সান্দ্রস্বরে ঘটে নিরাশার মোহমুক্তি: কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ রচিৎ 'আশ্রয়' কবিতা পাঠকেন্দ্রিক কয়েকটি অনুভূতি
সুশান্ত বর্মণ
সুশান্ত বর্মণ
কারও কারও কবিতা আছে যেগুলোকে খুব নিজস্ব বলে মনে হয়। দুলাইন পাঠ করে কবিতার ধ্বনিরেখায় আত্মমগ্ন হয়ে যেতে হয়। সৈয়দ সাখাওয়াৎ তেমন একজন কবি। তার কবিতার ভাষা কোমল, শান্ত। পাঠকের মননের গভীরে সহজে প্রবেশ করে। আশ্রয় দেয় ক্লান্ত প্রাণকে। প্রখ্যাত সাহিত্য ম্যাগাজিন 'বিন্দু' পত্রিকায় প্রকাশিত সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর ‘আশ্রয়’ শিরোনামের সিরিজ কবিতাগুলো এরকমই।
আশ্রয় শিরোনামে কবিতা রয়েছে আটটি। প্রতিটি কবিতা আত্মগত বেদনার পুনর্বয়ান করে। শৈল্পিক দক্ষতায় বয়ন করে চলে শোকাকুল চিন্তারেখার। নিজের অব্যক্ত আত্মবোধ ছড়িয়ে দেয় চরাচরে। কবি ধ্যানস্থ উচ্চারণে বিবরণ দেন আত্ম উপলব্ধির। স্বীকার করেন অসম্পূর্ণ অর্জনসমূহের নিখাঁদ বিবরণ। প্রথম কবিতার প্রথম ছত্রে কবি বলেন-
আজও জানি না কিছুই, ছুটে আসে বর্তুল পৃথিবীলোহার খাঁচায় বিদ্ধ শিকারের মতো ম্লান চোখে—কখনো দেখিনি আগে—যেন দূরতম ছবি একআলোকবর্ষ পেরিয়ে দূরের এক নক্ষত্রলোকে
সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে তার কোন দ্বিধা নেই। সরল বিশ্বাসে বলে যান রূপকল্পের অসীম বিবরণ। একই কবিতায় তিনি জানান-
সেসব মহাকালের ছবি, টেলিস্কোপিক মেমোরিবারে বারে ফিরে আসে, নদী ও নারীর মুখে মুখেঅথবা কাঁচের বল সম্ভাব্য ধ্বংসের ভয় নিয়ে—সন্ধ্যায় হারিয়ে যায় কোন এক আলোর অসুখে
কবি তাঁর দ্বিতীয় কবিতায় চেতনার অন্যপাশে গভীর অবচেতন জগতে যে অন্যসত্ত্বা বাস করে তাকে পর্যবেক্ষণ করেন। জেনে নিতে চান আত্মগত অভিব্যক্তি। তাঁর সরলতা স্মৃতির পাতা ওল্টায়। একটার পর আরেকটা পাতার ভাঁজে ভাঁজে খোঁজেন অপার্থিব কোন সংকেত।
প্রতি যাত্রায় মানুষ মূলত গভীরে চলে যায়শরীর থেকে ক্রমশ হয় আলাদা, নিঃসঙ্গতাসে কভু সাক্ষ্য মানে না, ছিঁড়ে শুধু অস্থির কাঁটায়সকল ঐশ্বর্য্য ঝরে, থাকে কেবল তন্দ্রাহীনতা
একজন বিজ্ঞানমনস্ক বিদগ্ধ মানুষের জ্ঞান তার চেতনায় বহমান। তাই তিনি 'আদিবাসী প্রণয়' চেনেন। রক্তের গভীর থেকে আর্তনাদ করে ওঠে এক আদিম মানব। ছিঁড়ে যাওয়া সুতো টানটান হয়ে ঝুলতে থাকে ইতিহাসের ডালে-পাতায়। মর্মের গভীরে খুব নীরবে উচ্চারিত হয় বিচ্ছিন্নতার মূল সূত্র।
সীমানায় ভাগ হলো মাটি ও মানুষের বিশ্বাসমানুষ ভুলেছে হায়—আদিবাসী প্রণয়ের টান
শব্দগুলোর শরীরে যেন এক অস্ফূট বেদনার ঢেউ বয়ে যায়। অনুচ্চারিত প্রশ্ন নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন পরিপার্শ্বকে। জানতে চান অন্তর্লীন ক্রিয়াকর্ম। তিনি অচেতন তা নয়। স্বজ্ঞাকে আগলে রেখে বুঝে নেন কার্যকারণগুলো। চার নং কবিতায় পাই:
তাদের স্মৃতিতে যেন বৈরাগ্যের অনর্থক ভারতারা বয়ে নিয়ে যায় উত্তরকালের আকাঙ্ক্ষায়
বৈরাগ্য হল ত্যাগ ও নির্লোভের রূপবাহী অথচ কবিতার এই অংশে তার অর্থবোধকতা করুণ হয়ে যায়; হারিয়ে ফেলে দার্শনিক ঋজুতা।
পঞ্চম কবিতায় প্রশ্নগুলো যেন অনুচ্চ থাকে না। প্রশ্নের পাশাপাশি এসে উপস্থিত হয় অনুচ্চারিত উত্তরগুলো। পাঠক সজ্ঞান হয়ে ওঠেন।
কেন এই বিয়োজন? পদভারে কেন হয় লীন?সবুজ ঘাসের দিন ফুরিয়ে যায় কোন কাঁপনেআকাশে মরুর মেঘ ধূলিঝড়ে ঢাকলো যেদিন—বাতাস তো ভুলেছিল ছায়াহীন ভিন্ন আলাপনে
ষষ্ঠ কবিতায় অপ্রাপ্তির স্মৃতিগুলো অমলিন হয়ে থাকে। এমন তো কথা ছিল না। মানুষের সাথে মানুষের যোগসূত্রতা স্বাভাবিক আলো বাতাসের মত নমনীয় হতে পারত। কিন্তু ভবিতব্য তো পরিণতি পায় অন্য মাত্রায়।
থাকে শুধু মায়া তার, ছবি হয়ে থাকে চির ভুলযেকোন সশস্ত্র দিন, হতে পারে সফল কার্তুজ
সপ্তম কবিতায় অনুরণন ওঠে একই উচ্চারণের। কবি নিরাশাকে রেখাঙ্কিত করেছেন এভাবে।
কত দীর্ঘ নিষ্ফলতা, ভাগ্যরেখা মুছে গ্যাছে যার—কীইবা হারাতে পারে, নতুন ব্যথা ভোলাতে হায়
সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর কবিতার শব্দগুলো মায়াময়, পেলব অনুভূতি নিয়ে মর্মতন্ত্রী ছুঁয়ে যায়। অপ্রচলিত, জটিল শব্দ ব্যবহারের গ্লানি তিনি চিনেন। তাই শব্দ বাছাই করতে গিয়ে বেছে নিয়েছেন সরল, সাবলীল ও পরিচিত শব্দগুলোকে। ফলে কবির আন্তরিক ভাবনাবোধ পাঠকের স্বপ্নজগতের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। পাঠকের মগজেও ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে আবছায়ার মতো অস্পষ্ট অতীত। যাবতীয় ভুল ও বিভ্রান্তিগুলো কত অজুহাতেই না নিজেদের প্রকট করে। কিন্তু দিনশেষে বেঁচে থাকে প্যান্ডোরার বাক্সের একমাত্র উপাদান। আর এজন্যই বোধহয় অষ্টম কবিতায় নম্রসুরে সান্দ্রস্বরে পাঠককে জানিয়ে দেন ভবিষ্যতের সুপ্ত আশা-
সমস্ত ভুলের পর সে-ও এক আশাবাদী নদীফিরছে বন্দরমুখী—পৃথিবীর শেষ পোতাশ্রয়েনতুন বসন্ত দিন মুখে মুখে রটে যায় যদি—মানুষ ফিরবে ঘরে—মানুষের অনঘ আশ্রয়ে…
অতঃপর বলা যায় ‘আশ্রয়’ শীর্ষক সিরিজ কবিতার মূল কথা এটাই। মানুষের প্রতি আশাবাদ। মানুষের সান্নিধ্য তো প্রত্যাশা করে মানুষই। আশাভরা বুক নিয়ে মানুষের জন্য আরেক মানুষের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোন গতি আছে কি?
মন্তব্য