নিহিলের বনে: ঢেউ মাটি মেঘের আখ্যান
সুবীর সরকার
সুবীর সরকার
নিহিলের বনে। একটি কবিতার বই। রচয়িতা কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ।
‘বাঙ্ময়’ প্রকাশনীর এই বইটি ২০২১ এর অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এটি কবির তৃতীয় কবিতার বই। ইতিপূর্বে প্রকাশিত কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর বই দুটি হল- খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ (২০১৩) এবং পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে (২০১৭)।
বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে বসে কাজ করছেন কবি, সম্পাদক সাম্য রাইয়ান।সাম্য আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতার এই বইটির সাথে। এবং একাধিক পাঠের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমাকে ঘিরে রেখেছে অদ্ভুত একটা ট্রান্স। একটা জায়মান ঘোর।
প্রায় ৩৫ বছর জুড়ে এত এত কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমি, অথচ এতদিন কেন সৈয়দ সাখাওয়াৎকে পাঠ করতে পারি নি! এই প্রশ্ন আমাকে সত্যি তাড়িত করে চলেছে।
২.
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ। ১৯৭৮ এ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম জেলায় তার জন্ম। বাল্য থেকেই বাসায় পেয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। বাবা ছিলেন কবি। মা সাহিত্যের মনষ্ক পাঠক। স্কুল জীবন থেকেই তার লেখায় হাতেখড়ি। পরে নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখতে থাকেন। কবিতার পাশাপাশি অনুবাদের কাজও করেন। চট্টগ্রামের অধুনালুপ্ত লিটিল ম্যাগাজিন ‘পদাতিক’ সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
নৃবিজ্ঞানের ছাত্র কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ বর্তমানে চাকরিসূত্রে ঢাকায় বসবাস করেন।
বাংলাদেশের স্বনির্বাচিত কিছু লিটিল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করেই তার সাম্প্রতিক লেখালেখি চলমান।
একটা নিজস্ব আড়াল আর নিভৃতি নিয়ে কবির জীবনযাপন। বলা ভালো অক্ষরযাপন। মেধা মনন আর শব্দচর্চার এক আলো আঁধারী পরিসরে কবির নিজস্ব এক যাপন।
৩.
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ একজন ঘোর নিয়ে হেঁটে যাওয়া কবি। তার কবিতা আশ্চর্য এক ধ্যানের মত।
তিনি উচ্চকিত নন। খুব মৃদু সুরের ম্যাজিক আর মায়া তার উচ্চারণের ভেতর সতত ক্রিয়াশীল। তার কবিতা আবৃত্তিযোগ্য নয়। খুব একান্তে এবং বারংবার পাঠ করতে হবে পাঠককে সাখাওয়াৎ এর কবিতা। আর কবিতা পড়বার পর অনেকটা সময় একজন পাঠক বেরিয়ে আসতে পারবে না সাখাওয়াৎ এর কবিতার আবহ থেকে। তিনি এমন ঘরানার একজন কবি যিনি পাঠককে কবিতার পাকে পাকে ডুবিয়ে মারেন।
সৈয়দ সাখাওয়াৎ বলছেন-
আমাকে করেছো পর, বাজিয়েছো আপন সানাইনদীর গহীন সুর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিতআমি যেন শিকারীর রাইফেলে দেখা নীলগাইভেঙে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত
কি অমোঘ এই উচ্চারণ!
একটা তীব্র সার্চ লাইটের আলো এসে কোথাও রহস্য রচনা করে ফেলে বুঝি।
কবি পাঠককে একটা যুক্তিফাটলের সংশয়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকেন এই উচ্চারণ আর ইশারা দিয়ে-
সেদিন শীতের বেলা,ফসলের আনকোরা মাঠেসবুজের মেলা ভাসে একটানা হলুদ সন্ত্রাসেপাখিরাও উড়ে আসে,অস্থির ডানা চমকে ওঠেতার পাশে অনুজ্জ্বল ঘর--শিশুরা উঠানে হাসে
আমরা চমকে উঠি।আমরা সচকিত হই।
নুতন করে চিনে নিতে থাকি ফসলের আনকোরা মাঠ আর হলুদ সন্ত্রাস।
এক নুতন দৃশ্যায়ন, এক নুতন নির্মাণ কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতার ভুবনজোতে।
৪.
দেশ কাল সময় সম্পর্ক প্রেম প্রতিবেশ অপরূপ নিসর্গ মানুষজন মানুষের দুঃখ বেদনাকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখেই কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ তার কথনবিশ্ব সাজিয়ে তুলতে থাকেন।
কবি আমাদের দেখান ঢেউহীন নদীগৃহ আর বর্ষার সুবাস।
এক হন্তারক রোদ উপাখ্যান লিখতে লিখতে কবি কখনো বিছিয়ে দিচ্ছেন শোকের ম্যাপ-
রূপালি জলের তীরে বলবো কে কে ভালো আছেনঅথচ দন্ডকারণ্যে গোধূলির সূর্য ডুবে যাচ্ছেপ্রবল প্রবল জ্বরে এখনো পাণ্ডুলিপি পুড়ছে
এই বইয়ের কোন আলাদা আলাদা কবিতার শিরোনাম নেই। মোট ৪৬ টি শিরোনামহীন কবিতার সমাহার। অথবা হয়তো একটিই কবিতা।
বহুবার ঘুরে ঘুরে ‘নিহিলের বন’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন কবি। আর এভাবে একটা তীব্র ব্যঞ্জনা, ভাইব্রেশন তৈরি হয়েছে। কবি লিখছেন-
নিহিলের বনে নামে একসারি কুয়াশার দিনযে তুমি হরণ করো শব্দে ও ছায়ায় হও লীন
কিংবা-
নিহিলের বনে তবু সেইসব দিন পড়ে থাকেরেশম ফোটার মতো সন্ধ্যা এখনো কাউকে ডাকে।
আচ্ছা নিহিলের বন আসলে কি?
অন্ধের ছায়ার পিছে দৌড়তে দৌড়তে কবি ঘন ঘন কেন ঢুকে পড়েন তাপদগ্ধ নিহিলের বনে!
এই প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়। আর আমি বুঝে ফেলি নিহিলের বন আসলেই এক আড়ালগুহা। একটা দূরাগত হাওয়ায় আমাদের জন্য রেখে যাওয়া ইশারা।
হয়তো কবির একটা কনফেশন বক্স।
হয়তো কবির ব্যবহৃত গোপন জ্যাকেট।
৫.
আসলে কবি আমাদের নিশ্চিতভাবেই জানিয়ে দেন যে পৃথিবীর বহু আগেই জন্মেছিল নিহিলের বন।
গোটা বইটি জুড়ে পাঠক দেখবেন ঢেউ মাটি মেঘের উপাখ্যান, ফসিলের মস্ত ছায়া, নবীন ক্ষেতের আল, মায়েদের গল্পের আসর, প্রিয় জলাভূমি, দরিয়া নগরে ছড়ানো গল্পের রেশম, শোকাকুল মেঘেদের গান, শেলবেঁধা ব্যথার গৌরব, সহজ দুপুর থেকে আলস্যভাঙা শব্দের ঝড় আরো আরো ঘোর জড়ানো এক অনন্য মায়াবী চালচিত্র।
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ একজন আদিঅন্ত ডুবুরি যিনি হেঁটে যেতে থাকেন শুধুমাত্র একটি সফল ডুব সাঁতারের দিকে,জন্ম জন্ম ধরেই।
আর একান্তে আউড়ে যান-
আমি সেইসব নদী ও নিখিলের হাতের পরহেঁটে যাচ্ছি, যেন মায়া থেকে হারিয়ে ফেলেছি রোদ
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ, আমি আপনার কবিতার উপর তুমুল নত হলাম। ঝুঁকে পড়লাম।
মন্তব্য