অস্তিত্ববাদ হল Kierkegaard এবং সার্ত্রের দার্শনিক মতবাদ যেখানে বিদ্যমান ব্যক্তিদের জন্য গভীর উদ্বেগ এবং দার্শনিক আদর্শবাদের প্রতি অবিশ্বাসকে ভাগ করা হয়। এ-সাহিত্য মানুষের অত্যাবশ্যকীয় দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও একাকীত্ব, ব্যর্থতা ও দুঃখের বিচ্ছিন্নতা, অপরাধবোধ, সীমাবদ্ধতা, বিচ্যুতি, মৃত্যু ইত্যাদির মতো বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এগুলি হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই মানুষ নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৫ আগস্ট ১৯২২--১০ অক্টোবর ১৯৭১) বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী। তাঁর প্রথম উপন্যাস লালসালু (১৯৪৯)। নিজের বিখ্যাত এ-উপন্যাস বেঁচে থাকাকালীন বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে দেখেছেন। পাকিস্তানের করাচি থেকে উর্দু ভাষায়, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে ইংরেজি অনুবাদ, ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ফরাসি অনুবাদ, জার্মান থেকে জার্মানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে লালসালু উপন্যাস। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হওয়ায় ইউরোপে তিনি লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন ও সুখ্যাতি পান। ১৯৬১ সালে লালসালু উপন্যাসের জন্যই তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ইউনেস্কোর উদ্যোগে লালসালু Tree Without Roots নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। সেটির প্রচ্ছদলেখক নিজেই করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত লালসালু গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেন বন্ধু জয়নুল আবেদীন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাময়িকী Sunday Telegraph লালসালু উপন্যাসকে 'gifted novelist' বলে অভিহিত করে মন্তব্য করে, poetic and hunting novel...novel that has the timeless quality. এ উপন্যাস বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত হয়েছে। এ উপন্যাসে অস্তিত্ববাদ ও আধুনিক যুগের অন্ধকার ও বিভিন্ন কুসংস্কারগুলি তুলে ধরা হয়েছে। 'বাঙালির আবেগ নিয়ে খেলা করে ভণ্ডরা' এ চিত্রই নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। মজিদ ও মহব্বতপুর গ্রামের লোকেরা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ও বেঁচে থাকার লড়াই/অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা দেখা যায়।
আমরা দেখি উড়ে এসে জুড়ে বসারা গ্রামের কোনো এক মেয়েকে বিয়ে করে প্রভাব বিস্তার করে। গ্রামীণ এ চিত্র অনেক দেখা যায়। চালাক-চতুর মজিদ রহিমাকে বিয়ে করে মহাব্বতপুর গ্রামে প্রভাব বিস্তার ক্রমশ বাড়াতে থাকে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। সন্তান না-থাকা মজিদ একসময় সন্তানের আশায় জমিলাকে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এরপর থেকেই জমিলার প্রতিবাদ ও প্রতিকূল পরিবেশে দুর্বল হতে থাকে মজিদ। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করে। ভণ্ড মজিদ গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় বিয়ের পর অবশ্য আর বেশি টিকে থাকেনি।
মজিদকে যেনো মহব্বতপুর গ্রামবাসী অভ্যর্থনা জানাতেই প্রস্তুত ছিল। নাটকীয়তা থাকলেও গ্রামে প্রবেশের প্রাথমিক বাধা সহজেই জয় করতে পারে। এরপর ছলাকৌশলে গ্রামবাসীর কাছে পৌঁছে যায় মজিদ। গ্রামের বিধবা রহিমাকে বিয়ে করার পর প্রভাব আরও বেড়ে যায়। পরস্পরের প্রয়োজনে ক্ষমতাশালী খালেকের ওপরও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। মাজার, মক্তব, ধর্মীয়গ্রন্থ ইত্যাদি এ উপমহাদেশের ঐতিহ্যগতভাবে জনপ্রিয় বিষয়। ধর্মীয় কথা বলে কৌশলী সুযোগ গ্রহণ করতে থাকে চতুর মজিদ। ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যখ্যা দিয়ে গ্রামবাসীর ওপর কর্তৃত্বস্থাপন করে সে। মহব্বতপুর গ্রামবাসীর ওপর অন্তর্দৃষ্টিটা খুব জোরালো ও তীক্ষè ছিল। দুর্বল জায়গা ধরে রেখে বা আবর্তিত করেই কাজে-অকাজে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগাতে থাকে মজিদ। মহব্বতপুর গ্রামের ওপর ডমিনেট করতে থাকে। মহব্বতপুরে এক অচেনা লোকের কবর/মাজারকে কেন্দ্র করেই নানা কুকীর্তি করতে থাকে। কবরে লাল সালু দিয়ে ঢেকে দেয়। লালসালু দিয়েই মজিদ যেন তার নিজের অন্ধকার চরিত্রকে ঢেকে দিতে চায়। তার ধর্মীয় ব্যখ্যা (আসলে কপটতা, কুসংস্কার ইত্যাদি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি) এবং ছলচাতুরীর মাধ্যমে গ্রামের শিরোমণি হয়ে ওঠে মজিদ। শেষে গ্রামের প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান ধনুক খালেককেও কৌশলে আয়ত্ত করে। খালেকের স্ত্রীকে পর্দার নামে তালাক দিতে কৌশল করে এবং গ্রামবাসীর নিকট খারাপভাবে উপস্থাপন করিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করতে চায় এবং সফল হয়। এভাবেই কৌশলে ও ধর্মীয় জ্ঞ্যানসমৃদ্ধ (কিন্তু নিজস্বার্থ চরিতার্থ করতে ভুলব্যখ্যা করেছে) মজিদ মহব্বতপুরের আদর্শ হয়ে ওঠে।
লালসালু ও অন্যান্য উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহ মানুষের সরলতা, বঞ্চনা ও দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করেছিলেন। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যাকে ঘিরে ঘটনা আবর্তিত হয়েছে তার নাম মজিদ। মজিদ বাংলাদেশী গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের প্রতিনিধি। এরা স্ব-সৃষ্ট ধর্মীয় পরিচয়ে তাদের অস্তিত্ব খোঁজেন। আমরা জানি, বাঙালির কাছে মসজিদ, মন্দির, মাজার শব্দগুলো বছরের পর বছর ধরে একটি অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক উপাদান হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় একটি স্থান দর্শন করা ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের আগ্রহের প্রধান একটি বিষয়। ঐতিহ্যগতভাবে, এই উপমহাদেশের মানুষের ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। ক্ষমতা এবং মৌলিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে অনেক ভণ্ড। আর এ সুযোগ গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় মজিদের মতো ভণ্ডরা। কেউ সফল হয়, কেউ আবার সফল হতে পারে না। মহব্বতপুর গ্রামকে কাল্পনিক ও পৌরাণিক হিসাবে লেখক সৃষ্টি করেছেন। আর বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন-আবহ সৃষ্টি করে মজিদ। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং সবাইকে অন্ধকারে রেখে ক্ষমতা ভোগ করাই প্রধান লক্ষ্য তার। ধর্মীয় বা আঞ্চলিক এক বা একাধিক বিষয় নিয়ে ভণ্ডরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য কৌশলী হন। লালসালু উপন্যাসের মজিদ এমনই একজন। মাজার কেন্দ্র করেই এ উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে, মজিদও তাই। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের বোকা বানিয়েছে মজিদ। ধর্মভীরু জনসাধারণকে মোক্ষম চাল দিয়েছেন এভাবে, 'আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপড়াহ। মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?'। এ শুরু থেকেই সরল প্রাণগুলোদের নিজের আয়ত্তে আনতে চেয়ে সফল হয়েছেন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী-এর প্রবীণ ব্যক্তি সর্বদা সাহসী মানব প্রকৃতির কথা ঘোষণা করেছেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসা্লু’র মজিদও কৌশলে বেঁচে থাকার তাগিদ ঘোষণা করেছেন। মাজিদ তার নিরাপত্তার জন্য তার মাজার ছেড়ে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি কারণ মাজার তার অস্তিত্ব। মাজার ছাড়া তার অস্তিত্ব বিপন্ন। মাজারকে কেন্দ্র করেই মজিদ শারীরিক অস্তিত্বর পাশাপাশি বিশ্বাসগুলিও টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মজিদের এ অস্তিত্ব তার চেতনা। এই উপন্যাসে গ্রামবাসীদের উপর ক্ষমতা/প্রভাব হারানোর জন্য মাজিদের ভয়। তার ঐশ্বরিক অনুগ্রহ হঠাৎ শেষ হয়ে যেতে পারে বলে সবসময় কৌশলী ও ভীত থাকে মজিদ। এতকিছু করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
আমরা দেখি, মহব্বতপুরে মজিদের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। মজিদ একটি নাটকীয় মুহূর্তে প্রবেশ করে মহব্বতপুরে নতুন জীবন শুরু করে। নিজের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। গ্রামবাসীদের জীবনধারা এবং তাদের অভ্যাস সম্পর্কে তার দারুণ অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। দুঃসাধ্য কাজগুলি গ্রহণ করার জন্য সে যথেষ্ট বিচক্ষণ। প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করতে মজিদকে কোনো প্রতিপক্ষেরই মোকাবিলা করতে হবে না বলেই মজিদ বুঝে নেয়। সে জানে, তার দ্বন্দ্ব নিজের মধ্যেই নিহিত। ফলে, নিজের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য সে খেলা করে গ্রামের জনগণের সঙ্গে। বক্তব্যে ভালো কিছু বললেও গ্রামবাসীর ভালো করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। রহিমার সাথে বিয়ের পর তার প্রভাব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। রহিমার পাশাপাশি গ্রামবাসীরা তাকে ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে। তাদের সরলতা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে মজিদ একটি জরাজীর্ণ কবরকে মাজারে রূপান্তরিত করে। সে মাজারকে জীবিকার উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। সে স্বার্থপর, দ্বিধাহীন এবং অবিচলিত লুকানো অস্তিত্বের প্রতি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গ্রামের লোকেরা দরিদ্র ও অশিক্ষিত অথচ মজিদ একজন ভণ্ড। মজিদ গ্রামবাসীদের কুসংস্কার ও অনগ্রসরতার সুযোগ নিয়ে তাদের শোষণ করতে শুরু করে।
মজিদ তার ভবিষ্যত অস্তিত্বকে শক্তিশালী করার জন্য সন্তান ধারণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে পৃথিবীতে মানবজাতির অস্থায়ী অস্তিত্বের দ্বারা আচ্ছন্ন হতে থাকে। তাই সে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে জমিলাকে বিয়ে করে। মজিদ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পথে প্রচুর সাফল্য অর্জন করে। শেষের দিকে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বিভিন্ন উদ্যোগে কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। পাশের গ্রাম নবাবপুরে এক নতুন পিরের আগমণ হয়। মহব্বতপুরের কেউ-কেউ সেখানে যেতে থাকে। এতে মজিদের প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এছাড়া মূলত দুটি কারণে মজিদের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়ে। প্রথমত দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলার আচারণ এবং দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মজিদ অত্যন্ত কৌশলে পির নবাবপুরকে ভণ্ডে পরিণত করার চেষ্টা করে। সে খালেককে তার স্ত্রী আমেনাকে তালাক দিতে বাধ্য করে। এই কঠোর কৌশলটি মজিদ তার অস্তিত্বকে স্থির রাখার জন্য। মজিদ অভ্যন্তরীণভাবে ভয়, উদ্বেগ এবং বিচ্ছিন্নতায় ভুগছে কিন্তু এগুলো তাকে তার দুঃসাহসিক কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এর মূল লক্ষ্যই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। মজিদ দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলাকে মাজার, ধর্মীয় এবং পরকালের ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। বরং সুন্দরী যুবতী জামিলার অদ্ভুত আচরণে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। জমিলার অপ্রত্যাশিত আচরণে সে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। মজিদ যত বেশি জমিলাকে আধিপত্য করতে চায়, তত বেশি বাধার সম্মুখীন হয়। জমিলা মাজিদের অস্তিত্বের জন্য স্থায়ী এবং অন্তহীন হুমকি হিসেবে কাজ করে। অবশেষে জমিলার প্রতিবাদ ও সাহসের কাছে মজিদ আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বাত্বক কৌশলী ভূমিকা পালন করে। এরপর মাজিদের অস্তিত্বের সন্ধানে প্রকৃতিও বাধা সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রামের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শিলাবৃষ্টি থেমে গেলে, মজিদ মাজারে বা জমিতে না-গিয়ে জমির মালিক খালেকের কাছে ছুটে যায়। এভাবে মজিদ সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে। গ্রামের লোক বুঝতে পারে আসলে মজিদের কোনো ক্ষমতা নেই, সে ভণ্ড।
মজিদ একজন চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যুক্ত। Peter T. Coleman এবং Andrea Bartoniterm-এর মতে, it as a complex phenomenon having a very deep and internal complexity which is often hard to see. এটি একজন ব্যক্তির বিশ্বাস, আচরণ এবং কার্যকলাপ যা চরম এবং সাধারণ থেকে অনেক দূরে। মজিদের ক্ষেত্রে আমরা এ অবস্থা লক্ষ করি। ওয়ালীউল্লাহ মহব্বতপুর নামে একটি কাল্পনিক গ্রাম তৈরি করেছেন যা বেশ পৌরাণিক। বিশ্বের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য বাকি বিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা দেখা যায়। বাঙালি মুসলমানদের অনেকেই ধর্মীয়, জাতিগত ও লিঙ্গগত বিপর্যয়ের মাধ্যমে তাদের জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। এই গ্রামটিতে মজিদ উপনিবেশ স্থাপনের জন্য ধর্মীয় ব্যবস্থার নামে বীজ বপন করে। মহব্বতপুরের মানুষকে উপনিবেশিত মানুষ হিসাবে তৈরি করেছিল মজিদ।
কলিন্সের মতে, ঔপনিবেশিকতা দুর্বল মানুষ বা এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করার জন্য একটি শক্তির নীতি এবং তার অনুশীলন। মজিদের টিকে থাকার চেষ্টায় বিভিন্ন কৌশল কিন্তু কলিন্সের সংজ্ঞার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্ম-প্রধান নীতিকে হাতিয়ার করে মজিদ দরিদ্র ও কুসংস্কারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য ক্ষমতার সর্বাত্বক চর্চা করে। মজিদের মৌলিক সিদ্ধান্তগুলি গ্রামবাসীদের জীবনকে প্রভাবিত করে। উপনিবেশকারীদের মতো, মজিদের লক্ষ্য হল দরিদ্র কৃষকদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা। মুসলিম সমাজ সম্পর্কে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অত্যন্ত উজ্জ্বল পর্যবেক্ষণ ছিল। মুসলমানদের অধঃপতনের কারণগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক তাঁর লালসালু উপন্যাসে। মজিদ নিজেকে মহব্বতপুরের শাসক হিসাবে বিশ্বাস করত। এবং এখানে উপনিবেশিকের মতো সে তথাকথিত কার্যক্রম শুরু করে। রহিমা (একজন পরিশ্রমী কৃষক মহিলা); খালেক (গ্রামের প্রধান); কুলসুম (বিধবা তার বাড়িতে কাজ করে); তারা মিয়া (কুলসুমের বাবা); আমেনা বিবি (খালেকের নিঃসন্তান স্ত্রী); এবং অন্যান্য গ্রামবাসীর সঙ্গে মজিদের সম্পর্ক ভাল। দরকার মতো যারা-তাকে সম্মান দেখিয়ে ও ব্যবহার করে নিজের কর্তৃত্ব ও অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছ। মজিদ গ্রামবাসীকে নিজের পথে রাখার জন্য মাজার ও ধর্মীয় ভয় দেখিয়েছে।
লালসালু উপন্যাস ভারতীয় উপমহাদেশের জনসাধারণের প্রতিচ্ছবি। বিশেষকরে ধর্মীয় লেবাসে সহজ-সরল সাধারণের কী যে অবস্থা তার প্রতিনিধি করে। শুরুই হয়েছে চমৎকার, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি । জানান দেওয়ার অভিপ্রায় এ উক্তিটিই সমগ্র উপন্যাসের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবেই মনে করি। ভণ্ডরা কোথায় করে, কখন করে, কেমন করে সংঘটিত করে ইত্যাদির প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে উপন্যাসটি বেড়ে উঠেছে। লালসালু উপন্যাসে উপমা ও অলংকার ব্যবহারে চমৎকারিত্ব লক্ষ করা যায়। অজগরের মতো দীর্ঘ রেলগাড়ি, হাওয়াশূন্য স্তব্ধতা ইত্যাদির মতো উপমা/অলংকারের ব্যবহার লক্ষণীয়।
অস্তিত্ববাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অর্জন করতে গিয়ে নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে এবং বিভিন্ন কৌশলী উদ্যোগ নিয়ে অন্য সকলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা। অস্তিত্ববাদ নিষ্ক্রিয়তার দর্শন নয়, কর্মের দর্শন। লালসালু উপন্যাসে মজিদ চরিত্র ছাড়াও খালেক, জমিলা এবং আক্কাস চরিত্রের মধ্যেও অস্তিত্ববাদের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র প্রথম উপন্যাসের অস্তিত্ববাদের এ ধারা পরবর্তী উপন্যাসসমূহেও বিস্তৃতিলাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এক উল্লেখযোগ্য নাম। প্রথম উপন্যাস লালসালু তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। এ-উপন্যাসে লেখক দার্শনিকের চোখে অস্তিত্ববাদের বিষয়বস্তুকে অত্যন্ত কৌশলে চিত্রিত করেছেন।
মন্তব্য