খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ
প্রথম প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪১৯, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত (মাসিমো নোটা’র চিত্রকর্ম অবলম্বনে)
প্রকাশক: কাঠপেন্সিল
জল ছাড়া ভেঙে পড়ার আর কোনো শব্দ শোনা যায় না
জানি সবাই, জল ছাড়া ভেঙে পড়ার আর কোনো শব্দ শোনা যায় না।
গোপন ক্ষয়, ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো নিস্তরঙ্গ; অবধারিত।
কেবল জানালায় দেখা দৃশ্যগুলো চলে যায় সশব্দে, জানিয়ে দ্যায়
দৃশ্যের বাইরে কোনো জগত নাই। ভেঙে পড়া যাবতীয় রূপ থেকে
দূরে কোথাও-- গোপন ক্ষরণে, চিরাচরিত নির্জনতায় ঝরে পড়ে
বৃক্ষের পাতা... সোনালি সোনালি রোদ ছুঁয়ে অবাক শীতের রোদ হয়ে।
চুড়ি ভেঙে পড়ার শব্দ দারুণ! দেশ-কাল-মাটি নিদারুণ কষ্টের
দাগ হয়ে রাত্রির সাথে বসে থাকে নিশ্চুপ, নিয়ত রক্তক্ষরণে
ক্ষত-বিক্ষত! জমির দীর্ঘ আল, মাটি ফুড়ে জেগে ওঠা কাঁটাতার
তোমাতে-আমাতে অতীত রোমন্থন ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নাই। রাত্রি
আর দিনের মতোই বিশাল পার্থক্য সীমান্ত, নাম-পরিচয় ঠিক
পাল্টে দ্যায় কাঁটাতার। রক্তাক্ত শরীর কাঁটা হয়ে ঝুলে আছে, রক্তের
জলতরঙ্গ নিঃশব্দই থাকে! যদিও জল ঝরে পড়ছে সশব্দে...
দৃশ্যান্তর বার্তায় চোখ বুলিয়ে দেখি
ভাতের মাড়ের গন্ধে ঘুমন্ত চোখের পাতা থেকে বেরিয়ে আসে নেড়ি কুকুর। চেটে চেটে
খায় নর্দমা পর্যন্ত। এ’দৃশ্য থেকে কেউ দূরে নয়। তবুও দৃশ্যান্তর বার্তায় চোখ বুলালে
দেখি, অজস্র প্রজাপতির ভেঙে পড়া ডানার ছবি। এ’ছবি আমাদের মনে স্থায়ী কোনো
রেখাপাত করতে পারে না। কেননা এ’দৃশ্য নতুন নয়, আগামীকাল নতুন দেহ মিলবে,
এ’শব্দশ্লোক চিরস্থায়ী অভাব হয়ে আমাদের দু’চোখে প্রশান্তির ঘুম আনে। আমরা
ঘুমিয়ে পড়ি যার যার ব্যক্তিগত বিছানায়, শরীরে বহুমুখী বেদনার ছাপ আঁকতে আঁকতে।
আমাদের ঘুম বহুল ব্যবহারে ভোঁতা হয় না। গভীর আহ্লাদে খান খান হৃদয়ের বাসনা
জড়িয়ে জড়িয়ে আমরা ছড়িয়ে পড়ি বাসনার অলিতে-গলিতে। আমরা এক-একটা
ইমারত বানাই। ঘুম সেখানে রাজার মতো ঢুকে পড়ে। আমাদের চোখে এ’দৃশ্যগুলো
পুরনো হয়ে গেছে। সুতরাং দৃশ্যান্তর বার্তা আমাদের জন্য নতুন কোনো প্যারাডক্স
তৈরীর আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে। আমরা সেই প্যারাডক্স দেখতে দেখতে নুন খাই।
আশ্চর্য! সবাই বেড়িয়ে আসছে, চারিদিকে শ্মশানে মড়া পোড়ানোর উৎসব দেখতে।
মাংসের পোড়া গন্ধ নিশ্চয়ই ক্ষুধার কাছে অতিশোয়াক্তির। আমরা মাংস পোড়ার
উৎসবে জড়িয়ে পড়ি, কেননা আজ আমাদের কোনো কাজ-কারবার নাই। মাংসের ভাগ
নিয়ে কয়েক দফা দাঙ্গা হলে আমরা যে যার লোকালয়ে ফিরে আসি।
আপাতত ইঁদুর মারা কলে কিছুটা পনির মাখি। যদিও এ’শব্দ আমাদের কাছে নতুন!
পনিরের সুঘ্রাণ ছড়ালে আমাদের শিশুরা শাঁ শাঁ করে ছুটে আসে। আর ঢুকে পড়ে
এক-একটা কলের ভেতর বিস্ফারিত চোখে।
তারপর, দৃশ্যান্তর বার্তা আমাদের শিশুদের ছবি ছাপে।ওদের পশ্চাতে তখনও লালা ঝরে!
অনঙ্গ'র ক্রোধ কিংবা রাইনা'র দুঃখ
(অনঙ্গ ও রাইনা দম্পতি পাহাড়ের সন্তান। উদ্বাস্তু হয়ে ভিটে-মাটি ছেড়েছেন বহু আগে। লেকের পানিতে যতটুকু দেখো যায় মাটি তা দেখিয়ে বলেছিলেন: ঐ যে কালাপাহাড় ঐখানে আমার বাড়ি ছিলো, আজ সব জলের অতল।)
লেকের পানিতে কেঁপে ওঠে পাহাড়ের মৌনতা
শব্দের উৎসবে ছড়িয়ে পড়ছে ফেনা জল
ওইখানে একদিন ছিলো পাহাড়ীর বুকের
ওম, আজ সব ডুবে গেছে জলের অতল।
কালো পাহাড় শুধু দাঁড়িয়ে, হয় কালের সাক্ষী
নীরব উদাস চোখে দেখে উদার আকাশ
ঘর ফেরা হয় না তার, থাকে ঘরের অদুর
ঝিরিঝিরি হাওয়া চলে তার এপাশ-ওপাশ।
ওইযে জলে উঁকি দ্যায় অজস্র ঘরের সারি
ওইখানে দাঁড়িয়ে নেই কেউ পাহাড়ের জাত
কে কারে দ্যায়, দিয়েছে বলো জাতের পরিচয়?
বুকে বয়ে যায় কত নীরব ক্ষতের আঘাত।
বিবর্ণ দিন গুনে যায় শুধু ব্যথার প্রহর
জলের অতল হতে আসে কী নতুন সমন
অনঙ্গ'র ক্রোধে কিংবা রাইনা'র দুঃখে
সেলাই করে করে যাই শুধু পৌরণিক মন।
পাড়ি দিচ্ছে ইচ্ছের রাত
শরীর থেমে গেলে, মাটি মুখে নেয় তৃষ্ণার পেয়ালা
জলের স্পর্শে মিটে যায় আদি-অন্ত বাসনার ঘুম
শিরায় মদমত্ত টান, খান খান আসক্তির জ্বালা
মাটির শস্য শেকড়ে শেকড়ে ছোঁবে বাসনার চুম!
মুহূর্তে, এই সকলেই ছেড়ে যাবে যার যার ঘরে
ইথারে ভেসে বেড়াবে না কোন আততায়ী নাম
স্রোতের মতো ঝড়বে না জল উষ্ণতম জ্বরে
যদিও বুকে চাপ চাপ কষ্ট পাহাড় সমান!
কণ্ঠের তীব্রতম জোর চিরে দিয়েছিল বৃষ্টিরেখা
আমাকে ঘিরে থাকা রোদ উড়ে গেছে প্রাচীন প্রলয়ে
বসতি ভেঙে গেছে, সবুজ জুড়ে শুকনো মর্মরতা
দিগন্তজোড়া ছবি এঁকে এঁকে গেছি নিজস্ব নিয়মে।
বাসনা এমনই জ্বর, পুড়িয়ে পুড়িয়ে করে খাক
সীমান্তে চৌকি পাতা মন, তবু পাড়ি দিচ্ছে ইচ্ছের রাত!
সকল বইয়ের মলাটই এক মনে হয়
প্রতিটি নতুন মুখ সম্ভাব্য বৈচিত্র্য থেকে দূরে
পুড়তে পুড়তে কয়লা হলে, সকল বইয়ের
মলাট তখন এক মনে হয়। কখনো বিচিত্র
লাগেনি রাশি রাশি মানুষের মুখের সারি দেখে।
অজস্র কত শত মানুষ, উদ্দেশ্যবিহীন হেঁটে
চলে যায়। একটা মানুষ, কখনো কখনো হয়ে
ওঠে একজন। কড়ে গুনে গুনে জটিল সংখ্যা
ভুলে গেলে বেওয়ারিশ তালিকায় ঠিকই নাম
উঠে যাবে নাম পরিচয়হীন, কুলিং চ্যানেলে
ফ্রিজ শট। থেতলে যাওয়া মগজের ঘ্রাণ, বনে
ছড়ালে; মাছিদের উল্লাস হয়, মাছিরাও হয়
মানুষ ! এ’ছাড়া আনন্দময় শোকবার্তা লেখার
সহসা আর কোনো মোক্ষম সুযোগ কেউ পাবে না।
পুড়ে কয়লা হলে সব মুখই এক হয়ে যায়
মাছিদের উল্লাস হয়, শোকবার্তা লেখা হয়!
ফিলিস্তিন: আমার কন্যার মুখ
রাত্রির কাঠগড়ায় কখনো বোমার কাঁপন শুনে
হয়তো আমাদের কারোর ঘুম ভাঙেনি কোনোদিন
কোনোদিন আমাদের ক্লান্ত রাত ভেঙে ভেঙে পড়েনি
বোমায় ছিন্নভিন্ন শিশুর রক্তাক্ত লাশের উপর
তবুও একজন পিতার হৃদয়ে বহমান ¯্রােত
স্নেহময়ী মায়ের চাপা কান্নার আর্তনাদ শুনতে
পাই। অসহ্য রাত্রির তীব্র ভয়ে হিম হয়ে যাওয়া
বুকের রোদন, টের পাই স্মৃতির হিম হিমালয়ে।
কত কত মাটি রক্তে ভিজে সিক্ত হলে, একটা শিশু
বারুদের রক্ত ইতিহাস পেরিয়ে, বৃক্ষরূপ হবে?
পাতার শরীর থেকে জল গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে
পাতার শরীর থেকে জল গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে-
কোনো একদিন আমিও হয়ে যাই জল, পাতার মতন
টের পাই শরীরে বহু বর্ণিল কোলাহল। পুড়ে যাওয়া
রোদের তৃষ্ণায়, চিরন্তন প্রেম, শেখায়: বৃষ্টির সজীব
আদর। আমি বেহিসাবী রোদ হই, ছড়িয়ে পড়ি কণায়
কণায়। ছায়ারোদ দীর্ঘ হলে বাতাসে টের পাই জলের
গন্ধ, মাটি থেকে উড়ে যাওয়া জলের সাথে পাড়ি দিয়েছি
পরিযায়ী পাখির দেশ। জল, বহুরূপী হয়েছে কোমল
শীতল জড়তায়। সেখানে আমি থাকি, স্থাণুর মতো রোদ
ছুঁয়ে। একদিন উড়ে যাবো পরিযায়ী পাখির বেশে, দূরে।
পাতার শরীর থেকে জল গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে
কোনো একদিন আমিও হয়ে যাই জল, গড়িয়ে পড়েছি
পাতার শরীর থেকে, মাতৃগর্ভ ছেড়েছি দারুণ একাকী!
পাখি ও রোদ-১
বলেছিলাম পাখিদের ডানা হারাবার গল্প।
পাখিরূপ মানুষের উড়ে যাবার ইতিহাস,
নক্ষত্র ছুঁয়ে যারা ফিরে আর আসেনি ঘরে।
জ্বলে উঠবার কথা, পতন উন্মুখ ধূমকেতুর।
সবকিছু লেখা আছে, থাকবে; অবিকল।
শুধু একমুঠো মাটির সৌরভ খুঁজে হারিয়ে
যাওয়া ষাঁড়ের গল্প-বলা হয়নি। বলা হয় না,
ষাঁড়ের চলে যাওয়া দাগহীণ। কেবল জোয়াল
কাঁধে ফালি ফালি করে মাটি কেটে যাবার দাগ,
চিরস্থায়ী হয়। আর থাকে-ফসলের সুঘ্রাণ,মাটির
বুকের উপর লিখে রাখা সময়ের রক্তাক্ত কথকথা!
পাখি ও রোদ-২
তুমি তখন ঘুমিয়ে ছিলে, চারিদিকে হাওয়াদের দুপুর
নেচে নেচে বাজিয়েছিল হারিয়ে যাওয়া পাখিদের গান।
পাখিদের গল্প তোমাদের মনে বিস্মৃতির কান্না মেখেছিল।
পাখিরা সঙ্গমে যায়নি, বাতাসে তখনও পোড়া মাংসের গন্ধ!
এভাবে সকলেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি কত কত রোদ।
আমাদের পরাশ্রয়ী কান্নারা জমে থাকে শিশিরের সাথে।
রোদ এলে পুড়েও যায়, থাকে শুধু বিষাদের স্মৃতি
অন্দরমহল পুড়ে গেলে কেউ কোনো গন্ধ পায় না!
পাখি ও রোদ-৩
মৃত পাখির আর ডানা হারাবার ভয় নেই
পড়ে আছে, পাশে পিঁপড়ের দল, পাশাপাশি
যায়, খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় শরীর, পালকের
উজ্জ্বল রঙ পুরনো হয়, ঢেকে দ্যায় পতিত
বালির পরশ। ব্যথা জাগানিয়া ভোরে কারো ঘুম
ভাঙলে, পাখিটির আর কোনো প্রয়োজন নেই
শুকনো শস্যদানা, জমা পানির নীরব ধারা।
জল শুকিয়ে গেলে, যতটুকু চিহ্ন থাকে তাও
কিছু আশাবাদ জাগিয়ে রাখে, জলের। কেবল
মৃত পাখিটির নেই ডানা হারাবার ভয়। কোনো
চিহ্ন নেই, ডানার নীরব রোদও পুড়ে গেছে,
উড়ে উড়ে চলে গেছে উষ্ণতার সোনালি জ্বরে।
পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
প্রচ্ছদ রাজীব দত্ত
প্রকাশক : বাঙ্ময়
স্বীকারোক্তি ১
জন্মকাল থেকে শিখেছি কীভাবে আলাদা হতে হয়
নাভীমূল থেকে জঙ্ঘাস্থি জটিল চুলের মত করে
নিয়মিত স্রাব ও মেহ করছে আলাদা তুমি-আমি
আমাদের কাল, কলের হাওয়া মাথায় করে দোলে।
চুলগুলো ঝরে পড়ছে সতর্ক টানের সাথে সাথে
রক্তস্রাব আর বীর্যের সকল পাহারা ধুয়ে ধুয়ে
কখনোবা মুখ ঢেকেছে বিপুল স্বপ্নের নীল দাগ
ঝরাপাতা বলে ডেকেছে রক্তের তুমুল আর্তনাদ!
তারপর, স্নান শরীরে আলাদা শোকের মৃদু টান
মধ্যযাম পার করছে নগর, সতর্ক হেঁটে যান!
বাইনারি ডিসকাশন অ্যাবাউট স্কুল
আমাদের স্কুল, দেহ থেকে দূরে নিয়ে যায় মন; দূরালাপনে
মাটিগন্ধ শরীরের কোলাহল ভুলে-আমরাও ব্যস্ত ভীষণ--
শরীরে শরীরে। দেহগুলো জানে পরিচিত হতে জলের মতো
কেননা জলের চোখে, আয়নার মতো ভেঙে পড়ে বিপন্ন স্কুল!
এইখানে, যে তুমি সেলাই করে যাও পৌরাণিক মন, গোপনে
তুমি বা তোমাদের ঘর-দোরে ভীড় করে টেরেস্টেরিয়াল ফেনো
বিমূর্ত হয়ে গেলে চোখ, জানো তোমাদের চোখগুলো মরে যায়?
তোমাদের স্কুল, চোখগুলো বানিয়েছে গোলকের ছাঁচে; বেহায়া!
আহা! সেই তুমি-আমি; পাড়ি দিচ্ছি প্যাগাসাসে চড়ে:দেশ-বিদেশ
জটিল যন্ত্রজালে তোমার-আমার শরীর কেঁপে উঠে কী সুরে!
মস্তিষ্কে বিবাদহেতু, বেড়ে যাচ্ছে আমাদের জাগতিক প্রমেহ
কেননা বন্ধ চোখে, স্কুলগুলো এঁকে যাচ্ছে মানচিত্র ও মুখোশ!
বিকজ উইকনেস ইজ গ্রেট থিংস
(Because weakness is a great thing and strength is nothing. When a man is just born, he is weak and flexible. When he dies, he is hard and insensitive. When a tree is growing, it’s tender and pliant, but when its dry and hard, it dies. Hardness and strength are death’s companion. Pliancy and weakness are expressions of freshness of being. Because what has hardened has never win. --Andrei Tarkovsky)
তুমি দেখেছো কখনো মটির উপর পিঁপড়ের হেঁটে যাওয়া?
দ্যাখোনি, কেননা তুমিতো দলেছ পায়ে দীর্ঘসারি, ন্যুন অহঙে!
ছোট পাখিসব, অল্পপ্রাণ মানুষের বেদনার শূণ্য কথন--
তুমি দ্যাখোনি। দ্যাখেছো পেশীর শয্যায় পোশাকী শরীর সঙ্গমে
অনন্য ক্ষমতা! বীরের বাগানে সাজানো অজস্র রঙ ফোয়ারা।
দেখেছে দলিত প্রেম, মুছে যাওয়া মানুষের চোখ দূর্বলের।
কেননা কবন্ধ আঁধারে ঢেকে গেলে সমস্ত শরীর, ওরা জাগে;
বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে ঠায় অচেনা অনুরাগে। ইতিহাস লোভের--
ক্ষমতা আর প্রাচুর্য্যরে-বীরেদের গল্প কেবলই লহু তৃষ্ণা!
কেননা লিখেছে যারা, তাদের তো নেই দায় কিছুই হারাবার!
ইতিহাস লেখে না যাদের কথা, সেইসব দূর্বল-ঘামসিক্ত
যারা পাহাড় কেটেছে নীলনদ-ভোলগা থেকে যমুনার তীরে,--
করেছে বপন সুপ্তবীজ মাটির বুকে, খনিতে খনিতে রিক্ত
যাদের বুকের উপর লেখা-স্পার্টাকাস কিংবা বীরসা মুন্ডা
কিংবা অন্ধ আবেগে ছোড়া বেদনার তীর সিধু-কানু অন্ত্যজ
পাহাড় থেকে বনে, সমুদ্রে সমুদ্রে-ধূলোওড়া মরুতে মরুতে
কত বেদুঈন ইতিহাস গড়েছে, কেবলি মিথ-গল্প-কথারা--
উড়িয়েছে বহুল আয়োজনে, ভুলে গ্যাছে বঞ্চিতের ইতিহাস!
দূর্বল করেছে ক্ষমা: কেননা ক্ষমাটাই ইতিহাস পৃথিবীর।
আ শক্ ডকট্রিন
(ধরা পড়ে যায় দেহটাই শুধু, ধরা পড়বে না মন-কবীর সুমন)
এইযে তোমরা, আমাদের শরীরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছো; ভেসে যাচ্ছো
এ কাইন্ড অফ বাটারফ্লাই, বেশ দ্যাখে নিচ্ছো নানারঙের ফুলমধু হু
আমিও জানি সেলাই করার কলে কত ঘাম জমে আছে, কত রক্ত নখে
হোইয়্যার ইজ দ্য ডার্ক হর্স, লিভিং উইথ আন্ডাওয়্যার! শুধু চেটে খাচ্ছো।
সেই যে আলেন্দে, বন্ধু আমার বোকা...শরীরের চিহ্ন মুছে দিয়ে কী এঁকেছে?
ওরা কী জানে না বুলেটের নাম লেখা থাকে রক্তের সাথে, এটাই নিয়তি!
একদিন বোকারাও বুঝে যাবে অর্থের ছলাকলা, বাজার থেরাপী যত
ভেঙে দেওয়া দেয়াল দ্যাখে নিশ্চয় তাদেরও ভালো লাগবে না সেদিন ।
ওইযে তোমরা যারা হলে এডভান্স ফ্রন্টিয়ার সো কলড, মাথা বিক্রিত
ডলারের দামের সাথে তোমার দামও উঠে-পড়ে, জানো কী মেঘের নয়
একফোঁটা মেঘ সরে গেলে জানো না তো সূর্য আনে রোদমাখা নতুন দিন
জানি তোমাদের ছলাকলা দিন ফুরালে একই থাকে-আ শক্ ডকট্রিন!
ভূগোল পাঠ
ভূগোল পাঠের নিরানন্দ ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এলে একদিন আমাদের
জানা হয়ে যায় পৃথিবীর পুরো মানচিত্র। আমরা নিমেষেই এঁকে ফেলতে পারি
মহাসাগর, মহাদেশ, গভীর-অগভীর নদী বা গভীর অরণ্য আর রতœভান্ডার।
অবশ্য ভূগোল পাঠ, কখনো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো, যখনই বালিকাদের ছাপা
কামিজে মানচিত্র আঁকতে চাইতাম। বালিকাদের চোখ তখন গভীর, দীর্ঘতম নদী।
চুল এক গভীর অরণ্য। পাহাড়ের চিত্রও কোনোদিন এঁকে ফেলতাম।
তারপর আমাদের ভূগোল পাঠ নিরানন্দই থেকে যেত। তবে পৃথিবী কমলালেবুর
মতো দু’পাশে চাপা। এ’কথা--শুনেই, আমাদের কেউ কেউ মুচকি হাসি দিয়ে মুখ
ঢাকতো। আমরা তখন কমলালেবুর গোপন হলুদাভ রূপ আর কোয়ার সাদৃশ্যতা
নিয়ে ঘুমাতে যেতাম ক্লাসরুম ফাঁকা করে। আামদের ভূগোল পাঠ আরো নিরানন্দ
হয়ে যেত,যখন কেউ কেউ বালিকার ছাপা জামায় মানচিত্র আঁকতে আঁকতে
হাত ধরে চলে যেত, আমাদের মাঠের উপর বিস্তীর্ণ নদী এঁকে দিয়ে।
আমাদের দিকচিহ্নহীন মুগ্ধতা-পোস্ট কলোনিয়ান হেজিমনি
১
এইযে আলো ছায়ার খেলা আমাদের পোস্ট কলোনিয়ান কমনসেন্স-এ দারুণ লাগে!
অদ্ভুত! অদ্ভুত!দিকচিহ্নহীন মুগ্ধতা নিয়ে জড়। জানো তোমাকে এভাবেই শিখিয়েছে-
রিএ্যাকশন, পোস্ট-রিএ্যাকশন। বাকি সব ফালতু মাল, ঠিক এভাবে নয় ওভাবে-
যেভাবে মাংসের ভেতর ঢুকে যায় শ্বদন্ত, নিমিষেই চিপে-চুষে বের করে নেয় রস-
সাথে একটু পেঁপে দিলে তো মন্দ নয়-জুড়ে যাবে। আর তোমার শরীর থেকে বের
হয়ে আসে সর্বনাশা রোদের দীর্ঘ পরিসর-তুমি ঘুমাও কলোনীতে।
২
শব্দের কী আর এমন দোষ বলো-এসবকিছু শেখানো আছে-মগজে-মস্তিষ্কে-দেয়ালে-
ঠোঁটে-নাভীতে। তুমি তুমুল হবে দূর্বাঘাসে, বনে-বাদাড়ে-লংবীচে,যেখানে বিকিনি রোদ
খেলা করে উরুতে উরুতে। শুধু একটিবার এসো, দ্যাখে নিও কতটা শিশির জমা থাকে
ভোরের সবুজ ঘাসে, পাতার বরজে। ধ্বনিপ্রবণ বেদনা বুক থেকে বের হয়ে আসা
দীর্ঘশ্বাস- ওটা পোস্ট প্রায়রিটি ডিসাইডেড-তুমি যাও! আর হ্যাঁ-ফুলতোলা রুমাল বলে
আর কোনো শব্দ নেই, ওটা এখন মৃত শহর অনবদ্য আর্কিওলজি।
জেব্রা ক্রসিং
শহরের ঘনবসতি ছেড়ে একদিন পাহাড়ে ডুব দিতে গিয়ে
আমরা জেব্রা ক্রসিং শুধু খুঁজে বেড়িয়েছি
অভ্যস্ত পায়ে এরচেয়ে বেশিকিছু খুঁজে ফিরিনি আর
অভ্যস্ত চোখ যেভাবে খুঁজে বেড়িয়েছে মৃত পাখিদের পালক
সেভাবেই বিষণ্ন সঙ্গীত খুঁজেছে শ্রবণাঙ্গ নীরব গাছেদের
কত কত চোখ সয়ে যাওয়া গল্প বেমালুম ঘটে যায়
আমি শুধু কল্পিত দর্শকের সারি ভেঙে বেরুতে পারি না
এইসব কতশত অভ্যস্ততা তোমার-আমার...
তারপরও খেয়ালের মানচিত্র ঠিক পাড়ি দিচ্ছে ক্লান্ত দুটি পায়ে।
জারিত শূন্যতার খোলস থেকে
নরম ঘাসের নিচে ঘুমিয়েছে ঘাসফড়িঙ, পিঁপড়ের দল
সুনসান নীরবতা তবু কোথাও যেন ডেকে ওঠে হাহাকার
কী নেই,কী নেই-এই শব্দের তীব্রতা বেজে ওঠে বুকের ভেতর
সশব্দে সেসব পাখিদের আর্তনাদ, যারা উড়ে গ্যাছে আতঙ্কে-
বেজে যায় কেবল। আর কোথাও পাগলাঘন্টি, নিয়মমাফিক।
আমি সেইসব ঘাসফড়িঙের, যারা ডানার রোদ হারিয়েছে
সেইসব পাখিদের, যাদের চিৎকার ধ্বণিত হয়নি আজো
পাতাগুলো ঝরে পড়ার আগে কী গান গেয়ে ডেকেছিল মৃত্যুকে
সে গানের সুরগুলো শিখছি-জারিত শূণ্যতার খোলস থেকে
বেরিয়ে আসার তীব্র বাসনায়- মৃত্যুর অবারিত মোহ নিয়ে।
জীবন, বিষণ্ন রোদের ডানা
১
মগজের কোষে কোষে সেসব নিঃশব্দ শিকার খেলা করে
যারা চলে গ্যাছে স্মৃতিময় ভোর হাতে করে নিয়ে দূরে
দীর্ঘবাহু ছড়িয়ে আছে যে তুমি ধরতে পারো আঙৃলবন
বেদনার হাত থেকে বেঁচে যাবে ছুঁয়ে সারসের ডানারোদ
২
মৃত্যুর অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছ মুখোমুখি
মাঝে খেলা করে বানভাসি আর্তনাদ আর শেষ দীর্ঘশ্বাস
দেহের শিৎকার জানে সেসব ভাষা আর রঙকরা প্রেম
পাখি উড়ে চলে গেলে শেষাবধি পায়ের ছাপেরা থাকে জলে
৩
তোমার হাতে শোকের মতো গুঁজে দেওয়া নিষেধ গুচ্ছগান
যারা হারিয়েছ স্রোতের সাথে তাদের নামে নেই কোনো কথা
মগজে এখনো খেলা করছে রোদ, করিডোরে দাঁড়িয়ে মৃত্যু
ভাঁজখোলা আঙুলে থাকে বুঝি প্রতারক বন্ধুর ব্যাথাচিহ্ন
৪
পর¯পর হেঁটে চলে গ্যাছি, ভেতরে ছায়ার শরীর শুধুই
অকারণ কথা বলেছে বিষ প্রহরের সাথে, বিষন্ন রোগ
দৃশ্য ধুয়েমুছে গ্যাছে বৃষ্টি আর সেসব স্মৃতিময় শরীর
হাড়ের ভেতর এখনও শ্যাঁওলার গন্ধ লেগে আছে যেন
৫
সুরের ভেতর হাত ধরে চলে যায় অনেকগুলো শরীর
কেউ আছে, কেউ নেই-এ ইতিকথা লিখেছে পাখিসব সুরে
তাই সে স্নেহপুরাণ হাতে নিয়ে কথা বলে গভীর বিশ্বাস
পর¯পর ডুব দিয়েছে ঠোঁটের গভীর স্রোতে ক্ষুব্ধ, জীবন্ত
৬
কতটুকু জল পড়ে, শিরা-ধমনীতে কতটুকু আর্তনাদ
শুনেছি পাহাড়-বন নাকি মাঝে মাঝে হয়েছে খুব উন্মাদ
মসৃন শরীর তাই ভেঙে যায় কখনো ফিরে আসে না বলে
উন্মাদ, সারা শহরময় ধূলোর আকাশ নিয়ে চলে গ্যাছে
৭
কেউ কেউ চোখ রাখে নিয়ত প্রবহমান হাতের রেখায়
বাক্যের আড়াল থেকে উঠে এসেছে সন্ধানী মনের চাওয়া
নিঃসাড় চোখ জানে শুধু মৃতবৎ হাত ও পায়ের কান্না
রাইজল মুখে নিয়ে হেঁটে গেছে শতাব্দী পুরনো পথে পথে
৮
আমাকে গ্রহণ করো, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হেঁটে গেছে কতজন
নিয়ত বন্ধুর হাত হয়ে ওঠে নির্ভেজাল ছুরি, আচানক
কোথাও কোনো আস্থা নেই, নেই বিশ্বাসী একফোঁটা রোদচিহ্ন
যেদিকে তাকাই থাকে শূধু ভয়কালো অন্ধকার-মৃত্যুনীল
৯
এসব উষ্ণ গান, প্রেমের আকুতি-চুলের বিন্যাসী আঙুল
জানে শুধু ছলাকলা, বিচ্ছেদের মলিনরেখার মতো শুণ্য
সর্বস্ব লুটে যাবার কালে, কেউ আঁকে চোখে পাপড়ি কাজল
পৃখিবীর দেহ ভেদ করে চলে যায় বর্শা এফোঁড়-ওফোঁড়
১০
কতদূরে যাবো? কোথায় আর এসে দাঁড়াতে পারি পর¯পর?
মুখোশের ছায়ার ভেতর মুখগুলো কাঁপে ঈর্ষার আলোকে
একই বৃত্তের ভেতর-মুখোমুখি শুণ্যতা খেলা করে শুধু
অন্ধকার বীর্যাধার জানে না মৃত্যুর মর্মরধ্বনি,করুণ!
১১
কিছু নেই, কেউ ছিলো না কোনোকালে-থাকে শুধু কালের কণ্ঠ
আমাকে রক্ষা করো, নিয়ে যাও এই মৃত্যুনীল আতঙ্ক থেকে
যেখানে খেলা করে খেয়ালি পাখির দল, বিস্তৃত নদী বয়-
আমাকে গ্রহণ করো হে বিষন্ন সৌরভভরা চিরহরিৎ
১২
অখণ্ড বৃষ্টির কথাগুলো মনে পড়ে, দেহঘড়ি ভিজে যায়
শঙ্খের বাঁশি বাজে- আঙুলে, ঠোঁটে, কোমল-কাতর গৃহদাহ
দিকচিহ্নপুর খুঁজে ক্লান্ত হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন মানুষ
প্রজাতির আর্তনাদ শুনে বুঝি বেহুদা মাতাল হয়ে ওঠে
১৩
ব্যথার মতো সহজ আর কিছুই নেই, একথা শিল্পরূপ
জীবন নিস্তরঙ্গ হয়ে গেলে, নিঃসঙ্গ পাখির মতো ডুব-
দিতে দিতে সকলেই হয়ে উঠি ধ্যানমগ্ন সারসের ঠোঁট
দীর্ঘ অপেক্ষা, কোনো কোনোদিন হয়ে ওঠে মৃতের মতো স্থির
১৪
সেসব সুর বাজে ,মনের মন্দিরে , যেখানে পাতা ঝরে পড়ে
সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে পড়ছে শব্দমালার মতো
আমাদের নিষেধদিন ফুরিয়ে গ্যাছে, এখন শুধু অপেক্ষা
মৃতের সারির ভেতর খুঁজে ফিরছে আপন মুখ গহ্বর
১৫
একাকী রাতের ট্রেন ছুটে চলে গ্যাছে, কুয়াশাবিস্তৃত জলে
মুছে গ্যাছি রাত্রির সামিয়ানা, নিসঙ্ক ছায়ার সীমানারেখা
জীবন, লিখে রেখে গ্যাছে এইসব সার, খেয়ালি উপকথা
মৃত্যুময় দিক-দিগন্তে চিলমারি করছি দয়িতার ঠোঁটে
১৬
কেন এই অমোঘ মৃত্যু? প্রতিপদে, শিল্প-সাধ্য-সাধ মিলিয়ে-
ঝরে পড়ছে মানচিত্র, বুকের গভীর থেকে দারুণ রোদ
ভেঙে পড়ছে, উড়ে যাচ্ছে; ধ্যানমগ্ন ঋষির ঘরে বাস্তুহারা
কিছু মায়া বুঝিবা এখনো রয়ে গ্যাছে-পৌরাণিক গৃহকোণে
১৭
আর ছিল অন্ধকার, পাথরের মতো শীতল এ’অন্ধকারে-
ঢেকে রেখেছি সকল ক্লেদ ও অপমান, অনঘ অনুভূতি
সারারাত শূনেছি হরিণদল হেঁটে গ্যাছে উদ্বাস্তু হাওয়া
চারধারে বৃষ্টির মতো ফুটেছিল কাঁটা, পাপড়িহীন বৃন্তে
নিহিলের বনে
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২১
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশক: বাঙ্ময়
১২
নির্মম! যেদিন জানি গম্ভীর এক সাঁকোর পারে—
একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে চলে গেলে নদীর উপর
শুশুকের মত ডুব দিয়ে আর উঠতে পারোনি
গভীর সে রাতে মৃদু বাহাসের পর ঘুমিয়েছি
ভেবেছি মৃত্যু—একটি সফল জন্মের কথা বলে
অথচ আমরা দ্যাখি নাম ফলকের ইতিহাস!
এবং সেসব শব্দ আমাদের ভীরু কণ্ঠস্বরে—
প্রতি পাঠে উড়ে চলে যায় বিস্মৃতির গাঢ় বনে
আমাদের কল্পনায় , মৃত্যু এক দুরতম বার্তা
মানুষ তার মৃত্যুতে হয়ে ওঠে পরিদৃশ্যমান।
না হয় তুমি দুপুর থেকে হেঁটে গ্যাছো পরিদৃশ্যে
আমরা হেঁটেছি যারা, আকাঙ্ক্ষার মহা জাগরণে
তাদের মুখে যেনবা সূর্যরশ্মি আলো দেয় আজো
যে’পথে নদী নেমেছে তার পাশে থাকে উদ্বাস্তুরা
যেন দীর্ঘ নখ এক—দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় চূড়ে
সে’ নদীপথে আমরা জীবনচিহ্ন রেখে এসেছি...
খুলে প্রতিবেশি দোর—পরস্পরের ছায়ার কাছে—
কোন এক ভুল নাম থেকে উচ্চারিত কথা বলি
১৪
সেদিন শীতের বেলা, ফসলের আনকোরা মাঠে
সবুজের মেলা ভাসে একটানা হলুদ সন্ত্রাসে
পাখিরাও উড়ে আসে, অস্থির ডানা চমকে ওঠে
তার পাশে অনুজ্জ্বল ঘর—শিশুরা উঠানে হাসে
ফসল কাটার পর মাঠ শূন্য খোলা পড়ে থাকে
বাদামি খড়ের স্তুপ, একপাশে আলস্যের স্বরে
দু’জন ঘনিষ্ঠ হয় আড়ালে—সকলের অলক্ষ্যে
প্রবল বুকের নিচে ভালোবাসার যৌথ খামারে
জীবন অরণ্য এক হাটখোলা কামারশালায়
লোহারা আকার পায় গনগনে আগুনের শিখা
কেবল লোহার শব্দ জেগে থাকে সমগ্র পাড়ায়
খড়ের শরীরে হায়, খাঁজ কাটে অকৃত্রিম রেখা
পড়ে থাকে মায়াময় দেহখানি শাড়ীর আঁচল
বুক পেতে কাছে রয়, যতটুকু শরীরের ভাষা
জানি তার নামখানি কামারের লোহার শিকল
দু’হাত বেঁধেছে জোড় —প্রকাশ্যে সরল ভালোবাসা
অথচ বহু অরণ্যে—শীত আসে হিম শব্দবন্ধে
গাঢ় কুয়াশায় ঢাকে যেনবা চাদরের মতন
প্রাণীদেহ তাপ মাখে পরস্পর শরীরের গন্ধে
লোকালয় থেকে দূরে—হয় না শব্দ উৎপাদন
নিহিলের বনে নামে একসারি কুয়াশার দিন
যে তুমি হরণ করো শব্দে ও ছায়ায় হও লীন
১৫
অথচ অগ্নিরেখায় সাজে দুজনের উপকূল
বিচ্ছিন্ন শবযাত্রায় যাওয়া আগন্তুক কখনো
যেন দূর থেকে দ্যাখা সমুদ্রে জাহাজের মাস্তুল
বিলয়ের আগে শেষ চিহ্ন ধীরে ভেসে ওঠে যেন
এবং রঙীন কাচে সেই নিস্পৃহ ছায়াটি দ্যাখে—
মনে পড়ে গেল এক শতকের আয়ু কেড়ে নিলো
কেননা তৃষ্ণায় লোক অপবাদ-অপমান থাকে
এ’দৃশ্যের সমরূপ পৃথিবীতে কত চমকালো—
তবুও থামেনি ঝড়—ক্রমশ সমর্পনের কোলে
মানুষের বলিরেখা আরো বেশি গভীর হয়েছে
শুনি , দূর লোকালয়ে সেসব গল্পকার পৌঁছালে
সময়ের ডাল থেকে আরোকিছু ব্যর্থতা ঝরেছে
এইসব লাস্যময় গ্লানি ঝরে পড়ে সূর্যপথে
সন্ধ্যা নামে, বাজারের ঝাঁপ পড়া শব্দের ভেতরে
রাত্রি ঢুকে পড়ে, রতি ও বিস্মৃতির ক্লিন্ন মূহুর্তে
স্মৃতিগুলো মরে যায়—চির গ্লানিময় অন্ধকারে...
২০
সকলেই চলে যায়, উদ্বাস্তু সময়ে—হাত ধরে বুকের ভেতর জমা ক্ষোভ ও দুঃখের পাথর
শরণার্থী শিবিরের পাখিগুলো জানে পরিচয় খেতের আল ভেঙেছে—উপড়ে গ্যাছে দীর্ঘ শিকড়
প্রতি পথে তার ছায়া হয়ে ওঠে অশরীরী এক বিকল হয়েছে গান—পালটায় জীবন—ভূগোল
অথচ মেঘের সারি উদ্বাস্তু হয়েছে কত আগে... তার বুকে জমা থাকে শত জলের বিম্ব যুগল
ওরা সংঘর্ষে কথা বলে—বেঁচে ওঠে—মৃত্তিকায়— নতুন জীবন আর অগণিত ফসলের মুখে
উদ্বাস্তু হলেই নয় দ্বিধাজড় মৃত্যুকূপ জেনো— কত শতাব্দী মানুষ ছুটেছে শিকারী হাত থেকে
এখনো পড়ছে ছায়া সেইসব নাতিদীর্ঘ গল্পে উদ্বাস্তু শিবিরে শিশু শেখে যুদ্ধের ললিতকলা
পৃথিবীর পথে পথে—সেইসব গ্লানিময় মুখ— ক্রমশ বধির করে—নারীরা হয় রজঃশলা
কারো কোলজুড়ে আসে নতুন শিশু ও সম্ভাবনা মানচিত্রে দাগ পড়ে, পথে পথে নতুনের দিন
কিঙবা নামে ট্যাংক—যুদ্ধ বিমানের আনাগোনা ব্যথাসুর বেজে ওঠে—ধূলোর শরীরে হয় লীন...
তবে কি পাথরসারি? হৃদয় নেই কি কোনখানে? শিশুর মুখের দিকে দেখা যাবে সহগের স্বর
যেখানে সন্ধ্যা নামবে সহস্র পাখির কলতানে বিভাগের দিন নয়—সীমানাহীন একটি ঘর
২৭
শুনেছি সম্পর্ক পোড়ে ব্যক্তিগত পালে—অনুবাদে
বাতাসে দুধ ফাটার নরম গন্ধের মতো ওরা—
মিলিয়ে যায়—যেনবা কোনদিন ছিল না—বিবাদে—
অথচ পোড়ার গন্ধে—জেগে উঠেছিল সারা পাড়া
কিছু কিছু ছায়া দ্যাখে কেউ চমকে উঠতে পারে
আবহাওয়া দপ্তরে হঠাৎ বৃষ্টির সংবাদে
কিঙবা দাঁড়াতে পারো এক কাপ চা’য়ে অবসরে
অলৌকিক যন্ত্রণার হাত ছেড়ে—স্মৃতির আবাদে
উঠেছিল স্বর্ণলতা—ক্ষণকাল জড়িয়ে শরীরে
সোনামাখা রোদ থেকে জ্বলে উঠেছিল চিরনদী
বাৎসায়নের শয্যা ছেড়ে নিপীড়ণের খবরে
সেই থেকে জ্বলে যেন ছায়া থেকে শরীর অবধি
কেন যাবার সময়ে—ঘেটে পরস্পরের রেজিন
চোখে উত্তরের মেঘ, জলে ভাসা পুকুরের মীন
৩৪
এইদিন শেষ হলে ফিরে এসো জানালার পাশে
রঙীন অক্ষর থেকে তুলে নিয়ো চালভাজা নুন
প্রতিবেশী গান হবে—কথা হবে জলের গেলাসে—
মিতব্যয়ি হাতগুলো রুয়ে যাবে আরেক ফাগুন
অপ্রিয় ব্যথার কথা, মনকে বোঝাবো সমতালে
পৃথিবী পালটে দিতে—জলাভূমি পাড়ি দিয়ে যাবো
নিজের আগল থেকে বের হবো সব পিছু ফেলে
নদীবুকে জীবনের আনন্দময়ী তৃষ্ণা মেটাবো
সকল খুচরো কাজ, জীবনের সব কোলাহল
তুলে নেবো আঙুলের প্রতিভাঁজে নিহিলের বনে
ঠোঁটে পুড়ে যাবে রোদ—শরীর শুষে নেওয়া জল
অতীত মিলিয়ে যাবে নিহিলের বাস্তুসংস্থানে।
৩৫
যাবার সময় হলো, মুখোমুখি বিয়োগের দিন
সবকিছু ভেঙে গেলে তুমি হও অখণ্ড আলাপ
মিশে যাও ঢিমেতালে যেন এক জলে ভাসা মীন
সাজঘর থেকে আসে আত্মজৈবনিক সংলাপ
অথবা কিছুই নয়, পাশাপাশি হেঁটে যায় যারা
তাদের মুখের দিকে—একযুগ বেদনার ভার
কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি-রাগ-তৃষ্ণাদিন পার হলে সারা—
জটিল জীবন থেকে শেষ করে দিনের আহার
আমাদের ইতিহাস—যেন এক সমুদ্র কাপ্তান
ঝড় ওঠে, শান্ত হয়-ধীর হয়ে আসে গতিবিধি
তবু এক কোলাহল অহেতুক কেন জায়মান—
তাড়া করে নিয়ে যায়, তোমাকে-গ্রীষ্মদিন অবধি
৩৭
সকলেই চলে যায়—কোনো দিকভ্রান্ত যমুনায়
যৌনপ্রহারের কালে, অস্তিত্বের দূর কিনারায়
শূন্য আকাশে তখোন, থাকে শুধু অশ্রুভরা নদী
নিহিলের মানচিত্র থেকে উচ্চারিত শব্দ যদি—
নেমে আসে পৃথিবীতে, তুমি তার নামভাগ্য হবে
বিস্মৃতির দ্বারে দ্বারে—কাঁদবে—মানুষের অভাবে
অথবা কেউবা পেতে পারে নির্ভেজাল আয়ুর কাল
তরঙ্গহীন বাষ্পের জীবন—ধূসর ও বিশাল
যেখানে জ্বলছে গ্লানি—যে পাতায় এঁকে যাও রাত্রি
জেনেছো—ক্ষমার কাছে, পৃথিবী নিরুপায়, একাকী
যেদিন নীরব হবে—ডুবে যাবে সূর্য গোধূলিতে
আঁধারে জানিও তাকে—এ’গান লুপ্তির প্রস্তুতিতে
৩৮
যতদূর দ্যাখা যায় পাহাড়ের অবিনাশী রেখা
ততদূরে রাখালের বাঁশিহীন পোড়া মাতৃভাষা
আশ্চর্য সেসব গান থেমে গ্যাছে, যেন বধিরতা
ভিখারির হাত থেকে পড়ে যায় ফুল জানেনি তা
অথচ মুখের দিকে অজস্র শব্দের চিৎকার—
ছুটে আসে—যে নিয়েছে কেড়ে ফসলের অধিকার—
তার দিকে—চেতনার ফলক এঁকে দিয়েছে আরো
মাঠ পুড়ে গ্যাছে তাই, নেই জীবনের সমারোহ
রাষ্ট্র নয়, যেন এক শতাব্দী প্রাচীন জেলখানা
শরীরে নিয়ত করে বাস প্রতিমৃত্যু সম্ভাবনা
তাই বুলেটেই বাঁচি—শীতল কার্তুজ ভালোবেসে
বহু বিদায়ের পর—কারা তবে কাছাকাছি আসে?
মনে পড়ে—পাহাড়ের চূড়া থেকে অসূর্য রেখায়
অগলিত বরফের চাইয়ে ফসিল দ্যাখা যায়
হয়তো আরাধ্য নাম—কোনদিন ভেঙে যেতে পারে
সফল গেরিলাযুদ্ধ থেকে সন্ধিৎসু চিৎকারে
অনেক গহ্বর ভেঙে উঠে আসে মালিকানা কা’র?
হতে পারে সুচতুর রাজনীতির দোকানদার
কিঙবা স্বদেশবাদী—মালিকানা ভাগ করে যারা
অন্তহীন ক্ষুধা নিয়ে যারা দ্যায় শান্তির পাহারা
নিয়ত খেলার ছলে—ছুঁড়ে বিভক্তির বীজধান
ঘড়ির কাঁটার মতো, যারা পরস্পর ধাবমান
তাদের অন্তিম ঠোঁটে যদি কেউ আঁকে পদচিহ্ন
আমি তার নাম হবো, ভালোবেসে হতে পারি ক্লিন্ন
৪৪
রাত্রির নিষেধাজ্ঞা পার হয়ে তোমরাও নেমে আসো
এ দিকশূণ্যপুর থেকে কোথাও যেন সুর বেজে উঠে
দুলছে, হাওয়ায় দুলছে কোনএক নামধারী পতাকা
স্বস্তির ঘোরলাগা সুখ ঠোঁটে নিয়ে তুমিও হেঁটে যাও।
তুমি, তোমাদের অংশ হয়ে তবুও ভীষণ একা যেন
অলকের বিষন্নতা থেকে উঠে আসে এক মুগ্ধশোক
শরীর পোড়ে, কোথাও কারো মাংসের তীব্র রোদ
এইসব কোথাও লেখে না কেউ, গোপন হিংসাকথা।
নিশ্চিন্তিপুর হাতে নিয়ে তবে কে হেঁটে যায়, বলো কে
মুখের রেখায় কে আঁকে অর্গলভাঙা তীব্র কুঞ্চন
দু’হাত জানে শুধু স্নিগ্ধ ভাঁজখোলা বেদনার নাম
অংশ ভাগ হয়ে গেলে, দেহ হয়ে ওঠে সরলরেখা।
শান্তি পাঠ
উত্তরমুছুন