আমি যখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং আবদুলরাজাক গুরনাহর লেখার গুণগত মান বিশ্লেষণ করতে উদ্যত হবার মত সাহস সঞ্চয় করছিলাম আহা কী বর্ণাঢ্য লেখার জগৎ তাঁদের। দিগন্ত বিস্তৃত পর্দা খুলে যেতে থাকে। সাম্য রাইয়ান এর অনুরোধে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এর ওপর লেখা তৈরি করতে গিয়ে আবার নতুন করে-লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো’র পৃষ্ঠা উল্টে স্বাদ নেবার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখনই গুরনাহর প্যারাডাইস চোখর ওপর ঝুলে পড়লো! একদিকে ধর্মব্যবসা অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত দরীদ্র পিতা নিজ সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। প্যারাডাইসের ইউসুফ আর লালসালু’র মজিদ দুু’টি চরিত্রই প্রতিবাদী কিন্তু অভাব তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। মুক্তির আশায় তারা স্বপ্ন দ্যাখে...অনবরত ভূখণ্ড, অরণ্য, মায়া তাদের দু’জনের স্বপ্ন রাষ্ট্রচিন্তার মত বিশাল প্রেক্ষাপট জুড়ে এগুতে থাকে। দু’টি চরিত্র দু’রকম হলেও কোথায় যেন একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। লুই আলথুসের রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ'র মত অভিনবত্ব ও প্রাসঙ্গিক করে তোলে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নোবেল লরিয়েট হলে আমরাও কম সম্মানিত হতাম না! উনি ইংরেজিতে লিখতেই পানতেন! কেন লিখলেন না? মাতৃভাষাকে সম্মান জানাতে গিয়ে কতকিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে ভাবুন তো একবার...?
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অধ্যয়ন, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ছিলেন একাগ্র। সমগ্র স্বদেশ পূর্ববাংলার অখণ্ড ভূগোলকেই তিনি নিজের বলে ভেবেছেন। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারিয়ে তিনি নিঃসঙ্গতাকে লালন করেছেন নিজের ভেতরে আর হয়ে উঠেছিলেন অর্ন্তমুখী। তাঁর আত্মগত উপলদ্ধিই তাঁকে করে তুলেছিল সহানুভূতিশীল ও দয়াদ্র। লালসালু উপন্যাস মুসলিম জনজীবনের দর্পন। যে আয়নায় জীবন দেখা যায় ধর্ম দেখা যায়, বর্হিমুখ উন্মত্ততা আগুনের হলকার মত পুড়িয়ে দেয় চারদিক। শস্যহীন জনবহুল এলাকার মানুষ সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত করে রাখে চারপাশ। লালসালু উপন্যাস ঘিরে বেড়ে উঠেছে অজগরে মতো দীর্ঘ সীমাহীন পথ যে পথে সত্য নেই, শস্য নেই কেবল ধর্মের আস্ফালন বেশি। নিঃসঙ্গতার বন্য শূন্যতা চারদিকে। এরকম এক অপরাহ্ণে মজিদের প্রবেশ ঘটে মহব্বতনগর গ্রামে। মজিদের আগমন চমকপ্রদ হলেও ধূর্ততায় ঠাসা ছিল- ‘আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ্। মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করে ফেলি রাখছেন?’
২
বিস্ময়করভাবে মজিদ ক্রমশ মহব্বতনগর গ্রামের মানুষকে ধর্মীয় শেকলে আবদ্ধ করে ফেলে।
মজিদ ভাবে, ‘তার ভুলভ্রান্তি তিনি মাফ করে দেবেন। তাঁর করুণা অপার, সীমাহীন।’
রহীমা ও জমিলা দু’টি নারী চরিত্রই প্রতিবাদী ও তীক্ষ্মস্বরে ঝঙ্কারিত যা ধর্ম ছাপিয়ে জীবন ও মানবিকতায় পূর্ণতা নিয়ে আসে। মৃত মানুষের চোখের মত নয়। দূঢ়তা আছে কিন্তু ক্ষমতাহীন।
লালসালু উপন্যাস পাঠ করলে বাঙালি মুসলমানের জীবনকে চক্কর খাওয়া চড়কবৃক্ষের মত মনে হয়। মহব্বতনগরের গ্রামের মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ যাবতীয় কর্মপ্রণালী পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে এক অসহনীয় ইঙ্গিত বহন করে। যা মানুষের জন্য শুভকর নয়। ফিউডল লর্ড এর মত এ গ্রামে মজিদের আর্বিভাব এবং মাজারে লালসালু দিয়ে আবৃত করার মধ্য ধর্মব্যবসার সূত্রপাত।
এক সময় মহব্বতনগরের স্বচ্ছল ব্যক্তি খালেক ব্যাপারী মজিদের শিকারে পরিণত হয়।
এ উপন্যাসে সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মের বলি হয়েছে জমিলা। প্রতিবাদী চরিত্র হলেও অবশেষে মজিদের শাসনের ভেতরেই আবদ্ধ হতে হয়েছে তাকে। ধর্মীয় জীবনাদর্শে মজিদ মহব্বতনগরের গ্রামের মানুষকে দুর্বল করে রাখতে চেয়েছে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। যেন তার কোন অর্ন্তযন্ত্রণা নেই। নেই কোন পাপের পরিণাম।
মানুষের মৃত্যু, শোক, ভেঙে পড়া, কূপম-কতা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো এসবই একজন বিবেকবান মানুষের চাওয়া হতে পারে। শ্রেণিসংগ্রামের লক্ষ্যকে নিদিষ্ট করতে এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রাও হতে পারে। কিন্তু লালসালু উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র মজিদ পুরো উপন্যাসের কাহিনী জুড়ে ধর্মকে পুঁজি করে নিজ স্বার্থের জন্য মহব্বতনগর গ্রামের মানুষের ওপর তার চোখ পড়ে- ‘গ্রামের লোকগুলি ইদানিং অবস্থাপন্ন হয়ে উঠেছে। জোতজমি করেছে, বাড়িঘর করে গরুছাগল আর মেয়েমানুষ পুষে চড়াই-উতরাই ভাব ছেড়ে ধীরস্থির হয়ে উঠেছে, মুখে চিকনাই হয়েছে। কিন্তু খোদার দিকে তাদের নজর কম। এখানে ধানক্ষেতে হাওয়া গান তোলে বটে কিন্তু মুসল্লীদের গলা আকাশে ভাসে না। গ্রামের প্রান্তে সেই জঙ্গলের মধ্যে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বুকে ঝোলানো তামার দাঁত-খিলাল দিয়ে দাঁতের গহ্বর খোঁচাতে খোঁচাতে মজিদ সেদিন সে-কথা স্পষ্ট বুঝেছিলো। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বুঝেছিলো যে, দুনিয়ায় স্বচ্ছলভাবে দু-বেলা খেয়ে বাঁচবার।
৩
জন্যে যে-খেলা খেলতে যাচ্ছে সে-খেলা সাংঘাতিক। মনে সন্দেহ ছিরৈা, ভয়ও ছিলো। কিন্তু জমায়েতর আধোবদন চেহারা দেখে পরিষ্কর হয়ে গিয়েছিলো অন্তর। হাঁপানি রোগগ্রস্ত অশীতিপর বৃদ্ধের চোখের পানে চেয়েও তাতে লজ্জা ছাড়া কিছু দেখে নি। জঙ্গল সাফ হয়ে গেলো। ইট-সুরকি নিয়ে সেই প্রাচীন কবর সদ্যমৃত কোন মানুষের কবরের মতো নোতুন দেহ ধারণ করলো। ঝালরওয়ালা সালু দ্বারা আবৃত হলো মাছে পিঠের মতো সে-কবর। আগরবাতি গন্ধ ছড়াতে লাগলো, মোমবাতি জ্বলতে লাগলো রাতদিন। গাছপালায় ঢাকা স্থানটি আগে স্যাঁতসেঁতে ছিলো, এখন রোদ পড়ে খটখটে হয়ে উঠলো; হাওয়ারও ভ্যাপসা গন্ধ খড়ের মতো শুষ্ক হয়ে উঠেলো।’
কবরের সৌন্দর্যের বৃদ্ধির সঙ্গে মজিদের জীবনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। একসময় সে মহব্বতনগরে গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হয়ে ওঠে। মজিদ একসময় নিজের মনেই-‘ভাবে, খোদার বান্দা সে নির্বোধ ও জীবনের জন্য অন্ধ। তার ভুলভ্রান্তি তিনি মাফ করে দেবেন। তাঁর করুণা অপার, সীমাহীন।’
এভাবেই সে প্রতিনিয়ত গ্রামের মানুষকে ঠকিয়ে নিজের অস্তিত্ব তৈরি করতে থাকে। একসময় গ্রামের লোকেরা তাকে ভয় পেতে শুরু করে। এবং স্ত্রী রহীমাও তার প্রতি ভেতরে ভেতরে লালন করে প্রগাঢ় ভীতি। নিঃসন্তান রহীমার সম্মতিই একসময় কিশোরী জমিলাকে সে বিয়ে করে। এখানে দেখা যায় মজিদ জমিলাকে বিয়ে করা তার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল বলে মনে করছে। জমিলা ধর্মকে ভয় পায় না এবং বিকৃত মস্তিষ্কেরও নয় সুস্থ্য এবং স্বাভাবিক এ কারণেই মজিদ জমিলাকে ভয় পেতে শুরু করে। এবং সে ভয় ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে।
একসময় মজিদ ক্রোধে অগ্নিমুখ হয়ে ওঠে- ‘তোমার এত দুঃসাহস? তুমি জায়নামাজে ঘুমাইছ? তোমার দিলে একটু ভয়ডর হইব না?... মাঝ-উঠানে হঠাৎ বেঁকে বসলো জমিলা। মজিদের টানে স্রোতে-ভাসা তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যাচ্ছিলো, এখন সে সমস্ত শক্তি সংযোগ করে মজিদের বজ্রমুষ্ঠি হতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। অনেক চেষ্টা করেও হাত যখন ছাড়াতে পারলো না তখন সে অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসলো। হঠাৎ সিধা হয়ে মজিদের বুকের কাছে এসে পিচ করে তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করলো।’
৪
‘লালসালু’ উপন্যাসে দেশ, কাল, সমাজ ও পরিবারের অর্ন্তদ্বন্দ্ব মূর্ত হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতিটি চরিত্রই স্পষ্ট। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি যেন। লালসালুর শেষ দৃশ্যের চিত্রায়ন প্রতিকী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতেই পারে- ‘ঝাপটা খুলে মজিদ দেখলো লাল কাপড়ে আবৃত কবরের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে জমিলা, চোখ বোজা, বুকে কাপড় নাই। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বলে সে-বুকটা বালকের মতো সমান মনে হয়। আর মেহেদি দেয়া তার একটা পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে।’
চিন্তা ও সময় একইসাথে দৌড়াতে থাকে। মানুষের জীবন ও সৌন্দর্য ঘুমান্ত ট্রেনের মত। যা অধরা হয়েই চিরকাল থেকে যায়।
মানুষমাত্রই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অসুখী তার ওপর রাজনীতি শাসিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বিশ শতককে ক্রান্তিকাল বলেই ভেবেছেন। তাঁর মতে এসময় মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, ব্যক্তির মানসিক টানাপোড়েন এবং দ্বিধা ও সত্তার দ্বন্দ্ব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লেখা বিশ্লেষণ করলে যেটা অনুধাবন করা যায় কার্ল মার্কসকেই বিশ শতকের অন্যতম অগ্রদূত বলে তিনি মনে করেছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নিজের জীবনও ছিল ঐশ্বর্যমিণ্ডত ও সমৃদ্ধ। একইসাথে তাঁর মানবিকতাবোধের জাগরণও ছিল সুতীক্ষ্ম। এবং সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর শুদ্ধতা, পরিশীলন ও পরিমার্জনবোধ।
প্রসঙ্গ: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু
সুহিতা সুলতানা
সুহিতা সুলতানা
মন্তব্য