.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ
বেশিরভাগ পাঠক  সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে (১৫ জুন, ১৯২২ — ১০ অক্টোবর, ১৯৭১) হয় ঔপন্যাসিক নয় ছোটগল্পকার হিসেবে জানেন। কিন্তু তিনি তিনি যে একজন মস্ত বড়ো নাটক লিখিয়ে ছিলেন— সে ব্যাপারটা যারা তাঁর ওপর অনুসন্ধিৎসুদৃষ্টি রেখেছেন তাঁরাই একমাত্র জানেন। তিনি তাঁর পঞ্চাশ বছরের জীবনে উপন্যাস লিখেছিলেন মাত্র তিনটি— ‘লালসালু’ (১৯৪৮), ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) আর নাটক লিখেছিলেন চারটি— ‘বহিপীর’ (১৯৬০), ‘উজানে মৃত্যু’ (১৯৬৩), ‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬৪) এবং ‘সুরঙ্গ’ (১৯৬৪)। বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অবশ্যই একজন শক্তিশালী কথা-সাহিত্যিক ও সার্থক নাট্যকার। পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-জনক পেশায় ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও মাতাশ্রী নাসিমা আরা খাতুনও ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা আর তাদের গর্ভের গর্বিত সন্তান বাংলা সাহিত্যের গর্ব-মশাল প্রজ্জ্বলন করেছেন। সমাজের মধ্যে প্রথা পরম্পরাগতভাবে প্রবাহিত নানাবিধ কুসংস্কার, প্রতারণা, ধর্মকে হাতিয়ার করে অধার্মিক কাজ-কারবার, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়জাত অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো হাতির পা-কে থাম ভেবে গতানুগতিক বোধহীন জীবনচর্চায় সুবোধ বালকের তকমা নিয়ে কৃচ্ছতা অনুভবী জীবন নয়। বাংলাদেশের ভূগোল সমীপে হারিয়ে যেতে বসেছে এমন লোকায়ত ধ্রুপদী জীবনপ্রবাহের দিকে ঔপন্যাসিকের দরদি মনের অনুভবগুলোকেই তিনি অক্ষরে অক্ষরে জিইয়ে রাখতে চেয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে। চট্টগ্রাম জেলার ষোলশহরে তাঁর জন্ম এবং জানা যায় তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়েছিল যখন তিনি ফেনী স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ভোরের আলো’ নামক পত্রিকা তাঁর হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ‘সীমাহীন এক নিমেষে’ তাঁর   প্রথম লেখা ছাপা অক্ষরে প্রকাশের গৌরবদীপ্ত নিদর্শন বলে সকলেই মনে করেন, এবং এটি ঢাকা কলেজ জীবনে প্রবেশের পর প্রকাশ সৌভাগ্য পেয়েছিল। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পের নাম– ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টার মিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বি.এ পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও শেষ করেননি। ফেনী হাইস্কুলে ছাত্র থাকাকালেই ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। এ সময় তিনি হাতে লেখা ‘ভোরের আলো’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র আরেকটি বিশেষ গুণ ছিলো তিনি ভালো ছবি আঁকতেন। শৈশব থেকে তিনি সাহিত্যের প্রতি যেমনি  ছিলেন আগ্রহী, তেমনি চিত্রশিল্পেও আগ্রহী ছিলেন। স্কুলের হাতে লেখা ম্যাগাজিন ‘ভোরের আলো’-র সমস্ত অলংকরণ ও অঙ্গসজ্জা তিনি নিজের হাতে করেছেন। 

তার লেখা প্রথম গল্প ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষায় তার দক্ষতা ছিল। কনটেম্পোরারি নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৪৫-’৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, পরিচয়, অরণি, পূর্বাশা প্রভৃতি পত্রিকায়ও তার লেখা প্রকাশিত হতো। কর্মজীবন শুরুর তিন মাস আগে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন।

নোয়াখালী অঞ্চলের মজিদ গারো পাহাড়ি অঞ্চলে ভণ্ডপীরের বেশ ধারণ করে সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো বিষয়গুলো ‘লালসালু’ উপন্যাসে অত্যন্ত সুচারুরূপে উন্মোচিত হয়েছে। এই উপন্যাসের বিশিষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে– মজিদ, খালেক ব্যাপারী, রহিমা, আক্কাস, আমেনা, তাহেরার বাপ প্রভৃতি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তাঁর উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহ রীতির ছায়া পাওয়া যায়। যে রীতির প্রথম আলোকশিখা দেখা দিয়েছিল সতীনাথ ভাদুড়ি এবং তাঁর ‘জাগরী’ (১৯৪৬), উপন্যাসে। যেখানে চেতনাপ্রবাহ রীতি নামক সাহিত্য ধারার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ দেখা গিয়েছিল। চেতনাপ্রবাহ রীতি বা ‘Stream of Consiousness’ কথাটি মনস্তত্ত্ব জাত। দার্শনিক উইলিয়াম জেমস মানবমনের অর্ধচেতন স্তরে ঘটে চলা নানান চিন্তা-স্মৃতির ঢেউকে প্রবহমান জলের প্রবাহের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ১৮৯০ সালে জন বের্গস ‘এলান ভাইটাল’ নামে মানবের জীবনীশক্তি পূর্ণতার প্রসঙ্গে আরো একটি তত্ত্বের কথা বলেন। মূলত এই দুই দর্শনভাবনার সংমিশ্রণেই চেতনাপ্রবাহ রীতি তত্ত্বটির উদ্ভব বলে মনে করা হয়। ১৯১৮ সালে ডরোথি রিচার্ডসনের ‘Pointed Roofs’ উপন্যাসের আলোচনায় ‘Stream of Consiousness’- প্রসঙ্গটির আলোচনা সকলের নজরে আসে এবং বিষয়টি সাহিত্যিক মহলে দ্রুত ব্যাপ্তিলাভ করে। মানব অন্তরের জটিল রেখাচিত্র অন্তগূঢ় মনের বিশ্লেষণ এই রীতির রচনায় স্থান করে নেয়। উল্লেখ্য, সতীনাথ ভাদুড়ীর তাঁর ‘জাগরী’ উপন্যাসের জন্য প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ীর এক নতুন দিগন্তের মুক্ত আকাশ পাঠকের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন। সতীনাথ ভাদুড়ী ছাড়াও বুদ্ধদেব বসু’-র ‘তিথিডোর’ (১৯৪৯), ‘নির্জন স্বাক্ষর’ (১৯৫১), ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়’-র ‘অন্তঃশীলা’ (১৯৫৫) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’-র ‘কাঁদো  নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসের নাম একসূত্রে উচ্চারিত হয়। সেই রীতিরই আরো সুগাঢ় প্রতিফলন দেখা গেল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের উপন্যাসে, নাটকে এমনকী ছোটগল্পের চরিত্রের অন্দরে অন্দরে। গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য কাদের। সে এক যুবতীকে বাঁশঝাড়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করে, যা ওই গ্রামেরই আশ্রিত স্কুলমাস্টার আরেফ আলি দেখে ফেলে প্রভৃতি ঘটনার সমন্বয়ে রচিত হয়েছে– ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪)। ‘চাঁদের অমাবস্যা’ মনঃসমীক্ষমূলক উপন্যাস বলে সমালোচকেরা অভিমত জ্ঞাপন করেছেন। এই উপন্যাসটি ফ্রান্সে অবস্থানকালে রচিত হয়েছিল। ‘আরেফ আলি’ এই উপন্যাসের নায়ক। কুমুরডাঙা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর নাম বাঁকাল নদী। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যারের ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের সঙ্গে কিছুটা হলেও বাকাল নদীর নামের অর্থ-সাদৃশ্যতা কেউ কেউ অনুভব করেন। বাকাল নদীর পার জুড়ে গড়ে ওঠা জনপদের জীবনকাহিনি নিয়ে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসের মূল কাহিনি গড়ে উঠেছে। খেদমতুল্লাহ, মুস্তফা, খোদেজা, সখিনা, কফিলউদ্দিন প্রভৃতি চরিত্রগুলো ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের মূল চালিকাশক্তি এবং উপজীব্য ঘটনার বাহক। ‘নয়নচারা’ ও ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ। ’৪৭-এর দেশভাগের ফলে কিছু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায় এবং কিছু মুসলিম পরিবার এদেশে চলে আসে, ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’ নামক গল্পে তারই মর্মদ্ভুত কাহিনি রয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ (১৯৬১), ‘আদমজী পুরস্কার’ (১৯৬৫), ‘একুশে পদক’ (১৯৮৪), এবং ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ (২০০১) সালে তিনি পেয়েছেন। ‘লেখকদের লেখক’ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ– ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি পরলোকে গমন করেন। প্যারিসের উপকন্ঠে মদোঁ-স্যুর বেলভুতে তাঁর নশ্বর দেহ সমাধিস্থ করা হয়।   

‘বহিপীর’ (১৯৬০) সালে প্রকাশিত হলেও এর রচনাকাল ১৯৫৫। এই নাটকটির জন্য তিনি P E N পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নাটকের উদ্দেশ্য দর্শক মনোরঞ্জন হলেও আধুনিক জীবনের ছায়াপাতে তা রসঘন আবেদন দাবি করে। ঐতিহাসিক নাটক এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকলেও নাটক সাহিত্যের একটি বিশেষ শক্তিশালী আবেদনক্ষম শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় তার মধ্যে আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পক্ষ-বিস্তার না থাকলে চলে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের আগে পর্যন্ত বাংলা নাট্য সাহিত্যে অনেক অনেক নাট্য-নিরীক্ষাপ্রবণ নাট্যকারদের আবির্ভাব ঘটেছে। মন্মথ রায়, শম্ভু মিত্র, বাদল সরকার হয়ে আবসার্ড নাটকের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্রভূমি আধুনিক বাংলা নাটক দেখে ফেলেছে। আর বাংলাদেশের অন্যান্য নাট্যকারদের মধ্যে  সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-ই সর্বপ্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী নাটক লিখতে তৎপর হলেন। এর কারণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের বহুদর্শিতা। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন অলীক কুনাট্য দিয়ে বাংলাদেশের রঙ্গমঞ্চে সাময়িক মঞ্চ-সফলতা আসলেও কালের সুদীর্ঘ রথের রেশে একদিন তাকে থেমে যেতে হবে। পুরোনো রশি আর পুরো্নো রথের শরীরে তাপ্পি মেরে যুগান্তের অভিমুখে ধাওয়া করা বেশিদিন সম্ভবপর হবে না। তাঁর প্রথম নাটক ‘বহিপীর’ (১৯৬০) দিয়েই তার নাট্যশরীরে নতুন রক্তের প্রবাহ-প্লাবন আনতে চাইলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ (১৯৪৮)-তে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের ভেতরে ধর্ম কীভাবে ভণ্ডধার্মিকের ইচ্ছাপথে অধর্মের শুশ্রূষা করছে। ব্যক্তি সমাজ-মানুষকে দিনের পর দিন রক্তহীন পাংশুটে আচার যাপনের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানিয়ে ফেলছে। তার অশ্রুসজল ইঙ্গিত দিয়ে একজন সচেতন ঔপন্যাসিক হিসেবে তার নৈতিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রেখেছেন। আপাত ধার্মিকের অন্তঃসারশূন্যতাকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আবার নতুন করে পাঠকের সামনে আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে দর্শকের সামনে উপস্থাপনের প্রথম প্রয়াস রখলেন তাঁর প্রথম নাটক ‘বহিপীর’ দিয়ে। মনে রাখতে হবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ একজন জাত-কথাশিল্পী। উপন্যাস আর ছোটগল্পের ভুবন তার মজ্জাগত। তবে তিনি আবার কেন যে কথা আগে তার উপন্যাস বা ছোটগল্পে বলা হয়ে গেছে সেই পুরোনো কথা আবার নাটকের নতুন আবেদনময় আঙ্গিকে বলতে চাইলেন? এর কারণ একটাই— সমাজের সর্বাত্মক প্রকেন্দ্রে সমাজ ব্যাধির অশুভ লক্ষণগুলোকে প্রতিবিম্বিত করা। একজন ঔপন্যসিকের এলাকায় তার পাঠকসংখ্যা একধরনের। অন্তত সমাজের মধ্যে যারা অক্ষরজ্ঞানের অধিকারী, তাদের বাইরেও যে আর একশ্রেণির বৃহৎ বোধিবৃত্ত আছে, যাদের হয়তো অ্যাকাডেমিক শিক্ষার শংসাপত্র নেই, কিন্তু জীবনাভিজ্ঞতায় বোধ এবং বুদ্ধিতে অন্যকেও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে— সেই শ্রেণির মানুষের জন্য ওয়ালীউল্লাহ তার সামাজিক অভিজ্ঞানকে পৌঁছে দেবার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে নাটককে বেছে নিয়েছেন। নাটকের আবেদন সংক্রমণ প্রবাহ অতি দ্রুত চালে চলে। আমদের মনে আছে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কথা। আমাদের অখণ্ড বাংলাদেশে ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রভাব এবং তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল আজও যে কোন বাঙালির সিনা টান টান, সুখদ উত্তেজনায় দৃঢ় রাখে তন-মন। ‘বহিপীর’ মুসলিম সমাজ এবং মননে বাহিত একটি  চৈতনিক রোগগ্রস্ত অব্যয়ের দিকে নাট্যকার তার সচেতন প্রজ্ঞাকে নিয়ে গেছেন। বাঙালি মুসলিম সমাজে ভণ্ড পীর,  ফকির ও মোল্লাদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে এর আগে কাজী ইমদাদুল হক তাঁর ‘আব্দুল্লাহ’ (উপন্যাস) এবং আবুল মনসুর আহমেদ ‘হুজুর কেবলা’ নামক (ছোটগল্প)-এ অত্যন্ত নির্ভীকতার সাথে দেখিয়েছিলেন। নুরুল মোমেন তাঁর ‘নেমেসিস’ (১৯৪৮) গ্রন্থে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে প্রথম আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন বলে নাট্য সমালোচকেরা মনে করেন। এরপর মুনির চৌধুরীর ‘কবর’ (১৯৬৫), আশকার ইবনে সাইদের ‘অনেক তারার হাতছানি’, (১৯৬৫), আবু যোহা নুর আহমদের ‘প্রতিরোধ’ (১৯৭০), সাইদ আহমদের ‘কালবেলা’ (১৯৭৬), জিয়া হায়দার-এর ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যানী আনন্দ’ (১৯৭০) এবং এর সঙ্গে একাসনে উচ্চার্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ‘বহিপীর’ (১৯৬০), ‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬৪) এই আটটি নাটক আধুনিক সময়ের চিন্তাভাবনা এবং বিষয় বৈচিত্র্যের নিরিখে বাংলাদেশের বাংলা নাটকের বাঁকফেরা ট্রেডমার্ক-যুক্ত নাটক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর নাটকে জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার পরিবর্তে তিনি মুখ ফিরিয়েছেন— সমাজের গভীরতর অন্তর্গূঢ় সামাজিক পরিমণ্ডলের চিরচেনা বারান্দায়। তার নাটক একেবারেই ব্যতিক্রমী। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের নবজাগরণ বলতে তারা আরব-পারস্যের অতীত আদর্শকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের সংগঠিত এবং সেই আদর্শ অনুসরণের সক্ষমতা বা পারঙ্গমতাকে প্রাধান্য দিত। আর এই কারণেই ‘আনোয়ার পাশা’, ‘কামাল পাশা’, ‘কাফেলা’ জাতীয় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের জীবন ও কর্ম অনুসরণ প্রয়াসী হয়ে ঐতিহাসিক নাটক রচনায় সে সময়ের নাট্যকারেরা বেশি উৎসাহবোধ করতেন। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং তার সঙ্গে উচ্চার্য আরো ছয়টি নাটক স্রষ্টারা ব্যতক্রমী পথানুসরণ করলেন। নাট্য সমালোচক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের সৃষ্ট নাটক সম্পর্কে তার ঋদ্ধ মতামত জ্ঞাপন করেছেন যা এককথায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের নাট্যচর্চার অন্দর এবং অন্তর মহলের মূলকথা।--‘‘নাটক তার মাত্র তিনটি, একাঙ্কিকাটি বিবেচনায় গণ্য না-করলে। কিন্তু তিনটিই বিভিন্ন গোত্রের। আমাদের নাট্যসাহিত্যে আবসার্ড নাটকের জন্মদাতা সম্ভবত তিনিই। ‘তরঙ্গভঙ্গ’ ও ‘উজানে মৃত্যু’-কে অন্যকোনো ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা অসম্ভব। ‘সুড়ঙ্গ’ নাটিকাটি ঘোষিতভাবেই ‘কিশোর-কিশোরীদের জন্যে লেখা’ যার লক্ষ্য ঐ বয়সী পাঠক দর্শককে ‘আমোদ’ যোগানো। আর ‘বহিপীর’ রঙ্গব্যঙ্গপ্রবণ কমেডি।’’

এইরকম জায়গায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ‘বহিপীর’ আবারও ‘অতি অল্প হইল’-র ডবল স্ট্রোক আর কী ! নাটকটি অত্যন্ত স্বল্প আয়তন, স্বল্প পরিসর— মাত্র একদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং স্বল্প নাট্যচরিত্র মানে মাত্র ছয়টি চরিত্রের মধ্য দিয়ে অন্বিত। নাটকের কাহিনি মোটামুটি এইরকম : জমিদার হাতেম আলি স্ত্রী খোদেজা ও পুত্র হাশেমকে নিয়ে তার বজরা নৌকায় বেরিয়েছেন। প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে হাতেম আলি দ্রুততার সঙ্গে তার বজরা অন্যত্র সরানোর সময় নাটকীয়ভাবে অন্য আরেকটি বজরার সঙ্গে জোর ধাক্কা লেগে যায়। এ ঠিক গ্রিক নাটকের নেমেসিসের   মতো। এক কাজ করতে গিয়ে অন্যরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যাওয়া আর কি! এখানে ঝড়ো পরিবেশে অন্য বজরার মাঝিদের মতো নিজের বজরাকে সন্তর্পণে মুশকিল থেকে নিরাপদ জায়গায় পোঁছাতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এই দুর্ঘটনা থেকে প্রতিরোধের সহস্র প্রচেষ্টায় হঠাৎ করে কোন ভুল করা না সত্ত্বেও জল ঢালা হয়ে যায়। এখানেও তা-ই ঘটেছে। সেই হঠাৎ করে অন্য বজরার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাওয়া বজরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবার ফলে সেই বজরায় পূর্ব থেকে অধিষ্ঠিত একজন পীরসাহেব হাতেম আলির বজরায় আশ্রয় নেন। তাকে আশ্রয় দেওয়া মানবিক ঔচিত্যের মধ্যেই পড়ে। হাতিম আলির বজরায় আশ্রিত এই পীরই হলেন বহিপীর। বৃদ্ধ এবং বিপত্নীক এই পীর সাহেব তার এক মুরিদের তরুণী কন্যাকে বিয়ে করেন। পীরভক্ত মুরিদ তার সওয়াব কামাতে তরুণী মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন। আর মুরাদ-তনয়া অষ্টাদশী তাহেরা বিয়ের রাত্রেই পালিয়ে আসে, নাটকীয়ভাবে সেই তরুণী ঢাকার কাছাকাছি ডেমরাঘাটে বিপণ্ণ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হাতেম আলির স্ত্রীর কথায় তাকে তাদের বজরায় আশ্রয় দেন। হাতেম আলির বজরায় আশ্রয় নেওয়া বহিপীর সাহেব জানেন না তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী যাকে তিনি খুঁজতে বেরিয়েছেন বর্তমানে তার সঙ্গে এই একই বজরাতে আছে। নব দম্পতির আশ্রয় একই বজরায়— পাঠক আর দর্শকের চেতনাকে টান টান রাখার জাদুকৌশল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ খুব ভাল করেন জানেন। নাটকের নাটকীয়তার উল্লম্বন দণ্ড তির তির করে ওপরে ঊঠতে থাকে। দুজন দুদিকে ছুটছে— একজন বহিপীর সে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে সমস্ত শক্তি, সমস্ত প্রলোভনের ভাণ্ড উজাড় করে দিয়ে তাকে আবিষ্ট করতে চাইছে— আর তাহেরাও বহিপীরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইছে প্রাণপণে। অথচ দৈবি-পাকে তারা দুজনেই একই বজরাতে।   

রেশমপুরের ‘যৎকিঞ্চিত জমিদারি’ যেটাও ‘সান্ধ্য-আইন’-র কবলে পড়ে নিলামে উঠতে চলেছে। এইরকম এক অসহনীয় মনঃকষ্ট এবং জাগতিক সামূহিক সম্মান ধু-লুন্ঠিত হওয়ার প্রদোষকালে হাতেম আলি ব্যতিব্যস্ত। স্ত্রী পুত্রকে তিনি জানাতে চান না তার জমিদারি তৎসংক্রান্ত ব্যাপারে আসন্ন  বিপণ্ণতার কথা। তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসছেন— তার শারীরিক চিকিৎসার কাজে, ডাক্তারের কাছে। আর এদিকে বহিপীর তার নব বিবাহিত স্ত্রীকে খুঁজতে তার তিরিশ বছরের বিশ্বস্ত খেদমতগার হকিকুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী তাহিরাকে খুঁজতে বেরিয়ে নৌকা দুর্ঘটনায় পড়েছে। আশ্চর্য এই-- যে বজরায় তারা এখন অবস্থান করছেন সেই বজরাতেই তার স্ত্রী তাহেরা আছে, এই খবর বহিপীর জানতেন না, কিন্তু জেনেছে তার তিরিশ বছরের বিশ্বস্ত খেদমতকারী হকিকুল্লাহ। সেই জানিয়েছে এই  বজরায় তারা যাকে খুঁজতে জীবন সন্নিপাত করে যে অবস্থায় বর্তমানে আছে। তাদের উদ্দিষ্ট মানুষ এই বজরাতেই আছে। এদিকে ঘটনার প্রবাহপরম্পরায় হাতেম আলি ঢাকায় তার বন্ধু আনোয়ারউদ্দিনের গৃহে পৌঁছে আশার ছলনে চরম হতাশার মধ্যে পড়ে। বন্ধু তার কাছে সাহায্যের হাত নিয়ে আসে না। আর আজকেই তার জমিদারির আখেরি দিন। মানসিকভাবে অত্যন্ত বিব্রত এবং হতাশাগ্রস্ত হাতেম আলির অস্থিরতা বহিপীরের নজরে আসে। সমাজের দুই প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি— দুজনেই স্বীয় চাহিদার অবস্থাবৈগুণ্যে আজ এই মুহুর্তে তারা মস্তকে আঘাতপ্রাপ্ত চতুষ্পদ প্রাণীর মতো স্থিরচিন্তাহীন। বহিপীরের কাছে যে সম্পদ আছে তা দিয়ে হাতেম আলির সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, আর হাতেম আলির কাছে যে সম্পদ আছে তা অর্পণ করলে বহিপীরের সমস্যা মিটে যাবে। অভাবনীয় এক সমস্যার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন নাট্যকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। পীর সাহেব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, কিন্তু একটা শর্তে—‘‘আমি পীর মানুষ, আমি অত টাকা কোথায় পাইব— যাহার দ্বারা আপনার জমিদারি উদ্ধার করা যাইতে পারে। কিন্তু খোদা আমাকে যথেষ্ট অর্থ দিয়াছেন।… তিনি আমাকে অনেক ধনী মুরিদও দিয়াছেন, যাঁহাদের কাছে হাত পাতিলেই যাহা চাহিব তাহাই তাঁহারা দিবেন।… আপনাকে আমি টাকা কর্জ দিব এই শর্তে যে, আমার বিবি আমার সঙ্গে ফিরিয়া যাইবেন। ’’ 

হাতেম আলি জমিদারি বাঁচানোর চেষ্টায় বিমর্ষ হয়ে পড়েন। শেষপর্যন্ত নাটকে দেখা দেখা যায় বহিপীর প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও তাহেরাকে বশে আনতে পারে না। সে প্রতিবাদী আধুনিকা নারীর মতোই ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছে— ‘‘ আমাকে বিবি ডাকবেন না। বিয়েতে আমি মত দিই নাই। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি।... আপনি পুলিশে খবর দিতে পারেন,…’’ 
এরপর আর কিছু করার থাকে না। তাহেরা হাশেমের হাত ধরে সামনে এগিয়ে যায়। নাটকটি বহিপীরের সহযোগিতায়  হাতেম আলি তার জমিদারিও রক্ষা করতে পারবে এরকম একটা ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয়। হাশেমের হাত ধরে বহিপীরের চোখের সামনে দিয়ে তাহেরা চলে গেলেও অসহায় বহিপীর  কোনরকম  ক্রোধ প্রকাশ  করতে পারে না, বরং তার মুখ থেকে একটা ভালবাসার শান্তিবাণী বিঘোষিত হয়-- ‘‘তাহেরা তো আগুনে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া যাইতেছে না। তাহেরা নতুন জীবনের পথে যাইতেছে।’’ এই কথা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বহিপীর তার খল চরিত্রের সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলোকে ঝেড়ে ফেলে হঠাৎ নায়কোচিত বৈশিষ্ট্যে ঊঠে যায়। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়ে ওঠে ‘নতুন জীবনের জয়ধ্বনি’ এবং ‘পুরাতন চেতনার’ পরাজয়। ‘লালসালু’ উপন্যাসের পরিণতি চেতনাপ্রবাহরীতির পথে ধরে ‘বহিপীর’ নাটকে এসে পূর্ণ পরিণতির রোদ ঝলমলে আকাশের নীচে ক্লান্ত পথিকের একটু জিরিয়ে নেবার বৃক্ষশাখার মৃদু পল্লব বাতাস এসে লেগেছে ঘর্মাক্ত শরীরে। এই প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের নাট্য গবেষকের উক্তি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য— ‘‘… কিন্তু আমরা জানি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ শিল্পী হিসেবে কেবলই সমাজের বহির্স্তরকে আশ্রয় করেন না। তাঁর রচনামাত্রই স্তরবহুল, বাহির ও অন্তর সত্যে উজ্জ্বল। বহিরাঙ্গিক সমাজবাস্তবতা তাঁর অবলম্বন হলেও অন্তর্গত মৌল প্রতিপাদ্য নয়। অন্য কথায়, একটি সমাজ চৈতন্যমূল ও প্রাত্যহিক বাস্তবতাকে অবলম্বন করেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর অভিপ্রেত সত্য পরোক্ষে, অনাসক্ত ও অনুত্তেজিত ভঙ্গিতে প্রকাশ করেন। বহিপীর-এও তিনি সেই অন্তর্গত সত্য (inner truth), তাঁর অস্তিত্ববাদী বক্তব্যসহ উপস্থিত। বহিপীর-এ গৃহীত চরিত্র বিশেষত, তাহেরা, হাশেম আলির পুনর্জাগরণ, দায়িত্বের দায়ভার বহন করে তাদের শুদ্ধ সত্তা ও মীমাংসিত চেতনায় সুস্থির হওয়ার মাধ্যমেই নাট্যকারের প্রতিপাদ্য, অন্বিষ্ট সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ’’৩   

‘তরঙ্গভঙ্গ’ (১৯৬৪) নাটকটিও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের আরও বেশিমাত্রায় শিল্পশুদ্ধ নাটক। তাঁর নামের সঙ্গে স্বতন্ত্র চিহ্নিত এবং অন্তর্মুখী চিন্তাপ্রকর্ষের এই নাটক পাঠক হৃদয়ের গভীরতম তলদেশে এই নাটকের মণিমাণিক্যগুলো এসে জমা হয়। এই নাটকের সঙ্গে তার ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের আন্তর্প্রত্যয় চেতনপ্রবাহের ধারার সঙ্গে এসে মিশে গেছে। এই নাটকটির রচনাকাল সম্পর্কে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জানিয়েছিলেন যে, নাটকটির রচনাকাল ১৯৬১—৬২। ১৯৬২ সালে ‘সংলাপ’ পত্রিকায় অসম্পূর্ণভাবে প্রকাশের পর বাংলা একাডেমি, ঢাকা  থেকে ১৯৬৪ সালের জুন-জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। মোট আটটি চরিত্র আর তিনটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে নাটকটি শৃঙ্খলিত। এই নাটকের মূল বিষয়— একটি হত্যা এবং সেই হত্যা মামলার বিচারব্যবস্থা ও তার পদ্ধতিকে কেব্দ্র করে পল্লবিত হয়েছে। নায়িকাপ্রধান এই নাটকের প্রধান চরিত্র আমেনা। সে তার স্বামী এবং শিশুসন্তানকে নিজের হাতে হত্যা করেছে। আব্দুস সাত্তার নেওলাপুরী এই হত্যা মামলা নিয়ে আদালতে গেছেন। ‘নেওলাপুরী’ স্থাননামের মানুষ হিসেবে পদবির শেষে এই স্থাননাম যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘নেউল’ শব্দজাত ‘বেজি’ তদজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেধর এই মানুষ। যে আমেনার বিরুদ্ধে আদালতে গেছে। কিন্তু এই মামলার নিষ্পত্তি আর হয় না। আদালতের কাজ এবং বিচারপদ্ধতির নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে গিয়ে মামলায় তারিখের পর তারিখ, তারিখের পর তারিখ আসতে থাকে। এই নাটকে ভিখারিণী চরিত্রটি বিবেক চরিত্রের মতো নাটকের উত্থান-পতনে মিশে আছে। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা অন্য যে কোনো নাট্যকারের নাটকের মধ্যে ভিখারিণী, বৃদ্ধ, মাতাল, ঠাকুর্দা জাতীয় চরিত্রকে আসতে দেখি। নাট্যকার এই ধরনের অপ্রধান চরিত্র কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় চরিত্রের মধ্য দিয়ে পাকে পাকে আটকে যাওয়া ঘটনার ঘনঘটা থেকে বেরিয়ে আসার নিশ্চিতপন্থা হিসেবে এই জাতীয় চরিত্রকে সময় বুঝে নাট্যমঞ্চে নিয়ে আসেন এবং তারাই কিন্তু শেষমেশ নাটকের গ্রন্থিমোচনে সহায়তা করে। ‘তরঙ্গভঙ্গ’ নাটকে ভিখারিণী সেই জাতীয় চরিত্র। আমেনার হয়ে বিচারের কাঠগড়ায় উঠে সে জজের প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথাই বলে দিয়েছে। আমেনা তার স্বামীকে তার শিশুসন্তানদের হত্যা করেছে। কিন্তু হত্যা করার পেছনের কারন কী? এই সমাজ সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অসাম্যই যে দায়ী তা বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড দারিদ্র্যের ভারে চার চারটে সন্তানের মুখে একবেলার ভাতও তুলে দিতে পারে না। কোলের শিশু সন্তানের গলা টিপে সন্তানকে হত্যা করেছে মা আমেনা। স্বামীকে বিষ খেতে দিয়েছে ওষুধের পরিবর্তে, কারণ রুগ্ন স্বামীর জন্য ওষুধের জোগাড় সে করতে পারেনি। আর স্বামীর মৃত্যু যন্ত্রণা, কষ্ট সে সহ্য করতে পারে নি। রুগ্ন স্বামীর সারাদেহে রোগা হাতে শুধু মাদুলি, তাবিজ-কবজ বাঁধা। সবাইকে হত্যা করে আমেনা আত্মঘাতী হতে চেয়েছিল— কিন্তু আবার বাকি সন্তানগুলোর মুখের কথা ভেবে সে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে নি। এর চাইতে কড়া সত্য আর কী হতে পারে। নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা গেছে— জজসাহেব আত্মহত্যা করেছেন। এবার তাঁর জায়গায় যে নতুন বিচারক এসেছেন তিনি— আরো বেশি তীক্ষ্ণধী, আগের বিচারকের মতো শান্ত ও স্থির-প্রাজ্ঞ নন। ভিখারিণী এই দৃশ্যে আবারও এসেছে, বিবেকের দূত হিসেবে। স্বামী-সন্তান হত্যাকারী আমেনার প্রতি ঘৃণা নয়, বরং কৌতূহল তৈরি হয়। কারণ আয়নায় সমাজের মুখ ভেসে ওঠে একটি দরিদ্র পরিবারের কষ্ট, যন্ত্রণাদীর্ণ সমাজ হাঁড়ির একটি ভাত টিপে। আর এই কারণেই প্রথম বিচারপতি নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে আত্মহত্যা করেছে। এই আত্মহত্যা আসলে সমাজ বিবেকের আত্মহত্যা। এই বিবেকেরাই সমাজের বিচারক—  তারা আসামীকে ফাঁসির হুকুম দিয়ে কলমের নিব ভেঙে গম্ভীর চলে যেতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত বিচারক যিনি আত্মহত্যা করেছেন— তিনি অন্তত বুঝেছেন, আমেনা বাহ্যিক দিক থেকে হত্যাকারী হলেও এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে সমাজই দায়ী সেকথাই সমাজচিন্তক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার নাটকের মধ্যে দেখাতে চেয়েছেন। নাটকের প্রথম দৃশ্যে দেখা গেছে বিচারক তাঁর আসনে বসে নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মঞ্চ নিস্তব্ধ, কেবলমাত্র বিচারকের নাসিকা গুঞ্জন চলছে। নাট্যদর্শক উত্তেজনাহীন হাসির কলরোলে নড়েচড়ে বসে। খেতে দিতে না পেরে মাতা তার স্নেহের আত্মজকে হত্যা করেছে— এইরকম  সৎ অবস্থার পরিমণ্ডলে কার্যত বাধ্য এক আসামিকে ফাঁসির আদেশ কীভাবে দিতে পারবে বিচারক ? বিচারককে তো আসামির পক্ষটাকেও একবার হলেও ভেবে দেখতে হবে। এ হত্যার দায় কি আসামী স্যব্যস্ত আমেনার একার ? আমেনা যে সমাজে দাঁড়িয়ে আছে প্রকারান্তরে সেই সমাজই কী এই হত্যার পটভূমি তৈরি করে দেয় নি ? সমাজ জীবনের প্রগাঢ় উত্তরহীন অমিমাংসিত জিজ্ঞাসাই নাটকের চৌহদ্দি জুড়ে ঘোরাফেরা করেছে। সবসময় ফাঁসি বা মৃত্যদণ্ডই ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ড হতে পারে না।এমনকি যে সমাজ যেখানে তার বাসিন্দাদের খিদের ব্যবস্থার সুরাহা করতে পারে না, সে সমাজের বিচার ব্যবস্থায় খাদ্যাভের কারনে সংঘটিত কোন হত্যাকাণ্ডে ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ডের মতো আদেশ ঘোষণা করতে পারে না। এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘তরঙ্গভঙ্গ’-এ দেখাতে চেয়েছেন। প্রথাগত বিচারে একজন হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড শাস্তিবিধান ঘোষণা করারই কথা—কিন্তু এই নাটকে প্রথম থেকেই দেখা যাচ্ছে— ‘বিচারক নিদ্রাচ্ছন্ন’... ‘চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না... ‘ আসলে বিচারক ঝিমিয়ে পড়ছেন এই বিচারের বিধান শোনাতে। কারণ বিচারক যিনিই হন না কেন, তিনি আইনশাস্ত্র বিচারশাস্ত্র খুব ভালো করেই পাঠ করেছেন, তাঁর পঠিত আইনের বিধানশাস্ত্রে প্রকৃত আসামীকে খুঁজে তাকে শাস্তি বিধান করার ক্ষেত্রে তিনি আসামী হিসেবে গতানুগতিক একজন ‘মা হন্তারক’-কে সামনে পেলেও তিনি বুঝে নিয়েছেন—এই হত্যার পেছনে অন্য কেউ আছেন। তখন তাঁর পক্ষে বিচারের বাণী শোনাতে সময় লাগছে। এই অবস্থায় আদালতে উপস্থিত বিচারের রায় শুনতে উদগ্রীব দর্শক-শ্রোতা ‘যুদ্ধংদেহী’ মনোভাব নিয়ে তেড়ে আসে এবং  বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেই  সমাজের ডাইরেক্ট হন্তারক প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত আমেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমেনার মৃত্যু ঘটে। আমেনাকে মেরে ফেলা হয়, অর্থাৎ সমাজ নিজেকে পরিষ্কার পবিত্র প্রতিপন্ন করতে একটা খড়কুটোময় নিষ্পাপ জীবনকে বলিকৃত করে।   বিবেকহীন সমাজের মুখের ওপর পূর্বতন জজের ঝুলন্ত মৃতদেহ ঝুলছে দেখা যায়। এটা বিবেকের মৃত্যুর প্রতীক হয়ে বুদ্ধিমান পাঠক দর্শকের মাথার ওপর ঘোরাফেরা করে। ‘লালসালু’ উপন্যাসের আবেদন আমাদের সমাজে ‘শেষ হয়েও শেষ হয় না’, সত্যিকার অপরাধী মজিদের বিচার হয় না। পাঠক মনের সেই জিজ্ঞাসার একটা উত্তর যেন পাঠক এই নাটকে আশা করেছিলেন—কিন্তু এখানেও আমেনার বিচার হলো না। তবে নাট্যকার বিচারকের মৃত্যুদৃশ্যের মধ্য দিয়ে দর্শকের সেই বিচার বাসনার কিছুটা সদগতি করেছেন বলা যায়। ছকে বাঁধা নিয়মে সমাজ চলে, বিচারক, আসামী এমনকী সমাজের সাধারণ মানুষ প্রচলিত নিয়ম তরঙ্গের মধ্য দিয়েই জীবনপ্রণালি বাহিত করে। নাটকে ‘তরঙ্গভঙ্গ’ হয়েছে একমাত্র বিচারকের স্বেচ্ছামৃত্যুতে। সত্যিই কল্পিতসমাজ চৈতন্যের দিকে স্থির চোখ রেখে তাকালে দেখা যাবে—অর্থনৈতিক বল, আর লোকবল যার আছে, তাঁর হাতেই সমস্ত আইন, বিচার ব্যবস্থা। অসহায়ের কাছে সেই বিচারের বাণী ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে। দশ বিশ জন মানুষকে হত্যা না করলে কিংবা দশ কুড়ি বছর জেল খেটে না আসলে এই সমাজে বড়ো রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। এই সমাজে নিজের স্ত্রীকে ভালোবেসে চুমু খেলেও জেল হাজত হয়ে যেতে পারে। দিনের বেলায় প্রকাশ্যে বলছেন এক রকম কথা আর সন্ধেবেলায় অন্যকথা, সকালে এক রাজনীতির ধ্বজা বইছেন বিকেলে অন্য দলের মিছিলে হাঁটছেন— তাঁরাই সমাজ নিয়ন্তা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানব অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্নগুলোকে ছকভাঙা সময়ের চক্ষুঃমানদের সামনে রেখেছেন। ‘তরঙ্গভঙ্গ’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের পরিণত সমাজ অভীজ্ঞার ফসল এবং বাংলা আবসার্ড নাটকের আবহ এই নাটকের দেহে সংক্রমিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে সমালোচকের অস্তর্থক-সূচক মন্তব্য তুলে ধরা যেতে পারে— ‘‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রাতিস্বিক নাট্যপ্রতিভার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে তরঙ্গভঙ্গ নাটকে। বিষয়ভাবনা, ঘটনাংশ উপস্থাপন, মানুষের অন্তর্বাস্তবতার প্রতীকী প্রকাশ এবং সংলাপরীতির অভিনবত্বে তরঙ্গভঙ্গ বাংলা নাটকের ধারায় এক বিচিত্র নির্মাণ। এই নাটকে অভিব্যক্তিবাদী নাট্যরীতির যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি রয়েছে অস্তিত্ববাদী নাটকের বৈশিষ্ট্য, আছে আবসার্ড নাটকের চারিত্র্যলক্ষণ। ভীতি-আশংকা-অস্ত্বিত্বভাবনা এবং মনোজাগতিক বাস্তবতা উন্মোচনে বহির্জাগতিক বাস্তবতার সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের অনিবার্য দ্বন্দ্ব আলোচ্য নাটকে নির্মাণ করেছে আবসার্ড আবহ।’’ ৪  

‘সুড়ঙ্গ’ (১৯৬৪) নামক নাটিকাটির মধ্যে মজা, আমোদ এবং কৌতুকরসের নির্ঝর প্লাবন রয়েছে। মূলত এই নাটকটি শিশু কিশোরদের মনোপযোগী করে লেখা। এই নাটিকার প্রধান চরিত্র রেজ্জাক সাহেবের কন্যা রাবেয়া। তার বয়স পনেরো-ষোলোর দোরগোড়ায়। সে নাটিকাটির নায়িকা হলেও বলা যেতে পারে কিশোরী। সে আমোদ পছন্দ করে। রোমাঞ্চকর ঘটনায় সে উৎফুল্ল হয়, আর দশটা-পাঁচটা কিশোর-কিশোরীদের মতোই। রেজ্জাক সাহেব  মেয়ের বিয়ের দিন নির্ধারণ করেছেন। হবু বিয়ের পাত্রকেও মেয়ের পছন্দ— কিন্তু বিয়ের নির্ধারিত তারিখের আগে রাবেয়ার চরিত্রে অদ্ভুত একটি উপসর্গ দেখা দেয়। সে সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকে। স্নান খাওয়া-দাওয়া প্রায় সব বন্ধ করে দিয়েছে। সে নিজে কারোর সঙ্গে কথা বলে না, বা কাউকেই তাঁর ঘরে ঢুকতে দেয় না। রাজ্জাক সাহেব ডাক্তার ডাকেন— নানাবিধ শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোন ত্রুটি ধরা পড়ে না। তেজি ঘোড়ার মতো নাড়ি চলছে, অথচ সে সারাক্ষণ নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে থাকছে। স্বাভাবিকভাবে রেজ্জাক সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে— হয়তো মেয়ের বিয়েতে মত নেই, পাত্র পছন্দ নয়। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এই কিশোরী মনের মধ্যে কখন যে কোন রহস্য দানা বাঁধে, সেই কিশোরী মনের হদিশ বাইরে থেকে অনেকেই পায় না। কিন্তু মনের আকাশে নানান রঙ বেরঙের মেঘ খেলা করে। দুর্দমনীয় রহস্যপ্রিয় রাবেয়া নতুন এক রহস্যের জাল মুক্ত করার জন্য সারাদিন ঘরের মধ্যে চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকা। কী সেই রহস্য ? রাবেয়ার ঘরে পুরোনো আলমারির নিচে সিন্ধুক আছে, আর সেই সিন্ধুকে আছে গুপ্তধন। এক যুবক দুদিন ধরে সুড়ঙ্গ কেটে চলল—গুপ্তধনের আশায়। যুবক একটু একটু করে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে আর রাবেয়ার কৌতূহল বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে। সে ভাবছে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে খুঁড়তে একদিন অবশ্যই গুপ্তধন প্রাপ্তির সফলতার মুখ সে দেখবে। কোদালের মুখে ঠং করে গুপ্তধনের সিন্ধুকে ধাক্কা লেগে আওয়াজ উঠে আসবে। গুপ্তধনের রহস্যে সে রোমাঞ্চিত। আন্য কারো কাজ বা খবরে তার কোন উৎসাহ দেখা যায় না। সে কেবলই রহস্যের মধ্যে ডুবে থাকতে চায়। শেষপর্যন্ত সুড়ঙ্গপথে সকলেইপ্রবেশ করেছে— কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান কেউই পায় নি। 

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’-র ‘সুড়ঙ্গ’ নাটিকাটিকে কোনভাবেই রূপক নাটকের শ্রেণিভুক্ত করা যায় না। রূপক নাটকের মধ্যে সমান্তরালভাবে দুটো ঘটনার স্রোত বয়ে যাবে— একটি বাইরের দিক থেকে একরকম অর্থ ছড়িয়ে যাবে, আর একটি ভেতরে ভেতরে অন্য আর একটি গভীরতর অর্থের দিকে পাঠক বা দর্শককে নিয়ে যাবে। ‘‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’-র সুড়ঙ্গ-এ নাট্যকারের এ জাতীয় কোন অতীন্দ্রিয় সাধনা কিংবা রূপ থেকে রূপান্তরে উপনীত হওয়ার অভিলাষ লক্ষ করা যায় না। সুড়ঙ্গ-এর বক্তব্য সহজ-সিদ্ধ, একেবারেই পার্থিব।’’৫ নাট্য সমালোচকের এই অভীজ্ঞা থেকে আমরা রূপক নাটকের গোত্র থেকে ‘সুড়ঙ্গ’-কে বাদ দিলেও এই নাটকের রসাবেদনে কোন ঘাটতি পড়ে  না। ‘সুড়ঙ্গ’ নাটিকার মূল রহস্য গুপ্তধন সন্ধান প্রক্রিয়ায় ব্যাপৃত হলেও যে চরিত্র দুটি এই নাটকের ঘটনাকে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে নিয়ে গেছে—সেই চরিত্রের দেখা কিন্তু পাঠক বা দর্শক বেশিক্ষণ পায় নি। বেশিরভাগ সময়টাই তারা মঞ্চের বাইরে থেকেছে। রূপক নাটকে অনুভববেদ্য মনের জগতের কথা বেশি বেশি করে ব্যক্ত হয়, বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্ব দেখা গেলেও অতীন্দ্রিয় ইঙ্গিত বাস্তবের ধুলোঝড় ঠেলে সবার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘সুড়ঙ্গ’-এ তেমন কোন বিষয় সেভাবে নেই।  

‘উজানে মৃত্যু’ নাটিকাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি। এই একাঙ্কিকাটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ‘সমকাল’ পত্রিকার ১৩৭০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। ‘‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’-র ‘উজানে মৃত্যু’ বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক বিরল ও নিঃসঙ্গ সৃষ্টি; আবসার্ডধর্মী বক্তব্য  ও সে অনুযায়ী আঙ্গিক নির্মাণ, ব্যক্তির অবচেতনায় স্তরীভূত ভাব-অনুভাবের রূপকল্প সৃষ্টি, শন্দ ও নৈঃশব্দ্য এবং রূপক ও প্রতীকের মেধাবী প্রয়োগ-সাফল্য-উজ্জ্বলিত এক অনতিক্রম্য নাটক। বলা যায় বহিপীর-এর মাধ্যমে জে-নাট্যযাত্রার সূচনা তরঙ্গভঙ্গ-সুড়ঙ্গ-এর মোহনা পেরিয়ে উজানে মৃত্যু-তে এসে তা হয়েছে বিশ্বপ্রসারী, সমুদ্রসমর্পিত।’’৭ বাংলা একাঙ্ক নাটকের সমস্ত গুণসমৃদ্ধ এই নাটকটি অপার শূন্যতা বোধের এক চেতনাকে বহন করে আসছে।এই বিশ্বে মানুষ সত্যিই খুব একা নিঃসঙ্গ এমনকি সে বিপন্ন। গল্পহীন জীবনের এক গল্প শুনিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মোট তিনটি চরিত্র এতে রয়েছে— ১. নৌকাবাহক ২. সাদা পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি এবং ৩. কালো পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি। উদ্দেশ্যহীনভাবে একটা নৌকায় তারা উঠে বসেছে।—নৌকোবাহক কঠোর পরিশ্রম করে নৌকো চালিয়ে যাচ্ছে, সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তি হাল ধরে আছে, আর কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি পাশে বসে গল্প করে যাচ্ছে। নৌকোবাহক পরিশ্রম করতে করতে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কালো পোশাক পরিহিত বক্তিটি মঞ্চ থেকে চলে গেছে। আর সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তি নৌকাতেই রয়ে গেছে। আমরা মানুষেরা এইভাবেই প্রতিদিন এক নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছি। ব্যাপক শূন্যতা আমাদের চারদিকের বিশ্ব পরিমণ্ডলে। মানুষ প্রতিদিন তার জীবন নামক তরীটিকে বহু কায়ক্লেশে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। নৌকোবাহক মায়াময় পৃথিবী থেকে অত্যন্ত অনিচ্ছায় বিদায় নিয়েছে। স্ত্রী সন্তান ছেলে মেয়ে সবাই মারা গেছে। অশান্ত সময়ের কালচক্রে পড়ে নৌকোবাহকের শেষ সম্বল জমিটুকুও হারাতে হয়েছে। অথচ সব কিছু হারিয়ে ফেলেও সে দুঃখের ভারে কান্নাকাটি জুড়ে দেয় নি। বরং তবুও মৃত্যুর উজানে জীবন নৌকো চালিয়ে যাবার অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুকে সামনে দেখে ও মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সে মৃত্যুর উজানে জীবন তরী ঠেলে যাচ্ছে। এই নৌকোবাহক গল্পের ছলে তার গ্রামের এক নিদারুণ মৃত্যুর গল্প বলে— ‘‘বাঁশে বিদ্ধ হয়ে মরেছিল লোকটা। ব্যথা লাগবে বলে কাউকে বাঁশটা বের করতেও দেয় নাই। কী ভয়ানক মৃত্যু ! মরতে তিন-দিন তিন-রাত লেগেছিল। ... আর তিন-রাত তিন-দিন আত্মীয় স্বজনরা তার পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল। অবশেষ বাঁশবিদ্ধ লোকটিও কাঁদতে শুরু করে। হয়তো সে ভেবেছিল, সে নয় অন্য কেউ নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছে এবং তারই জন্য অন্যদের সঙ্গে সে-ও কাঁদছে। ... না, শেষে সে আর কষ্ট ভোগ করে নাই। তার নিদারুণ কষ্ট এবং ভীষণ মৃত্যু অবশেষে অন্যান্য কষ্টে এবং মৃত্যুতে পরিণত হয়েছিল।’’ এই নৌকোবাহক মানুষটিও যে আসলে বাঁশ বিদ্ধ মানুষেরই প্রতিভূ তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয়না। শুধু সেই নৌকো বাহক কেন আমরা যারা এই গল্পহীন জীবনের গল্প শুনছি তারা প্রত্যেকেই এই বাঁশবিদ্ধ মানুষ। শোচনীয় মৃত্যুর দিকে আমরা প্রতি নিয়ত এগিয়ে যাচ্ছি। এগিয়ে যেতে হবে— এটাই মানুষের নিদারণ পরিণাম। নাট্যকার মানব জীবনের এই ঘোর পরিণামকে কী সুন্দরভাবেই না গল্পের ছলে আমাদের মনের মধ্যে আর একটা গল্পেরবীজ পুঁতে দেন।  নাটকের সাদা পোশাক পরিহিত মানুষটি বিদ্যা আর বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে চালনার পক্ষপাতি। আর অইজন্য সে নৌকোর হাল ধরে আছে, সে নির্দেশ দিচ্ছে নৌকোবাহককে— যে সমুদ্রে গভীর এবং বড় বড় ঢেউ উঠছে, ঢেউ আসছে, সে যেন ঢেউকে পাশ কাটিয়ে নৌকোকে সঠিক দিকে নিয়ে যায়। নাটকের শেষদিকে দেখা গেছে পৃথিবী তরীর নৌকো নৌকোবাহকের দ্রুত টানে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে, এত দ্রুত ছটছে যে যে কোন মুহুর্তেই আন্য কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেতে পারে। চরম ইঁদুর-দৌড়, চরম প্রতিযোগিতা। সাদা পোশাকের নৌকারোহী মানুষ সে বার বার থামতে বলছে, ভয় দেখাচ্ছে, কখনো অনুনয় বিনয় করছে—কিন্তু শুনছে না মাঝি ওরফে নৌকোবাহক। সে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যা কিছু সেই মুহুর্তে করণীয়কে শ্রেয় বলে মনে হয়েছে সেই সাদা পোশাকের মানুষটি করেছে। আর শেষপর্যন্ত মানুষের মৃত্যু হলেও সে বেঁচে গেছে একজন মানুষ হিসেবে। আর সংসারে এগুলো থাকে বলে সাদা পোশাক পরিহিত মানুষেরা বেঁচে থাকে। কালো পোশাক পরিহিত মানুষটি সে শুধু নৌকায় বসে থেকেছে, গল্পগাছা করে সময় কাটিয়েছে। বলা যেতে পারে সে নৌকোবিহারীদের ভ্রামণিক সত্তাটিকে বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে। তার কোন উত্তেজনা নেই, কোন কাজে বাঁধা সে দেয় না। নৌকোবাহক জোরে নৌকো চালালেও সে বারণ করে না, উভয়ে উভয়ের সঙ্গে ঝগড়া করলেও তার হেলদোল নেই। বোঝা যাচ্ছে এই কালো পোশাক পরিহিত মানুষটি আসলে অধ্যাত্মচেতনা সম্পন্ন। সে জানে যে মানুষের জীবনের জন্য এত সব কিছু, এত লড়াই-ঝগড়া, ক্লান্তি, গ্লানি, সুখদ-দুখদ সমস্ত জাগতিক আশ্লেষ পূর্ব নির্ধারিত। কাজেই এখানে এই ভবসাগরে এসে একটি নতুন কিছু করলাম বা ভেবে ফেললাম বলে আমরা যে আত্মশ্লাঘা বোধ করছি— তা নতুন কিছু নয়। এরকমই হয়, এরকমই আগে থেকেই নির্ধারিত, আমরা শুধু ছকে ছকে সার্কিট বরাবর— লাইন বরাবর হেঁটে যাচ্ছি, আর আনন্দে বিস্ময়ে তড়পাচ্ছি। পুতুলনাচের ইতিকথার শেষ গান আমাদের শোনা হয়ে ওঠে না। সব মিলিয়ে নাট্যকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘উজানে মৃত্যু’ একাঙ্কিকায় একেবারে বাস্তব সময়ের মানুষের কথা অতিবাস্তব সরল–সিদ্ধ ভঙ্গিতে উপলব্ধিত করিয়েছেন। একই মানুষের মধ্যে নিহিত ত্রিবিধ সত্তাকে ব্যঞ্জিত করেছেন। একই মানুষের পরিবেশগত ভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন আচরণ, সংলাপের মধ্য দিয়ে চরম জীবন সত্যকে চিনিয়ে দিয়েছেন।—‘‘যেখানে মানুষের মৃত্যু হলেও মানব থেকে যায়— এ জাতীয় উক্তির নিরিখে নয়, বরং মানুষের মৃত্যু হলেও সাদা পোশাকের গুণগুলো হতাশ হয়, পথ হারায়; আর কালো পোশাকের সত্তা অমর-অক্ষয়-অব্যয় এই জাতীয় সূত্রই রটিত হয়। শুধু দেহটার বাস্তবিক চেতনা যায় হারিয়ে। তবু ‘উজানে মৃত্যু’ নাটকে কাহিনির মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন গল্প গড়ে ওঠেনি। অস্থির সময়ের বাস্তবতায়, মানুষের অস্তিত্বহীনতাকে লেখক প্রকাশ করেছেন আবসার্ড রীতির দ্বারা।’’৯ 

একজন ঔপন্যাসিক তথা ছোটগল্পকারের হাতে লেখা নাটকও যে অবলীলায় উৎকর্ষের চরমতম সীমায় উঠে যেতে পারে— তা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’-র নাটক না দেখলে বোঝা যায় না। ‘যে পারে সে আপনি পারে, পারে সে ফুল ফোটাতে’-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সেই ফুল ফোটানোর সাহিত্যিক তথা নাট্যকার। যদিও তাঁর নাট্যপ্রতিভা বার বার একটা রূপান্তর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজের নাট্য-পথপরিক্রমা জঞ্জালমুক্ত করে নিজের মত-বিস্তারী পথকে সুদৃঢ় করে নিয়েছেন। হয়তো অনেক বেশিসংখ্যক নাটক তিনি লেখেন নি, কিন্তু হাতে গোনা যে কয়খানি লিখেছেন তা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ। তাঁর নাট্য-প্রতিভাদীপ্তি বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চৌদিক চমকিত করে দিয়েছেন। একইসাথে সাহিত্যের এতগুলো প্রকরণ প্রকোষ্ঠে নিজেকে সমপ্রজ্ঞামানে উজ্জ্বীবিত রাখতে খুব কমসংখ্যক সৃজনীশিল্পীকেই আমরা হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পেয়েছি। এইদিক দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অবশ্যই প্রিয় স্মরণীয় সাহিত্যিক সারণিতে পড়েন । চারটি চারধরনের গোত্র বিভাজিত নাটকে আধুনিক নাট্য সাহিত্যের আধুনিক ব্যঞ্জনা তিনি এনে দিয়েছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্টিলোকের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়— প্রথমত তিনি গল্পকার, দ্বিতীয়ত তিনি ঔপন্যাসিক এবং তৃতীয়ত তিনি নাট্যকার। সৃজনীশিল্পের মূলত সমৃদ্ধতম তিনটি ধারাতেই তিনি সিদ্ধহস্ত। আধুনিক অস্তিত্ববাদী দার্শনিক প্রজ্ঞা, গভীরতর জীবনবোধ এবং আবসার্ড নাট্যবিদের সুচেতনায় বাংলা নাট্যাঙ্গনকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের কুলে বসে অনেক অনেক দূরবর্তী কুল-চিহ্নিত সময়ের ছায়াচিত্র স্পষ্ট করে গেছেন।    

সূত্র নির্দেশ ও টীকা : 
১। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ‘নাটকসমগ্র’, সম্পাদনা: হায়াৎ মামুদ, ‘ভূমিকা’ প্রতীক, ঢাকা, ২০০৫  
২। ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচনাবলী ২’, সম্পাদনা: সৈয়দ আকরম হোসেন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ 
 পৃ- ৪২৪ 
৩। জীনাত ইমতিয়াজ আলি, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবনদর্শন ও সাহিত্যকর্ম’, (A Ph. D Thesis of Dhaka University, Submitted on October in 1991 and Degree obtained on 30 th July 1992) নবযুগ প্রকাশনী, ২/৩ প্যারীদাশ রোড, ঢাকা-১১০০, পৃ- ১৬৬
৪। বিশ্বজিৎ ঘোষ, ‘আবসার্ডবাদ ও সাহিত্যে তার প্রয়োগ’, ‘উলুখাগড়া’, প্রথম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, মে-জুন ২০০৬, ঢাকা, পৃ-২৭৯ 
৫। জীনাত ইমতিয়াজ আলি, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবনদর্শন ও সাহিত্যকর্ম’, (A Ph. D Thesis of Dhaka University, Submitted on October in 1991 and Degree obtained on 30 th July 1992)  নবযুগ প্রকাশনী, ২/৩ প্যারীদাশ রোড, ঢাকা-১১০০, পৃ- ১৮১
৬। ‘উজানে মৃত্যু’, সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৭০ (৬ বর্ষ : ১০ম সংখ্যা, পৃ ৭২০-৩৭)  সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছিল। 
৭। জীনাত ইমতিয়াজ আলি, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবনদর্শন ও সাহিত্যকর্ম’, (A Ph. D Thesis of Dhaka University, Submitted on October in 1991 and Degree obtained on 30 th July 1992) নবযুগ প্রকাশনী, ২/৩ প্যারীদাশ রোড, ঢাকা- ১১০০, পৃ-১৮৪ 
৮। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ‘নাটকসমগ্র’ ‘উজানে মৃত্যু’, হায়াৎ মামুদ, ‘ভূমিকা’, প্রতীক, ঢাকা, ২০০৫, পৃ- ৪০
৯। রঙ্কু দাস, ‘কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: সাহিত্য ও জীবন দর্শন’, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, ২০০৮, পি-এইচ. ডি. ডিগ্রির জন্য অভিসন্দর্ভ, পৃ-৩৩, উৎস: Shobdhganga: a reservoir of Indian theses@INFLIBNET   

গ্রন্থ সহায়তা :
১। ‘বহিপীর’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, গ্রীন হাউস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৬০
২। ‘জলতরঙ্গ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৬৪ 
৩। ‘সুড়ঙ্গ’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৬৪ 
৪। ‘উজানে মৃত্যু’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সমকাল পত্রিকা, ঢাকা, ১৯৬৩
৫। ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচনাবলী’, সম্পাদনা: সৈয়দ আকরম হোসেন, প্রথমখণ্ড, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, জানুয়ারি ১৯৮৬
৬।‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচনাবলী’, সম্পাদনা: সৈয়দ আকরম হোসেন, দ্বিতীয়খণ্ড, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ 
৭। ‘নাটকসমগ্র’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সম্পাদনা: হায়াৎ মামুদ, প্রতীক, ঢাকা, ২০০৫ 
৮। ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবনদর্শন ও সাহিত্যকর্ম’, জীনাত ইমতিয়াজ আলি, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১ 
৯। ‘কালের প্রতিমা’, অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৭৪   
১০। ‘আধুনিকতা ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’, নুরউল করিম খসরু, ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০০২  
আন্তর্জাল:  
Shobdhganga: a reservoir of Indian theses@INFLIBNET
Wikipedia

লেখক: ড. আশুতোষ বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক তথা বিভাগীয় প্রধান, মানভূম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। সম্পাদক, সাহিত্যের আলোকপত্র তারারা

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ  
আশুতোষ বিশ্বাস

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ
জন্মশতবর্ষে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। বিশেষ সংখ্যা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক আঁজলা উজালা আকাশ আশুতোষ বিশ্বাস
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/w320-h160/syed-waliullah(bindu).png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgCXVAoLCZJ9Mn-jeee6-OFAGHcb1S2smH6gyMtye_dV2Ma88evadXLqnT_N19fdT12bn6zRxQlNQY-RataIKzsrQJVuGh4Hny1QR2W_uC5X5_tdvtUgAzet8i6grT17qrOmzsmAiK3Ch-O4dS0NZr-UJgVJ58dUC2FJ4r4T4r1MphKGPc94LfLcVdy/s72-w320-c-h160/syed-waliullah(bindu).png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/01/articleon-the-play-of-syed-waliullah.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/01/articleon-the-play-of-syed-waliullah.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy