নিবেদন- কবির প্রতি কবির
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
একজন কবি কি কেবলই ‘ক’বয়ব? নাকি, রক্তমাংসের অন্তস্থে প্রাণের বায়ুতাড়িত পাখা মেলা চলন্ত এক ক্যামোফ্লাজ পোষাক?
এ আমার অকপট স্বীকারোক্তি-- কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর ‘নিহিলের বনে’ কাব্যগ্রন্থে নিহিলিস্ট কবি’র কাব্যগ্রন্থের এটি কোনো রিভিউ নয়। বরং বলা ভালো, একজন স্বপ্নদর্শীর স্বতন্ত্রতার বিচরণ ভূমিতে এ আমার কিছুক্ষণের অবতরণ।
আশ্চর্যজনকভাবেই ওপারের বাংলাভাষীক কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ পৌঁছে গেলেন (নিহিলের বনে) এপারের কবি শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস-এর কাছে আরও একজন বিশিষ্ট কবি ও ‘বিন্দু’ সম্পাদক সাম্য রাইয়ান মারফত। তারপর যা হয়, কেবলই ঘোরের মধ্যে আত্মীয়করণ এ-র ডাক শুনতে পাচ্ছি।
এ সেই ডাক, যা থামতে দেয় না। কেবলই ছুটিয়ে মারে জীবনানন্দীয় ডাক, ‘এ পৃথিবী একবার পায় যারে’, সেই অনির্বচনীয় আনন্দের আনাচকানাচে। পৃথিবী একবার যাকে পায়, তার সবটুকু ভালো, মহত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীই কি পারে তার শুন্য অংশটুকুকে ভরাট করে দিতে? --এ প্রশ্ন জনান্তিকের কাছেই।
‘নিহিলের বনে’, নামকরণে কতবার ও বারবারই ধাক্কা ও গোত্তা খেয়ে এই ভূমণ্ডলীয় নিখিল- অনন্ত মহানভে ‘আমি’- এক আদি সত্তার চ্যালেঞ্জকে উদার দরজা থেকে বর্হী প্রান্তরে উন্মুক্ত করে দেয়, তখন কবি সাখাওয়াৎ-এর উন্মুক্ত দৃষ্টিতে ‘আমি’ হয়ে যায় বাদ্যরত এক আদিতম সানাই। যে সানাইএ-র সুর বাদকের কণ্ঠার্জিত চিরতরের জন্য পর হয়ে যাওয়ার আকুলতা।
কবি লেখেন--
আমাকে করেছো পর,বাজিয়েছো সানাইনদীটা গহীন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিত..
কোথায় যেনো বাঁ বুকে ধাক্কা লাগলো। উচাটনি মনের বুকে হাত রেখেই প্রশ্ন রাখি-" মন,তুমি ভালো আছো তো?"
নদীর গহীন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিত।
মানেটা কি!
তবে কি এতোদিনকার চেনা নদীর রচনায় নদী আর নদী নয়! নয় কি প্রবাহ! তবে ভুল টা কোথায়! ভুল এই নয় তো যে, সানাইবাদক এর কণ্ঠের নির্যাসমিশ্রিত মূর্ছনায় দেওয়া হয়েছে যতটুকু গান, নেওয়া হয়নি তার কিছুই! প্রশ্ন এই কারণেই, পরক্ষণেই কবি যখন লেখেন-
আমি যেন শিকারীর রাইফেলেদ্যাখা নীলগাইভেঙে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত।
এখানে একজন মননশীল ব্যক্তির শব্দ ব্যঞ্জনায় রচিত শিকারীর রাইফেল নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও ভেঙে পড়ার এই নৈর্ব্যক্তিক টুকরোটাকরা ঢিল যে আমাদেরকেও আঘাত করছে- এটি সহজেই অনুমেয়।
‘নিহিলের বনে’- এর প্রথম কবিতার আস্বাদ বুঝি এটুকুই নয়। অপেক্ষার শেষ সিঁড়িতে সেই অসম্ভব সুন্দরের প্রতিক্ষায় পৃথিবীর বৃহত্তম ও ক্ষুদ্রতমের বৈপরীত্যে হাতি ও তেলাপোকার দৈহিক বিশ্লেষণ কখন যেনো হয়ে যায় মনস্তাত্ত্বিক মর্মন্তুদ সেই বাঁশি, যে বাঁশি বেজে যায় কেবলই উদয় হয়ে অস্তের চলাচলের পথে পথে।আর, আমরা শয়নে স্বপনে আস্বাদন করতে করতে ভাবি--- "অতিকায় হাতিদের দিন বুঝি ফুরিয়েছে পথে। /পালাক্রমে / তেলাপোকা টিকে গেছে নবায়নে- প্রায় অসম্ভবে/ আমিও জেনেছি শেষে টিকে থাকার চির মৌসুমে / স্মৃতিরা বেদির মতো শব্দহীনতার ফুল- স্তম্ভে!
'বাক্ রহিত' বলে বাংলা শব্দ ভান্ডারে এক বিস্ময়কর ক্রিয়াশীল ক্রিয়া আছে,ইংরেজিতে spellbound. আরশোলা নতুনতর অভিযোজিত অবস্থায় টিকে থাকার আদি কৌশলে live থাকলেও, পুরানো সভ্যতার বেদিতে নবায়িত আরশোলার মতো একজন কবি রূপ আনুভূতিক প্রাণী বুঝি বা এভাবেই স্মৃতির বেদিতলে অস্তিত্বশীল ইতিহাসকে রেখে রোমন্থন করে বয়ে চলে আগামীর উল্লম্ফনতার গতি জাড্যের অভিমুখে ।
দ্বিতীয় কবিতায় কবি একাকি হেঁটেছেন ক্যামোফ্লাজ পোষাকে বিলয়ের দিকে।
প্রশ্ন জাগে- ‘বিলয়’ শব্দটিকে নিয়ে। প্রলয় নয়।লয় নয়। একেবারে অন্যরকম- ‘বিলয়’, যা লয় বা শেষ নয়। বরং যান্ত্রিকতাবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে এই লয় বিশেষ কিছু, যা অসম্ভব significant and Smart একটি শব্দ এবং এই ‘বিলয়’-ই কবিতাটির প্রাণভোমরা হয়ে অবস্থান করছে কবিতাটির হৃদপিঞ্জরে।
তৃতীয় কবিতা। আহা! কবিতার শরীরের এমনতর গঠনে কখন যেনো কবি এক মৃৎশিল্পী হয়ে গেছেন। আর আমিও এর প্রাণের আস্তানা মৃৎপাত্রের জলে চন্দন হয়ে ঢুকে গেছি।
পাঠক, আসুন আমারই পিছু পিছু অখন্ড বাংলার মাঠে ঘাটে বাটে, আমরা আমাদের নিজস্ব সম্পদের মালিক বলে নিজেদেরকে ঘোষনা করি।
যে ব্যথা নেশার মতো ছড়িয়েছে রক্তে ও নিদ্রায়-মিশে গেছে নিঃশ্বাসে,শেষ গল্পে- আলোকরেখায়তাকে দেখি উৎপাতে- দুপুরের রোদেজায়মান যেন স্থির রেখা একজলে নামা মহিষের স্নানআমাদের বাড়িপথে ধূলিধূসরিত সেই সন্ধ্যাথেমেছিলো- অসীমের টানে-প্রিয় জাগতিক ক্ষুধাদড়িয়া নগরে তুমি ছড়িয়েছো গল্পের রেশমঅতি বর্ষায় জোয়ার কমে আসা উনুনের ওমসকল আঁধার শেষে তবু আসে শরীরের সাঁকোযে ব্যথা নেশার মতো তাকে কেনো ভুল নামে ডাকো।
একেবারেই নিজের মতো করে এই কবিতার ব্যাখ্যায়, ব্যথার এক বিশেষ আভিধানিক অর্থে কষ্ট যেনো আধি ভৌতিক এক আওয়াজ, যা উপশম হয় না ব্যথা উপশমকারী ঔষধ মরফিনে। এ ব্যথা এমনই, যা স্নানতর মহিষকে স্থির রেখার ভেতরেও অস্থির তোলপাড় করে ফ্রেমে বন্দী করে দেয়। আবার সেই বন্দীত্বকেই উপশমের হেতু হিসেবে বিজিত শরীর সাঁকো (পথ আছে বলেই সাঁকোও অবশ্যম্ভাবী। শরীর আছে বলেই না- শরীরও বাস্তবতার দাবী রাখে) পেরিয়ে যাওয়ার পরেও, ব্যক্তি নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যায়। নামহীন, গোত্রহীন এমন সুক্ষতায় স্মৃতি কেবলই ভুল নাম ধরে ডাকে।
বাকি বিশ্লেষণ পাঠক- আপনাদেরই জন্য রইলো।
তিনটে কবিতার পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বলতেই হয়, সমস্ত কবিতাগুলো স্মৃতির মাইলফলক হয়ে গিয়েও, পিছুটান থাকে যেমন,তেমনই থাকে আশাবাদের আদরণীয় ডাক। সে ডাকের বড় কোমল স্বভাব। বিভোর করে রাখে সারাক্ষণ। এমন বিমোহিত আস্কারায় পাঠক পাতায় পাতায় পায়ে পায়ে চলতে চলতে পৌঁছে যায় ৪৬ নম্বরের দোরগোড়ায়। দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে সেই সকাল,যা আর কোনো দিনও ফিরে যেনো না আসে।
এমনতর সকাল কখনো যেনো ফিরে না আসে।মুদ্রার এপিঠ থেকে ওপিঠে - বদলে যাচ্ছে যারাহিংস্রমুখ, রক্তাক্ত আঙুলের সাথে ঝুলে থাকে- বিষাদের পাথরেরা-ফোলা চোখের থির জলেরা এখানে জমছে শুধু,হৃদয়ের বানভাসি জল থামুক এবারএই বিষময় কঙ্কালের নাচপরসিয়ানাও থেকে আসুক ফুল গন্ধসুবাসএকটা নিশ্চিন্ত দিন,শীতে পাক উষ্ণতার আঁচজানিএসবই স্বপ্ন- যখন তুমি ভাঙছো পূজামানুষের মানচিত্র কাটো,আরো কাটো সমনামদেবতা আধার কেটে- করছো দিগ্বিদিক উল্লাসধর্মের জিরাফে দ্যাখো - হন্তারক রোদ উপাখ্যানএমনতরো সকাল কখনো যেনো ফিরে না আসেফলকের বন্দী হয়ে মানুষের দীর্ঘনিশ্বাসে!
না - কবি সাখাওয়াৎ। না।
ধর্মে বসবাসকারী জিরাফের লম্বা গলা বরং এলিটিও হাতি খাদক হোক। বেঁচে থাক নবায়ন গ্রস্ত আরশোলা জীবনের প্রাণচঞ্চল ছটফটানি। আর, আমরা দেখি পৃথিবীর আশ্চর্যতম প্রাণ থেকে প্রাণীর জয়যাত্রার বিবর্তিত পরিক্রমণ। মহাকালের কক্ষপথ ব্যাপি উৎসব এর দিগ্বিদিক উল্লাস চলুক। চলতেই থাকুক ‘নিহিলের বন’ থেকে বনান্তরে।
মন্তব্য