার করার জন্য তারা বাতিকগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছিল। আমি এই ধরনের নারীদের প্রতি গভীর মমতা বোধ করি। সুন্দর ভারসাম্য রেখে জীবন চালাচ্ছে এমন মাতা ও গৃহিণীদের চাইতে এরা আমাকে বেশি টানে। তবে সবচাইতে বেশি আকর্ষণ করে সেই ধরনের নারী, যারা সৎ এবং স্বাধীন; যারা কাজ করে ও সৃষ্টি করে।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার কোন নারী চরিত্রই প্রেম-প্রতিরোধী নয়। আপনি রোমাঞ্চকর বিষয়গুলো পছন্দ করেন বুঝি?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: ভালবাসা হলো একটা বিরাট সুযোগ। সত্যিকারের ভালবাসা বেশ দুর্লভ। যে নারী ও পুরুষ এটা পেয়েছে, তাদের জীবন ঐশ্বর্যময় হয়ে গেছে।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার উপন্যাসে, দেখা যায় নারীরা, আমার মনে হয় ‘শী কেম টু স্টে’ এর ফ্রাঙ্কোইজ এবং ‘দ্যা ম্যান্ডারিনস’ এর অ্যান এই দুজনের দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: এর কারণ হলো সবকিছু সত্ত্বেও নারীরা ভালবাসাতে নিজেকে উজাড় করে দেয়। এর কারণ বেশিরভাগ নারীর এছাড়া দেবার মত আর কিছু নেই। হয়তো তাদের গভীরভাবে অনুভব করার সামর্থ আছে, অবশ্য এটাই হল ভালবাসার ভিত্তি। হয়ত পুরুষদের চাইতে নারীদের ভিতর দিয়ে নিজেকে বেশি সহজভাবে দেখাতে পারি। আমার নারী চরিত্ররা আমার পুরুষ চরিত্রদের চাইতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ।

ম্যাডেলিন গোবেল: ‘দ্যা সেকেন্ড সেক্স’ এর মূল তত্ত্বকে কোন না কোনভাবে ফুটিয়ে তোলে এমন কোন স্বাধীন ও সত্যিকারের মুক্ত নারী চরিত্র আপনি কখনও তৈরি করেননি। কেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: নারীরা যেমন, আমি তেমনভাবেই তাদের দেখিয়েছি, বিচ্ছিন্ন মানুষ হিসেবে। যেমন হওয়া উচিত তেমনভাবে নয়।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার দীর্ঘ উপন্যাস ‘দ্যা ম্যান্ডারিনস’ এর পরে আপনি গল্প লেখা বন্ধ করে স্মৃতিকথা লেখার কাজ শুরু করেছেন। কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমি দুটোই পছন্দ করি। তারা ভিন্ন প্রকারের সন্তুষ্টি এবং হতাশা জোগায়। স্মৃতিকথা লেখার সময় বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যায়। অপরপক্ষে যখন কাউকে দিনের পর দিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যেমন আমার হয়েছে, সেখানে একপ্রকারের গভীর বোধ, এক বিশেষ প্রকারের পৌরাণিক কল্পনা এবং তার অর্থ ছিল, যা যে কারও অপছন্দ হতে পারে। যাই হোক, উপন্যাসে, যে কেউ প্রাত্যাহিক জীবনের এইসব বিবর্ণ ক্ষণগুলো প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেখানে কিছু বিরক্তিকর মিথ্যাচারের প্রলেপ থাকতে পারে। যে কারও মিথ্যাচার বাদ দিয়ে উদ্ভাবনের দিকে লক্ষ্য থাকা উচিত। আমি দীর্ঘদিন ধরে নিজের শৈশব ও তারুণ্যের কথা বলতে চেয়েছি। এদের সাথে এখনও গভীর সম্পর্ক ধরে রেখেছি। কিন্তু আমার বইগুলোতে এদের কোন চিহ্ন নেই। প্রথম উপন্যাস লেখার আগে আমার এমন ইচ্ছাটা ছিল, আগে যেমন ছিল, হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের ছোঁয়া লাগা কথা বলা। খুবই আবেগ মাখানো ব্যক্তিগত ইচ্ছা। ‘মেমোয়ারস অফ এ ডিউটিফুল ডটার’ নিয়ে আমি অতৃপ্ত ছিলাম। আমি এরপর অন্য কিছু করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি পারিনি। আমি নিজেকে বলেছিলাম “আমি মুক্ত হবার জন্য লড়াই করছি। আমার স্বাধীনতা দিয়ে আমি কী করেছি? শেষে কী হল?” একুশ বৎসর বয়স থেকে যা আমাকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বহন করেছে তার বিবরণ ধারাবাহিকক্রমে লিখেছি। ‘দ্যা প্রাইম অফ লাইফ’ থেকে ‘ফোর্স অফ সারকামস্টেন্স’ পর্যন্ত।

ম্যাডেলিন গোবেল: কয়েক বৎসর আগে ফোরমেন্টর-এ লেখকদের এক সম্মেলনে কার্লো লেভী ‘দ্যা প্রাইম অফ লাইফ’কে “শতাব্দীর শ্রেষ্ঠপ্রেম কাহিনী” হিসেবে আখ্যা দেন। সার্ত্রে এই প্রথমবারের মত ব্যক্তিরূপে উপস্থিত হলেন। আপনি এমন এক সার্ত্রেকে তুলে ধরেছেন, যাকে সঠিকভাবে বোঝা হয়নি। কল্পিত সার্ত্রের চাইতে এই মানুষটি একেবারে অন্যরকম।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করেছিলাম। তাকে নিয়ে লিখি এটা তিনি কখনও চান নি। শেষে যখন দেখলেন, আমি যেভাবে বলি সেভাবেই তাকে উপস্থাপন করেছি- তখন আমাকে স্বাধীনতা দিলেন।

ম্যাডেলিন গোবেল: এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়। বিশ বৎসর ধরে মর্যাদা পাবার পরও সার্ত্রের মত লেখককে এখনও ভুলভাবে বোঝা হচ্ছে এবং এখনও সহিংস আলোচনার শিকার হচ্ছেন।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: রাজনৈতিক কারণে। সার্ত্রে হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি নিজের শ্রেণীচরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। এজন্য অবশ্য তাকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়। কিন্তু সেটা এমন এক শ্রেণী, যাদের টাকা আছে, যারা বই কেনে। সার্ত্রে বৈপরীত্যে ভুগতেন। তিনি বুর্জোয়া বিরোধী লেখক। তাকে বুর্জোয়ারা পড়েন এবং নিজেদের শ্রেণীজাত বলে উৎসাহিত করেন। বুর্জোয়াদের সংস্কৃতিতে একচেটিয়া আধিপত্য আছে এবং তারা সার্ত্রেকে জন্ম দিয়েছে বলে মনে করে। একইসাথে তাকে ঘৃণা করে, কারণ তিনি একে আক্রমণ করেন।

ম্যাডেলিন গোবেল: ‘দ্যা প্যারিস রিভিউ’ এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, “রাজনীতিমনস্ক লেখকের কোন কাজ যদি টিকে যায় তাহলে তাকে পড়তে গিয়ে রাজনীতিটুকুকে উপেক্ষা করতে হবে। নিশ্চয় আপনি এর সাথে একমত হবেন না। আপনি কি এখনও ‘অঙ্গীকার’ এ বিশ্বাস করেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: হেমিংওয়ে ঠিক সেই ধরনের লেখক যারা নিজের প্রতি কখনও অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে চান নি। আমি জানি তিনি স্পেনের বেসামরিক যুদ্ধে জড়িত ছিলেন, সাংবাদিক হিসেবে। হেমিংওয়ে কখনও গভীরভাবে দায়িত্বশীল ছিলেন না। সেজন্য তিনি মনে করেন, যা কখনও সেকেলে হয় না, কোনকিছুর প্রতি দায়বদ্ধ নয়, তাই সাহিত্যের সারবস্তু। আমি একমত না। অনেক লেখকের বেলায় রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তাদের আমি পছন্দ বা অপছন্দ করি। বিগত দিনেও খুব বেশি লেখক ছিলনা, যারা কোন কিছুর প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। কেউ কেউ এখনও রুশোর ‘সোশাল কন্ট্রাক্ট’ তার ‘কনফেশন’- এর মত আগ্রহ নিয়ে পড়ে, কিন্তু কেউ আর ‘দ্যা নিউ হেলইস’ পড়েই না।

ম্যাডেলিন গোবেল: সম্ভবত যুদ্ধের শেষ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত সময় হল অস্তিত্ববাদের পূর্ণ বিকাশকাল। বর্তমান কালে “নতুন উপন্যাস” লেখা একরকম ফ্যাশন মাত্র। আর এ ধরনের লেখকরা হলেন দ্রু লা রোশেল এবং রজার নিমিয়ের।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: এসব অবশ্যই ফ্রান্সে ডানপন্থীদের ফেরত আসার চিহ্ন। এই নতুন উপন্যাসগুলো প্রতিক্রিয়াশীল নয়, লেখকরাও নন। এর সমর্থক কেউ হয়ত বলবে যে, তারা বুর্জোয়া রীতিনীতির মধ্য থেকেই কাজ করতে চাচ্ছেন। এই লেখকরা বিরক্তিকর না। দীর্ঘমেয়াদে গলের কার্যক্রম আমাদেরকে পিটেন তত্ত্বে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আর একমাত্র এটাই প্রত্যাশিত ছিল যে লা রোশেলের মত সহযোগী এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল নিমিয়ের এর মত ব্যক্তিদের আবারো উচ্চে তোলা হবে। বুর্জোয়াতন্ত্র আবার নিজেকে আসল রূপে মেলে ধরছে- অর্থাৎ একটি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী হিসেবে। সার্ত্রের ‘দ্যা ওয়ার্ডস’ এর সফলতা দেখুন। এখানে অনেক কিছু নোট করার মত। এটা হয়ত, আমি সবচেয়ে ভাল বলব না, বলব ভালগুলোর মধ্যে একটা। যে কোন বিবেচনায় এটা একটা চমৎকার বই, লেখ্যশিল্পের আকর্ষণীয় উপস্থাপন, এক অসাধারণভাবে লিখিত কাজ। একইসময়ে এতটা সফলতার পিছনে কারণ হচ্ছে এটা সেই বই যার কোন দায়বদ্ধতা নেই। যখন কেউ একে ল্য ন্যসিয়া’র মত শ্রেষ্ঠ বই বলে, তখন তার মনে রাখা উচিত যে ‘ল্য ন্যসিয়া’ আগের কাজ। এটাও কোন দায়িত্ববোধ থেকে লেখা নয়। আর নাটকগুলোর মত এটাও ডান-বাম উভয় পক্ষের দ্বারা সাদরে পঠিত হয়েছিল। একই ঘটনা আমার সাথে ‘দ্যা মেমোয়ারস অফ এ ডিউটিফুল ডটার’ নিয়ে হয়েছিল। বুর্জোয়া নারীরা এর মধ্যে নিজের যৌবনকে চিনতে পেয়ে উচ্ছসিত হয়েছিল। প্রতিবাদটা শুরু হয়েছিল ‘দ্যা প্রাইম অফ লাইফ’ থেকে, আর চলেছিল ‘ফোর্স অফ সারকামস্টেন্স’ পর্যন্ত। পার্থক্যটা খুবই পরিষ্কার, খুবই শাণিত।

ম্যাডেলিন গোবেল: ‘ফোর্স অফ সারকামস্টেন্স’ এর শেষাংশ আলজেরিয়ার যুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে লেখা। সেখানে মনে হয়, আপনি খুবই ব্যক্তিগত ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমি কোনোকিছু অনুভব ও চিন্তা করি রাজনৈতিক পদ্ধতিতে। আমি অবশ্য কোনরকম রাজনৈতিক কাজে জড়িত নই। ‘ফোর্স অফ সারকামস্টেন্স’ এর পুরো শেষাংশ সেই যুদ্ধ প্রসঙ্গেই। সেই যুদ্ধ সম্পর্কে আর সচেতন নয়, এমন ফ্রান্সে এটা সেকেলে হয়ে যাওয়ার মত।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনার কি মনে হয় না যে, মানুষ এসব ভুলে যাবেই।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমি ওই অংশ থেকে অনেকগুলো পৃষ্ঠা বাদ দিয়েছিলাম। তারপর বুঝতে পারলাম এটা ইতিহাসবিমুখতা বা বিকৃতি হয়ে যাবে। অথচ আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম। মানুষের ভুলে যাওয়ার মাত্রা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তরুণ পরিচালক রবার্ট এনরিক এর করা ‘লা বেলে ভি’ সিনেমা আপনি দেখেছেন কি? এই সিনেমায় আলজেরিয়ার যুদ্ধ দেখে মানুষ অবাক হয়ে গিয়েছিল। ক্লদ মরিয়াক ‘লা ফিগারো লিটারেইর’ পত্রিকায় লিখেছিলেন- “আমরা জনসমুখে প্যারাশুট ট্রুপারদের দেখছি কেন? এসব তো জীবনের স্বাভাবিক সত্য নয়”। কিন্তু এটা জীবনের জন্য সত্যই ছিল। আমি তাদেরকে সেইন্ট জার্মেরিন দ্যা প্রে-তে সার্ত্রের ঘরের জানালা দিয়ে প্রতিদিন দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। মানুষ ভুলে গেছে। তারা এসব ভুলতে চায়। তারা তাদের স্মৃতি ভুলে যেতে চেয়েছে। আমি যা আশা করেছিলাম, তার বিপরীত কিছু ঘটনার কারণ এটাই। আলজেরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে যা বলেছি তার জন্য সমালোচনা না করে প্রৌঢ়ত্ব এবং মৃত্যু নিয়ে বলার জন্য আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে। আলজেরীয় যুদ্ধ নিয়ে বর্তমানে এমন হয়েছে যে, এখনকার ফ্রান্সবাসীরা মনে করে সেরকম কিছু ঘটেনি। এমনকি কেউ অত্যাচারিত হয় নি। এটা এতদূর যে, অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছিল, আবার তারাই অত্যাচারের বিরুদ্ধে।

ম্যাডেলিন গোবেল: ‘ফোর্স অফ সারকামস্টেন্স’ এর শেষে আপনি বলেছেন “এখন অবিশ্বাস নিয়ে আমি বিশ্বাসপ্রবণ কৈশোরের দিকে তাকিয়ে দেখি, কীভাবে যে প্রতারিত হয়েছিলাম তা জেনে অবাক হয়ে যাই।”- এরকম কথা মনে হয় সব ধরনের ভুল বোঝাবুঝিকে উস্কে দিয়েছে।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: মানুষজন, বিশেষ করে শত্রুরা বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে, মনে হতে পারে আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এছাড়াও এর কারণ হিসেবে যা তারা বোঝায় যে, আমি বুঝতে পেরেছি- আমার রাজনৈতিক অবস্থান ভুল ছিল, অথবা আরও কারণ হল, আমি বুঝতে পেরেছি যে কোন নারীর অন্তত সন্তান থাকা উচিত ইত্যাদি। সতর্কতার সঙ্গে আমার বই পড়েছেন এমন যে কেউ বুঝতে পারবেন আমি বরং উল্টো বলেছি। আমি হিংসুটে নই, জীবন যেমন চলছে তাতে আমি সন্তুষ্ট। আমি আমার সকল অঙ্গীকার রক্ষা করেছি এবং যদি আমাকে আরেকবার জীবন দান করা হয়, তাহলে সে জীবন খুব একটা অন্যভাবে যাপন করবো না। আমি কখনই বাচ্চা না থাকার কারণে দুঃখ পাইনি। তার চাইতে আমি সবসময় লিখতে চেয়েছি।
তাহলে ‘প্রতারণার’ কথা কেন এল? যখন কেউ যদি আমার মত অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে, তাহলে দেখবে যে মানুষের জীবন স্ববিরোধীতায় ভর্তি। মানব জীবনের দুর্ভাগ্য এটাই যে কেউ একজন কিছু একটা হওয়ার জন্য চেষ্টা করে, আর দিনশেষে তাদের খুব কম টিকে থাকে। এটা এই ধরনের পার্থক্যের কারণে ঘটে যখন আপনি নিজের অস্তিত্বকে অনিশ্চিত করে তুলবেন। এমন এক উপায়ে, যেভাবে সবসময় পরিকল্পনা করেন, এমনকি এটা নিশ্চিতভাবে জেনে যে নিজের স্বকীয়তা নিয়ে আপনি সফল হতে পারবেন না। পিছু ফিরে যখন ছেড়ে আসা জীবনের দিকে তাকাবেন, তখন আপনার চোখে পড়বে যে আপনি খুব সাধারণভাবে শুধু জীবন নিয়ে টিকে ছিলেন। অন্যভাবে বললে বলা যায় সৃষ্টিকর্তার জীবনের মত আপনার জীবন নিরেট নয়। আপনার জীবন হচ্ছে খুব সাধারণ এক মানুষের জীবন।
তাই যে কেউ বলতে পারে, যেমন অ্যালেন বলেছিল, আর তার কথাটি আমার খুব ভাল লেগেছে- “কোনকিছুই আমাদের নিকট অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়”। একদিক থেকে এটা সত্যি, আবার অন্যভাবে দেখলে তা নয়। কারণ একজন বুর্জোয়া কিশোর বা কিশোরী যে বিশেষ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, তা আসলে প্রতিশ্রুত বিষয়। আমি মনে করি যে তরুণ বয়সে কঠিন জীবন পেয়েছে সে বড় হয়ে নিজেকে প্রতারিত ভাববে না। কিন্তু যখন আমি বলি যে ‘আমি প্রতারিত’; তখন আমি বোঝাচ্ছি যে, সতেরো বৎসর বয়সের যে মেয়েটি গ্রামের হেজেল ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে পরবর্তী জীবনে কী করবে সেই দিবাস্বপ্ন দেখছিল- তার কথা বলছি। আমি যা চেয়েছি, তার সবগুলোই করেছি। বই লিখেছি, নতুন জ্ঞান অর্জন করেছি, তারপরও আমি নিজেকে ‘প্রতারিত’ মনে করেছি। কারণ কখনই আমি বেশি কিছু করি নি। মালার্মের এরকম একটা লাইন আছে “দুঃখের ঘ্রাণ হৃদয়ে থেকে গেছে।” লাইনটা কেমন ছিল ভুলে গেছি। আমি যা চেয়েছিলাম তাই পেয়েছি, এবং, যখন সব বলা ও করা হয়ে গেছে, তারপরও কিছু একটা আশা সবসময় অপূর্ণ থেকে গেছে। একজন নারী মনোবিশ্লেষক আমাকে এক বুদ্ধিদীপ্ত চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন যে “শেষ বিশ্লেষণে প্রত্যাশার বস্তুর চাইতে মনের আশা আরও বেশি চেয়ে থাকে”। আসলে ঘটনা হল যে আমি যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি। কিন্তু ওই যে ‘আরও বেশি’ যা প্রত্যাশার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তা যখন প্রত্যাশা পূরণ হয়, তখনও অর্জন হয় নি। তরুণ বয়সে জীবনে অনেক আশা ছিল,  সংস্কৃতিমান ও বুর্জোয়া আশাবাদীরা যে জীবন পাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে, সেই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে দেখতাম। এই জীবনের কথা না বলার জন্য পাঠকরা আমাকে অভিযুক্ত করে। এটাই সেটা যা আমি বোঝাতে চাচ্ছি। আমি যা কিছু ভেবেছি ও করেছি তার জন্য কোন আফসোস নেই।

ম্যাডেলিন গোবেল: কেউ কেউ ভাবেন যে আপনার লেখার আড়ালে ঈশ্বরের প্রতি এক বাসনা লুকিয়ে আছে।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: না, সার্ত্রে আর আমি সবসময় বলেছি, এটা এজন্য না যে, প্রত্যাশাকে এমন রকমের প্রত্যাশা হতে হবে যা বাস্তবসম্মত। কান্টের বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্বে এটাই বলা হয়েছিল। ঘটনা হল যেকোন ঘটনার পিছনে কারণ থাকার জন্য কোন চরম কারণে বিশ^াস করার দরকার নেই। ঘটনা হল মানুষের কিছু হবার ইচ্ছা আছে এর মানে এই নয় যে সে কখনও এটা অর্জন করতে পারবে। এমন কী সেই অর্জন হওয়াটাও এতটা স্বাভাবিক যে, কোন মূল্যেই এটা সেই অর্জন, যা হল কোন কিছুর প্রতিফলন এবং একই সময়ে একটা উপস্থিতিও বটে। অস্তিত্ব এবং সত্ত্বার পারস্পরিক সংশ্লেষণ অসম্ভব। আমি ও সার্ত্রে এসবকে সবসময় বাতিল করেছি। এই প্রত্যাখ্যান আমাদের চিন্তারই প্রতিফলন। মানুষের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা আছে। এমনকি তার নানান সাফল্যের মধ্যেও এই শূন্যতা আছে। এটাই সব, ব্যাস। আমি যেসব লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছি সেগুলো সফল হয়েছে এমন বোঝাতে চাই না। তার চাইতে এটাই বাস্তব যে মানুষ যেমনটা ভাবে, লক্ষ্য অর্জন আসলে তেমন নয়। এছাড়াও সরলসোজা মানুষেরা ভাবে যে আপনি যদি সমাজে একটু সাফল্য পান, তাহলে আপনি সমাজে মানুষের বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট। কিন্তু ঘটনা সেটা নয়।
“আমি প্রতারিত” আরো অন্য কিছুকেও বোঝায়। সরাসরি বললে এটা যে, জীবন আমাকে পৃথিবীটা যেমন, ঠিক তেমনভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ দিয়েছে। জীবন কেমন? জীবন হল পৃথিবীভরা দুর্ভোগ ও অবদমনের শিকার হওয়া। বেশিরভাগ জনগণের জন্য বরাদ্দ অপুষ্টি। ছোটকালে এসব জানতাম না। আমি ভেবেছিলাম পৃথিবীকে আবিষ্কার করার মানে এর সৌন্দর্য আবিষ্কার করা। সেই একই অর্থে, আমি বুর্জোয়া সংস্কৃতি দ্বারাও প্রতারিত হয়েছিলাম। আর সেজন্য অন্যদের ঠকানোর কাজে অংশগ্রহণ করতে চাইনি। সেজন্য, আমি যে প্রতারিত সেকথা বলব, যাতে অন্যরা না ঠকে। এটা একটা সামাজিক ধরনের সমস্যা। আমি পৃথিবীর অসুখ আবিষ্কার করেছি, অল্প অল্প করে, তারপর আরও, আরও বেশি করে। অবশেষে আমার ভ্রমণকালীন সময়ে আলজেরীয় যুদ্ধের ব্যাপারে এই দুঃখটা আমি বুঝতে পেরেছি।

ম্যাডেলিন গোবেল: কিছু সমালোচক এবং পাঠক অনুভব করেছেন যে আপনি প্রবীণ বয়সকে অস্বস্তিকরভাবে বর্ণনা করেছেন।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: আমি যা বলেছি তা বেশ কিছু মানুষ পছন্দ করে নি। কারণ তারা এটা বিশ্বাস করতে চায় যে জীবনের সব স্তর আনন্দময়। সব শিশুরা যেন নিষ্পাপ, সব নববিবাহিত দম্পতি সুখী, যেন সব প্রবীণরা শান্ত। আমি এই জাতীয় ধারণার বিরুদ্ধে সারাজীবন প্রতিবাদ করে গেছি। এটা নিঃসন্দেহে সেই মুহূর্তের ঘটনা যেটা আমার ক্ষেত্রে বার্ধক্য নয়, বার্ধক্যের সূচনা। বয়সের এই অবস্থা এমন বোঝায় যে, এমনকি যদি কেউ যা চায় তার সব পায়, গভীর সম্পর্ক, বাকী থাকা কাজ থাকতে পারে; কারও বাস্তব অস্তিত্বের পরিবর্তন হয়; এই পরিবর্তন অসংখ্য ক্ষতির বিনিময়ে প্রকাশিত হয়েছে। যদি কেউ সেসব হারানোতে দুঃখ না পায়, তাহলে বুঝতে হবে সে আসলে সেগুলোকে ভালবাসেনি। আমি মনে করে যারা বার্ধক্য বা মৃত্যুকে ইচ্ছাপূর্বক উচ্চপ্রশংসা করে, মহিমান্বিত করে, তারা জীবনকে ভালবাসে না। হ্যাঁ, অবশ্যই। এখন ফ্রান্সে তো আপনাকে বলতে হবে সবকিছু ঠিক আছে, সবকিছু সুন্দর, এমনকি মৃত্যুও।

ম্যাডেলিন গোবেল: বেকেট মানবসত্ত্বার অসহায় অপচয় গভীরভাবে অনুভব করেছেন। অন্য ‘নিউ নভেলিস্ট’দের থেকে বেকেট কি বেশি আকর্ষণীয়।
সিমোন দ্য বোভোয়ার: অবশ্যই। ‘নিউ নভেল’-এ সমকালের যা কিছু আছে, তা ফকনারেও পাওয়া যায়। কাজের পদ্ধতি তিনিই শিখিয়েছেন। আর আমার মতে তিনি এটা যথাযথভাবে করেছেন। বেকেট প্রসঙ্গে বলা যায়, জীবনের অন্ধকার দিকগুলোকে তিনি যেভাবে তুলে আনেন, সেটা বেশ  সুন্দর। যা হোক, তিনি নিশ্চিত যে জীবন কালিমালিপ্ত। তার প্রভাবে আমিও বিশ্বাস করি যে জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং একই সময়ে আমি জীবনকে ভালবাসি। তার এই স্বীকৃতি তার সবকিছু প- করে দিয়েছে বলে মনে হয়। যখন এটাই আপনার সব কথার বলা হয়ে যাওয়া, তখন পঞ্চাশ প্রকারে বলার কিছু নেই। আর আমি দেখেছি যে, তার অনেক লেখা তার পূর্বের লেখার কেবল অনুলিপি মাত্র। ‘এন্ডগেম’ তার ‘ওয়েটিং ফর গডো’র প্রতিলিপি, কিন্তু একটু দুর্বলভাবে।

ম্যাডেলিন গোবেল: আপনাকে আকর্ষণ করে এমন সমকালীন ফরাসী লেখকদের সংখ্যা বেশি কি?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: খুব একটা না। অনেক পা-ুলিপি আমার হাতে আসে। আর এটা বিরক্তিকর যে এর বেশিরভাগ একেবারে খারাপ। বর্তমান সময়ে আমি ভায়োলেট লেদুক'কে নিয়ে উৎসাহিত। তিনি ১৯৪৬ সালে ‘কালেকশন এসপোয়ার’ (ঈড়ষষবপঃরড়হ ঊংঢ়ড়রৎ) পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হন। কামু সম্পাদনা করতেন। আলোচকদের উচ্চ প্রশংসা তাকে আকাশে তুলে দেয়। সার্ত্রে, জেনেট এবং জোহানদু তাকে বেশ পছন্দ করতেন। তিনি কখনও বিক্রি হন নি। সম্প্রতি ‘দ্যা বাস্টার্ড’ নামে একটা দারুণ আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। এর সূচনাংশ ‘দ্যা মডার্ন টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন সার্ত্রে। আমি এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছি। কারণ আমার মনে হয়েছে, যুদ্ধ পরবর্তীকালে অবহেলিত ফরাসি লেখকদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি বর্তমান সময়কালে ফ্রান্সে দারুণ সফলতা পাচ্ছেন।

ম্যাডেলিন গোবেল: সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সিমোন দ্য বোভোয়ার: জানি না। কী দিয়ে কেউ মূল্যায়ন করবে? গুজব, অনুল্লেখ বা উপেক্ষা, অনুসারী, পাঠক সংখ্যা, পাঠকের অভাব, ব্যয়িত সময়ের গুরুত্ব? আমি মনে করি মানুষ আমাকে কিছু সময়ের জন্য পড়বে। অন্ততঃ এজন্য আমার পাঠকরা একথা বলছিল। আমি নারীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় কিছুটা হলেও অবদান রেখেছি। তখন যে চিঠিগুলো পেয়েছিলাম সেসব থেকে এই বিষয়টা বুঝতে পারি। আর আমার কাজের সাহিত্যিক গুণ প্রসঙ্গে, শব্দের সঠিক বোধ থেকে বললে বলতে হবে, আমার সামান্যতম ধারণাও নেই।

সিমোন দ্য বোভোয়ার : সাহিত্য ও দর্শন
রচনা, সংকলন ও ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
দাম ৩৫০ টাকা
প্রকাশক: ঘাসফুল, ঢাকা

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: পাণ্ডুলিপিপাঠ/ শিল্পের শৈলী : সিমোন দ্য বোভোয়ার
পাণ্ডুলিপিপাঠ/ শিল্পের শৈলী : সিমোন দ্য বোভোয়ার
বাঙলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিন বিন্দু। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh1QoZEbG7akRIALtoNysZ4YOjOPDmRg8_7jMznrzhBSgvi3xsq-7UjsASA2qgvAQzjM9fGGhyvrdWkTn34lHkZ_DghpeNWxFiuCLiCAWAKPllmpXVslfkBkQVrXRAXV_KimGu4U5p-i9E2c1OOjRSzOc-RJHC0gwC6DCWNiBL0aHNQHl8jZ-Cobbmj/w320-h200/simon-de%20(bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh1QoZEbG7akRIALtoNysZ4YOjOPDmRg8_7jMznrzhBSgvi3xsq-7UjsASA2qgvAQzjM9fGGhyvrdWkTn34lHkZ_DghpeNWxFiuCLiCAWAKPllmpXVslfkBkQVrXRAXV_KimGu4U5p-i9E2c1OOjRSzOc-RJHC0gwC6DCWNiBL0aHNQHl8jZ-Cobbmj/s72-w320-c-h200/simon-de%20(bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/01/simone%20de-beauvoir.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/01/simone%20de-beauvoir.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy