ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল (১৭৭২- ১৮৫৭) এবং তারপর ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ শাসনকালে (১৮৫৭- ১৯৪৭) হিন্দু-মুসলিমদের বিরোধকে ইংরেজরা বারে বারেই নিজেদের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে গেছে। সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতির পারস্পরিক সহাবস্থন সমরূপে চিহ্নিত হলেও বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে তা সবসময় সত্যি ছিলনা। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমল থেকেই ইংরেজ-পদানত এ দুটি জাতি কখনও প্ররোচনাবশত বা কখনও স্বার্থবুদ্ধি প্রয়াসে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ইংরেজ সরকারের স্বার্থবুদ্ধি সেখানে প্রবল হলেও একথা ঠিক হিন্দু-মুসলিম দুটি জাতি একে অপরের প্রতি বিশ্বাস , ভরসা , ভালোবাসা কোনোটাই ধরে রাখতে পারেনি।
কেবিনেট মিশনের(১৯৪৬) পক্ষ থেকে এক ঘোষণায় জানানো হয় যে, পরীক্ষা করে দেখা গেছে মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী 'পাকিস্তান' সৃষ্টি করলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে। মাউন্টব্যাটেনের কৌশল মাফিকই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে দেশভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তর দুটিই একসাথে সংগঠনের মধ্যে দিয়ে 'ভারত' ও 'পাকিস্তান' নামক দুটি স্বাধীন ইউনিয়নের সৃষ্টি হলো। আজকাল অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন ১৯৪৭-এর 'দেশভাগ' আসলে জিন্নাহ ও নেহেরুর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতারই এক অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরিণতি। যাই হোক বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও অনায়াসে বলা যায় উচ্চ শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের স্বার্থ ও খামখেয়ালির পরিণতি হলো দেশভাগ; শুধু দেশভাগ নয়, যার অন্তিম পরিনিতি হাজার হাজার উদ্বাস্তু। এ প্রসঙ্গে মণিকুন্তলা সেন বলেছেন-
"এটা প্রমোদ ভ্রমণ নয়। পাশের গ্রামে ক'দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া নয়। ভারতীয় বা পাকিস্তানি যেই হোক সংসারের পাঠ চুকিয়ে এক মূলক থেকে আরেক মুলুকে চলেছে ওরা। ঘর বাড়ি, জোত জমি ফেলে হতাশ মানুষের দল মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে আর ফিরবে না বলে। এই পথ চলার ওদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হলো রোগ,ব্যাধি ক্ষুধা তৃষ্ণা। আরও কত বাঁধা আছে যা প্রতিকার করার সামর্থ্য তাদের নেই।”১
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। দেশভাগের আগে ও পরে সমাজ জীবনে অভিশাপ হয়ে এলো দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু সমস্যা।
১৮৪৭ সালের আগস্ট মাসে হাজার হাজার অসহায় মানুষ কেঁদেছিল। অভিশপ্ত আগস্ট মাসে তারা যখন স্বাধীনতা পেয়েও নিজেদের বাস্তু হারিয়েছিল, হারিয়েছিল প্রিয়জনদের তখন তাদের মনে হয়েছিল কেন জীবনটা জুলাই মাসেই শেষ হয়ে গেল না। এপ্রিল মাসেও মুর্শিদাবাদ, খুলনার মানুষ বুঝতে পারেনি তাদের অংশে ভারত না পাকিস্তানের পতাকা উড়বে, সিলেটের করিমগঞ্জে পাকিস্তানের পতাকা উড়েও নেমে যাবে। বাংলাকে বিভক্ত করার বাউন্ডারি কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্যার সেরিল রেডক্লিফকে, যিনি আগে কোনোদিন ভারতবর্ষেই আসেননি, ভারতবর্ষের মানুষদের জীবন সংস্কৃতি, ভাষা, জীবিকা, আবেগ, অনুভূতি কোনোকিছু সম্পর্কেই তার প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা নেই। অথচ সেরিল রেডক্লিফের মতো মানুষদের কূটকৌশলের রাজনৈতিক সমীকরণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। অনেকের নতুন পরিচয় হয় উদ্বাস্তরূপে, নতুন ঠিকানা হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশভাগের পর মানুষগুলোর ছেড়ে যেতে হয় সাত পুরুষের বসতি, আশৈশব হেঁটে যাওয়া চেনা পথ, ছেড়ে যেতে হয়েছিল স্মৃতি বিজড়িত মাঠ- ঘাট- নদী -জঙ্গল, শ্মশান আর কবর।
এই জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ ভারতীয় সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে গভীরভাবে- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক এবং প্রবন্ধে। কৃষণ চন্দর(১৯১৪_১৯৭৭), সাদাদ হাসান মান্টো(১৯১২_১৯৫৫, খাজা আহমেদ আব্বাস(১৯১৪-১৯৮৭), ভীষ্ম সাহানিঈ(১৯১৫-২০০৩), খুশবন্ত সিংরা(১৯১৫_২০১৪) যেভাবে হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যে এই দেশভাগের চিত্র এঁকেছেন ঠিক তেমনি দেশভাগ এসেছে বাংলা সাহিত্যে। ভারত স্বাধীন হয়েও যারা নিজের দেশকে হারালো তাদের যন্ত্রণার কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায়।
‘ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগ বাংলা উপন্যাসের দর্পণে’ গ্রন্থে চন্দন কুমার কুঞ্জ বলেছেন-
"১৯৪৬- ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের কলকাতা নোয়াখালী বিহারের দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং হাজার হাজার স্বজন হারানো আহত মানুষগুলির কথা ও সাতচল্লিশের বঙ্গবিভাগ তথা ভারত ভাগে ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া মানুষের দুঃখ- দুর্দশা বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না এমন হতেই পারে না। অন্যান্য ভাষায় যেমন পাঞ্জাবি, উর্দুর মতো প্রত্যক্ষ ও প্রকট বাস্তবতার ছবি এখানে না থাকলেও বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে দাঙ্গা ও দেশভাগ এসেছে নানাভাবে।"২
বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু নিয়ে অসংখ্য ছোটগল্প ও উপন্যাস রচিত হয়েছে। শিল্পগুণের বিচারে সবগুলো উচ্চমানের না হলেও সব ছোটগল্প ও উপন্যাসগুলোতে দেশভাগের বাস্তবতা ও উদ্বাস্তুদের জীবনযন্ত্রণা খুব সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দেশভাগ ও উদ্বাস্তু দিয়ে লেখা কয়েকটি ছোটগল্প হলো ঋত্বিক ঘটকের 'স্ফটিকপাত্র', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'খতিয়ান', সমরেশ বসুর 'নিমাইয়ের দেশত্যাগ', 'আদাব', সতীনাথ ভাদুড়ীর 'গণনায়ক', নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'হেডমাস্টার' ও 'পালঙ্ক', নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শ্বেতকমল' ও 'অধিকার', প্রতিভা বসুর 'দুকূলহারা', বিমল করের 'অন্তরে', শওকত ওসমানের 'আলিম মুয়াজ্জিন', শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'তোমার উদ্দেশ্যে', সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী', সৈয়দ মুজতবা আলীর 'নেড়ে' ইত্যাদি। এপার বাংলা ওপার বাংলা দুই দেশেই দেশভাগ নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশে এর সংখ্যা কম, এর কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া এবং দেশভাগের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এপার বাংলায় দেশভাগ নিয়ে অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে- জ্যোতির্ময়ী দেবীর(১৮৯৪-১৯৮৮) 'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা'(১৯৬৮), রমেশচন্দ্র সেনের (১৮৯৫-১৯৬২) 'পূর্ব থেকে পশ্চিমে', জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) 'জলপাইহাটি' (১৯৪৮), 'বাসমতীর উপাখ্যান' (১৯৪৮), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯৯-১৯৭১) 'বিপাশা' (১৯৫৮), বনফুলের (১৮৯৯-১৯৭৯) 'পঞ্চপর্ব' (১৯৫৫) ও 'ত্রিবর্ণ' (১৯৬৩), প্রবোধকুমার সান্যালের (১৯০৫-১৯৫৩) 'হাসুবানু' (১৯৫২), অমরেন্দ্র ঘোষের (১৯০৭-১৯৬২) 'ভাঙছে শুধু ভাঙছে' (১৯৫০), 'মন্থন' (১৯৫৪), 'ঠিকানাবদল' (১৯৫৭), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮- ১৯৫৬) 'সার্বজনীন' (১৯৫২), প্রতিভা বসুর (১৯১৫-২০০৬) 'সমুদ্র হৃদয়' (১৯৫৯), নরেন্দ্রনাথ মিত্রের (১৯১৬-১৯৭৫) 'উপনগর' (১৯৬৩) ও 'মহানগর' (১৯৬৩), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৯১৭-১৯৭০) 'বিদিশা' (১৯৫৪), অচ্যুত গোস্বামীর (১৯১৮-১৯৮০) 'কানাগলির কাহিনী' (১৯৫৫), অমিয়ভূষণ মজুমদারের (১৯১৮-২০০১) 'নির্বাস' (১৯৫৯), শক্তিপদ রাজগুরুর(১৯২২- ২০১৪) 'দণ্ডকথেকে মরিচ ঝাঁপি', 'মেঘে ঢাকা তারা'(১৯৬২), গৌড় কিশোর ঘোষের(১৯২৩_২০০০) 'প্রেম নেই', নারায়ণ সান্যালের (১৯২৪-২০০৫) 'বকুলতলা পি. এল ক্যাম্প’ (১৯৫৫), সমরেশ বসুর (১৯২৪-১৯৮৮) 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা' (১৯৬৯) এছাড়াও 'সওদাগর' (১৯৭১) ও 'খণ্ডিতা' (১৯৭৮), শঙ্খ ঘোষের (১৯৩২-২০২১) 'সুপুরিবনের সারি' (১৯৯০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৯৩৪-২০১২) 'অর্জুন' (১৯৭১), প্রফুল্ল রায়ের (১৯৩৪- ) 'কেয়া পাতার নৌকা' (১৯৭০), ‘শত ধারায় বয়ে যায়’(২০০৮), ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’(২০১৪), অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯৩৪-২০১৯) 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' (১৯৭১), হাসান আজিজুল হকের(১৯৩৯_২০২১) 'আগুনপাখি'(২০০৬), সেলিনা হোসেনের (১৯৪৭- ) 'গায়ত্রী সন্ধ্যা' (১৯৯৪), তসলিমা নাসরিনের (১৯৬২- ) 'ফেরা' (১৯৯৩) ইত্যাদি।
কিছু উচ্চ শ্রেণীর মানুষের অদূরদর্শিতা, স্বার্থপরতার পরিণাম দেশভাগ হলেও এতে সাধারণ মানুষের কোন দোষ ছিলনা। কিন্তু সব থেকে বেশি ভোগান্তি হয়েছিল সাধারণ মানুষদের। পূর্ববঙ্গ থেকে যত সংখ্যক হিন্দুদের উদ্বাস্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে হয়েছিল সংখ্যাটা একটু কম হলেও অনেক মুসলিমদের পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ববঙ্গে যেতে হয়েছিল। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় দুধর্মের নিষ্পাপ মানুষদেরই প্রাণ হারাতে হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে গেল, দেশভাগ হয়েও সাম্প্রদায়িক হিংসা বন্ধ হলো না। সেই সাম্প্রদায়িক হিংসার ছবি উঠে এসেছে সাহিত্যের পাতায় পাতায়। সে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের পর হিন্দু- মুসলিমের সম্প্রীতির ছবি কম হলেও দুর্লভ নয়। সেই সম্প্রীতির কথাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্প অবলম্বনে আলোচনা করার প্রয়াস থাকলো ।
বাংলা সাহিত্যের এক স্বনামধন্য লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের জন্ম চট্রগ্রামে ১৯২২ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখে। তাঁর মাতৃবংশ ও পিতৃবংশ ছিল বনেদী পরিবার। তিনি অনেক ধরনের পেশাকে তাঁর কর্মজীবনে বেছে নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে চলতো তাঁর সাহিত্য সাধনা। বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন ফরাসি রমণী আন-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবো-র সঙ্গে। তাঁর প্রথম বই ‘নয়নচারা’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। তিনি লালসালু (১৯৪৯), ‘চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৫), ‘কাঁদো নদী কাঁদো' (১৯৬৮) উপন্যাস এবং ‘দুইতীর ও অন্যান্য গল্প' (১৯৬৫) নামে গল্প গ্রন্থ এবং কয়েকটি নাটক রচনা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সাধ্যমত অংশগ্রহণ করলেও তাঁর অকাল প্রয়াণে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেন নি, ১৯৭১ সালের ১০ই অক্টোবর অধ্যায়নরত অবস্থায় তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাঁর জীবনাবসান হয়।
‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের একটি স্মরণীয় গল্প। গল্পটি লেখকের ‘দুইতীর ও অন্যান্য গল্প'(১৯৬৫) গল্পগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যে উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় গল্পটি তা নিয়ে লেখা। পূর্ববঙ্গ থেকে হাজারে হাজারে উদ্বাস্তু যেমন পশ্চিমবঙ্গ এসেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমরাও উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ববঙ্গে গেছে যদিও সংখ্যায় তা অনেক কম। সেইরকমই একদল মুসলিম যুবক কলকাতা ছেড়ে পূর্ববঙ্গে যায়। উদ্বাস্তু সেই যুবকের দল আশ্রয় নেয় একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে। কাদের, বদরুদ্দিন, হাবিবুল্লা, মোদাব্বের, মতিন, ইউসুফ, এনায়েত, মকসুদ এরা নতুন দেশে গিয়ে আস্ত একটি বাড়ি পেয়ে স্বর্গ পাওয়ার মতো খুশি হয়, পুরো বাড়িটাই তারা দখল করে বসে। গল্পের কাহিনি খুব ছোট কিন্তু প্লটের বিবেচনায় গল্পটাকে এত সরল বলা যাবে না। গল্পটি বলা হয়েছে লেখকের জবানিতে। পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর অত্যাচার এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের উপর অত্যাচারের কোনো ছবি নেই তবে উদ্বাস্ত মানুষদের দেখেই সে অত্যাচারে ছবি বুঝতে পারা যায়। লেখক প্রথমেই বলেছেন বাড়িটি কেউ জোর দখল করেনি; বাড়িটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত ছিল। বাড়িতে উঠে আসা মানুষগুলো সবাই নিরীহ, গরীব, শান্তিপ্রিয় কারণ তারা পুলিশকে দেখলেই ভয় পায়। বাড়িতে থাকতে থাকতে একদিন মোদাব্বেরের চোখে পড়ে বাড়ি উঠোনের কোণে একটি তুলসী গাছ, জলের অভাবে পাতাগুলির খয়েরি হয়ে গেছে, মোদাব্বেরের চিৎকারে বাড়ি শুদ্ধ সবাই চলে আসলেও কেউ তুলসী গাছটিকে তুলে ফেলেনি-
“মোদাব্বের আবার হুঙ্কার ছাড়ে।
ভাবছ কী অত? উপড়ে ফেল বলছি!
কেউ নড়ে না। হিন্দুর রীতিনীতি এদের তেমন ভালো করে জানা নাই তবু কোথাও শুনেছে যে হিন্দু বাড়িতে প্রতি দিনান্তে গৃহকর্ত্রী তুলসী গাছের তলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে।”৩
আজ সেই গৃহকর্ত্রী কোথায় কেউ জানে না, তাইতো তুলসী গাছের তলায় ঘাস গজিয়েছে। তুলসী গাছটিও জলের অভাবে ধুঁকছে। কেউ তুলসী গাছটিকে তুলে ফেলতে পারেনা। মাতিনের চোখে সেই গৃহকর্ত্রীর ছবি ভেসে ওঠে। ইউসুফ বলে সর্দি হলে তুলসী পাতা লাগে। এনায়েত মৌলবী ধরনের মানুষ, সে দাড়ি রাখে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। সে পর্যন্ত গাছটি উপড়ে ফেলার কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
হিন্দুরা বাড়ির মঙ্গলের জন্য বাড়িতে তুলসী গাছ রাখে, হিন্দু বাড়ির দখল নিয়ে তারা হয়তো কেউ কেউ সেই মঙ্গল-অমঙ্গল ধারণায় বিশ্বাস করতে শুরু করে আর কেউ হয়তো ভাবে একদিন নিশ্চয়ই বাড়ির মালিক ফিরে আসবে। সবথেকে অবাক হওয়ার বিষয় একদিন মোদাব্বের লক্ষ্য করে তুলসী গাছের তলায় ঘাস উধাও, জল পেয়ে পেয়ে গাছটিও সবুজ সতেজ হয়ে গেছে। তুলসী গাছটিকে কেউ গোপনে গোপনে যত্ন করছে। মোদাব্বেরের হাতে ছিল কঞ্চি সেটি সে তুলে গাছের উপর চালিয়ে দেয় কিন্তু তবু অক্ষত থাকে তুলসী গাছ। মোদাব্বের যদিও সত্যিই গায়ের জোরে কঞ্চি চালাতো তাহলে আর অক্ষত থাকতে পারত না ছোট্ট একটি গাছ। আবার পুলিশ আসে, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়। কয়েকদিন পরে উদ্বাস্তু মুসলিম যুবকেরা বাড়িটি খালি করে চলে যায় নতুন আশ্রয়ের আশায়। বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেয়েই তারা আর কেউ তুলসী গাছের কথা ভাববার সময় পায়নি, স্বাভাবিকভাবেই জলের অভাবে আবার খয়েরি হয়ে যায় তার পাতা-
“উঠানের শেষে তুলসী গাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয় নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়েনি।”৪
মাথার মাথার উপরে ছাদ পাওয়া উদ্বাস্তু মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা শুধু যেমন তেমন ছাদ নয়, একটি সুন্দর বড় গোটা বাড়ি মতিন কাদেররা পেয়েছিল। তারা যখন জানতে পেরেছিল বাড়িটি হিন্দুবাড়ি তখন বাড়ির মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই হয়তো তারা সেই বাড়ির প্রধান হিন্দুয়ানির চিহ্ন মুছতে চাইনি। ধর্মের ভেদাভেদির জন্যই সেই নিরপরাধ হিন্দু পরিবারকে এত সুন্দর বাড়ি ছেড়ে হয়তো পথে পথে ঘুরতে হচ্ছে এটা ভেবেও তাদের মধ্যে কেউ হয়তো মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভেবেছে। মানবিকতাবোধ থেকেই হোক আর কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই হোক হিন্দু বাড়ির সেই প্রধান চিহ্নকে সেই মুসলিম যুবকেরা নতুন করে প্রাণ দিয়েছে-
“আগাছা অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। যে গাঢ় সবুজ পাতাগুলি পানির অভাবে শুকিয়ে খয়েরি রং ধরেছিল, সে পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে।”৫
দেশভাগ হয়ে গেল ধর্মের ভিত্তিতে, হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ বলি হলো ধর্মের হিংসার আগুনে একথা যেমন ধ্রুব সত্য ঠিক তেমনি সেই ঘটনার জন্য সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র হাত ছিল না। ভালো মানুষ যেমন হিন্দুধর্মের মধ্যে ছিল ঠিক তেমনি ভালো মানুষ ছিল মুসলমান ধর্মের মধ্যে। তবে দেশভাগের পর হিন্দু মানুষদের বেশি কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দুদের বেশি প্রাণ গিয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক সত্যকে মাথায় রেখেই গল্পকার 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্প রচনা করেছিলেন। আলোচ্য গল্পের ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবতার জয় ঘোষিত হয়েছে। লেখক এখানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির চিত্র সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছেন।
আলোচ্য ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী' গল্পের কাহিনি গল্পটির পটভূমি ১৯৪৬ এর দাঙ্গা ও ৪৭ এর দেশভাগ। ধর্মের সুড়সুড়ি থেকে বেরিয়ে গল্পটিতে মানবতার কথা যেমন শোনানো হয়েছে ঠিক তেমনি দুই ধর্মের সম্প্রীতির ছবিও আমরা দেখতে পাই। ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’তে আমরা দেখি মুসলিম যুবকেরা হিন্দু বাড়িতে যেমন আশ্রয় নেয় তেমনি হিন্দুয়ানির প্রধান চিহ্ন তুলসী গাছকে জল দিয়ে সতেজ করে তোলে। গল্পগুলির কাহিনি বিশ্লেষণ করলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ছবি পরিষ্কারভাবে পরিস্ফুট হয়।
তথ্যসূত্র
১. সেন মণিকুন্তলা, 'সেদিনের কথা', নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা -০৯, প্রথম প্রকাশ -১৯৮২, পৃষ্ঠা: ১৮১।
২. কুঞ্জ ড: চন্দন কুমার, 'ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগ বাংলা উপন্যাসের দর্পণে', বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা -০৯, প্রথম প্রকাশ -২০১২, পৃষ্ঠা: ৬৭।
৩. ওয়ালীউল্লাহ সৈয়দ, 'গল্পসমগ্র', প্রতীক প্রকাশন, ঢাকা -১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ -২০০৫, পৃষ্ঠা: ৬৯।
৪. তদেব, পৃষ্ঠা: ৭১।
৫. তদেব, পৃষ্ঠা: ৭০।
আকর গ্রন্থ
১. ওয়ালীউল্লাহ সৈয়দ, 'গল্পসমগ্র', প্রতীক প্রকাশন, ঢাকা -১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ -২০০৫।
সহায়ক গ্রন্থ
১. ভট্টাচার্য তপোধীর, 'কথাসাহিত্য: পুনঃপাঠ', দি সী বুক এজেন্সি, কলকাতা- ০৭, প্রথম প্রকাশ-২০১৫।
২. মুখোপাধ্যায় অরুণকুমার, 'কালের পুত্তলিকা (তৃতীয় খণ্ড), দে'জ পাবলিশার্স, কলকাতা- ৭৩, চতুর্থ সংস্করণ- ২০১৬ ।
৩. আচার্য অনিল, 'সত্তর দশক', অনুষ্টুপ, কলকাতা- ০৭, তৃতীয় সংস্করণ- ২০১৪ ।
৪. ভট্টাচার্য দেবীপ্রসাদ, 'উপন্যাসের কথা', দে,'জ পাবলিশিং, কলকাতা- ৭৩, প্রথম সংস্করণ-২০০৩ ।
৫. ঘটক ঋত্বিককুমার, 'চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু', দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা- ৭৩, দ্বিতীয় সংস্করণ- ২০১৮ ।
৬. কুণ্ড ড: চন্দন কুমার, 'ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও দেশভাগ বাংলা উপন্যাসের দর্পণে', বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা- ০৯, প্রথম প্রকাশ- ২০১২।
৭. সেন মণিকুন্তলা, 'সেদিনের কথা', নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা- ০৯, প্রথম প্রকাশ- ১৯৮২।
৮. সিনহা হেনা, 'বাংলা উপন্যাসে দেশভাগ ভগ্ননীড়ের বেদনা', বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা- ০৯, প্রথম প্রকাশ- ২০১০।
৯. বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দীপ, 'দেশভাগ-দেশত্যাগ’, অনুষ্টুপ, কলকাতা- ০৭ প্রথম প্রকাশ- ১৯৯৪ ।
১০. ভট্টাচার্য তপোধীর, 'দেশভাগ: নির্বাসিতের আখ্যান', সোপান, কলকাতা- ০৬, প্রথম প্রকাশ- ২০১৬।
১১. ভট্টাচার্য অধ্যাপক দেবাশীষ, 'বিশ শতকের কথাসাহিত্যে নিম্নবর্গীয় চেতনা', অক্ষর পাবলিকেশন, কলকাতা- ১২, প্রথম প্রকাশ- ২০১০।
১২. নাথ প্রিয়কান্ত, 'কাল বিভাজিত বাংলা উপন্যাস', বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা- ০৯, প্রথম প্রকাশ- ২০০৭।
১৩. মকসুদ সৈয়দ আবুল, 'সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য( প্রথম খন্ড)', মিনার্ভা বুকস, ঢাকা ১১০০, প্রথম প্রকাশ ১৯৮১।
১৪. ওয়ালীউল্লাহ সৈয়দ, 'গল্পসমগ্র', প্রতীক প্রকাশন, ঢাকা -১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ -২০০৫, পৃষ্ঠা: ৬৯।
লেখক: Ph.D গবেষক, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর
বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্পে সম্প্রীতি ভাবনা
সত্যা দেবনাথ
সত্যা দেবনাথ
মন্তব্য