স্বপ্নের ভুল সংশোধন
গ্রীষ্মের ঘামেভেজা দু-একটি বিকেলের কটুগন্ধ গায়ে মেখে
তুমুল শীতের ভোর রগড়ে লালগোলা প্যাসেঞ্জার
তন্বী নদী হয়ে কুয়াশায় মেশে
নিদ্রার সুখটানে অ-সুখী নামতা কপচে
স্বপ্নের ভ্রম সংশোধন নাকি আর একটি ভ্রমের বিনুনি গ্রন্থন !
সূর্যের লালপেড়ে শাড়ি ছিঁড়ে
গোধূলি ভুলুন্ঠিত সন্ধ্যামণি ঝাড় অকাল বৈধব্য-লব্ধ
তরুণী সঙ্কোচে হাতে হাতে পুষ্পগোলক শুভাশিস দীর্ঘায়ু বিলায়
বিড়িঅলার পানের দোকানে লটারির টিকিট মেলাতে আসা মুখগুলোয়
লটকে থাকা চন্দ্রসূর্য আর একটি দিনের পৃথিবী চায়
স্বপ্নবীজ পোঁতা মৃত্তিকায় আর একবার তীক্ষ্ণ চোখ বুলানো খুব দরকার
সান্ধ্য পদাবলি
খোলাচোখে যাপনচক্রে অনর্গল বিতরয়ে হাসি
তনু মন মোহাবিষ্ট প্রতারিত হতে ফিরে আসি
ফিরে আসি ফিরে আসি তোমার গৃহে যক্ষ ছানারা
শৃগাল পণ্ডিত টোলে কৃচ্ছতা কী শিখেছে তাহারা।
কনে দেখা অস্তরাগে সমুদ্রের স্বর্ণ ঠোকাঠুকি
ভাঙা হ্যারিকেন হাতে ঝাউবনে লুকাল জোনাকি
লুকাল জোনাকি বনে কেননা অন্ধ কেহ তো নহে
তন্বী ষোড়শী পড়শি রেণু চায়ের চুমুকে বহে।
ব্যাপারটা এলোমেলো পঙ্কিলে অপরিমেয় মাছ
কায়াহীন ছায়া নাচে উৎসাহিত পাইক বরকন্দাজ।
আভূড়ি পূর্ণতা তবু তৃপ্ততার যে শেষ নাহি রে
শেষ নাহি রে প্রমত্ত রজঃবহ্নি অন্তর-বাহিরে।
সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছ যার দিকে
চোখ তার আঙুলের বিকিরিত রত্নের স্ফটিকে
প্রসারিত হাপিত্যেশ সাঁকো-তলে বহমান নদী
প্রবাহিত মনোজলে ভেসে ভেসে বেচাকেনা গদি।
সুতোকাটা ঘুড়ি আকাশ বিচ্ছিন্না তহি পুং-সংক্ষোভে
মৃত প্রেমিকের পাশে শোবে পরকীয়া জানুক লোকে
আসন্ন বরিষ জেনে তাতল সৈকত ঘন ঘন চুমি
ওষ্ঠচুমি দেহ পুড়ে দূরদৃশ্য ধূমায়িত নগ্ন বনভূমি।
সাজঘরে পুনরাগমন
তোমার কাছে যাব বলেই আমার আজকের সাজঘরে পুনরাগমন
নতুন জামা, ফুলেল তেল, স্নো পাউডারের চড়া মেকআপ লাগি্য়েছি
দেখো আমাকে কত অপরূপ লাগছে আজ
অনেকক্ষণ সেজে-গুজে আছি
আমার সযত্নে সাজান শরীর এবার তবে ভোলাবে তোমায় !
আমি চিরকাল খুব সাজুনে
সাজতে সাজতে গিয়েছি ভুলে আমার আসল মুখের রঙ
সত্যি কী সে রূপ— যে রূপের আগুনে টাটিয়েছে প্রতিবেশী চোখ
না কী তুমুল বৃষ্টিভেজা গন্ধহীন ফ্যাকাশে রজনিগন্ধা ডাটি !
রঙে রঙে লেখা সাজঘরে গানের খাতা আর অনুপান বটিকা
বাঁপাশে সরিয়ে রেখে— এ বিশ্বসুন্দরী সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায়
অংশ নিতে যাচ্ছে, এবারের জামা কাপড় অলংকারসমুহ
আজকের অন্তিমে তোমাদের মনোমতো পরিয়ে দিও।
শ্রীজাতক
আলোর ঘেরাটোপ থেকে রাত নিজেকে সরিয়ে রেখেছে
মৃত্যুকে সমঝে রেখে জীবনকে প্রত্যহ নখাগ্রে চেখে চেখে
হামাগুড়ি থেকে দেয়াল ধরে দাঁড়াতে শিখে মার ছুট খিঁচে
অনাদরে বনফুল রামধনু রঙ ছোঁড়ে জংধরা কামানের পিছে
জন্ম জয়তু জীবন মোমবাতি প্রাণের সুত্যগ্রে অগ্নি প্রজ্বলিত
নিঃশেষ অবশ্যাম্ভাবী জেনেও স্মিত অন্তঃহাস্য মৌন তথাগত
ষড়রিপু শরজাল খরতর প্রদোষ স্বল্পালোকে হাতছানি দিয়ে
বার বার রুহুকে আমার করেছ ভ্রষ্ট লালসার লালা ছড়িয়ে
যে বাঁশির সুর দিয়েছ কর্ণে সে বাঁশি তুমি লুকালে কোথায়
সারা বাঁশবন ঘুরে ঘুরে আমি বংশীবাদক ছটপট সন্দিধায়
কত না কাব্য লিখিলাম জপিলাম ধ্যানিলাম সে সুর গঙ্গোত্রী
রত্নাকর সমুদ্রের নোনাজলে সাঁতরে চলেছে অক্লান্ত অগ্নিহোত্রী
মিঠাশোণিতে আগুন-আগুন লেলিহান ঘুসঘুসে জ্বরের অনল
ঊষার দুয়ারে নগণ্য আমি তবু শ্রীভৃগু লিখে রাখে রাশিফল
মৃত্যুঞ্জয়
কখনও অন্যমনস্ক হাঁটছি কাগনি ধানক্ষেতের সরু আলপথ ধরে
হাঁটতে হাঁটতে সূর্যটা টুক করে পথের কিনারেই নেতিয়ে পড়ে।
বাঁশের কঞ্চি ঘেরা দু’একটি টিলায় তখন আনন্দ ঘন-জমকালো
ক্রমনিভু মালসা থেকে প্রমিথিউস বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে মুঠো মুঠো আলো।
নদীতীরে তেষ্টা মেটাতে অনার্য হরিণী খেলাচ্ছলে কৌমার্য হারিয়ে বেশ খুশি
রাধিকার অহং-বরফখণ্ড গলে গলে যমুনাজল ছলাৎচ্ছল এলোকেশী।
এক পৃথিবী দেখা চর্মচক্ষু গড়িয়ে গড়িয়ে অনায়াস ওপারের নিকষ অন্ধকারে
গেল তো গেলই এলো না ফিরে মাঝে মাঝে ডাকে শৈশবের চেনানাম ধরে।
খুব চেনা হলুদ পাখিটি মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অপলক
দূর দাবানল-ক্ষত অরণ্য পেরিয়ে পাখি উড়ে চলে সকাল-সন্ধ্যে তক।
আলপথে হাঁটা শেষ করে দাঁড়ালাম এসে— ভিড়ের প্রপঞ্চ চৌরাস্তায়
মাঝপথে কিছু নদী অহেতুক দৌড়ঝাঁপে শুকিয়ে কাঠ ভুগছে রক্তাল্পতায়।
তবুও আমাদের বাসনাসকল স্বপ্নমোচী-আকাশে আকাশে রঙ ধরে
উড়ে যাওয়া ঘরের ছাউনী ফের জোড়া লাগে ঝড়ের অব্যবহিত পরে।
জরা ব্যাধি রোগ শোক-স্বাদ একই জিহ্বা চেখে চেখে চৌখশ ওস্তাদ
মৃত্যুকে জয় করিনি তবে মৃত্যু দিয়ে জন্মের আনন্দে তুলেছি শঙ্খনাদ।
দোষের শিরোমণি
আমাদের হাঁটা-চলায় দোষ অনেক
হুজুরের করণকক্ষের ভেতরে ঢুকে চোখে চোখ রেখে
সরাসরি তাকিয়ে বলি: ‘আমি কি আসতে পারি স্যার’?
তকতকে পরিষ্কার রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে
এমনি এমনি হোঁচট খেয়ে পড়ি
হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে ভুগি দু’চারদিন।
আমাদের দেখা-শোনাতেও দোষ অনেক
যেটা দেখি সেটা প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে মেলে না
যেটা শুনি সেটাও ‘কোট আনকোট’ জিভ থেকে সরে না।
অদৃশ্য কেউ সেটা এমনভাবে বলে দেয়
তার অত মানে-টানে বুঝি না
আমাদের মাথানত নিশ্চুপ সম্মতি বুঝে নিয়ে
মামলা বিপক্ষে চলে যায়।
আমাদের বাঁচা-মরাতেও দোষ অনেক
আধার কার্ডের ছবির সঙ্গে আসল ছবি মেলে না
টিপসই দিতে গেলে বুড়ো আঙুলের রেখা ওঠে না
শ্মশানে উঠতে শ্মশানযাত্রী যে নাম বলে তা এপিক কার্ডে লেখা
নামের সাথে কষ্টে-সৃষ্টে মিললেও বাবার নামের বানানে ভুল বেরিয়ে পড়ে।
আমাদের হাঁটা-চলা দেখা-শোনা আর বাঁচা-মরাতেও দোষ অনেক
আমরা দোষের শিরোমণি।
পাণ্ডুলিপি: দোষের শিরোমণি
লেখক: আশুতোষ বিশ্বাস
প্রচ্ছদ: পলাশ দাস
দাম: পঞ্চাশ টাকা
প্রকাশক: টার্মিনাস, কলকাতা
অন্যস্বাদ, অন্যভঙ্গি,, অনবদ্য, অসাধারণ
উত্তরমুছুন