নিহিলের বনে : এক গুপ্ত অস্তিত্বের নির্যাস
ফেরদৌস লিপি
ফেরদৌস লিপি
গত বইমেলায় (ফেব্রুয়ারি/২০২২), কবি ও বিন্দু সম্পাদক সাম্য ভাইসহ কিছু বইয়ের স্টলে ঘুরছি রিসেন্ট কবিদের সদ্য প্রকাশিত কিছু বই কিনবো বলে। এভাবেই তখন, হাতে এলো সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর “নিহিলের বনে” কবিতাগ্রন্থটি।
ছমছমে নাম। অন্তঃপুরে কাফকাস্কীয় জগৎ? কে এই নিহিল? বনটির অবস্থান? পৃথিবীতে? রক্ত মাংসের মানুষ- নিহিল? উত্তর—সর্পিল, জটিল। উৎপলের কবিতার ঘোর চেপে এলোমনে— “তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়েছ বাদাম পাহাড়ে।/ আমার ব্যক্তিগত লিখন ভঙ্গিমা আমি হারিয়েছি বাদাম পাহাড়ে।“ এবং, এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষদিকের রচনা “প্রথম দিনের সূর্য” কবিতাটি মনে পড়ে—
প্রথম দিনের সূর্যপ্রশ্ন করেছিলসত্তার নূতন আবির্ভাবেকে তুমি।মেলেনি উত্তরবৎসর বৎসর চলে গেলদিবসের শেষ সূর্যশেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরেনিস্তব্ধ সন্ধ্যায়কে তুমি।পেল না উত্তর।
এই নিরুত্তর সত্তাই কি নিহিল? বইটি হাতে নিয়ে এইরকম একটা ফিল হয়েছিল তখন।
এটাও হতে পারে, নিহিল কবির কল্পনা বা স্বয়ং কবি। “নিহিল জেনেছে সব—সেইসব শব্দের উত্থানে” (২৪ সংখ্যক কবিতা)। আর বনটি কবির ‘হৃদয়’--দূরদিগন্তে স্তব্ধতায় মোড়ানো ঘনছায়াময় কবির একলা-হৃদয়। যেন সেখান থেকেই উঠে আসছে তাঁর সর-ঘন আত্মোপলব্ধি যার শান্ত-শাদা পলি জমা পড়ে আছে সবকটি কবিতার তলদেশে।
২.
কবিতার মূল্যায়ন করতে সংশয় হয়। দ্বিধা হয়, ফ্রস্টের ‘দ্য রোড নট টেকেন’ এর ‘আমি’র মতো, কোন পথে যাব? দুটো নয়, পথ অনেক। বহু অর্থ দেয় কবিতা। সময় সময় পাল্টে যায় অর্থ। আর পাঠক হিসেবে কতটা যোগ্য আমি? স্মরণে আসে কবি ও প্রাবন্ধিক সুজিত সরকারের একটি কথা—
“সকলেই কবিতার পাঠক নন, কেউ কেউ পাঠক” এবং জীবনানন্দের সেই কথাও— “কোনো একটি অনশ্বর কবিতা প্রচুর অভিজ্ঞতা দাবি করে পাঠকের কাছে, ভাসাভাসা অর্থ পেরিয়ে উপলব্ধির আলোয় অর্থের অনমনীয় শিবত্বে পৌঁছানো দরকার।” সুতরাং, কিছুটা শঙ্কিত খরগোশ হয়েই ঢুকে যাবো—সাখাওয়াৎ-এর কবিতার গহন প্রদেশে।
৩.
সংখ্যার হিসেবে বিয়াল্লিশটি খন্ড কবিতার এক সংহত ক্রমবিন্যাস দেখি গ্রন্থটিতে। কবিতাগুলো মূখ্যত যেসব বিষয়ের মুখোমুখি করে দেয় আমাদের তা হলো—স্মৃতিকাতরতা, সময়, অস্তিত্ব ও মৃত্যু। বাক্য—গীতল। শব্দরা পরস্পর ধ্বনিময়। ভাব ও বিভাবে গুরুগম্ভীর। আঠারো মাত্রার চাল। চিরায়ত বিষয় ও আঙ্গিক। আর কবিতার হয়ে ওঠায় কবি থেকেছেন সতর্ক ও নির্ভার। একইসাথে সহজাত ও স্বত্বঃস্ফূর্ত, ওয়ার্ডসওয়ার্থ যাকে বলেন—“spontaneous overflow of powerful feelings”. আর কবিতায় দেখে উঠি ‘’বৈপরীত্যের সমন্বয়’’ ,সামগ্রিক পারম্পর্যতা। তাঁর কবিতার মূল শক্তি হলো ‘বিষয়ে’। যেসব বিষয় বেছে নিয়েছেন তা অমীমাংসিত, দর্শনতাড়িত। আমাদের নতুন করে ভাবায়। বোধে সঞ্চারিত হয়, আন্দোলিত হয়, অভিঘাত নিয়ে আসে। এবং তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কবিতায় তিনি তাঁর দূরদৃষ্টি ও কল্পনাপ্রতিভার দ্বারা ব্যক্তিবোধ ও বিশ্ববোধের মাঝে ঘটান নিবিড় সংযোগ। এবং, প্রকৃতির রহস্যের ভেতর নিরন্তর খুঁজে চলেন অস্তিত্ব। Casper david এর আঁকা “Wanderer above the sea of fog’’এর সেই wanderer, যিনি একটি পাহাড়ি ঢালের উপর দাঁড়িয়ে কুয়াশাছন্ন সাগরের দিকে তাকিয়ে খুঁজে চলছেন ‘জীবন’। সাখাওয়াৎ-এর কবিতাগুলোকে এরকমই অস্তিত্ব-গন্ধী মনে হয়। যেন ভেতরে অবিরাম সিসিফাসীয় প্রচেষ্টা নিজেকে খুঁড়ে দেখবার জন্য। এমন অভিজ্ঞতাই হয় আমাদের। কিছু উদাহরন দেখা যাক—
ক.
আমাকে করেছো পর, বাজিয়েছো আপন সানাইনদীর গহীন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিতআমি যেন শিকারির রাইফেলে দ্যাখা নীল গাইভেঙ্গে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত।(নিহিলের বনে)
খ.
প্রতিনিয়ত দেখছি জানালায়—আকাশের দিকেযেন কনডেম সেল—একটাই সুযোগ বাঁচারচির বলয়ের দিকে হাঁটবো ক্যামোফ্লেজ পোশাকে(২ সংখ্যক কবিতা)
গ.
যে ব্যথা নেশার মতো ছড়িয়েছে রক্তে ও নিদ্রায়মিশে গেছে নিশ্বাসে, শেষ গল্পে—আলোক রেখায়তাকে দেখি উৎপাতে—দুপুরের রোদে জায়মান(৩ সংখ্যক কবিতা)
এভাবে মৃত্যু, স্মৃতিকাতরতা ও অস্তিত্বের গভীর ব্যঞ্জনা শব্দে শব্দে ফুটে ওঠে—আমাদের মর্ম স্পর্শ করে আর পীড়া দেয়। স্মরণে আসে কিটসের “ওড অন এ গ্রিসীয়ান আর্ন”-এর সেই গ্রিসীয় মর্মর পাত্র যা কেবল পাত্রই নয়, যার গা ফুঁড়ে উঠে আসে অনন্তকালের ঘ্রাণ আর অতীতের বিস্মৃতি। কবির সহজ উচ্চারণ—
এরকম প্রতিদিন বহুল ঘটনার ভেতর--একদিন সংবাদ পেলাম, কেউই আর নেইসীমান্তে সংঘাতের মতো উদভ্রান্ত দিনগুলো--ফিরে আসে—প্রতিশব্দে খুঁড়ে চলি নিজের কবর।(৮ সংখ্যক কবিতা)
লক্ষ্য করি, কবিতায় উঠে আসে কবির এমন অন্তদর্শন ও গভীর প্রজ্ঞা যাতে খোদিত হয়ে যায় তাঁরই নিজস্ব সিগনেচার---
জেনেছি—মানুষ প্রায় মরে যায় শরীরের কাছে(১১ সংখ্যক কবিতা)
কবির স্বতন্ত্র অভিব্যক্তি, ইঙ্গিত, কূটাভাস কবিতার পূর্বাপর সুদীর্ঘ প্রবাহে নিয়ে আসে নতুন বাঁক। বাঁকে দেখা যায় কুয়াশার মতো কিছুটা বোর্হেসীয় মায়াবী ঘোর বা আবেশ। কিন্তু পরক্ষণেই সেই কুয়াশা কেঁটে গিয়ে সবকিছু পরিষ্কার দেখা হয়ে যায়।
নির্মম! যেদিন জানি গম্ভীর এক সাঁকোর পাড়েএকটা সন্ধ্যা কাটিয়ে চলে গেলে নদীর উপরশুশুকের মতো ডুব দিয়ে আর উঠতে পারোনিগভীর সে রাতে মৃদু বাহাসের পর ঘুমিয়েছভেবেছি মৃত্যু—একটি সফল জন্মের কথা বলেঅথচ আমরা দেখি নাম ফলকের ইতিহাস
৪.
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর জন্ম ১৯৭৮ সালে, চট্টগ্রামে। আলোচ্য গ্রন্থটির পূর্বেই তাঁর আরও দুটো কবিতার বই বেরিয়ে গেছে। ২০১৩ ও ২০১৭ তে যথাক্রমে ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ ও ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’, পড়ে নেবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি আমার। ‘নিহিলের বনে’ কাব্যগ্রন্থটির কবিতার ফর্ম বা আঙ্গিক, শব্দ ব্যবহার, ভাষা ও বিষয় বিবেচনায় কবিকে অত্যন্ত সচেতন মনে হয়। এই উত্তর-আধুনিক, উত্তরাধুনিক বা পুনরাধুনিক প্রেক্ষাপটেও কবিকে মনে হয় একজন ধ্যানী, এবং মূলধারার কবি। যিনি কবিতায় নিবিড়ভাবে অখন্ড কালপ্রবাহকে ধারণ করেন। সচেতনভাবেই নিজেকে বিষয়হীন উচ্ছৃঙ্খল সমসাময়িকতার আবর্ত থেকে দূরে রাখেন। আর এভাবেই বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করে যান কবি সাখাওয়াৎ।
৫.
আমরা দেখি, গ্রন্থটিতে কিছু শব্দবন্ধ বারবার উঠে এসেছে যা প্রকারান্তরে কবি মানসের সুতীব্র আবেগকে পাঠকের কাছে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে। যেমন, ‘নিহিলের বনে’ (৯ বার), ‘নিহিলের মানচিত্র’, ‘নিহিলের পাতা’, ‘আনাজের বন’, ‘রেশমের বন’, ‘তামাকের বন’, ‘ফুল’, ‘গন্ধ’, ‘অস্তিত্ব’, ‘শিশির’, ‘ছায়া’, ‘ঘুম’, ‘স্বপ্ন’—কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চোখ রাখলেই ‘পাঠক’মাত্রই দেখে ওঠে কবির অপূর্ব চিত্রল ভাবনাগুলো।
কবিতাগুলো ক্রমান্বয়ে বারবার পড়তে ভালো লাগে। পারম্পর্যহীন নয়, কেবল ৩৮ সংখ্যক ও ৩৯ সংখ্যক কবিতাদ্বয়কে বিষয়-ভাবনায় কিছুটা খাপছাড়া মনে হতে পারে, যেন অনেকটা উত্তেজনাময়। তবে পাঠকবিশেষে ভিন্ন অভিজ্ঞতাও হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আবারও আমরা একজন মহৎ কবি রবীন্দ্রনাথে ফিরে আসতে পারি —তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করে--
“—এইরূপে পরিণাম না জানিয়া আমি একটির পর একটি কবিতা যোজনা করিয়া আসিয়াছি। তাহাদের প্রত্যেকের যে ক্ষুদ্র অর্থ কল্পনা করিয়াছিলাম আজ সমগ্রের সাহায্যে নিশ্চয় বুঝিয়াছি, সে অর্থ অতিক্রম করিয়া একটি অবিচ্ছিন্ন তাৎপর্য তাহাদের প্রত্যেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া আসিয়াছিল।” (গীতাঞ্জলি’র গান বা কবিতাগুলোকে সাজানোর ব্যাপারে)
অনবদ্য আলোচনা৷ প্রতিভাবান ব্যক্তিরা যেখানে হাত দেয়, সেখানেই সোনা ফলে৷
উত্তরমুছুনঅপূর্ব
উত্তরমুছুন