এইচএসসি পরীক্ষার পরে বেড়ানোর তেমন সুযোগ ঘটেনি। কেন ঘটলো না, তা মনে করতে গিয়ে বেশ কিছু কাল নষ্ট করেছি। কিন্তু পরীক্ষা পরবর্তী সময়টা মোটামুটি ঘরে বসেই কাটিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য প্রতি সপ্তায় ফতেয়াবাদ গিয়ে ক্রিকেট খেলাটা চলেছে নিয়মিত। অন্য সময় বেশির ভাগই কেটেছে সহপাঠী অরুণাভ পোদ্দার রাজেনের বাসায় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির পাঠাভ্যাসে। রাজেনের বাবা ছিলেন জজকোর্টের বিচারক তথা জজ সাহেব, পক্ককেশ রাশভারী ভদ্রলোক; মাসীমাও একইরকম। মনে হয় বয়সেও দুজনেই কাছাকাছিই হবেন। উচ্চতার দিকে তাঁরা যতটা খাটো, গাম্ভীর্যে তার চেয়ে অনেকগুন ভারী। থাকতেন ফজলুল কাদের চৌধুরীর পাহাড়ী বাড়ির পশ্চিমে বর্তমানে আইডিয়াল স্কুলের সামনের রাস্তার উল্টা পাড়ের লম্বা বাড়িটির তেতলায়। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের এমন সাধারণ বাসায় বাস, আজকের দিনে ভাবাও সম্ভব নয়। প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পরে আমি চলে যেতাম রাজেনের বাসায় এবং সন্ধ্যা উজিয়ে শেষ করতাম পাঠ। কখনও কখনও ফুটপাত ধরে হাঁটতাম, প্যারেড ময়দান পর্যন্ত। আমাদের আরেকটি আড্ডার জায়গা ছিল চট্টগ্রাম কলেজের পেছনে অর্থাৎ পূর্বদিকে আয়েশা আক্তার লেনের এককক্ষের বেড়ার ঘর, যাতে বন্ধু খুরশীদ আলম মিলন তার বাবার সাথে বাস করতো। এখানে আড্ডা দিতে আসতো মাসুদ, ছুটি, শিপন এবং বাবু। আরও দুয়েকজন আসতো, তবে আজ আর তাদের নাম মনে করতে পারছি না। ততদিনে আমরা হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার পাঠের অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল, গোর্কির মা, কিংবাবিভূতিভুষণের আদর্শ হিন্দু হোটেল পাঠ অভিজ্ঞতায় উত্তীর্ণ হয়েছি। মিলন আমাদের মধ্যে একটু বেশি আবেগপ্রবণ ছিল। হুমায়ুনের প্রতিও ছিল তার অগাধ ভালবাসা। মিলনকে যখন লা মিজারেবল পড়তে দিলাম এবং পাঠ শেষে আমাদের একগভীর আলোচনা হলো, মিলন তার অতি প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদকে চিঠি লিখে বসলো, কেন তিনি শুধু মধ্যবিত্তসেন্টিমেন্ট নিয়ে লেখেন, কেন তিনি লা মিজারেবলের মতো উপন্যাস লেখেন না। তার উত্তরও এসেছিল বেশ অল্প ক’দিনেই।হুমায়ুন মিলনকে অশেষ ভালবাসা জানিয়ে ভদ্রভাবে বলেছিলেন, “তিনি তো হুগো নন, তাঁর বাস্তবতাও তেমন নয়, তাই…”। যাই হোক, আমাদের এতসব আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ভর্তি প্রস্তুতির কসরত চলছে। অংক, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য পাঠ্যবিষয় পাঠের ফাঁকে ফাঁকে নিত্য আলাপ হতো সমাজতন্ত্রের, বিপ্লবের। আলাপ হতো গোর্কি, দস্তয়েভস্কি, হুগো থেকে লেনিন, মার্ক্স, চে পর্যন্ত।আমাদের চোখ এতটা রঙিন স্বপ্নে ভরা ছিল যে, দেশে চিরশান্তি শীঘ্র নেমে আসবে, এমন বিশ্বাস আমাদের পাকা ছিল। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবার জন্যে মূলবইয়ের পাশাপাশি একটা পাতলা গাইডবই সেবছর বা তার আগের বছর থেকে বাজারে পাওয়াযাচ্ছিল। সেই গাইডবই মূলত বিগত কয়েক বছরের প্রশ্নের নমুনা দিয়ে সাজানো ছিল। সেকালে হালের কোচিং ব্যবসা মোটেইছিল না। একমাত্র এই গাইডবইটি পরবর্তীতে জানতে পারি ছাত্রশিবিরের একটি উদ্যোগ। জানার পরেই বিবমিষা লাগে আমাদের, এবং তা আর তেমন করে পড়া হলো না। সাধারণ জ্ঞানও তো কিছু পড়তে হয়েছে, তার জন্যে প্রাত্যহিক দৈনিক সংবাদ পাঠ সহায়। সে যুগে এত হাজার লক্ষ প্রথম বিভাগধারী ছিল না, তাই সারাদেশে যেমন মেডিকেল কলেজের সংখ্যা কম ছিল, তেমনি পরীক্ষার্থীও সীমিত ছিল। লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোন একটা হলে, তা আর মনেপড়ছে না। তবে, মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম প্রাচীন দ্বিতল কলেজ ভবনের নীচ তলায় প্যাথলজি ল্যাবরেটরিতে। তিনজনশিক্ষকের মধ্যে যিনি প্রধান ছিলেন তাঁর নাম পরে জেনেছিলাম অধ্যাপক জহুরুল মওলা, জাঁদরেল পরীক্ষক, জবাব কেমনদিয়েছিলাম মনে নেই, তবে এটা জানতে পেলাম, যেখানে অন্যান্য বোর্ডে ছাত্ররা ১৬/১৭/১৮ নম্বর পাচ্ছিল, সেখানে আমাদের বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল ১৩, এবং আমিও ওই ১৩ই পেয়েছিলাম। ভাগ্যের ব্যাপার ছিল লিখিত পরীক্ষা ভাল হওয়ায় আমিটিকে গেলাম। সেকালে সারা দেশে মেডিকেল কলেজ ছিল মাত্র আটটি। বর্তমানে ১১৫টি মেডিকেল কলেজের তুলনায় তা কত অপ্রতুল এবং ভর্তির সংগ্রাম কত পরিশ্রমসাধ্য ছিল তা বোধহয় বলে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। বাবা-মা আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন নিয়তি। তাই ডাক্তারী পড়া ছাড়া অন্য ভাবনা মাথায় ঢোকার সুযোগ পায়নি।
অবশ্য প্রস্তুতি না নিলেও বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। আব্বা সাথে করে নিয়ে যান ঢাকায়। এটা আমার দ্বিতীয় ঢাকা সফর। তোপখানা রোডে কোন এক হোটেলে রাত্রিযাপন করি। আব্বা ফজরের নামাজ পড়তে উঠে আমাকেও তুলে দিলেন।নামাজ শেষ করে আব্বা আমাকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন স্টেডিয়ামের দিকে। স্টেডিয়াম মার্কেটে প্রিন্স এবং প্রেসিডেন্ট নামে দুটো রেঁস্তোরা তখন বিখ্যাত ছিল। আব্বা বললেন প্রিন্সের পায়া ও নানা খুব মজা। কিন্তু তখনও দোকান খোলেনি। অগত্যা দুই তিনচক্কর ঘুরতে হলো স্টেডিয়ার চারদিকে। এতে খিদে বাড়লো এবং পায়া ও নানের স্বাদ অতুলনীয় হয়ে ধরা দিল জিহ্বায়। আব্বার সাথে একা ভ্রমণ এটাই প্রথম। আব্বাও আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে লাগলেন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জীবনের কথা। কার্জন হলের নানা গল্প। আব্বা সম্ভবত সেবারই প্রথম আমার সাথে নিজের গল্প করেছিলেন। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখতে যাবার কোনকারণ আব্বা খুঁজে পাননি, কারণ এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। সে যুগে তো সশরীরে না গেলে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন ছিল। এদিকে আমার বন্ধুদের মধ্যে দুয়েকজন জানালো আমি টিকেছি, আবার কেউ কেউ বললো, না, তারা আমার রোল নম্বর তালিকায় দেখেনি। আমার বাবা এসব ভাবনা মাথায় আনতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন। অবশেষে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পূর্ব মেডিকেল টেস্টের দিন ধার্য্য হলো। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম বেশ কিছু অগ্রজ মেডিকেল ছাত্র আমাদের সাথে আমাদেরই কাগজ পত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। প্রস্রাব পরীক্ষা কালে মনে হচ্ছিল যেন আমার পক্ষে তাঁরাই প্রস্রাব করে টেস্ট টিউব ভরে নেবেন। অবশ্য পরে তা না করে বাথরুমের বেসিনের ট্যাপের জল ভরে নিয়ে জমা দেওয়া হলো পরীক্ষার জন্যে। আমি এদিকে দারুণ উৎকন্ঠায় পড়ে যাই। মেডিকেলের ট্যাপের পানিতে না জানি কতরকম জীবাণু থাকে! শেষে আমার প্রস্রাব পরীক্ষায় যদি জটিল কোন রোগ ধরা পড়ে তখন তো সব বরবাদ হয়ে যাবে। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সময় বড়ভাইয়েরা দিলেন না। নিয়ে গেলেন সার্জার বহির্বিভাগের একটি কক্ষে। সেখানে আরেক বেইজ্জতি কারবার। বলে কিনা “প্যান্টখোল”। প্যান্ট খোলার পরে বলে আন্ডারওয়্যার নীচে নামাও। সে কি রে! ডাক্তার পড়তে এসে এভাবে ইজ্জত খেয়ালে হবে! না, তেমন জটিল কিছু না। তারা শুধু বললেন “কাশি দাও, জোরে কাশি দাও”। কাশিতে সব দুলে উঠল বটে, তবে এক কাশিতেইতাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গিয়েছিল। হায়, পরে কত লোককেই আমিও এমন কাশতে বলেছি! যাই মেডিকেল পরীক্ষা উত্তীর্ণহয়ে আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। রোল নম্বর হলো ৫৮। এখানে বলতেই হবে আমার জ্যাঠামশাই অর্থাৎ জেআব্বু আমার মেডিকেলেভর্তির ব্যাপারে খুব বেশি উত্সাহী ছিলেন। আমাকে সাথে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন, প্রিন্সিপাল অফিস, এনাটমি বিভাগ, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ, লাইব্রেরি এবং ওনার ভাষ্য মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ “নোটিশ বোর্ড”। জেআব্বু বললেন, প্রতিদিন আসা যাওয়ার ফাঁকে অন্তত একবার নোটিশ বোর্ড ভাল করে দেখতে হবে। এনাটমির এক টেক্সিডার্মিসের সাথে দেখাকরে বোনস সেট সংগ্রহ করে দেবার জন্যে বলে দিলেন। জেআব্বুর খুব আগ্রহ — ঘরে একটা ছেলে অন্তত ডাক্তার থাকা দরকার।যদিও আমার জ্যাঠাতুত বোন, মানে মেজ আপা তখন ডাক্তারী পাশ করে ইন্টার্ন শেষ করেছেন। তবু জেআব্বু আমার ডাক্তারহওয়া বেশি জরুরী ভেবেছিলেন সেকালের সমাজ ব্যবস্থা ও সমাজ মানসিকতার কারণে। এটাকে নিছক পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরচিন্তা বলা যায়, তবে আশৈশব জেআব্বু আমাকে যে অপার স্নেহ দান করেছেন, তাঁর সে ভালবাসার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বলহয়ে উঠেছিল যেদিন আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। তখনও তিনি সার্জিক্যাল আউটডোরে মেডিকেল অফিসার হিসেবেকর্মরত। জেআব্বু এল এম এফ ডাক্তারী পড়েন আন্দরকিল্লাস্থ তৎকালীন মেডিকেল স্কুলে। পাশ করে বিভিন্ন উপজেলায় চাকরিকরেন। বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের কোয়ার্টারে আমরা পরীক্ষার পরে সবসময় কয়েকদিন গিয়ে থাকতাম।পরবর্তীতে এলএমএফ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রীতে উত্তীর্ণ হবার জন্যে সরকার পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে জেআব্বু সে পরীক্ষায়তিনবার অবতীর্ণ হবার সুযোগ পেলেও এক্সফলিয়েটিভ সোরিয়াসিসে আক্রান্ত হয়ে বারবার অসুস্থ থাকায়, তিনি নিজ ডিগ্রীরউন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। চাকরির শেষ সময়টা তিনি সার্জিক্যাল আউটডোরে মেডিকেল অফিসার হিসেবে সম্মানের সাথে কাজকরে যান। জেআব্বু আমাকে ডাক্তার হতে দেখেছিলেন। কিন্তু আমার সারাজীবনের আফসোস, জেআব্বুর মৃত্যুকালে আমি তাঁরপাশে ছিলাম না। আমি গিয়েছিলাম ভারতে প্রথম সর্বভারতীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে যোগ দিতে ১৯৯৩ সালে। এখনওসেকথা মনে পড়লে নিজের ভেতরে নিজেই কুঁকরে মরি।
০৮ জুলাই ২০২২
মন্তব্য