.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

নয়নচারা: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিপর্ব

নয়নচারা: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিপর্ব
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র(১৯২২-১৯৭১) সাহিত্য জীবন হচ্ছে মূলত গত শতকের চল্লিশ,পঞ্চাশ ও ষাটের দশক। চল্লিশের শুরুতেই কলিকাতার ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় নয়নচারা গল্পটি প্রকাশের পর থেকেই তিনি গল্পকার হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকেন। ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কবি কথাকার ও সমালোচক সঞ্জয় ভট্টাচার্য(১৯০৯-১৯৬৯)। বুদ্ধদের বসুসহ কলকাতার অনেক খ্যাতনাম লেখক ও নবীন লিখিয়েদের আত্মপ্রকাশের অন্যতম স্থান ছিল এই  পূর্বাশা। ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম দিকের অনেক গল্পই পূর্বাশা থেকে প্রকাশিত। আবার বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনেক লেককের গ্রন্থ প্রকাশের ভরষাও ছিলো পূর্বাশা প্রকাশনী। এই প্রকাশন থেকে জীবনানন্দ দাশ, সঞ্চ ভট্টাচার্য, প্রবোধচন্দ্র সেনসহ অনেকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্রও প্রথম গল্পের বই নয়নচারা ১৯৪৫ সালে এই পূর্বাশা প্রকাশনী কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়। মধ্যচল্লিশের এই সময়টা ছিল ওয়ালীউল্লাহ্র জীবনে নান কারনে গুরুত্ববহ। এই পঁয়তাল্লিশে তার পিতা আহমদউল্লাহ্ পরলোকগমন করেন। তখন তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ, অর্থনীতির ছাত্র। একই বছর তিনি কলকাতার অন্যতম ইংরেজী পত্রিকা ‘দ্যা স্ট্টেসম্যান’-এর সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন। এর আগে ১৯৪৩ সালে ওয়ালীউল্লাহ্ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিস্টিংশন সহ বি.এ পাস করেন।

মোটামুটি চল্লিশের দশকটি ছিল তাঁর গল্প লেখার প্রস্তুতি কাল। প্রথম গল্প গ্রন্থ নয়নচারা(১৯৪৫)তে প্রকাশিত আটটি গল্প ছাড়া ও এই সময়ে লিখিত আরো কিছু গল্প পরবর্তীতে প্রকাশিত ‘দুইতীর ও অন্যান্য গল্প’(১৯৬৫) গ্রন্থে স্থান পায়। এই গ্রন্থের ভূমিকাতে ওয়ালীউল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ এ সংকলনের গল্পগুলির কয়েকটি নূতন, কয়েকটি পুরাতন, কয়েকটি প্রকাশিত, কয়েকটি অপ্রকাশিত। দু’টি  আবার প্রথম ইংরেজী ভাষায় লেখা এবং ছাপা হয়। পূর্ব প্রকাশিত গল্পগুলি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেগুলি এ সংকলনের জন্য ঘষামাজা করেছি। নাম বদলেছি, স্থানে স্থানে লেখকের অধিকার সূত্রে অদল-বদল করেছি। (তথ্যসূত্র: আবদুল মান্নান সৈয়দ-সৈয়দওয়ালীউল্লাহ্ পৃষ্ঠা-২৫)। এই চল্লিশের দশকেই ‘নয়নচারা’ গ্রন্থের গল্পসহ বেশ কিছু গল্প কলকাতেই রচনা করেন এবং কলকাতার পূর্বাশা সহ বেশ কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। আর তখন থেকেই ওয়ালীউল্লাহর কথাশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। সমাজ চেতনা এবং ব্যক্তি চেতনাকে ধারন করে মূলত বাংলা কথা সাহিত্যের প্রথম দিকের মুসলিম কথাকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। পরবর্তী দশক পঞ্চাশে তার পথ ধরেই অগ্রসর হন প্রকৃত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু রুশদ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম প্রমুখ।

নয়নচারায় আটটি গল্পের স্থান, পটভূমি ও চরিত্রসমূহ ওঠে এসেছে পূর্ব বাংলার নিম্নবর্গ থেকে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, বরিশাল, খুলনা, যশোর ও ঢাকা অঞ্চলের মানুষের যন্ত্রনাক্লিষ্ট জীবনের পটভূমি নিয়ে গল্পসমূহ পল্লবীত হয়ে ওঠে। আর চরিত্র হিসেবে ওঠে আসে সমাজে অবহেলিত জনগোষ্ঠী ভিখারী, দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষ, মাঝি, দর্জি, চোর, খুনি, বস্তির গাড়োয়ান, জাহাজের সারেং, খালাসি প্রমুখ। আর তাদের জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে ১৯৪৩ এর মন্বন্তর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল। ওয়ালীউল্লাহ্ নিম্নবর্গের সমাজ থেকে ওঠে না আসলেও তাদের মনোজগত্রের যন্ত্রনা, দুঃখ, হাহাকার নিখুত শিল্পের তুলিতে ধারন করেছেন। সমকালীন সেই চল্লিশের লেখকের তুলনায় অনেক অগ্রগামী ছিলেন ওয়ালীউল্লাহ; বিশেষ করে মুসলিম লেখকদের সাথে তুলনা করলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথমদিকের লেখা নয়নচারা গল্পগ্রন্থের আটটি গল্পের দিকে খানিকটা চোখ রাখা যায়ঃ

নয়নচারা: শিরোনাম গল্পটির পটভূমি ১৯৪৩ এর মন্বন্তর। দুর্ভিক্ষপিড়িত সময়কে তিনি শুধু প্রত্যক্ষই করেননি; ক্ষুধার্ত মানুষের তিব্র যন্ত্রনাকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই শিল্পের তুলিতেও অনন্যরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘ভুতনি এবার নাক ওপরের দিকে তুলে কম্পমান জিহ্বা দেখিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেললে ভ্যা করে। কেই দিলো না বুঝি, পেট বুঝি ছিড়ে যাচ্ছে?’

কিংবা-‘নয়নচারা গাঁয়ে কি মায়ের বাড়ি?’ গল্পের এই শেষ উক্তির মধ্য দিয়েই যেন বার বার ফিরে পেতে চায়  ফেলে আসা সেই নয়নচারা গ্রাম আর বয়ে চলা ময়ুরাক্ষী নদী, যার সাথে তুলনা চলেনা যেন তাবাৎ বিশ্বের কোন স্থানের। তাইতো আমুর ক্ষুদার নেশায় মাতাল চোখে এই দুর্ভিক্ষপিড়িত সময়ে কলকাতার অলী-গলিতেও যেন খুঁজে পায় ময়ুরাক্ষী নদী ও সেই নয়নচারা গ্রাম। ক্ষুধার নেশায় জন্মভিটা পূর্ব বাংলা ছেড়ে আধুনিক নগর কলকাতা শহরে ছুটে আশা বুভুক্ষ মানুষের এখানেও স্বপ্নভঙ্গ ঘটে। মনে পড়ে নিজ গ্রাম নয়নচারার ‘ওই তারাগুলোই কি সে বাড়ি তেকে চেয়ে-চেয়ে দেখতো? কিন্তু সে তারাগুলোর নিচে ছিলো ঢালা মাঠ, ভাঙ্গা মাটি, ঘাস, শস্য আর ময়ুরাক্ষী। আর এ তারাগুলোর নিচে খাদ্য নেই। রয়েছে শুধু হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতা, অসহ্য বৈরিতা’। মন্বন্তরের এই অস্থির সময় কে কথাকার ধারন করেছেন কোন সংবাদ প্রতিবেদন কিংবা রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে নয়; অন্তর দৃষ্টি দিয়ে।

‘জাহাজী’ গল্পে ওয়ালীউল্লাহ ভাসমান জাহাজের ভেতর কিছু চরিত্রের নিঃসঙ্গতা আত্মীয়-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং শ্রমিক শ্রেনীর দুঃখ কষ্ট কে বৃদ্ধ করিম সারাঙের জবানীতে জীবন্ত করে তুলেছেন। সাগরও কর্ণফুলি তিরবর্তী অঞ্চল চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলের প্রচুর মানুষের জিবীকা চলে জাহাজের সারেঙ বা খালাসীর কাজ করে। আর এই পেশাটিকে পটভূমি করে তাদের সুখ-দুঃখের বয়েচলা জীবনে একাকিত্বের হাহাকার বৃদ্ধ করিম সারাঙের আঞ্চলিক ভাষার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

গল্পের প্রয়োজনে এসেছে মতিন, ছাত্তার, হাসেম, লস্কর, চীফ অফিসারদের মতে চরিত্র গুলো। জাহাজের ভেতরের জাহাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন নামের সাথেও পাঠকের পরিচয় ঘটে। লেখকের সুক্ষ্ম চিন্তার জাল নিসঙ্গ বৃদ্ধ করিম সারাঙের বোধের মধ্যেই প্রবাহিত। করিম সারাঙের শেষ জীবনের হৃদয়ের শূন্যতাকে জাহাজী জীবনের নিসঙ্গতার সাথে বিলিয়ে দেয়। ওয়ালীউল্লাহর বেড়ে ওঠা সময়ে যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নদী পথে। জাহাজে করে তাঁর প্রচুর যাতায়াত করতে হয়েছে। উপরন্তু জাহাজীদের জীবনাচারন অংকনে চট্টগ্রামেরই শন্তান ওয়ালীউল্লাহ্কে ব্যাগ পেতে  হয়নি। ‘জাহাজী’ গল্পের প্রায় দু দশক পরে (ষাটের দশকে) আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ‘কর্ণফুলী’ উপন্যাসই যেন জাহাজী গল্পের এক পূর্ণাঙ্গ রূপ। কর্ণফুলী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের উপভাষা দিয়ে রচিত জাহাজ নির্ভর জীবনাল্লেখ্য কর্ণফুলীর বৃহৎ ক্যাম্ভাসে রচিত যেন পাঠক জাহাজী গল্পের অমোঘ নিয়তিকে খুঁজে পায়। করিম সারেঙ এর সাথে কর্ণফুলির ইসমাইল সারাঙের সাতসমুদ্রে  নিরুদ্দেশ যাত্রাপথের মিল খুঁজে পায়।

পরাজয়: নদী বিদৌত অঞ্চলে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নানা অঞ্চলে নদী পথে পরিভ্রমন যেন লেখকের জীবনে অনেক খানি রেখাপাত করেছে। নাও ও নদী এবং তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের সুখ--দুঃখ, জয়-পরাজয়ের এক অনবদ্য চিত্র পরাজয় গল্পের পটভূমি। কুলসুমকে বেষ্ঠন করে মজনু, কালু, ছমির যেন এক একটা জীবনের ফোর খাওয়অ চরিত্র।“হুক্কার গুড়গুড় আওয়াজ এবার হঠাৎ থেমে গেলো, ছই-এর গর্ত দিয়ে সশব্দে নদীতে থুথু  ফেলে লোকটা বলে উঠলোঃ- পানিটা কেমুন বোদাঁ-বোদাঁ, গলায় ধরলো না। একটু পরে ছই এর পেঁছন দিয়ে বেরিয়ে এলো কালু,  হাতে তার হুক্কা। সেটি মজনুর হতে দিয়ে সে চলে গেলো সামনে দাঁড় বাইতে হবে। সূর্য তখন অনেকটা উঠে পড়েছে। যেখানে তারা এসে পৌছলো সেটা নদীর তীর নয়, নদীর মাঝখানে জলে ডোবা বিস্তীর্ণ চর।’’

পরাজয় গল্পে নিসর্গ-মেঘ-বৃষ্টি-রোদ আর নদীর জ্বলের ঢেউ একাকার হয়ে যায়-মজনু কালু ও কুলসুম চরিত্রে। শেষ পর্যন্ত কার পরাজয় ঘটে- মজনু-কালুর না সাপের কামড়ে মৃত ছমির কিম্বা তার অসহায় স্ত্রী কুলসুমের। এখানে জীবিতের চেয়ে মৃতের শক্তিই যেন অধিকতর প্রখট। ‘তাইতো মজনু নেবে গেলো নিচে, কালুও উঠে পড়লো। দুজনার মুখই কাঠের মতো নিস্পন্দ’।

মৃত্যুযাত্রা: সমাজের নীচুতলার বাসীন্দাদের ক্ষুধার জালায় জলপথে যে নিরোদেশ যাত্রা মূলত তাই  মৃত্যুযাত্রা গল্পটি। শুরুটি এভাবে-‘অন্ধকার নিবিড় হলেও তবু আবছা আবছা নজরে পড়ে ঘাটে  বাঁধা ছইশূন্য ভারী খেয়া নৌকাটা। আর এই নৌকার একঝাক বুভূক্ষ মানুষই গল্পের নায়ক। চরিত্রের সাথে উপভাষা ব্যবহারে গল্পের শৈল্পিক গভীরতা এবং বাস্তবতা বহু মাত্রায় উৎসারিত।

যেমন:
তৈল কুতি যে বাতি দিবে?
কিন্তু মোর যে বড্ড ক্ষিদে লেগেছে, কদিন মুই পেট ভরে খাতি পাইনি...।
কী জায়গা গো ওই গা ? সোনাভাঙা বোধয়। মতিগঞ্জ কী খুব দূরে হবি?
অসংখ্য মানুষের পেটের ক্ষুধা আর একমুটু অন্নকে নিয়েই অগ্রসর হতে থাকে গল্পের গতি। পাশা পাশি এক ঝাকঁ বুভুক্ষ ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, বৃদ্ধা। ক্ষুধার তারণায় নৌকার মধ্যে অনেকের মৃত্যু যে হাতছানি দিচ্ছে এতেও যেন কারো শোকাতুর হবার কিংবা কান্নার প্রয়োজন নেই্। মৃত্যুই যেন এই ক্ষুধা থেকে পরিত্রানের একমাত্র পথ। এই যাত্রায় শুধু কোন বুড়োর মৃত্যু লাশ তাদের যাত্রায় বিলম্ব কিংবা বাধা সৃষ্টি করে  মাত্র। যারা ঠিকে আছে তাদেরও মনের মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই । ১৯৪৩- এরম মন্বন্তরের চিত্র এতটা রেখাপাত করে কম শিল্পীর তুলেতেই ধরা দিয়েছে।

খুনী: গল্পের রাজ্জাক চরআলেকজান্ডার থেকে ফজু মিঞার ছেলেকে খুন করে পালিয়ে আসে উত্তরবঙ্গের মহকুমা শহরে। আবেদ দর্জির দোকানে আশ্রয় নিয়ে তার হারিয়ে যাওয়া ছেলে মোমেন এর ছদ্ধভেসে ভালোই দিন কাটছিলো। আবেদের পরিবারও তাকে সন্তানতুল্য ভালোবাসতো।রাজ্জাক ও এহ্যান পরিবেশ পেয়ে পরিত্রান পেতে চায় খুনিজীবন থেকে। ফিরে আসতে চায় স্বাভাবিক জীবনে। অনুসূচনার মধ্যদিয়ে ভুলে থাকতে চায় সেই অপরাধকে। দর্জি পরিবারের একজন হয়ে ক্রমাগত দূর্বল হয়ে পরে মোমেনের বিধবা স্ত্রীর প্রতি। সপ্ন দেখে জরিনাকে নিয়ে ঘর বাঁদার । বিষয়টি আবেদ দর্জিকে বলবে; আর  তখনই সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। প্রকৃত মোমেনের প্রত্যাবর্তনে। মোমেনও রাজ্জাকের উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না। আবারো নিরূদেশের পথে পা বাড়ালো রাজ্জাক। খুনী জীবন থেকে যেন পরিত্রান পেল না। রাজ্জাক চরিত্রটি খুনী হলেও তার প্রতি সহানুভূতি ছিলো আবেদ দর্জির ,ভালোবাসা ছিলো তার পরিবারেরও। রাজ্জাকও ভালো হতে চেয়েছিলো। কিন্তু নিয়তি যেমন খুনী বানিয়েছে, তেমনি তার থেকে পরিত্রানও দিল না। এটিই গল্পের মূল উপজীব্য হলেও  গল্পকারের একধরনের সহানুভূতি ছিল খুণী রাজাকের প্রতি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই  সহানুভূতির স্থায়ী রূপ দিতে পারেনি। এই গল্পেও বরিশালএবং  উত্তবঙ্গের উপভাষা ব্যবহারে ওয়ালীউল্লাহ্ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন । দ্বীপ অঞ্চল চর আলেকজান্ডার এর ভাষা এবং উত্তরবন্দের মহকুমা শহরের আঞ্চলিক ভাষার বহুল ব্যবহার গল্পের পটভূমিকে দৃঢ় করেছে । তবে গল্পকারের অপরাপর গল্পের মতো মৃত্যুর বিষয়টি পিছু ছারেনি এই খুনী গল্পেও ।

রক্ত: গল্পের পটভূম্ওি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। একদিকে খাদ্যের হাহাকার , সাধারণ মানুষের চরম উৎকণ্ঠা  অপরদিকে  মুষ্টিমেয় মানুষের অবৈধ টাকা হাতিয়ে  ন্ওেয়া এবং সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা । সামাজিক চরম অব্যবস্থা । ‘খামার শূন্য , দেশে মানুষ মরছেম, মুহূর্তে মুহূর্তে কুকুরের মতো মরছে, আর মৃতের  স্থপের ওপর বাকী লোক  অর্থের স্তুপ গড়ছে।’

রক্ত গল্পের প্রধান চরিত্র  দীঘ সাত বছর  বিশাল সমুদ্রের বুকে  বাস করা খালাসী আবদুল । অপর চরিত্র বুভুক্ষ ক্ষুধার্ত আক্কাস। দুটি চরিত্রকে বেষ্টন করে গল্পের কাহীনি পল্লীবিত হয়ে ওঠে ।  চাকুরি থেকে বখাস্ত অসুস্থ আবদুল স্ত্রী-পুত্হীন । অপরদিকে আক্কাসের ঘরে স্ত্রী রয়েছে আক্কাসের আঙ্গিনার কাটে আবদুল চরম আসুস্ত্র হয়ে পরলে তার স্ত্রী আবদুলকে সেবা দিতে থাকে। তখন আবদুলের হৃদয় রক্তাক্ত। গল্পটিতে নিসঙ্গতা, নারী সঙ্গহীনতাই তিব্র হয়ে ধরা দেয় আবদুলের অন্তরে-বাহিরে । তার এই রক্ত স্নাতক বাহিরে-অন্তরে। একদিকে অবসর জীবন এবং  জীবনের প্রান্ত বেলায় তার এই শূন্যতা যেন  শত রক্ত প্রবাহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ।  গল্পের শেষ সংলাপ : ‘‘এমন দিন কী কখনো আসবে যখন  নিবিড় স্নেহ-মমতায় ডুবে গিয়ে সে বলতে পারবে যে, বিগত কোন একদা ¯েœহ ভালোবাসা শূন্য শুষ্ক প্রান্তরে তার নিঃস্ব রিক্ত হৃদয় দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরেছিলো রক্ত?”

গল্পের নামকরনের যথার্থতা এখানে বিদ্যমান।

খন্ড চাঁদের বক্রতায়: মৃত্যু, ক্ষুধা, যন্ত্রনা, অস্থিরতার পর খন্ড চাঁদের বক্রতায় গল্পে পাঠক ভিন্নস্বাদ-আনন্দ উল্লাসের সন্ধান পায়  বঠে। আর সে কারনে নয়নচারা গ্রন্থের সবকটি গল্পের পটভূমি থেকে এ গল্পের পটভূমি ভিন্ন মেজাজের। গল্পকার বস্তির ধনী জব্বার শেখের  পরিচয় সুরুতেই তুলে ধরেন এভাবে- ‘শেখ জব্বারকে ধনী বলতেই হবে। তার দুটি গাড়ি, দুটি ঘোড়া, জন আটেক চাকর, আর চিকে-ঘেরা অন্দর মহলে চারটি বিবি। আয়-ব্যয় যদি ধনীর লক্ষন হয়ে থাকে, তবে সে ধারনায় যথার্থঃ আয়ের দিকে রয়েছে দুটি ঘোড়ার গাড়ি এবং ব্যয়ের দিকে রয়েছে চারজন বিবি’। বর্ণনা কৌশলেও অভিনবত্ব রয়েছে বটে। এভাবে একটি বস্তির আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে গল্পটি এগিয়ে চলে। আর এই আনন্দের বন্যার অন্যতম কারন শেখ জব্বারের চতুর্থ বিয়ের আয়োজনের ঘটনা। গল্পের পটভূমি গত শতকের চল্লিশের দশকের নগরে ঘোড়া আর গাড়োয়ানদের নিয়ে বস্তী জীবনের এক আনন্দ উল্লাসের দিন-রাত্রি। এর মধ্যেও রাজ্জাকের প্রথম স্ত্রী তার হারানো প্রথম কন্যাটির প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পেলো নতুন কিশোরী চতুর্থ সতীনের মধ্যে। ‘-তার ঠোটটা কি এমন ছিলো। এই নয়া বিবির ঠোটের মতো? আর চিবুকটা কপালটা ঠিক যেন তেমনি। তবে চতুর্থ স্ত্রীর আগমনের মধ্যে আনন্দ-উল্লাসের কমতি না থাকলেও বিষাদের ও শূন্যতার সুরও শুনতে পেল যেন অপর তিন বিবি । এবং এটাই গল্পের সাধারন পরিণতি। চতুর্থ বিবির আগমনটা উপলক্ষ্য হলেও ঘোড়া ও গাড়োয়ানদের জীবনে একটি দিনের উল্লাস, তাদের আঞ্চলিক ভাঙ্গা ভাঙ্গা  উর্দূ সংলাপে গল্পের পটভূমি ও বর্ণনাকে জীবনঘনিষ্ট মনে হয়েছে।

সেই পৃথিবী: সমাজের অন্যায় কারীকে সুপথে ফিরিয়ে আনবার প্রবণতা এই গল্পের একটি অন্যতম গন্তব্য। একজন হত্যাকারি (খুনী গল্পে) কে অনুসূচনার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসার চেষ্টার মতো ‘সেই পৃথিবী’ গল্পেও চোর সাদেকের মানসিক পরিবর্তন ও লক্ষনীয়। সাদেক চুরি করতে গিয়ে ফুটোদিয়ে একজন নারীর অনবৃত্ত স্তন দেখতে পায়। চোর সাদেকের মনে হয়েছে এই মাত্রশিশুটিকে দুধ পান করিয়ে ঘুম পারিয়েছে। আবারও শিশু  জেগে উঠলে মা তাকে গান গেয়ে স্তনদান কওে ঘুম পাড়াবে। এ রকম দৃশ্য ও চিন্তা থেকে চোর সাদেকেরও বড় রকমের মানসিক পরিবর্তন ঘঠল। বন্ধুদের মদের আড্ডায় আর মন বসাতে পারে না। এই সুন্দর পৃথিবীতে সৎপথে চাকুরি করে জীবন কাটাতে চুরি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। বস্তুত লেখক সাদেক চরিত্রের মধ্যদিয়ে মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘঠিয়ে একটি সুখি-সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। সেই পৃথিবী অন্ধকার পৃথিবী থেকে এক শিশুর মতো ঝলমলে আলোর পৃথিবী।

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ যখন প্রথম গল্প লেখায় হাত দিলেন তখন তার চিন্তাশক্তি গ্রাস করে নিল প্রথম জীবনে দেখা বাংলাদেশের শিল্পকর্মে মানুষেরই জীবনছবি। প্রথম গল্পগ্রন্ত নয়নচারা সমকালীন নি¤œবর্গের দু:খক্লিষ্ট জীবনাচরনই ঘুরে ফিরে প্রতিফলিত হয়েছে। আটটি গল্প ছাড়াও চল্লিশের দশকে লেখা তারঁ আরো কিছু গল্প চিলো যা পরবর্তীতে দুইতীর ও অন্যান্য গল্পে প্রকাশিত হয়। নয়নচারায় আটটি ওদুইতীরের নয়টি সহ মোট ১৭ টি গল্প গ্রন্থভ’ক্ত হলেও ওয়ালীউল্লাহ্ গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ অনেক অনুসন্ধান করে তার আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ২৭ টি গল্পের সন্ধান পায়। সে হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্র গল্প সংখ্যা ৪৪টি। এর বাইওে ইংরেজী, ফরাসি ভাষায় ও তার কয়েকটি গল্প থাকতে পারে এমনটি ধারনা করেন গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ। তবে চল্লিশের দশকেই তিনি মূলত অধিকাংশ গল্প রচনা করেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনের প্রথম অংশের গল্প রচনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে যেন মনে হয় অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক তিনটি উপন্যাস ও নাটকের মতো বৃহৎ পরিসরে প্রস্থান করে কথাশিল্পে অধিকতর দক্ষতার পরিচয় দেন।

ওয়ালীউল্লাহ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পর কলিকাতার দ্যা স্টেট্সম্যান পত্রিকার চাকুরী ইস্তফা দিয়ে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। আর সেই সময়ে ঢাকার নীমতলীতে বসে সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাল সালু’ রচনা করেন। এবং পরবর্তীতে ঢাকা কমরেড পাবলিশার্স থেকে ১৯৪৮ সালে ‘লালসালু’ বই আকারে প্রকাশিত হয়। লালসালু থেকে চাদেঁর অমাবস্যা (১৯৬৪) হয়ে কাদোঁ নদী কাদোঁ (১৯৬৮) যেন নিখুত পরিকল্পীত ভাবে পূর্ব বাংলার এক ঘোর অন্ধকার থেকে ক্রমাগত আলোর দিকে, সভ্যতার দিকে সমাজকে নিয়ে যাত্রা করেছে এবং সে যাত্রা কাঁদো নদী কাঁদোতে এসে পরিসমাপ্তি ঘঠে। তারঁ উল্লেখযোগ্য তিনটি নাটক রয়েছে। বহীপির গ্রন্থকাওে প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে গ্রীন বুক হাউস ঢাকা থেকে। তরঙ্গভঙ্গ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে। সুরঙ্গ ও ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পোষন করেন। তারমতে সাহিত্য রচনা কোন পেশাদারি ব্যবসা নয়, কিংবা সুখ্যাতি অথবা সামাজিক মর্যাদালাভের বাহকও । একজন লেখক তখনই সৃষ্টিকর্মে আত্মনিয়োগ করেন যখন তিনি কোনবিশেষ সত্য প্রকাশের জন্য প্রানিত ও সংকল্পবদ্ধ হন, যন্ত্রনা ও আন্তরিক আবেগে হন উদ্বুদ্ধ। ওয়ালী উল্রাহের জীবনাচরন ও শিল্প কর্মকে বিশ্লেষণন করলেও এই উক্তির সত্যতা প্রতিয়মান হয়। এক আলোকি পরিবেশেচট্টগ্রামের ষোলশহরে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে উঠা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনকেও নির্মান করেছেন সেভাবে। তিনি পিতৃ-মাতৃ উভয় দিকেই ছিলেন শিক্ষিত-অভিজাত এক মুসলিম পরিবারের সন্তান। পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ্ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর এম.এ. এবং উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা নাসিমা আরা খাতুন। ফটিকছড়ির নারায়ন হাট নিবাসী নানা আবদুল খালৈক সেন্টজেভিয়াস কলেজ থেকে আইনে স্মাতক। মামী রাহাতআরা বেগমও ছিলেন উর্দু লেখক (রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের জনপ্রিয় উর্দু অনুবাদক)। মামাত ভাই বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম প্রবাস জীবন থেকে নিজ বাসভূমে (চট্টগ্রাম) ফিরে এলে তার সাক্ষাতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র দেশে ও বিদেশের জীবনাচার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। আমাদের পার্শ্ববতী ইউনিয়ন নারায়নহাটে বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম একদিন নিজ বাস্তুভিটা দেখতে গিয়ে স্মতিচারনে বলেই এই  ইদুলপুর গ্রাম শুধু আমার নয়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মায়ের ও বাস্তুভিটা এই গ্রামে ওয়ালীউল্লাহ্র পদদুলিও পরেছে। ওয়ালীওল্লাহ্ শেষ জীবনে কর্মসূত্রে প্রবাস জীবন অতিবাহিত করলেও মনে প্রাণে ছিলেন পুরো স্বদেশী, যা তার সৃষ্টিকর্মেও প্রতিয়মান হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে তারঁ কবর জন্মমাটি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে না হয়ে সুদুর প্যারিসে কেন?

বোদ্ধা সাহিত্যিক প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের সাথে ১৯৪৬ সালের দিকে কলকাতায় কাজী আফসার উদ্দীনের ‘মৃত্তিকা’ অফিসে আড্ডা হতো ওয়ালীউল্লাহ ফররুখ আহমদ কামাল রহিম চৌধুরী। তিনি তখন অভিজাত ইংরেজি পত্রিকা দ্যা স্টেট্সম্যান এর সাব এডিটর। ব্যাক্তি ওয়ালীউল্লাহ্ এবং তারঁ গল্প সম্পর্কে আলী আহসানে মন্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য-‘ ওয়ালীউল্লাহ্ কে দেখলে মনে হয় তিনি অনেক দুরবর্তী। তারঁ দীর্ঘআয়তন দেহ, সুডৌল কপোল, তীক্ষন চিবুক এবং নাসিকা সকলের মনে একটি সমভ্রমের ভাব আনত্। কিন্তু কথার উচ্চকন্ঠে ওয়ালিউল্লাহ্কে যখন পেতাম তখন নিবিড়ভাবে পেতাম।ওয়ালীউল্লাহ বাংলাতেও গল্প লিকতেন ইংরেজিতেও গল্প লিখতেন।গল্প রচনায় তিনি ছিলেন অদম্য সাহসী। তীক্ষন ইঙ্গিত এবং তীর্যক ভাবে একএকটি চরিত্রের অন্তর্নিহিত সত্তাকে তিনি উদঘাটন করতেন। তারঁ গল্পের চরিত্র গুলো টাইপ চরিত্র ছিলনা, ছিল সজীব মানুষ, কখনও দূর্বলতায় বিপর্যস্ত কখনও অহমিকায় দূর্বিনীত’। ( সৈয়দ আলী আহসান সতত স্বাগত, পৃ:১৫৭)

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্ম ও বেড়ে ওঠার মধ্যে যেই জীবন প্রত্যক্ষ করেছেন সেই চারপাশকে দিয়েই তারঁ সমস্ত সাহিত্য পল্লবীত হয়ে উঠেছে।জীবনের দ্বিতীয় পর্বে যে আধুনিক পাশচাত্য জীবনমনষকতা তারঁ পরিচয় গড়ে ওঠে তা কিন্তু সাহিত্যের কোথাও প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৪৩ সালের ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ তার গল্পে ঘুরে ফিরে স্থান করে নিয়েছে। লেখক নিজে উচ্চবংশ এবং অবস্থাপন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠলেও চার পাশের দু:খক্লিষ্ট জীবনই তাকে গভীর ভাবে রেখাপাত করেছে এবং গল্পের পটভ’মিতে উপজীব্য হয়ে ওঠে। তার গল্প গুলো চরিত্র নির্ভর নয়-ঘটনা নির্ভর। এবং মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতায় মোড়া। তবে অনেক সময় ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পের ভাষায় জড়তা আছে বলে মনে হয় ভাষা যেন ঝরঝরে বেরিয়ে এসে অগ্রসর হতে চায়না, পাঠরত অবস্থায় যেন খানিকটা হুচট খেতে চায়। তবে তারঁ উপমাগুলো যেন মাটির সোধা গন্ধ থেকে ওঠে আসে যেমন-

১. অথচ ঘুম লেগে থাকে জোকের মতো (নয়নচারা)
২. মানুষের প্রান যেন বেলেমাছের মতো কালো ধরনীর বুকে কিলবিল করছে (খন্ড চাঁদের বক্রতায়)
৩. মৃত্যু যেন তাকিয়ে রয়েছে কালো জীবনের পানে (মৃত্যুযাত্রা)
৪. তারপর ঝরা শুকনো পাতার মতো।
অস্পষ্ট শুষ্ককন্ঠে বলে উঠলো (পরাজয়)।

ঘটনা প্রবাহ এবং চরিত্রকে অধিকতর জীবনঘনিষ্ট করে গড়ে তুলবার তাগিদে লোকচরিত্রের মুখে উপভাষার ব্যবহার কথাশিল্পের এক শৈল্পিক নৈপূন্য। বাংলা কথাসাহিত্যে এই নৈপুন্যের প্রকাশ ঘটেছে পদ্মানদীর মাঝি, পটলডাঙার পাঁচালী, কর্ণফুলি, নীলদর্পন ইত্যাকার উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থে। এদের সাথে প্রাজ্ঞ কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নয়নচারা গ্রন্থেও সকল গল্পেরই উপভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ পরিলক্ষীত। গল্পের স্থান ও পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের নীচুতলার বাসীন্দাদের মুখের ভাষা- চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, যশোর, বরিশাল, খুলনা ও ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সার্থক ব্যবহারে তার মুনসীয়ানা রয়েছে।

তারঁ গল্পের পটভূমি চরিত্র ও বিষয় সবই ওঠে এসেছে গ্রাম জীবন থেকে। গল্পের চরিত্র সমূহও দারিদ্রক্লিষ্ট, ভাঙ্গা ও দুমড়ানো-মুচড়ানো মানুষেরই গল্পকথা। চরিত্রকে অধিকতর গ্রহনযোগ্য করে তুলার নিমিত্ত্বে তিনি সফল ব্যবহার দেখিয়েছেন অঞ্চল ভেদে আঞ্চলিক ভাষার সমূহের সাগর-নদী জলরাশির কাছে কথাকারকে বার বার ফিরে যেতে দেখি। নয়নচারার অধিকাংশ গল্প-নয়নচারা, জাহাজী, পরাজয় গল্পে সাগর নদী বেষ্টিত দ্বীপাঞ্চলের মানুষদের সাথে ভাসমান নাও-জাহাজ ও জলের খেলা যেন তারঁ সৃষ্টিশীলতায় আস্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে যেকোন লেখককে জীবনবাস্তবতার ভিতর ও বাহির দুটি দিকই নজর রেখে চলতে হয় । তবুও অনেক শিল্পরী নির্মানে বাইরের দিকটি অধিক উজ্জ্বল হয়ে উঠে। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্র রচনা সমূহের ক্ষেত্রে জীবন বাস্তবতার ভিতরের দিকে চলবার প্রবণতাটিই বেশী। সেটি তারঁ গল্প কিম্বা উপন্যাস উভয়ের ক্ষেত্রে। তবে জীবনবাস্তবতায় ক্ষুধা-লাঞ্চনা আর দুখক্লিষ্টে যে জীবন পৃষ্ট তাকেও পাশকাটিয়ে যায়নি। নিম্নবর্গের চরিত্র চিত্রনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগোত্রিয় কথাসাহিত্যিকরা যেখানে ক্ষুধার সাথে আর এক মানবি প্রবৃত্তি রিরংসা কে নিয়ে পাশাপাশি হেটেছে, সেখানে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যের ক্ষেত্রে ক্ষুধার তারনায় যেন জৈবীক চাহিদা রিরংসা চাপা পড়ে গেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে আমরা যদি একজন প্রকৃত জীবনশিল্পী হিসেবে দেখতে চাই তাহলে পরে জীবনের সকল অনুসঙ্গই শিল্পে ওঠে আসা সংগত বৈকী। কিন্তু তিনি তার গল্পের শরীর বুননে প্রাধান্য দিতে অধিক স্বাচ্ছন্ধ বোধ করেছেন মৃত্যুমুখী জীবনের ; যা শিল্পরসের ক্ষেত্রে একধরনের ঘাটতিই বলা চলে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখালেখির জগতে প্রবেশের আগে পূর্বপ্রস্তুতির সময়কাল মূলত গত শতকের তিরিশের দশক। স্কুল-কলেজের শিক্ষাজীবনে বাবার সরকারি চাকুররি বদলিজনিত কারনে তাকেও দেশের নানা স্কুল কলেজ পরিবর্তন করতে হয়। নতুন নতুন স্থানে গিয়ে তাঁকে খাপ খাইয়ে নিতে সময় নিতে হতো। আর এই সময়টাই ছিল তার প্রচুর পঠন-পাঠনের সময়।

আধুনিক শিক্ষামনস্ক পরিবার হওয়াতে ঘরে বইপত্রের অভাব ছিলনা। তারঁ এই প্রচুর পাঠাভ্যাসই তাঁেক পরবর্তিতে লেখার দিকে ধাবিত করে। সম্ভবত তিনি এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গল্পের স্বাদ আতস্থ করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখালেখির সময় যেখানে শেষ (একচল্লিশ) ওয়ালীউল্লাহর লেখার শুরু কিন্তু সেখান থেকে অর্থাৎ চল্লিশের দশকেই তার নয়নচারা গ্রন্থে গল্প গুলো রচিত হয়। গল্পের পটভহূমি ও চরিত্রচিত্রনে একটি বিষয় কিন্তু উভয় কথা শিল্পীর মেলবন্ধন লক্ষনীয়। জমিদার পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথের কিন্তু সমাজের নি¤œবগের্র মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ কখনো হয়নি। কিন্তু তারঁ গল্পের অসংখ্য চরিত্র ও পটভূমি রয়েছে তাদের জীবানাচরনকে বেষ্ঠন করে। পোস্টমাস্টার গল্পের রতন চরিত্র এবং ছুটি গল্পের ফটিক চরিত্র নিয়ে চিন্তা করলে প্রতিয়মনা হবে জমিদারী দেখাশুনা করতে আসা রবীন্দ্রনাথের কাচারী বাড়িতে একটি পোস্টাফিস থাকতেই পারে; তবে সেই পোস্টমাস্টার কিম্বা রতনের সাথে কখনোই রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিলনা বা যোগাযোগ ঘটেনি। তৎরুপ জমিদারী দেখাশুনা করার জন্য বোডে করে রবীন্দ্রনাথ কে পদ্মারবুকে ভাসতেহলে, হয়তো তিনি বোর্ড থেকে দেখেছেন  নদীতীরে কিছু বালক একটি গাছের গুড়ি ঠেলে নদীতে ফেলেছে কিম্বা নদীতীর বেয়ে কলসিকাঁখে কোন গায়ের বধূ পানি নিতে এসেছে কিন্তু তাদের সাথে কথাবলা বা মেলামেশার কোন সুযোগ ছিলনা তথাপি, তিনি একজন রতন, ফঠিক কিম্বা হরিপদ কেরানির বৌ এর মনোজগতে অনায়াসে বিচরন করেছেন। এর মূল কারন রবীন্দ্রনাত প্রথমত একজন বড়মাপের দার্শনিক তারপর একজন কথাসাহিত্যিক। তদরূপ ওয়ালীউল্লাহ্র নয়নচারা গল্পগুলোর পটভূমি ও চরিত্রের দিকে দৃষ্টিদিলে প্রতিয়মান হবে তিনি উচ্চবংশিয় পরিবারে বেড়ে ওঠেছেন সত্য কিন্তু তার অধিকাংশ গল্পের পটভূমি ও চরিত্র নি¤œবর্গের সমাজ থেকে ওঠে আসা। একজন ভিক্ষুকের ক্ষিধার জ্বালা, একজন চোর বা খুনির মনোজগৎ আবিষ্কার এবং বৃদ্ধ সারাঙের হৃদয়ের শূন্যতাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন তার দর্শন চিন্তা থেকে। সুতরাং কোন সফল চরিত্র চিত্রায়নের ক্ষেত্রে একজন সৃজনশীল লেখকের অভিজ্ঞতার চাইতেও দর্শন চেতনা অধিকতর কার্যকর। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র নয়নচারা সৃজনশীলতার প্রথম ধাপ হলেও সুক্ষ্ম দর্শন চেতনায় স্বাথর্ক সৃষ্টি।

নয়নচারা: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিপর্ব
শাকিল আহমদ

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: নয়নচারা: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিপর্ব
নয়নচারা: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিপর্ব
জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। নয়নচারা: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথাসাহিত্যের প্রস্তুতিপর্ব
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/w320-h160/syed-waliullah(bindu).png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/s72-w320-c-h160/syed-waliullah(bindu).png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/01/prelude-to-syed-waliullahs-fiction.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/01/prelude-to-syed-waliullahs-fiction.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy