.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

এই ভোরলগ্ন জীবনে

এই ভোরলগ্ন জীবনে  ধীমান ব্রহ্মচারী

এই ভোরলগ্ন জীবনে 
ধীমান ব্রহ্মচারী


মাঝরাতে কথাগুলো উড়ে আসে অন্যলোক থেকে— কখনো রাগী, কখনো ভীত-সন্ত্রস্ত আশ্রয়প্রার্থী তোমার উদ্বাস্তু চোখ, আমাকেও ভয়গ্রস্ত করে অসুখের দিনলিপি থেকে দূর কোন কোলাহলে।

সবুজ বৃক্ষছায়ায় অথবা সমুদ্রতীর, গ্রামে একটা নিবিঢ় জলে, ডুব দেওয়া সন্ধ্যার মতো— তাই খুঁজি দৃশ্যলোক, যেখানে তুমি-ই উৎসব এই নবজন্ম, তুমি শোনো বিষাদের বিটোফেন।

শহর নজরবন্দী হলে আর কোথায় উড়বে বলো বরং এ-উৎসবে এসো বাঁচি সকলের মতো —ভবিষ্যতের পূর্ণ নেশায় প্রথম পাখির মতো অথবা উড়ন্ত সাদা হাঁস।

এই উৎসর্গ পড়তে পড়তে আমি ফিরে যাই,আমার শৈশব ঘেরা  গ্রামে। কত আবছা স্মৃতি। ওপার বাংলার ‘কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ সংখ্যা’ নিয়ে একটি পত্রিকা প্রস্তুত হচ্ছে। এবং এই জন্যই সুদূর বাংলাদেশ থেকে বিন্দু পত্রিকার সম্পাদক জানান,আমাকে একটা লেখা দিতে হবে। সমসাময়িক কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর একটি প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ।  কবিতাকে নিয়ে এযাবৎ যা লেখা হয়েছে বা আগামীদিনে যা লেখা হবে,সব লেখায় কোনো না কোনো ভাবে প্রকাশিত হবে। দীর্ঘকাল কবিতাকে নিয়ে মানুষের উৎসাহের অন্ত নেই। এই বর্তমান বিশ্বে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম দ্রুত হয়েছে। ইন্টারনেট এসেছে,একটা ক্লিকেই মানুষের সঙ্গে মানুষের মুখ দেখাদেখি অনায়াসেই সেরে নেওয়া যাচ্ছে,তবুও মানুষ কবিতার অপরিসীম মায়া নিয়ে কবিতার অনন্ত উপলব্ধির খোঁজে হাঁটছেন।

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,' (জীবনানন্দ দাশ/ বনলতা সেন) আজকে পর্যন্ত সেই পথের শেষ নেই। আচ্ছা এই পথ কি আমাদের এই কবিতার পথ হাঁটা নয় ? যদি যুক্তির খাতিরে ধরেনি,সে পথ এ পথ নয়,তবে আজ থেকে একটু নতুন সংযোজন করে নি,অজানা এক পথ হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মতো আমরাও যেন কোথাও একটা দিকে এগোচ্ছি। 

যাক এবার আমরা আসি কবিতায়। তাঁর প্রথম কবিতার প্রথম দুটো পংক্তি :

'আমাকে করেছো পর, বাজিয়েছো আপন সানাই নদীর গহিন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিত আমি যেন শিকারির রাইফেলে দ্যাখা নীলগাই ভেঙে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত

তবে কি প্রশ্নের সারি পড়ে আছে স্বপ্নের ওপারে— সুরস্রষ্টার বিনয়ে? লোক থেকে অতি কোন লোকে? নাকি আনাজের বনে পাখিদের দূর সংসারে যেখানে সকাল আসে শিশিরের জলে-কিংশুকে।

বইয়ের উৎসর্গ পত্রে কবি লিখছেন,
‘মাঝরাতে কথাগুলো উড়ে আসে অন্যলোক থেকে— কখনো রাগী, কখনো ভীত-সন্ত্রস্ত আশ্রয়প্রার্থী তোমার উদ্বাস্তু চোখ, আমাকেও ভয়গ্রস্ত করে অসুখের দিনলিপি থেকে দূর কোন কোলাহলে।' -- এই লেখায় আমরা কী দেখি ? দেখি একটা অজানা সংকেত। অর্থাৎ এই অজ্ঞাত সন্ধানের খোঁজ কবি যেন জানেন না,কিন্তু তিনি অনুমান করতে পারছেন যেন। এখানে একটি শব্দ ' অন্যলোক ' অর্থাৎ বস্তুবাদের থেকে সরে বাইরের কোনও এক জগৎ। বিজ্ঞানে আমরা প্যারালাল শব্দটার সঙ্গে অনেকটা মানসিকভাবে যুক্ত, অর্থাৎ আমাদের বিশ্বের বাইরে গিয়েও একটা বিশ্বকে দেখার বা ভাবার কথা আমরা জেনেছি।  এবং এই অজানা সংকেতই কবিকে যেন ইশারা দিচ্ছেন। আর এই ঘটনা ঘটার সময় কবি শারীরিকভাবে সুস্থ নন। কেননা সদ্য কবি অসুখের দিন কাটিয়ে এসেছে। এরপর কবি চান মুক্তির এক অনন্য স্বাদ,তাই তিনি বলছেন, ' আশ্রয়প্রার্থী তোমার উদ্বাস্তু চোখ' । কিন্তু এই চোখ কবির অজানা বা অদেখা নয়। এই চোখ কবির খুবই পরিচিত। এবং বাস্তবিকভাবেই এই চোখ কিন্তু কোন আশ্রয় নয়,বিপরীতে এই চোখ ' উদ্বাস্তু চোখ '। উদ্বাস্তু জীবনের প্রতি সাধারণত আমাদের একটা বিশেষ কৌতূহল থাকে। সেই সমস্ত উদ্বাস্তু যাদের না আছে ঠিকানা,না আছে অর্থ, না আছে সম্বল। সবই যেন অগোছালো এক জীবন দশা। তাই কবি সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছেন। ক্লান্ত চোখ আর পরোখ করে নিতে পারে না বিষণ্ণতার ছবি। পরের শুরুর কবিতায় কবি যেন নিজের পজিশন বা অবস্থা নিশ্চিত করেছেন,

'আমাকে করেছো পর, বাজিয়েছো আপন সানাই নদীর গহিন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিত আমি যেন শিকারির রাইফেলে দ্যাখা নীলগাই ভেঙে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত' - এই কবিতার লাইন গুলো আমাকে একটু অন্য ভাবেই যেন ভাবাচ্ছে। এখানে কবির একটা মর্মান্তিক চেতনা যেন কবিকে একটু নাড়িয়ে তুলছে। কবিকে এখানে পর করা হয়েছে। কবিকে যেন ব্যবহার করেছেন দ্বিতীয় পক্ষ কেউ। কবি তাই একটা তুলনা তুলেছেন,'বাজিয়েছো আপন সানাই নদীর গহিন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিত আমি যেন শিকারির রাইফেলে দ্যাখা নীলগাই ভেঙে পড়ছি' কবিকে যেন কোথাও একটা কষ্ট পাচ্ছেন। সানাইয়ের সুরের সঙ্গে আমরা সবাই খুবই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ঠিক এই খানে এক ইংরেজ কবির একটা কথা বেশ মনে পড়ছে, Our sweetest song that tell us saddest thought ( P.B.Shelly). কি অদ্ভুত একটা সুতোর মতো যেন আমরা বাঁধা। আমাদের যন্ত্রণা কোথাও একটু কমে যায়,যখন আমরা নিজদের দেখি শান্ত ভাবে। একটা অন্ধকার ঘরের জানালা। যেখানে সন্ধের চাঁদের আলো এসে পড়ে বিছানায়। কালো আকাশের নিচ দিয়ে সাদা মেঘ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। এমনই এক ঘোর গ্রামের কথা মনে পড়ে। একটা শান্ত হাওয়া ঘরের মধ্যে হুট করে ঢুকে পড়ে। এমন অনেক দিন গেছে এভাবে আমারই নিজের শৈশবে। ' নদীর গহীন স্বর ' - একটা নদীর ভাষা আছে, সে ভাষা গভীরে আছে। সেই ভাষা প্রকাশ্য নয়, চাপা। অন্তরের মধ্যে থেকে এই ভাষা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এইরকম প্রবাহ থেকেই কবি নিজেও যেন এগোচ্ছেন। অথচ নির্বাক। তাই কবির কিছুটা অনুতাপ রয়েছে সেই আবেগের ,তাই নিজেকে বন্দুক বা নলের সামনে দাঁড়িয়ে রেখেছেন। এই ধরনের চিন্তা যে কোনো কবি বা শিল্পীর ক্ষেত্রে একটা সাধারণ আবেগ। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো নয়। এখানে আছে যাতনা। নিংড়ে নেওয়ার তাগিদ সমাজে যে ভাবে একে ওপরের সঙ্গে চলে আসছে,সেখানে কবি যেন সেই রকমই নিংড়ে নেওয়া বস্তু বা উপাদানের সমান। তাই তাঁর বেদনাতুর ভারাক্রান্ত আওয়াজ, - '  ভেঙে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত।' এই ভেঙে পড়া মানে একদিন ভাঙন,যন্ত্রণা,নিঃশব্দ বিপ্লব। কিন্তু তাতে কোনোদিন জীবনের বাজিমাত হওয়া সম্ভব নয়। এই যে নিজেকে বিষন্ন ভাবে নুইয়ে ফেলা,এযেন এক শান্ত ঝড়ের আহ্বান জানায়। 

এপ্রসঙ্গে একটা লেখা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, আমাদের কবিতার এক অনন্য স্বর ও ঈশ্বর শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা -

কীভাবে তোমাকে লিখব হে শূন্য যখন
মাথার উপর খাঁড়া কালপুরুষের !
তুমি মেঘ পরনীল, কৃষ্ণছায়া, এ ভরা ভাদরে
আমাদের কথা নেই, বার্তা আছে  ; সে-ভাষা বাতাসে
শঙ্খ ঘোষের মতো কলরোলহীন ভেসে থাকে।
[ জ্বলদর্চি হে বিশুদ্ধ মেঘ ]

আচ্ছা এখানে সেই কবিতার 'একা বিষন্নতা ', যা নিরাকার,যা নিঃশব্দ প্রহরী,সেই কি এই বিষাদের ছবিতে ধরা পড়ছে না? কবি শঙ্খ ঘোষ ছবি আঁকছেন বসে, 'তুমি মেঘ পরনীল, কৃষ্ণছায়া, এ ভরা ভাদরে' আমরাও দেখছি সেই নীল মেঘ। চারিদিকে বর্ষার ধারাপাত। গীতগোবিন্দের স্বর বাজছে আমাদের কানের মধ্যে। ' কৃষ্ণছায়া ' কাল মেঘ ঘনিয়ে এসেছে আমাদের মাথার ওপরে। আর আমাদের কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ লিখছেন, ' রাইফেলে দ্যাখা নীলগাই ভেঙে পড়ছি'। নীলগাই এবার থমকে যাবে। মুজ্যমান হয়ে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। এই নীল আর কালো একই অঙ্গের দুই দিক। একদিকে আনন্দের অফুরান লালিমা নিয়ে ঝড় উঠছে বাদল দিনে,একদিকে মৃত্যুর দূত হয়ে আসছে কেউ নিজের ভাগ্য নিয়ে একটা লোডেড রাইফেলের সামনে।

আবার দ্বিতীয় কবিতায় কবি লিখছেন -

সেদিন বৃষ্টির রাতে তুমি যেন অতন্দ্র প্রহরী 
রাত জেগে জেগে ক্লান্ত দুচোখে ছিল শীতল ভয়
মনে হচ্ছিল যেন বা এক বাকহীন অশরীরী
তুমি শেখালে করুণা—বিরহ গানে শোনানো হয়
সেদিন জেনেছি ক্রোধ, খুনের পিপাসা কাকে বলে
উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি জলের পিপাসা বাড়িয়ে দিতে পারে 
যেন শিকারির টোপ টপকে যেতে হবে কৌশলে
কখনো ব্যাধির মতো চলে যাবে ভুল সংসারে
তখন জেনেছি হাড়ে কী অসহ্য শীত জমে থাকে
কুয়াশার মতো ঘন অন্ধকার ঘিরে চারপাশ
বাড়ে বেদনার আয়ু—মৃত জীবন কখনো ডাকে— 
বলে—তবে কেন করো এই স্থূল জীবনের চাষ ?
জীবন এক ব্যাধির মতো ওষুধের কারবার
প্রতিনিয়ত দেখছি জানালায় – আকাশের দিকে
যেন কনডেম সেল – একটাই সুযোগ বাঁচার 
চির বিলয়ের দিকে হাঁটবো ক্যামোফ্লেজ পোশাকে 

আমার জানিনা কেন মনে হয়েছে এক নিখাদ জীবনের কবিতা। আসলে আমাদের জীবন মানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন আর পাঁচটা কবিদের থেকে আলাদা হলেও যেন কোথাও এক। আমি নিজেই যখন নানান কবি বা লেখকদের বাড়ি যাই,দেখি আমাদের মতোই তারা বাড়িতে বাগান যত্ন করেন, নিজেরাই বিকেলে জল দেন। বাড়ির দেওয়ালে দরজার ওপরেই থাকে তেল আর ধুলো ধরা কলিং বেল। এমন কোনও কোনও বার হয়েছে যে, কলো তেল চিট চিটে কলিং বেল আর বাজে না। তখন ভাবতাম এনারা আমাদের মতোই তো বাঁচেন। কিন্তু কীভাবে? তখন মাথার মধ্যে তাঁদের সৃষ্টির কথা মনে আসে। তাঁরা যে নেশায় বুদ হয়ে একের পর এক সৃষ্টি করে থাকেন কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস বা কোনো গান, ঠিক তেমন ভাবেই বর্ষার জল তাদেরও উঠোন ভরিয়ে দেয়,তাদেরও গলির মুখে ড্রেনের জল জমা হয়। এই তো জীবন ! এই এক অনন্য প্রবাহ। এই প্রবাহের একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ থাকে,তাঁরা সব ছেড়ে সেদিকেই এগিয়ে যেতে থাকে। আমরা হাল ছেড়ে পেছনে ফিরি।  কবিতায় ' তুমি ' যেন একটা নারী। এবং কবি সেই নারীর প্রতি আজন্ম কৃতজ্ঞ। কেননা ' অতন্দ্র প্রহরী ' অর্থাৎ তন্দ্রা নেই এমন একজন তাকে পাহারা দিচ্ছে  যারজন্য কবি নিশ্চিন্তে আছেন। বাইরে থেকে অনাহুত কোনো এক অশরীরী কবিকে যেন বার করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু কবি যাবেন না,কবির স্থির বিশ্বাস, ' মনে হচ্ছিল যেন বা এক বাকহীন অশরীরী /তুমি শেখালে করুণা—বিরহ গানে শোনানো হয় ' - এই ধরনের চিন্তা কবিকে অনেকটা স্ব-প্রতিভো করে রাখে।

‘জয়ের সুনীল’ নামক দে'জ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে, জয় গোস্বামী একটি আলোচনায় লিখছেন -

নদীর ওপারে ও কে। ও কি মৃত্যু? দাঁড়িয়ে
রয়েছে
মুখে ভেজা হিম হাসি হিরন্ময়, ওকে বলো, আমি আর পাশা খেলতে
ভালবাসি না
হিরণ্ময়, ওকে বলো, আমি এই সন্ধ্যে একটু গাঢ়
হলে
নদীতে আচমন সেরে যজ্ঞে বসবো
হিরণ্ময়, ওকে বলো, আমি এই সন্ধ্যে একটু গাঢ় হলে আগুনে ঘিয়ের ছিটে দিয়ে তুলবো প্রলয় নিনাদ--

কবিতার প্রথমেই কবির মৃত্যু চেতনা ফুটে উঠছে। কবি জানছেন এই জীবনের কাজ শেষ করে চলে যেতে হবে। তাই বাইরের দিকে কবি যেন দেখতে পাচ্ছেন, ' কুয়াশার মতো ঘন অন্ধকার ঘিরে চারপাশ

বাড়ে বেদনার আয়ু—মৃত জীবন কখনো ডাকে— ' এই ডাকা তো চিরকালের ডাক। যা কোনোদিন কেউই বাঁধা দিতে পারবে না। তাই সব মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। এরজন্য অনুতাপ বাড়ে, ' বাড়ে বেদনার আয়ু—' তাই তো কবি এখন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন কিন্ত,এই মুক্তি কোনো বাধ্যাধকতা নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন কবি নিজেই। ' জীবন এক ব্যাধির মতো ওষুধের কারবার 

প্রতিনিয়ত দেখছি জানালায় –' ব্যাধি যে একটা চমক , একটা খেলা কবি নিজেই বুঝতে পারেন। এ যেন একটু জয় গোস্বামীর লেখা কথায় বলতে ইচ্ছা করে, ' বার্গম্যানের সেভেন্থ সীল-এ আন্তেনিয়স ব্লক, ক্রুসেড থেকে ফেরা যোদ্ধা, দাবা খেলতে চেয়েছিল, মৃত্যু তাকে নিতে এলে। মৃত্যুকে বলেছিল, আমাকে না হারিয়ে পারবে না তুমি। আর যদি আমি জিতি, আমি স্বাধীন। মৃত্যু বলেছিল, বেশ, কিন্তু জিতবে না তুমি। " -- এখানে কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ কি তাই ইঙ্গিত করছেন ?

২.
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ  এর কবিতার বইটি কী অসাধারণ সব কবিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে। তাঁর লেখা ১৭ নং এর কবিতাটা একটু এখানে আলোচনা করি -

তোমাকেও আবিষ্কার করি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যেন
এত এত বিপরীত মত লুডু খেলছে এখনো
বৈচিত্র্য সুন্দর জেনে আপোষে কাছে টেনেছি আরো 
প্রাচীরের দৈর্ঘ্য বেড়ে—সম্পর্কে রাত নেমেছে গাঢ়
চিঠির ভাষার মতো কখনো গভীর উৎসবে
প্রিয় সুর থেকে গেয়ে উঠেছিল কবিতা সম্ভবে
নিহিলের বনে তবু সেইসব দিন পড়ে থাকে 
রেশম ফোটার মতো সন্ধ্যা এখনো কাউকে ডাকে ।
 
কবির সবচেয়ে প্রয়োগকারী শব্দ এই বইয়ে তাহল ' তুমি ' শব্দটি। বার বার তাঁর কবিতায় তুমি নামে এক অজানা প্রেয়সী বার বার উঠে এসেছে। এরই সঙ্গে আরও এক কবির কবিতার কথা তুলে আনি --

'প্রথম দেখার পলকেই তোমার ওই চোখে চশমা হবার ইচ্ছে ছিল /আমার জীবন উপাখ্যানে মাছরাঙা কপোলপুড়ে তোমার দু'চোখের/ রাষ্ট্রদ্রোহ সীমানায়, আমি চিরকালই পলকগৃহের আসামি —অথচ দ্যাখো/ যখন তুমি চশমাবিহীন খালি চোখে আমাকে পড়ো, আমাকে দ্যাখো/ আর নীল আকাশ ঝরে পড়ে তোমার চোখে-মুখে /আমি কাকদৃষ্টির ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে যাই। শূন্যের আপন-ঘরে বাসনার/ প্রজাপতি ওড়ে রঙিন-বাতাসে, দিগ্বিদিক ছুটে মরি স্বপ্ন রেখে /বলো মোর শুধাময়ী নারী – ছাইপাশ দেখে দেখে আজকাল তোমার/ চোখ আমাকে দেখে ঠিকই, কিন্তু মন বোঝে না...' ( মেঘপুরাণের যতিচিহ্ন/ মাসুদ মুস্তাফিজ/খসড়া খাতা)।

আগেই আলোচনা করছিলাম ' তুমি ' শব্দ। কতটা আবেগ প্রবণ, কীভাবে একে ওপরের থেকে আলিঙ্গন করছে প্রেম আর প্রতিজ্ঞা। এই কবিতার মধ্যেই যেন প্রেম কোথাও আশ্রয় পেয়েছে কবির ভাষায়। পরে কবি মাসুদের যে কবিতা এখানে তুলে আনলাম, তিনিও লিখছেন, ' প্রথম দেখার পলকেই তোমার ওই চোখে চশমা হবার ইচ্ছে ছিল ' । অর্থাৎ হননি। হবেন। এমনটাই ইচ্ছা আছে। খুব সাধারণভাবে বলব, ঘটমান ভবিষৎ কালের রূপ নির্ধারণ করেছেন। আবার কবি সাখাওয়াৎ ও কিন্তু ' আবিষ্কার ' শব্দের মধ্যে দিয়ে ওই একই ভালোবাসার আকুতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছেন।  একই প্রেম। ভিন্ন মূর্তি। ভিন্ন সত্তা। কবি নিজের দৃষ্টির বাইরে থেকে দেখছেন এই সভ্যতা,এই শহরের কোলাহল। আবার এই সব কিছুর উর্ধ্বে কবির এক শান্ত সীমা রয়েছে,যেখানে আকাশের সঙ্গে মিশে থাকে এক সন্ধ্যাঘন কালো মেঘ। সেই মেঘের আড়াল থেকে একটা টুকরো নীল মেঘ তাঁর নজরে আসে। তাই কবি শেষে বলেন - ' চিঠির ভাষার মতো কখনো গভীর উৎসবে

প্রিয় সুর থেকে গেয়ে উঠেছিল কবিতা সম্ভবে
নিহিলের বনে তবু সেইসব দিন পড়ে থাকে 

রেশম ফোটার মতো সন্ধ্যা এখনো কাউকে ডাকে ।'- রেশম ফোটার মতো অর্থাৎ ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয় মানুষ স্বপ্নের দৌড়ে সামিল হন। আবার এদিকেও কবি মাসুদ মুস্তাফিজ ' প্রজাপতি ওড়ে রঙিন-বাতাসে, দিগ্বিদিক ছুটে মরি স্বপ্ন রেখে' এই কথার দার্শনিকতার প্রসঙ্গে অনেকটাই একই। আসলে আমাদের অনুভূতি আমাদের নিজেদের প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে নিয়ে চলে যেন। সারা কবিতার বইয়ের এক আবছা ও প্রচ্ছন্ন একটা প্রবাহমানতা আছে। যেখানে কবি তাঁর নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে স্বপ্নের খেলা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। একই সময়ে দুই ভিন্ন স্থানের কবির অনুভূতি কোথাও যেন একই সুরে বাঁধা। কবি নিজের সন্তাপ ও অনুতাপের মধ্যে দিয়েই আমাদের একবার আঙুল তুলে দেখিয়ে দেন, নয়তোবা খুব পা টিপে টিপে চলার একটা মসৃণ রাস্তা কবি নিজে থেকেই তৈরি করে দেয়। তবে কবির মৃত্যুও যেন অনেকটা রোমান্টিক।কবি তাঁর সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চায়ছেন অনেক দূর। ভূলোক ছাড়িয়ে দুলোকে। এই কথায় কেমন যেন আমাদের কবি খুব সহজে বোঝাতে পারেন। আমরা এক দৃষ্টে চেয়ে থাকি।

অসাধারণ কবিতায় একের পর এক ভাষা শৈলীর প্রয়োগে হয়েছে। আমরা শুধুমাত্র এর নির্যাস গ্রহণ করতে পারি। তাই অনেক কবিতা আছে যা সত্যিই কবির কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার ও ভালোলাগার। তাই তো বার বার আমরা আমাদের বরেণ্য কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা ধার করি। কিন্তু আমরা হয়তো সেই একই চিন্তার প্রসার এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমাদের আবার ওই কবির  কবিতার কথা আলোচনা করা যেতে পারে - আমাদের রূপসী বাংলার কবি -

'কত দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দু'জনে; আকাশপ্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস সাজায়েছে, মাঠ থেকে গাজন গানের ম্লান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস 

ভেসে আসে; ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনে
আকন্দ বনের দিকে: – একদল দাঁড়কাক স্নান গুঞ্জরণে

“নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ।” -- এখানেও সেই একই আকুতি প্রকৃতির কাছে। প্রেমের বড় তন্ময়তা তার গ্রহণে,চলা ফেরায়, তার ব্যবহারে, তার দিন যাপনের কাজে কর্মে। 

সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর প্রায় পুরো বইটাই পড়েছি সাধ্য মতো। অনেক কবিতা ছুঁয়ে যেতে পারিনি। কিন্তু বেশ কিছু কবিতা নিয়ে তাঁর এই ‘নিহিলের বনে’ সাজানো আছে একটা বাগান। অনেক নাম না জানা পথের সন্ধান আছে। শুধুমাত্র সাহস করে সেই পথে আমাদের  একটু মাটি ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে যেতে হবে।

মন্তব্য

BLOGGER: 2
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: এই ভোরলগ্ন জীবনে
এই ভোরলগ্ন জীবনে
বিন্দু। সৈয়দ সাখাওয়াৎ সংখ্যা। প্রবন্ধ: ধীমান ব্রহ্মচারী
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhh-jttcFhDUobbBkZqWDqKkbI-M1kG1nLVP3CGK-qILnBI8cIBg4fPV3l80jJRRJyo_h_rgsO_yv5nqj38U1FiHTtkfyvLQEMFO-Lr7WgHupwKTav4UFLKZ6q_3Vfgqs0JZ5BNUh8FpffiMIoPP_QcZlI57yu6gBHnnkBguIrpTcAHPqHq4cVXIbiE/w320-h180/%E0%A6%A7%E0%A7%80%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A7%9F%E0%A6%A6-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%8E.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhh-jttcFhDUobbBkZqWDqKkbI-M1kG1nLVP3CGK-qILnBI8cIBg4fPV3l80jJRRJyo_h_rgsO_yv5nqj38U1FiHTtkfyvLQEMFO-Lr7WgHupwKTav4UFLKZ6q_3Vfgqs0JZ5BNUh8FpffiMIoPP_QcZlI57yu6gBHnnkBguIrpTcAHPqHq4cVXIbiE/s72-w320-c-h180/%E0%A6%A7%E0%A7%80%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A7%9F%E0%A6%A6-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%8E.jpg
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2022/10/dhiman-brahmachari.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2022/10/dhiman-brahmachari.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy