জীবনের ধারনা লিখেছেন সৈয়দ সাখাওয়াৎ
সব্যসাচী মজুমদার
সব্যসাচী মজুমদার
‘মানুষ’ এই শব্দটাকে এখন আর চেনাশোনা ধারনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আরও বৃহত্তর প্রসঙ্গ প্রয়োজন হচ্ছে তাকে ব্যাখ্যা করার জন্য। আবার মানুষকে প্রধান্য দিয়ে যে সব প্রবাদ প্রচলিত ছিল, তারাও ব্যাখ্যা বদলে নিচ্ছে ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’ এই ধারনারও ইতি ঘটেছে কয়েক দশক আগেই। এবং এও তো দেখা যাচ্ছে যে, এই সেপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ অতিবিপজ্জনক এক গণহত্যা ঘটিয়ে কিংবা তার কারণ হয়ে অভিব্যাক্তি ঘটিয়েছে। আবার একই সময়ে লক্ষ করার দরকার, বামপন্থী আন্দোলনগুলো এতদিন কার্ল মার্ক্সকে নির্ভর করে গড়ে উঠতো, কিন্তু বিগত শতকের আশির দশক থেকে তার বাত্যয় ঘটতে শুরু করল। বরং তারা মার্ক্সের দর্শনকে প্রশ্ন করে করে বিবর্তিত চিন্তাগুলোতে নির্ভর করতে শুরু করলো। কিন্তু এও তো ঠিক, মানুষ যখন ঈশ্বর হওয়ার দিকে পা বাড়িয়েছে,সঙ্গত কারণেই বিপন্ন হয়ে উঠেছে শ্রমজীবী মানুষের, চিন্তা করতে পারা গরীব মানুষের বেঁচে থাকাটা। এ ক্ষেত্রে আমরা একবার নোয়া হারারির বক্তব্যেও মনোনিবেশ করে দেখবো, এতদসত্ত্বেও সেপিয়েন্সের লড়াই ও প্রতি লড়াইয়ের জন্য কিন্তু অমোঘ অস্ত্র কালেক্টিভিটি।যেভাবেই হোক না কেন, একটা গোষ্ঠী গড়ে তুলে,তার সামগ্রিক সক্ষমতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সে। বৌদ্ধিক ও শারীরিক উভয় ভাবেই সে সমষ্টির শক্তিকেই প্রয়োগ করতে পছন্দ করে,সে উদাহরণ এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার মধ্যে ভীষণভাবে টের পাওয়া যায়।কালেক্টিভ কনসাসনেস সদা প্রবহমান সমকালীন বাংলা কবিতায়। বাংলাদেশের কবিতা যে চেতনাকে কখনই অস্বীকার করতে পারেনি। বরং সুনির্দিষ্টভাবে তার ধারাকে পুষ্ট রেখেছে। সৈয়দ সাখাওয়াতের কবিতাবই ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ -এর পাঠক হিসেবে তো সেই ধারনাটিতে বিশ্বাস বাড়ে। মানুষ, আবহমানের মানুষ এবং তার গোষ্ঠিগত মনস্তাত্ত্বিক বয়ান যেন এই কবিতাগুলো। গদ্য গড়নকে অক্ষরবৃত্তের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বস্তুত কবি আজানের রণন ছড়িয়ে দিলেন যেন পংক্তিগুলিতে। উদাহরণ হিসেবে,
বলেছিলাম পাখিদের বনাম হারাবার গল্পপাখিরূপ মানুষের উড়ে যাওয়ার ইতিহাসনক্ষত্র ছুঁয়ে যারা ফিরে আসেনি ঘরে
পংক্তি তিনটিকে লক্ষ করুন। তিনটি লাইনে পরপর তিনটি সমষ্টিবাচক শব্দ ব্যবহার করলেন লেখক। এবং বার বার ফিরে গেলেন ‘দের’, ‘এর’ ইত্যাদি সম্বন্ধ পদে। বাংলা কবিতার আবহমান ব্যষ্টির মনস্তত্ত্ব তার ডানা মেলল আর তারপরেই ঐ একই কবিতায় কবি লিখছেন,
ষাঁড়ের চলে যাওয়া দাগহীন। কেবল জোয়ালকাঁধে ফালি ফালি মাটি কেটে যাবার দাগচিরস্থায়ী হয়।
একাকিত্বকেও একটি বীজক্ষেত্রে বিস্তার করে বস্তুত এক অজস্র সম্ভাবনার সূত্রটিকেই প্রতিষ্ঠা করে দেন। বস্তুত পক্ষে মানুষ আর ম্যাজিকের দ্বিরালাপ চলে সাখাওয়াৎ-এর কবিতায়।
‘ম্যাজিক’ বলতে পড়ল, শব্দটির অনিবার্য ব্যবহার হতেই পারে কাব্যটির প্রসঙ্গে। কবি ফ্রেমের পর ফ্রেমে সাজিয়েছেন বিভিন্ন অবস্থানের রিয়ালিটিকে। এজন্য তিনি যে উপাদান ব্যবহার করলেন তা সচরাচর বাস্তবের,
ক্লান্ত সূর্যস্নান শেষ করে নৌকোর গলুই থেকে মুছে নিয়েছি অখণ্ড শিশির
কিংবা
বাজারে সাজানো স্কিনি নারী পুতুল
অথবা
তুমি হারিয়ে যাওয়া মার্বেলগুলি
পংক্তিগুলি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, কবি তাঁর সমসাময়িক দৃশ্যগুলোকে নির্মাণ করেছেন তাঁর নিজস্ব বাস্তবতার বহুমুখীতায়। জাদু নির্মাণের চেষ্টার ভেতরেও তিনি সক্রিয় থেকেছেন সংগ্রাহকের ভূমিকায়।
বলা যায় মানুষের আবহমান যৌথ প্রবৃত্তির ব্যাক্তিগত চিন্তা লিখেছেন সৈয়দ সাখাওয়াৎ তাঁর এই কাব্যের আলাপে, জোড়ে আর বিস্তারে যোগ করেছেন মৌল অর্জনগুলো।
দারুণ বিশ্লেষণ
উত্তরমুছুন