.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সন্ধান

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সন্ধান
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক স্বনামধন্য ও শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ষোল শহরে ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট এক অভিজাত পরিবারে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ ছিলেন ব্রিটিশ আমলের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী । ওয়ালীউল্লা্হর মাতামহ ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের আইনের স্নাতর।তাঁর মামী রাহাত আরা বেগম ছিলেন তখনকার সময়ের এক নাম করা লেখিকা।রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটক এবং ‘নিশীথে’ গল্প তিনি উর্দুভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ওয়ালীঊল্লাহর পিতা বিশ্বযুদ্ধের সময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে করমে নিযুক্ত হন । বাংলার বিভিন্ন মহকুমায় এস.ডি.ও পদে কাজ করার পর ১৯৪৪ সালে তিনি বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদে উন্নীত হন। পরের বছর ঐ পদে ময়মনসিং জেলায় চাকরি সুত্রে চলে আসেন। পিতার এ হেন উচ্চ পদে কর্ম ও পরিবর্তনশীল কর্মজীবনে ওয়ালীঊল্লাহ ও আবাল্য পিতার সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সংগে মেলামেশার সুযোগ বাল্যে ও কৈশোরে তিনি পান নি। যে কারণে তিনি ছোটবেলা থেকেই অনেকটা কল্পনা প্রবণ ছিলেন। বইয়ের জগত কে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর মনের দোসর হিসেবে। ‘একটি  স্কুল ও সে এলাকার স্মৃতি হৃদয়ে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পূর্বেই তাকে সে সব ছেড়ে যেটে হয়েছে পিতার পরবর্তী নতুন কর্মস্থলে সেখানে ভিন্ন পরিবেশে অচেনা সহপাঠী ও অপরিচিত এলাকাবাসীর সঙ্গে নতুন করে ঘনিষ্ট,আন্তরিক ও অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয় সময় তিনি পাননি। কারণ আবারো পিতার হয়েছে অন্যত্র বদলি। ফলে সব সময়েই এক ধরণের সীমাহীন একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা বোধ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সত্ত্বায় আমূল প্রোথিত ছিল ।’১ 
পিতার কর্মস্থলে তাঁর ছাত্রজীবন পরিবর্তিত হওয়ার ফলে একটি কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা জনগোষ্টীকে তিনি নিজের বলে ভাবতে পারেননি ; বরং সমগ্র বাংলাদেশ ও তার সমগ্র ভৌগোলিক সত্ত্বার প্রতি মমত্ববোধ করেছেন। 

ওয়ালীউল্লাহ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘দ্য স্টেটসম্যান’পত্রিকায় ১৯৪৫ সালে অয়ালীঊল্লাহ প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। তখন তিনি কলকাতার বাসিন্দা। লেখালেখি শুরু বলা যায় অনেক আগে থেকেই। তখন ফেনি হাইস্কুলে পড়তেন। সময়টা ১৯৩৬ সাল। তিনি স্কুলের ম্যাগাজিন সম্পাদক ছিলেন।প্রথম গল্প ‘হঠাৎ আলোর ঝল্কানি’(১৯৪১) ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে বের হয়। এইসময় ‘ চিরন্তন পৃথিবী ’নামে গল্প টি প্রথম ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় (১৩৪৮) বঙ্গাব্দের পৌষসংখ্যায় ছাপা হয়। তখন ওয়ালীঊল্লাহ ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ নয়নতারা’ (১৯৪৫) কলকাতার ‘পূর্বাশা’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর চাকরি পরিবর্তন হয়। দেশভাগ । ১৯৪৭ সালে রেদই পাকিস্থান ঢাকা কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে যোগ দেন । তখন তিনি ঢাকার বাসিন্দা । এইপর্বে তাঁর সৃষ্টি বিচিত্র পথে প্রবাহিত  ‘মাসিক মহাম্মদী’, ‘মাসিক সওগাত’, ‘অরণি’ , ‘পূর্বাশা ’ ,’চতুরঙ্গ ’, ‘পরিচয়’ , ‘দৈনিক স্বাধীনতা’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর গল্প ও প্রথম উপন্যাস’ প্রকাশিত হতে থাকে। ‘লালসালু’ (১৯৪৮) উপন্যাসটি ঢাকার ‘কমরেড পাব্লিশার্স’ প্রকাশ করে। এ সময়ে ওয়ালীঊল্লাহ দিল্লির পাকিস্থানী দূতাবাসে তৃতীয় সেক্রেটারির পদে কর্মরত। তাঁর পরবর্তী কর্মজীবন শুরুহয় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে।তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস’ চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) এবং তৃতীয় উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮)। এই দুই উপন্যাস রচনাকালে তিনি প্যারিসে অবস্থান করতেন। ওয়ালীউল্লাহ বহুপ্রসূ লেখক ছিলেন না। তিনটি উপন্যাস ,তিনটি গল্প গ্রন্থ ও একটি নাটিকা নিয়ে তাঁর সাহিত্যভুবন নাটক ‘বহিপীর’ এর জন্য পেয়েছিলেন পি.ই.এন.আঞ্চলিক পুরস্কার। ‘লালসালু’ উপন্যাসের জন্য ১৯৬১ সালে পেয়েছিলেন ‘সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার’।গল্প গ্রন্থ “দুই তীর” এর জন্য ১৯৬৫ সালে “আদমজী” পুরস্কার লাভ করেন । আর ‘বহিপীর’ নাটকের জন্য ‘জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা’ পুরস্কার ইত্যাদি তে ভূষিত হলেও এই সব বাহ্যিক বিষয়ে তিনি খুশী হবার থেকে সাহিত্যসেবা করে অনেক বেশী আনন্দ পেতে এবং আনন্দ দিতে চাইতেন।এই পর্বের সাহিত্য আলোচনা করতে গিয়ে সুশীল জানা বলেছেন-–“ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের ঝোঁক মনঃসমীক্ষণের দিকেই বেশি।”

‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসে ওয়ালীঊল্লাহ মনঃসমীক্ষণের স্তর অতিক্রম করে আমাদের নিয়ে যান অন্যতর বাস্তব। এসময় ওয়ালীঊল্লাহ প্যারিসে থাকতেন। বেকেট, কাম্যু,কাফকা,সার্ত্র ইত্যাদি ফরাসি সাহিত্য ও দার্শনিকদের অস্তিত্ববাদ, কিংবা সমকালে উদ্ভুত নানা ইজমধর্মী সাহিত্য আন্দোলনের দ্বারা তিনি প্রভাবিত ছিলেন। উপন্যাসে কুমুরডাঙ্গা এক ছোট্ট শহর। শহরটি বাকাল নদীর তীরে অবস্থিত। যে নদী এক সময় ছিল খুবই খরস্রোতা। তার যৌবন উচ্ছল স্রোতে ভেসে যেত জোটবাঁধা কচুরিপানা। আর মাঝে মাঝে স্রোতের ঝড়ে মাল বোঝাই নৌকা হত টলমল। এইভাবে কুমুরডাঙ্গার জীবন চোলোমাণ নদীর মত চলেছিল বয়ে। শহরের উপকণ্ঠেই স্টিমার ঘাট। এই শহরের অধিবাসীদের অন্য শহরে যাতায়াতের জন্য স্টিমার ,লঞ্চ, নৌকা ই প্রধান মাধ্যম ছিল। বাকাল নদীর জীবন চাঞল্যে মখরিত ছিল কুমুরডাঙ্গা শহরের প্রাণ। স্টিমার যাত্রীদের কথক তবারক ভুইঞার মুখেই প্রথম কুমুরদাঙ্গার ভবিষ্যৎ দুর্ভাগ্যের কথা জানা যায়। সে জানায় যে শহরবাসীর অজান্তেই বাকাল নদী অগভীর হয়ে ষ্টীমার চলাচলের অযোগ্য হয়েপড়েছে। হঠাৎ এক সরকারী নোটিশে খবরটি চাউর হয়। ঘাটের স্টেশন মাস্টার খতিব মিয়াঁ কম্পানির ‘তার’ মারফত প্রথম জানতে পায় যে ,বাকাল নদীতে চড়া পড়ার জন্য স্টিমার চলবে না। লেখক ওয়ালীউল্লাহ নদীর চর জেগে ওঠার ঘটনা বিবৃত করার মধ্যদিয়ে দুটি সমান্তরাল বাস্তবের বয়ন করেছেন। বাকাল নদীতে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়েগেলে মানুষের জীবন জীবিকার উপর ভীষণ প্রভাব পড়বে।চাষি, মজুর,ডাক্তার,রুগী, উকিল এককথায় সবস্তরের মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন। অন্যদিকে মুহাম্মদ মুস্তাফার জীবনের ভাগ্যচক্র, তার মনের গভীরে ঘটেচলা ঘটনার স্তর পরম্পরার এক অন্তর্লীন বাস্তবতার বয়ন করেছেন যা জাদুবাস্তবতা নামে পরিচিত। এই আলোচনায় সেই জাদু বাস্তব কে ধরার চেষ্টা করা যেতে পারে। 

সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার প্রতিফলন ঘটবে এটা স্বাভাবিক। সেই বাস্তবতার কাঠামোর উপর কথক যখন কল্পনা,স্বপ্ন এবং ফ্যান্টাসির মিশ্রনে আমাদের সামনে অন্য এক বাস্তব কে তুলে ধরেন তখন তা হয়ে উঠে যাদুবাস্তব। বাস্তবতার এই নতুন ধারনাটি পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে বাংলা সাহিত্যে এসেছে। বাংলা কথা সাহিত্যে বিশ শতকে অনেক নতুন প্রবণতা সংযোজিত হয়ে জগত ও জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিয়েছে। লেখকের মনেহয় বাস্তবে বাস্তবে যা দেখি–শুনি–বুঝি তার অনেক খানি আমাদের পারিপার্শ্বিক প্রয়োজন মেটায়, মনের অভিলাষ সেখানে অপূর্ণ থেকে যায়। এই অপূরণীয় স্বাদ মেটাতে লেখক তখন বাস্তবের সীমা অতিক্রম করে পৌঁছে যান কল্প বা জাদুবাস্তবে।ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘জীবন রহস্য’-গ্রন্থে এই উপলব্ধির কথা প্রসঙ্গে বলেছেন--‘‘আসলে লেখার বীজে যখন ভাষা দিয়ে যখন কিছুতেই পৌঁছতে পারিনা, তখন অস্থিরদশায় অই সব পাগলামির জায়গায় পৌঁছে যাই।” (জীবনরহস্য, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা,১৪১৪, পৃষ্ঠা-২১৩) এইভাবেই হয়তো লেখক তাঁর কাঙ্ক্ষিত বিষয় ও ভাব কে ধরার চেষ্টা করেন ওয়ালীউল্লাহ আশৈশব কল্পনাপ্রবণ এবং আত্মমগ্ন স্বভাবের ছিলেন। তিনি কল্পনা দিয়ে চরিত্রের ও সমাজের অন্তর্বাস্তবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। জগদীশ গুপ্তের কথায় ‘উন্মুখ প্রবৃত্তি’ আর ‘মনোভাবের বিশ্লেষণ’ আছে ওয়ালীউল্লাহ্র সাহিত্যে। হায়াৎ মামুদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন—‘‘তিনিবস্তুজাগতিক বিশ্বের ও বাস্তবের মাঝামাঝি এক প্রদোষান্ধকারে নিয়ে যান আমাদের।” (গল্পসমগ্র, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, ভূমিকা অংশ, হায়াৎ মামুদ,প্রতীক, ঢাকা, বাংলাদেশ, ২০১৭)

নদীর বুকে চর জেগে ওঠার কাহিনী প্রথমে কুমুরডাঙ্গার মানুষ বিশ্বাসই করেনি। আবহমান কাল ধরে বয়ে চলা জীবন কি হঠাৎই বন্ধ হতে পারে তাই প্রাথমিক ভাগ্য বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে সবাই স্থির করে নদীতে চড়া পড়ার কাহিনী সত্য নয় এবং স্টিমার না আসার ও কোন কারণ নেই। কুমুরডাঙ্গার ব্যবসা সফল নামকরা আইনজীবী কফিলউদ্দিন,কিছু ব্যবসায়ী,ডাক্তার,উকিল মোক্তার–হেকিমদের নিয়ে তাঁর বৈঠক খানায় সরকার তথা কোম্পানি বাহাদুরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করেন। শেষপর্যন্ত মানুষের মনের সন্দেহ ঘোঁচে না। পাশেই অবস্থিত কামালপুর শহরের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির ফলে কুমুরডাঙ্গা ক্রমে তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে, ইত্যাদি নানা যুক্তিজালের মধ্যে মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। ক্রমে মানুষের মনে ও ধীরে ধীরে চড়া জাগে। তারা এবার বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাদের জীবনে স্টিমার আর ফিরে আসবে না। ওয়ালীউল্লাহ্ বাস্তব এবং বাহ্যিক সমস্যাটিকে অন্তরের চেতনার গভীরে চারিয়ে মানুষের ভেতরকার মননের উন্মোচন করেছেন উপন্যাসে । মনের অসুখের মতো এক দুর্ভাগ্য তাড়িত দুঃস্বপ্ন সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের মণ থেকে ক্রমে বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে । লেখকের বয়ানে বাস্তব অনেক সময় চেতনার গভীরে পরাবাস্তব, কখনো বা মায়াবাস্তবে পৌঁছে যায় । 

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুহাম্মদ মুস্তাফার জীবন কুমুরডাঙ্গার কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মুস্তাফার বাবা খেদমতউল্লাহ্ ও মা আমেনা খাতুন।বাপের ইছহা ছিল ছেলে উকিল হবে।সেই ইচ্ছাপূরণের আগে খেদমতউল্লাহ্ খুন হন। অনেক কষ্টে শিক্ষা লাভ করে সে আজ উকিল হয়েছে। তার জীবনের করুণ এক অতীত লেখকের বয়ানে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। এই দুই সমান্তরাল কাহিনী ওয়ালীউল্লাহ্র রচনাগুণে পাঠকের মনে এক লৌকজা–অলৌকিক ও মায়ার জগত সৃষ্টি করেছে। 

উপন্যাসের শুরু হয়েছে  কুমুরডাঙ্গা নামক ছোট্ট মহকুমা শহরের কথা দিয়। লেখক বলেছেন –“কুমুরডাঙ্গা শহর এমনই এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে রেলগাড়ির মতো লৌহদানব তো দুরের কথা তেমন একটা সড়ক ও কল্পনাতীত ছিল যে-সড়ক বর্ষাকালে তলিয়ে যাবে না, বৃষ্টি তে ভেসে যাবে না। নদী-খাল–বিল এবং বিস্তীর্ণ জলাভূমি পরিবেষ্টিত শহরটির জন্যে দ্রুত যানবাহন হিসেবে যে–স্টীমার ছাড়া আর কোন গতি ছিল না সে-স্টীমার ও বন্ধ হয়ে যায় ।” 
এই বর্ণনায় শহরের দুরবস্থা যেমন প্রকাশ হয় তেমনি মনে হয় কুমুরডাঙ্গা শহর আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া বঞ্চিত । কোন এক দূর অতীত যেন বর্তমানের সামনে পরদা সরিয়ে উঁকি  দিচ্ছে।শহরের উপকন্ঠে যে বাকাল নদী, বর্তমানে তার ক্ষীণ স্রোত নিয়ে কোন রকমে বয়ে চলেছে । অথচ এই বাকাল নদী এক সময় ছিল-“অতিশয় খরধার বিশাল নদী যার অপর তীরে প্রতি শরত কালে মাঠের পর মাঠ ঢেকে বিস্তৃত কাশবন রূপালি শুভ্রতায় ধবধব করত, যার দ্রুতগতি স্রোতে ভেসে যেত জোটবাঁধা অজস্র কচুরিপানার দল এবং নূতন হাঁড়ি–পাতিলে বোঝাই ডুবু-ডুবুপ্রায় অসংখ্য কুমোর নৌকা, মধ্যে মধ্যে ঝড় এসে যার পানিতে তুমুল তরঙ্গমালা সৃষ্টি করত আর যার গভীরতাসূচক গাঢ় রঙ দ্বিপ্রহরের সূর্যালোকেও হাল্কা হত না ।”৪-এ বর্ণনায় নদীর কায়ারূপ মায়াময় আবেশে তার অতীতের পূর্ণরূপ নিয়ে পাঠকের মনোদর্পনে ধরা দেয় । 

সেই নদীতেও চড়া জাগে , স্টিমার নাকি চলবে না, এ যেন কুমারডাঙ্গার অধিবাসীর কল্পনার অতীত বিশ্বাস কে ও আঘাত হানে।একবার উজানে একবার ভাটিতে দু-বার কুমুরডাঙ্গার নদীঘাটে জীবন স্পন্দন জাগিয়ে যে স্টিমার আসা যাওয়া করেছে, সে স্টিমার নাকি আসবে না ।স্টিমার আসবে না।কোম্পানির এই সংক্ষিপ্ত ও আকস্মিক তারে স্টেশনমাস্টার খতিব মিয়াঁ স্টিমার ঘাটের অফিস ঘরে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল ।কুমুরডাঙ্গার সমস্ত বৃত্তির জীবনে যেন আকস্মিক দুর্যোগ নেমে এলো,এখানকার অধিবাসীদের জীবন শুধু স্তব্ধ ই নয় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে,এই সব দুশ্চিন্তায় অসহায় বোধ করে সে।খবর টি প্রথমে শহরের বিশিষ্ট উকিল কফিলউদ্দিন এবং মুহম্মদ মুস্তাফা সহ সেদিন যে সব যাত্রী স্টিমারে করে ঢাকা বা অন্য কোন শহরে যাবার জন্য ঘাটে এসেছিল তাদের মধ্য দিয়ে ক্রমে সমস্ত শহরবাসীর কাছে ছড়িয়ে পড়ে।স্টিমার না আসার কারণ যে কুমুরডাঙ্গার অনতি দূরে বাকাল নদীগর্ভে চর জেগে ওঠা, -কথাটা সেদিন কেউ বিশ্বাস করে নি।এই চর জাগা মানেই তো নদীর মৃত্যু ঘটা আর নদীর মৃত্যু মানেই যাত্রীদের কোলাহল , জীবিকা, ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস আদালত জীবনের স্পন্দন সবই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। স্টিমার না চলার ঘটনা শহরবাসীর  থেকে গ্রামবাসী,-ক্রমে আর বিস্তৃত হয় মানুষের মনের ভিতর।জন্মহয় নানা জনশ্রুতির,কুসংস্কারের।কুমুরডাঙ্গার ভাগ্যাকাশে যেন গ্রহণ লাগে।লেখকের বর্ণনার গুণে ও মানুষের আচরণে এক অন্যতর বাস্তবের জন্ম হয় । সে বাস্তব অলৌকিক নয় , মনের বিশ্বাস দিয়ে তাকে মেনে নিতে হয় । সেই বিশ্বাসে নদীর চড়া ক্রমে শহরবাসীর মনে ও জাগে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর–“One Hundred Year Of Solitude”(1967) বা “নিঃসঙ্গতার একশো বছর” গ্রন্থে এক মায়াবাস্তবের বয়ন করেছেন।ম্যাকোন্দ শহরের একশো বছরের সময়কালের ইতিহাস মেকুতয়াদেস চরিত্রের মুখে এমন ভাবে বয়ন করেছেন যেখানে বাস্তব সত্ত্বা ও অবাস্তবের দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে দিয়েছেন। “কাঁদো নদী কাঁদো” উপন্যাসে লেখকের বয়নে যেন সেই লক্ষণ দেখা যায়।

“একটি লোক নয় অনেক লোক ,অনেক লোক নয় গোটা পাড়া, একটি পাড়া নয় সমস্ত শহর’’
এতদ অঞ্চলের লকের মনের বিশ্বাস,স্টীমার আসবে মনে মনে তার বাঁশি ও শোনে তারা। সেই বাঁশির সুপরিচিত শব্দটি তাদের কানে স্পষ্ট বাজে,এখনো একটু দূরে আছে,হয়তো স্রোতে ভেসে আসছে, এই বুঝি স্টিমার ঘাটে লাগলো। মনের ব্যস্ততা,ব্যগ্রতা নিয়ে তারা এইভাবে অধীর আগ্রহে দিন গুনে। মনের এই বিশ্বাস যেন বাস্তবের বিশ্বাসকে ও হারিয়ে জয়ী হয়ে যায়।হাবু মিয়াঁ, যে লোকটি স্টিমার বন্ধ হওয়ায় তার বারো বছরের মৃতপ্রায় ছেলেকে শহরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারেনি, মনের ভেতর সে ও একদিন স্টিমারের বাঁশির শব্দ শোনে। শুধু শোনে ই না “বারো বছরের মৃতপ্রায় ছেলেকে কোলে নিয়ে মোক্তার হাবু মিয়াঁ ঊর্ধ্বশ্বাসে স্টিমার ঘাট অভিমুখে”৬ রওনা হয়। উকিল কফিলউদ্দিনও মনে মনে স্টিমারের বাঁশির শব্দ শোনে।কিন্তু যেদিন কুমুরদডাঙ্গার ঘাটে একটি লঞ্চ এল, আর গ্রাম-শহর ভেঙ্গে লোক ছুটে দেখতে গেল; সেদিন তাদের সব বিশ্বাস সব মনের জোর ভেঙ্গে গেল।কারণ লঞ্চটি লোকজন পারাপারের জন্য আসেনি,এসেছে স্টিমার ঘাটটিকে স্থানান্তর করার জন্য।সেদি কুমুরডাঙ্গার মানুষ যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।তাদের আজন্ম লালন করে জীবন প্রতিপালন করে আসছে যে বাকাল নদী, সে নদী আজ মৃত্যু মুখে পতিত। “নদীটি যেন মানুষের মতো মরতে বসেছে …ধীরে ধীরে বার্ধক্য ঘনিয়ে আসে দিনান্তের মতো এবং এবার তার আয়ু ফুরিয়ে এলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে;মানুষের জীবনের মতো নদীর জীবন ও নশ্বর। সে কথাই তাদের মন ভারী করে তোলে।” 
নদীকে জীবনের এক সত্ত্বা বলা যায়, কিন্তু সে তো আর কথা বলতের পারে না ! সে কারণে তার দুঃখের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম ও হয়তো ভিন্ন । সেদিন –“রাতে মোক্তার মছলেউদ্দিনের মেয়ে সাকিনা খাতুন বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়।” শুধু একদিন নয়, প্রথম দিন রাতে ঘুম ভেঙে যায় কান্নার আওয়াজে।পরের দিন স্কুলে বেরনর সময়ে, এবং এভাবে প্রায়ই– “সে কান্নাটি শুনতে পায়–যে কান্না কখনো ঝড়ের মতো কখনো ধীরে- ধীরে বিলম্বিত বিলাপের মতো শুরু হয় ।” সে কান্না কাঁদে একজন নারী এবং তা যেন ভেসে আসছে নদীর দিক থেকে।” কে যেন কোথাও সর্বক্ষণ কাঁদে ।”১০ কথাটা সে তার মাকে না বলে পারেনি। ক্রমে কান্নার বিষয়টি সমাজে চাউর হয়। প্রথমে পাড়ায় তারপর মহল্লায় ,দকানে , বাজারে এমন কি সাকিনা যে মেয়েদের মাইনর স্কুলে পড়াতে যায় সেখানে ও বিষয়টি ছাউর হয়। উপন্যাসে দীর্ঘ অনেক অধ্যায় জুড়ে এই কান্নার প্রভাব লেখক এমনভাবে বুনেছেন যে সমাজের বেশীরভাগ মানুষ ও ক্রমে বিশ্বাস করে যে , নদীর আসন্ন মৃত্যু অনিবার্য, সেই দুঃখে নদী কাঁদে। আর সেই মৃত্যুর পেছনে কোথাও না কোথাও কুমুরডাঙ্গার বাসিন্দাদের পাপবোধের ফল জড়িয়ে আছে । পনেরো –বিশ বছর আগে একবার কুমুরডাঙ্গায় বসন্তের মড়কে অনেক লোক মারা যায় ।সেই সময়কালে ছালিম মিয়ার স্ত্রী করিমন বিবি থিক এই রকম কান্নার আওয়াজ শুনেছিল ।সে বলে –“তখনো মড়ক লাগেনি , সহসা আমি কি একটা কান্না শুনতে শুরু করি সাকিনার খাতুনের মতই।একে অকে জিজ্ঞেস করি, কোন কান্না শুনতে পাও? সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায় যেন,আমার মাথা খারাপ হয়েছে।আমি অবশেসে বুঝতে পারি কোথাও কেউ যদি কেন্দে থাকে সে-কান্না আমিই কেবল শুনতে পাই । তার পর মড়ক লাগে । কত লোক মারা গেল সেবার !”-একটু থেমে আবার বলে -“, মড়ক লাগবে বলেই অন্তরে কান্নাটি শুনতে পেতাম। অন্তর অনেক সময় আনেক কিছুই জানতে পায়।”১১ অর্থাৎ এবার ও কিছু অনিষ্ট বা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে কুমুরডাঙ্গায় যার পূর্বাভাস মানুষের অন্তর্চারিণী এই কান্না। পর পর কুমুরডাঙ্গায় কান্না কেন্দ্র করে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগলো।একদিন মিহির মন্ডল মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে–“শুনতে পায় নদীর দিকে একটি মেয়ে লোক যেন আর্তস্বরে কাঁদছে ।”১২ পরদিন অশীতিপর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ঈমান মিয়াঁ কান্নার শব্দ শোনে। এইভাবে রুকুনুদ্দিনের স্ত্রী, ফনুমিয়াঁ, জয়তুন বিবি সুরত মিয়াঁ-সহ আর অনেকের হৃদয়ে বিচিত্র বিলম্বিত নারী কন্ঠের কান্না কখন আর্তনাদ,কখন করুণ হা- হা করে আলোড়ন তোলে।মায়াবাস্তবের বুননে লেখক বলেন–“ধীরে ধীরে অনেকে  সময়ে অসময়ে সে কান্না শুনতে পায়, যে–কান্না বাঁশঝাড়ে হাওয়ার মর্মরের মতো শনায় ,কখন বা বাঁশির রব ধরে,কখন আবার রাতের অন্ধকারে পাখি– শাবকের কাতর আর্তনাদের মতো শুরু হয়ে অবশেষে বিলম্বিত রোদনে পরিনত হয় ।”১৩ চমৎকার এক মায়া বা জাদুবাস্তবতার চারণা বলা যেতে পারে বিষয়টিকে । 

ততদিনে কান্নার উৎপত্তি বা কি কারণে কান্না,এ সব নিয়ে কুমুরডাঙ্গা জুড়ে নানা গুজব কুসংস্কারের বাতাবরণ তৈরী হয়। শহরের মোল্লা মউলবীরা সভা-সমিতি করে সিদ্ধান্ত করে যে, কান্নাটি শয়তানের কারসাজি। প্রশাসন ও এর রহস্য উন্মোচনে তৎপর হয়।এমনসময়ে এক অদ্ভুত খবর আসে যে, তবারক আলী মুন্সীর ঘর পর্দানসীন বিবি জয়নাব খাতুন, কোনদিন ঘরের চৌকাঠ পেরয়নি , সে মাঝরাতে বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনে যেন কোন অতিলৌকিক দাকে সাড়া দিতে, বা জিন পরিতে পেয়েছে এমন মনে করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে অনুসরণ করে নদীর দিকে হেঁটে যায়। এই ঘটনায় মোল্লা মউলবীরা আরও শঙ্কিত হয়ে শহরের সর্বত্র আজানের ও নামাজ পড়বার ব্যবস্থা করে।তাদের মনে ও আশঙ্কা ক্রমে দৃঢ় হয় যে,-- “নদী কাঁদে, যে কান্না শুনতে পায় তারা সে–কান্না মরণোন্মুখ নদীর বেদনার্ত শোকাছন্ন অন্তর থেকেই জাগে।”১৪ এই বিশ্বাস বাস্তব জগতের সমস্ত যুক্তিবোধ কে অগ্রাহ্য করে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের মনের গভীরে প্রোথিত হয় গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শহরের পুলিশ,হাকিম, উকিল সবস্তরের মানুষের মনে সেই বিশ্বাস বিস্তারলাভ করে।ঔপন্যাসিক এমন এক  বাস্তবতের বয়ন করেন যা যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করা মুশকিল, আবার অবাস্তব ও নয় যে অবিশ্বাস করা যাবে । মানুষের চেতনায় যে জগত আর মগ্নচৈতন্যে  যে জগত, বা বলা যায় চিন্তার সঙ্গে কল্পনার ও স্বপ্নের মিশেলে এক বিশুদ্ধ বাস্তব তৈরী হয় ওয়ালীউল্লাহ্ আমাদের সেই জগতে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন ।

উপন্যাসের আর এক করুণ কাহিনী সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে। মুহাম্মদ মুস্তাফার বাগদত্তা খোদেজা। অল্প বয়সে খোদেজার মা বিধবা হয়ে ছয়-সাত বছরের খোদেজা কে নিয়ে দাদা খেদমতউল্লার  বাড়িতে ওঠে।বোনের দুঃখের কথা ভেবে খেদমতউল্লা স্থির করে বড় হয়ে মুস্তাফা খোদেজা কে বিয়ে করবে।-“তখন ওয়াদা করার বয়স হয়নি মুস্তাফার, হলেও তার মতামতের কেউ অপেক্ষা করত কি না সন্দেহ।”১৫ প্রথমে বড়দের এই প্রতিশ্রুতি নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের একটি চুক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছিল । সেকারণে পরাশুনা কালে দেশের বাডি ফেরার সময় মাঝে মাঝে খোদেজার জন্য ফিতা,আয়না,চিরুনি,সুগন্ধ তেল নিয়ে আসতো । ক্রমে মুস্তাফা বড় হয় , তার নিজস্ব মতামত তৈরি হয় । শিক্ষিত হয়ে আজ সে হেকিম হয়েছে । একসময় বাবা খেদমতউল্লার করে যাওয়া প্রতিশ্রুতি তার কাছে অর্থহীন বলে মনে হয় । খোদেজার প্রতি দায়িত্বও ক্ষীণ হয়ে পড়ে।বাড়িতে মুস্তাফার মা ও এ প্রসঙ্গে কোন কথা বলে না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই যেন বাল্যকালের ছেলেখেলার মতই একরকম গুরুত্ব হারিয়েছে। সেকারণে বন্ধু তাসলিমের আনা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয় মুস্তাফা কন্যাপক্ষের ইচ্ছা খুব দ্রুত অর্থাৎ -‘আগামী জুম্মাবারেই বিবাহের দিন’ ঠিক করে। সেই বিয়ের খবর জানিয়ে মুস্তাফা তার মা কে চিঠিতে সব জানায়। খোদেজা চিঠির সমস্ত কথা শোনার পর একা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে ভাবে–“তারপর বাড়ির পশ্চাতে শ্যাওলা–আবৃত পুকুর অভিমুখে রওনা হয়। সে–পুকুর থেকে জীবিত অবস্থায় মেয়েটি ফিরে আসে নি ।”১৬

খোদেজার মনে নিশ্চয়ই মুস্তাফার জন্য কোন গভীর ব্যথার জন্ম হয়েছিল, যার কারণে সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল।মুস্তাফার মনে এই প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর ছিল না। কারণ, ইতোপূর্বে মুস্তাফা বাড়ি ফিরলে খোদেজার সেবাযত্নে তেমন কোন আন্তরিকতার উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেনি।এই আকস্মিক ঘটনায় মুস্তাফার বিয়ে পিছিয়ে যায়। অন্যদিকে প্রতিশ্রুতির ভঙ্গের কারণেই যে খোদেজা আত্মহত্যা করেছে,একথা পরিবারের সদস্যদের হাবেভাবে প্রকট রূপে দেখা দেয়। খোদেজার–“মা সহসা মুখে আঞ্চল গুঁজে অদম্যভাবে সমগ্র দেহে থরথর করে কেঁপে কাঁদতে শুরু করলে কয়েক মুহুর্তের জন্যে প্রতিশ্রুতিটি একটি মহাসত্যের রূপ ধারণ করে।’’১৭ এই ঘটনার রেশ সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে ,এবং মেয়েতটির দুঃখের জীবন একটি রূপকথার করুণ কাহিনী আকারে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে খোদেজার আত্মা একটি ‘অতিশয় স্নেহশীল দরদী আত্মায়’ রূপান্তরিত হয়। লেখকের বর্ননায় এক মায়াময় পরিবেশ রচিত হয়েছে, যা বাস্তব নয় অথচ মনের অবচেতনে সে সদা জাগরুক। মুস্তাফার অবচেতন সত্ত্বায় এবং চেতন সত্ত্বায় খোদেজা বা তার স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। তাকে কোন ভাবে স্বস্তি দেয় না, জীবনানন্দীয় বধে তাকে সরিয়ে রাখতে ও পারে না– “পথে একটি ক্ষীণ তনু নারী মুর্তি দেখতে পেলে সে চমকে ওঠে । মাথার উপর নত করে রাখা একটি মস্ত  কালো ছাতার জন্য মেয়েটির মুখ ঠিক দেখতে পায় না,তবু তার মনে হয় সে যেন খোদেজা ; একই শারিরীক গঠন ,একই হাঁটার ভঙ্গী ,চিবুকের যে অংশটি নজরে পড়ে তা ও মৃত মেয়েটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।”১৮ 
তার বিস্ময় বভ্রম সব একাকার হয়ে যায় অবাস্তব যেন বাস্তবের রূপ ধরে এগিয়ে আসে । মুস্তাফা ভাবে সাকিনা ই খোদেজার রূপ ধরে তার সামনে উপস্থিত হয় । সে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। একটা অস্বস্তি মেশানো অনুভূতির স্বীকার  হয়ে মনেমনে ভাবতে শুরু করে যে খোদেজার মৃত্যুর জন্য সে ই দায়ী।

নদীর মৃত্যু আসন্নপ্রায়,এবং সেই মৃত্যুর নেপথ্যে নিশ্চয় কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের কৃতপাপের ফলই দায়ী। সে পাপস্খলন না হলে কুমুরডাঙ্গার জীবনে ঘোর ভয়ানক অমঙ্গল নেমে আসবে নিশ্চিত।হয়তো মহামারী,মহাপ্লাবন,ভুমিকম্প রূপে ভেতরে ভেতরে এমন ভাবনা ও মানুষের মনে দানা বাঁধে। কুমুরডাঙ্গার সমাজ ও জীবনে ও তখন এক পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেল। -“এ –সময়ে চুরি-ডাকাতি কমে গিয়েছিল ,কাছারি –আদালতের সামনে ঘাঘু মামলাবাজদের ভিড়টাও পাতলা হয়ে উঠেছিল,এমনকি দু-একজন লোক সহসা বিপক্ষ দলকে ক্ষমা করে বহুদিনের পুরান মামলা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিল। শত্রুরা তাদের শত্রুতা ভুলেগিয়েছিল, মানুষের মনে অচিন্ত্যনীয় ধরণের স্নেহ প্রীতি উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বা লাম্পট্য চরিত্র মানুষের দুরাত্মপনায় ভাটা পরেছিল – এ সব সত্য, কল্পনা নয়।” ১৯ এক অদ্ভুত পাপবোধের জাগরণে মানুষের মনে যে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল তার হেকে উত্তরন ঘটে।উকিল কফিল উদ্দিন শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন কুমুরডাঙ্গা ছেড়ে চলে যাবেন। সেই মতো নদী ঘাটে বজরায় উঠেতে যাবেন এমন সময় সর্পদৃষ্ট মানুষের মতো অকস্মাৎ মৃত্যুর কলে ঢলে পড়লেন।এ খবরে শহরে এক আশঙ্কার জন্ম হয়– “যেন তার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়,জরা-বার্ধক্য–সে মৃত্যুর জন্য দায়ী নয় কাছারি–আদালতে,কাছারি-আদালতের সামনে, ঘাস শূন্য ধুলাচ্ছন্ন মাঠে, বাজারের পথে, সে- পথের দুপাশের দকাঙ্গুলিতে, মানুষের বাড়িতে উঠোনে সর্বত্র একটি থমথমে ভাবের সৃষ্টি হয়।”২০ 

উকিলের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আর মানুষের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। এই মৃত্যু যেন নদীর কান্নার অবধারিত ভয়ানক ফল। ভয়ে ভাবনায় মানুষের চেতনা লুপ্ত হবার উপক্রম হয়। কেউই যেন আর বাস্তব সমাজের বাসিন্দা নয় ; যেন এক অতিবাস্তব জগতের বাসিন্দা।তারা সকলে মিলে সংকল্প করে আসন্ন বিপদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে নিজেদের অজানিত অর্জিত পাপের স্খালন করবে। উপায় ই বা কি? কোন উপায়ে হবে এই পাপ স্খলন?—একদিন সন্ধ্যায় দর্জি পাড়ার রহমত শেখ এক নবজাত বাছুর কে বুকে জড়িয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে নদীর তীরে গিয়ে ক্ষিপ্র ভঙ্গীতে বাছুরের গলা কেটে তার তাজা রক্তে নিজেকে রাঙ্গিয়ে বুকজলে নদীতে মস্তকছিন্ন বাছুর কে ভাসিয়ে দেয় । এই ঘটনার সাক্ষী ছিল অনেক মানুষ । যেন রহমত শেখ কুমুরডাঙ্গার  পাপ স্খালনের পথ তা বাৎলে দিল । তারপর কুমুরডাঙ্গায় দেখাগেল –“ দলে দলে তারা নদীর তীরে উপস্থিত হতে শুরু করে , হাতে এটা সেতা। যে যা পারে ,যা যার কাছে মুল্যবান মনেহয়, তাই নিয়ে আসে: হাঁড়ি–পাতিল, জামা-কাপড়, চাল-ডাল, টাকা- পয়সা,এমন কি সোনা-রূপার গহনাও। এসব তারা পানিতে ছুঁড়তে শুরু করে।”২১ এইভাবে এক অদ্ভুত বিশ্বাস –যা আগে ছিল শুধুমাত্র অনুমান– যা প্রথমে মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ক্রমে তা সত্যবিশ্বাসে সমগ্র সমাজের স্থির বিশ্বাসে পরিণত হয় । বাস্তব এবং অবাস্তবের মেলবন্ধনে ওয়ালীউল্লাহ্ যেন এক জাদুবাস্তব জগত গড়ে তোলেন। সমালোচক Angel Flores জাকে বলেছেন–“An amalgamation of realism and fantasy.”২২

অন্যদিকে মুহম্মদ মুস্তাফা ও ঘটনা পরম্পরায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে–“খোদেজা একটি প্রতহিংসাপরায়ণ আত্মায় পরিণত হয়েছে,যে–আত্মা সারাজীবন তাকে পদে পদে অনুসরণ করবে,অদৃশ্যভাবে, ছায়ার সঙ্গে মিশে থেকে, হয়তো -বা তাকে এক সময়ে ধ্বংস ও করবে।”২৩ 
এই ভাবে এক যন্ত্রণাময় সংকট থেকে মুক্তি পেতে মুস্তাফা শেষপর্যন্ত বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। এইভাবে সমগ্র উপন্যাস জুড়ে কাহিনী বাস্তবের সীমা অতিক্রম করে অধিবাস্তব, বা তার সীমা লঙ্ঘন করে অতিবাস্তবের স্তর পেরিয়ে পৌঁছেযায় কল্প-বাস্তবে বা জাদুবাস্তবে । সে জগতে কালুগাজী যেমন অশরীরী থেকে শরীরী রূপ নেয় ;তেমনি খোদেজার অশরীরী  আত্মা সাকিনা খাতুনের শরীরী রূপ ধরে মুহম্মদ মুস্তাফার সামনে উপস্থিত হয় । সময়ের অন্তর্লীন প্রবাহে যেন স্বাভাবিক ভাবেই সব ঘটেচলে । লেখকের জাদু দন্ডের স্পর্শে বাস্তব এবং ফ্যান্টাসি পাশাপাশি ধরাদেয় পাঠকের কাছে । সময়ের প্যারামিটার যেন উন্মুক্ত হয়েগেছে ,অতীত বর্তমান একই কালচক্রে বয়েচলে । আতঙ্কময় ভৌতিক পরিবেশ তখন অনায়াসে বাস্তবের হাত ধরে এগিয়ে চলে । মুহম্মদ মুস্তাফা এইভাবে বাস্তব অবাস্তবের যৌক্তিক সমীকরণের খোঁজে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় । সে যেন চোখ খোলা রেখে শ্যাওলা আবৃত ডোবার মতো পুকুরে খোদেজা বা তার আত্মা কে খুঁজে ফেরে,লেখকের বর্ননায় এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ,যখন তার আত্মহত্যা আর আস্বাভাবিক মনে হয়না । সমালোচক সৈয়দ আক্রম হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন- “বলা বাঞ্ছনীয়, কুমুরডাঙ্গার ঘটনাপুঞ্জ, চরিত্রাবলী ও বহির্জগত এবং মুহম্মদ মুস্তাফার যন্ত্রণাময় স্বতন্ত্র অন্তর্জীবন– সৃষ্টি করেছে “কাঁদো নদী কাঁদো"র বস্তুময় সমগ্রতা ও আত্মসমগ্রের সমন্বয় । সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাস আমাদের নিয়ে যায় অস্তিত্বের প্রগাঢ় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে । বিমিশ্র সত্ত্বা থেকে শুদ্ধসত্ত্বার অভিমুখে।”২৪ ঔপন্যাসিক ওয়ালীউল্লাহ জাদুবাস্তবতার বয়নে এইভাবে পাঠক কে “স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি মেক প্রদোষান্ধকারে” নিয়ে যান। কারণ তিনি নিজেই বলেছিলেন-- “তা হলে কষ্ট করে লেখার প্রয়োজন কী ?মনের কোণে লুকানো আশা বা স্বপ্নের (সে সবের দাম জা-ই হোক ) কথা কিছু প্রকাশ না করলে চলে কি করে?”২৫ বাস্তবে ও অন্তর্বাস্তবে মেশা, “ভিতরকার মানুষ”এর উন্মোচনে ওয়ালীউল্লাহ বাংলাকথাসাহিত্যে ধুর্জটিপ্রসাদ, গোপাল হালদার, বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য দের সার্থক উত্তরসূরি । একই সঙ্গে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের আধুনিক যুগের স্রষ্টা ।
 
উল্লেখপঞ্জি:
১। ‘বিশ্বাসের পাথরে খোদাই সে চোখ’, ওয়ালীউল্লাহ্  সাহিত্য, লিপিকা ঘোষাল, প্রজ্ঞা বিকাশ, কলকাতা, ২০০৭, পৃষ্ঠা-৫
২। ‘বাংলা উপন্যাসের রূপ ও রীতির পালাবদল–ষাট বছরের (১৯৪৯-২০০৯)’, বাংলা উপন্যাস, অরুণ মুখোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা। জানুয়ারি, ২০১১ 
৩। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ 
The Online Library of Bangla Books
www.Bangla Book.org—p-10
৪। তদেব--------p---11
৫।   ”   ------p----37
৬।   ” -------p----39
৭।    ”-------p----47
৮।   ”-------p----50
৯।   ”------p-----50
১০।   ”------p----53
১১।   ”------p----67
১২।   ” ----p-----80
১৩।   ”-----p----81
১৪।   ”------p-----88
১৫।   ”------p-----28
১৬।   ”------p-----27
১৭।   ”------p-----27
১৮।    ”-----p-----97
১৯।   ”----p-------90
২০।    ”-----p------101
২১।   ”----p------104
২২। ‘জাদুবাস্তবতা –ম্যাজিক রিয়ালিজম : নানা প্রসঙ্গ’, শম্পা রায়,’ম্যাজিক রিয়ালিজম ও বাংলাসাহিত্য’,সম্পাদনা:পলাশ খাটুয়া, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ,কলকাতা
২৩। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ 
The Online Library Of Bangla Books
 www.Bangla Book.org,-p—104
২৪। ‘বাংলা কথাসাহিত্য জিজ্ঞাসা’, অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৪, পৃষ্ঠা–৩৮৩ 
২৫। ‘গল্পসমগ্র ; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’, সম্পাদনা : হায়াৎ মামুদ, প্রতীক, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১৭, ভূমিকা অংশ

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রামানন্দ সেন্টেনারি কলেজ , পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।  

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সন্ধান 
ড. রামশঙ্কর প্রধান

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,151,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সন্ধান
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সন্ধান
জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। বিশেষ সংখ্যা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সন্ধান
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/w320-h160/syed-waliullah(bindu).png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/s72-w320-c-h160/syed-waliullah(bindu).png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/01/magical-reality-in-syed-waliullahs-kando-nadi-kando-novel.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/01/magical-reality-in-syed-waliullahs-kando-nadi-kando-novel.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy