কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ : বিমূঢ় বিভ্রান্তির কবি নন
ড. আশুতোষ বিশ্বাস
ড. আশুতোষ বিশ্বাস
খণ্ড খণ্ড অবকাশ মিলে মহা-অনন্ত দুয়ারের সহস্রমুখ খোলা মানব গোচরপরিধির বাইরে বিরাজিত জমাট অজানা অন্ধকার নয়তো বা আলোময় আলেয়া দেওয়াল। সময় সমুদ্রের সেই গঙ্গোত্রী মোহনায় সময় অসময় আর দুঃসময়ের চৌম্বকীয় দুর্বার মহাকর্ষ-টানে আমাদের মত ক্ষুদ-পিপাসিত ডান বামপকেট সামলাতে সামলাতে মুখে ফেনা ওঠা মানুষের সব ক্লান্তি উপজিত ঋণ গচ্ছিত চাবি হীন লোহার সিন্ধুকে জমা হয়। প্রতিটি খণ্ড আর চূর্ণ–বিচূর্ণ বালি কঙ্করে দ্যুতিময় মানবের হাত ঘাম তেলচিটে দাগের নিশান খুঁজে খুঁজে সময়ের কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা সময়কে লিখে রাখেন সময়ের বর্ণমালা দিয়ে। খণ্ড খণ্ড দিন রাত্রির পরমাশ্চর্য আলাপ, বিলাপ। পাকা পাকা রঙ ধরা আমের সবুজে, হৃদয়ের মুকুরে চিকচিক সূর্যের আলোক আর চোখের কৌণিক আনুভূমিক মাহুর্তিক বিজারণ ইমারত কোন কোন কবির মর্মদ্যুতিতেই ধরা পড়ে। নাহলে আপেলের বাগানে ঢুকে সবাই সারাজীবন কামনা করে এসেছে ততদিন দশটা বিশটা আপেল তাদের কোঁচায় এসে পড়ুক— আর আপেল কেন নিচে পড়ল তাই নিয়ে একা আইজাক নিউটনের মাথা ব্যথা ! বড়ো বিস্ময় জাগে। বড়ো বিস্ময় জাগে সময়কে যারা বুনে নেন সময়ের ধারাপাতে সেইসব সৃজনশিল্পীদের ব্রহ্মত্বে আমাদের সাময়িক হলেও মাথাভার অবনত মস্তক সৃজনবেদিমূলে খানিকটা হলেও ঝুঁকে পড়ে। খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপে অনন্ত রাত্রি নতুবা অনন্ত জ্যোৎস্নালোকিত ছায়াপথ এঁকে দেন আমাদের জীবন মায়াপথের ক্রমাস্তিত্বের বাঁকে বাঁকে। সৈয়দ সাখাওয়াৎ কালের হিসেবে একের দশকের কবি, অন্তত তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ (২০১৩)-র নিরিখে। এই মুহুর্তের শক্তিমান কবিসারণির মধ্যে তিনি কিন্তু সগৌরবে বিরাজিত।
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ বিমূঢ় বিভ্রান্তির কবি নন— মূঢ় ম্লান মূক সময়ের কবি নন। তিনি কবি এই প্রযুক্তি সভ্যতার উড্ডীন, বিজ্ঞান আর যুক্তির তীব্র আলোক প্রস্ফুটিত ঝলমলে সময়ের চনমনে কবি। কবিতাকে পেশা নয়— নেশার ঘনঘোর যন্ত্রণাপ্রসব অস্থির সময়ের মন্থনবৃক্ষের মগডাল থেকে উঠে আসা এক একটি নিখাদ কাব্যচরণ স্রষ্টা হিসেবে কাব্যপাঠক সখ্যতা তিনি অনেকদিন থেকেই অর্জন করেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে— ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ (২০১৩, প্রকাশক : কাঠপেন্সিল), ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’ (২০১৭, প্রকাশক : বাঙময়), ‘নিহিলের বনে’ (২০২১, প্রকাশক : বাঙময়)। কবির জন্ম ১৯৭৮ সালের ৮ আগস্ট বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। আর তা ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান পড়ার দিনগুলোতে। যখন কবি না হতে চাওয়া এই ছাত্র ছাড়পত্র নিষ্প্রয়োজন কবিতার প্লাটফর্মে অবাধ প্রবেশাধিকার একা একাই পেয়ে গেছেন। একান্তভাবে কবিতার নিজস্ব জগতের অধিবাসী হিসেবে নিজের মনন, মেধা কল্পনাকে সাথে করে, বাস্তবের কান্না হাসি রোদ মেঘলা দিনে নির্ভার আকাশগাঙে পানসি ভাসালেন। নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি কলাবিদ্যার খাপ না খেলেও এই বিজ্ঞান মেধাপ্রযুক্ত সেদিনের ছাত্র ভেতরে ভেতরে কবি হয়ে গেছেন, তা নিজেও হয়তো জানেন না। বেহায়ার মত প্রেমিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে ! বহুবার একথা ভেবেছে প্রেমিকা। প্রেমাস্পদ তার এমনই হায়াহীন— কিন্তু আসলে তা নয়, প্রেমিকের কবিমন দেখছে অন্যকিছু, ভাবছে অন্যকিছু— শুধু সামনে তোমার মুখ আড়াল করেছে কবির চোখ। শুধু শুধু নিরপরাধ ছেলেটিকে ‘পাঁজি’ বলো, ‘বেহায়া’ বলো ! এ অন্যায়— ঘোর অন্যায়। সৈয়দ সাখাওয়াৎ ঢ্যাঁড়া না পিটিয়ে নামা আমাদের সেই কবিপুরুষ, যার কবিতাকল্পনালতার প্রতিটি শাখে শাখে কবিতামুকুল প্রস্ফুটাপেক্ষায় কাঁপছে, শীতের প্রথম হিমে, শরতের প্রথম আকাশ চেয়ে দেখা কাশফুল-পুলক- স্বনন অর্ধমুকুলিত কবিতাঘ্রাণে। বাঁধভাঙা চাঁদ তার বুক থেকে সবটুকু জোছনা গঙ্গা-পদ্মাপারের বালুচরে ঢেলে দিলে, মায়াময় নৃ-জগতে এই কবি আর ছুরি কাঁচি চালাতে পারেন না। হাতে হাত রাখা্র কঠোর প্রজ্ঞাকিরণের ছায়ায় অচেনা-অজানা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে এই কবি ভাবতে পারেন— আমরা মানুষ, মানুষের জন্য। জাত-পাত নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নয় হৃদয়নৈতিক দিক দিয়ে হাত বাড়াও, আমি তোমার বন্ধু এবং তোমার বন্ধুতা চাই। পাঠক, একবার পড়ে দেখুন, এই কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, আর সেই গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি—
এখানে রাত্রির কাছে মাথানত গাছেদের সারি, ঘুমিয়ে নয় ; শোক দিচ্ছে পাড়িঅবিন্যস্ত মেঘেদের দল, স্থির-বেদনার গাঢ় গ্রহণে আজ কাঁদে অবিরতমাঠে মাঠে রাশি রাশি শায়িত শরীরগুলো, নির্ঘুম ; আর্তনাদে কেঁপে উঠছে মাটি।সুদূরের বারান্দায় বসে তুমি কী সাক্ষ্য দেবে ইতিহাস, লিখে রাখো এই কথাএখানে যারা বুক পেতে দিয়েছিল দারুণ গৌরবে তোমার-আমার প্রেমের নামেযারা রক্তের ধারা দিয়ে এঁকে দিয়েছিল তোমার–আমার নাম, মাটির পতাকায়আমরা তাঁদেরই নামে এখানে মিলিত, আমাদের চেতনার নিয়ত প্রবহমান ধারারনাম-বাংলাদেশ ! বুক বেঁধে নিরস্ত্র মানুষের উঠে দাঁড়াবার ইতিহাস তুমি লিখে রেখো। (১)
একটা রাষ্ট্রের মাথা তুলে উঠে দাঁড়াবার, একটা জাতির মাথা তুলে দাঁড়াবার আবেগদীপ্ত কণ্ঠ-কম্পিত কাব্য-উৎসার আত্মকেন্দ্রিক যশোলাভের বশবর্তীহীন এই কবিকণ্ঠকে চিনে নিতে বেশি দেরি হয়না। অচিরেই এই কবি আমাদের দলে মানুষের দলে ভিড়ে যান— মানবীয় ত্যাগ তিতিক্ষা ধৈর্যের স্নায়বিক তঞ্চনে শিরদাঁড়াটি সোজা রেখে হাঁটতে পারেন। সম্পূর্ণ মানবিক বোধে উজ্জীবিত কবিকে মানবের প্রেমে আর্দ্র রক্তেভেজা মৃত্তিকা সুবাস কবিকে মানবিক বোধে গর্বিত করে রাখে।
একটা ভাবকে কবিতা হয়ে উঠতে গেলে কবিকে নির্মাণ আর বিনির্মাণের খেলাতে হতে হয় দঢ়। কবির অনুভবরাজ্যে প্রতি মুহুর্তেই জন্ম নিচ্ছে নানারকমের সাধ-স্বপ্ন। কবির চোখের সামনে দৃশ্যমান যে জগত তা অপরাপর আর সব চক্ষুমানের সঙ্গে মোটামুটি একই— তবুও কবি তার চেতনা আর চিন্তার প্রকাশ নবায়নে মুন্সিয়ানা যদি দেখাতে পারেন, আর সহস্রজনের দেখার সঙ্গে নিজের দেখাকে আলাদা করে প্রকাশের নব-মিতায় নিজস্ব বাকপ্রতিমা পাঠক মানসে মুদ্রিত করে দিতে পারেন তাহলেই তার অনুভব কবিতা পদবাচ্য এবং তিনি কবি পদবাচ্য হয়ে ঊঠতে পারেন। সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর ‘মেঘ আমার প্রতিবেশি’ নামের কবিতায় আমাদের আম- মানুষের চিরকালীন দেখা সত্য আলম্বনভাব আকাশের মেঘ আকাশ জুড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। এই মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে এসে আমাদের বহির্জগত আর অন্তর্জগতে সৃষ্টির নবাঙ্কুর উন্মেষ বার্তা দিয়ে যায়। মানুষের চিরকালীন এই মেঘকে নিয়ে আমাদের এই কবি এঁকে দিয়েছেন এক অনবদ্য গার্হস্থ যাপন কথা। ‘মেঘ’ হয়ে উঠেছে কবির খুব কাছের একজন চেনা শোনা তন্বী মেয়ে এবং সেই মেয়ে কবির প্রতিবেশী। ‘মেঘ’ একজন রক্তমাংসে সজীব মেয়ের দ্যোতনা নিয়ে পাঠকের অনুভবকে টান টান করে রাখে। টানা গদ্যে লিখিত গতিময় এই কবিতার প্রথম চরণ ‘’ইদানীং আমার ফেরার পথে মেঘের সাথে দেখা হয়’— আড়ষ্টতাহীন কবিতা শুরুর এইরকম চরণের পাঠ-প্রলোভন পাঠক কী করে এড়িয়ে যাবেন ? পাঠক কবিতার ছায়াপথে নিজেকে মেলাতে মেলাতে এগোবেন আর কবি একটার পর একটা কাব্যপথের নতুন নতুন বাঁকে নিয়ে এসে চমকিত, আমোদিত বিস্মিত করতে থাকবেন। প্রাচীন ইতিহাসের অর্ধচেনা, অল্প-জানা ঘটনা গহ্বরের ভুলভুলাইয়ায় পাঠককে ভাসিয়ে দেবেন কবির স্বেচ্ছা খননকৃত মননগহ্বরে। এই কবিতার শুরুর আলেয়াপথে আলো জ্বেলে কবি আমাদের নিয়ে আসলেন—
দেখতে পাই, প্রাসাদের টেরেস থেকে ল্যান্ডিং-এ নেমেআসছে দল বেঁধে সাজানো নারীরা। দেখতে পাই তাদের শুষ্ক ঠোঁট,ভয়ে ফ্যাকাসে মুখ ক্রমশ বেগুনি হয়ে ওঠা চোখের রঙ। দীর্ঘলন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে শেষ প্রান্তে বাঁধানো কুয়োর মুখ। একে একেহারিয়ে যাচ্ছে গভীর গহ্বরে একাকী। হেরেমের বন্দী মুখ ভুলেদীর্ঘ গহ্বরে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাবে দিকচিহ্নহীন, স্বেচ্ছামৃত্যু ! (২)
আমাদের চোখের সামনে মননের বেড়ার চারিধারে সেই বাদশাহ হারেমের বন্দিনী-কক্ষ আলাদিনের জাদুপ্রদীপের জাদুবাক্যে খুলে গেল বেদনার ঝটিকাসফর। মেঘ-মেয়েদের গোপন অভিমানাহত নীরব আত্মত্যাগ কবির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাঠককূলকে ভারাক্রান্ত করে। আমরা অনুভবাক্রান্ত হয়ে বিষাদী সুর তুলি। আকাশের মেঘ দেখলেই সেই মেঘ-মেয়ে আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমরা একে অপরকে অদৃশ্য করস্পর্শে অনুভব করি, নয়তো বা কাচের জানালার এপার-অপার পিঠোপিঠি ব্যবধানে পরস্পরকে অনুভব করি। কবিতাপড়ার পর এইরকম অনুভব-প্রদীপ্ত মেঘ-মেয়ে আমাদেরও পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হয়ে পড়ে। একজন কবির সার্থক কবিতার এইটাই গুণ।
‘বন্ধু বলে কেউ আমাকে ডাকেনি আজ’ কবিতায় ‘পাতার শরীর থেকে জল গড়িয়ে পড়া দেখতে দেখতে’ কবিও একদিন জলের মতো স্বভাবপ্রাপ্ত হন— পাতার মতন শরীরে বহু বর্ণিল কোলাহল অনুভব করেন। চাঁদের জোছনা থেকে আলো নিয়ে দীর্ঘ এই কবিতার শরীর আলো্কিত, নদীর কোলাহল প্রমত্ততা নিয়ে ক্লান্ত শহরে চাঁদের জোছনায় কবির পিপাসা বাড়িয়ে দিয়েছে—এই পিপাসা জলের নয়, এই তৃষ্ণা সুন্দরের। কবি বেরিয়ে পড়েন জলের মত গড়িয়ে পড়েন ক্রমশ একাকী। কবির নিজস্ব মুদ্রাদোষে একাকী হয়ে যান। কবির কপালের এই ভবিতব্য লেখা নিয়ে দারুণ অসহ তাড়নায় বহুপথে বহু প্রান্তরে বহু আধারে নিজেকে সামিল করেন। আধুনিক বাংলা কবিতার খোলনলচে পরবর্তিত পথপরিক্রমায় সৈয়দ সাখাওয়াৎ-র এই কাব্যভ্রমণ বাংলা কবিতা ভুবনে একেবারে নতুন না হলেও সৈয়দ সাখাওয়াতীয় উত্তরাধিকার ভার আগামীতে কোনো কবিকে নিতেই হবে। অনিবার্য এই উত্তরাধিকার বললে অত্যুক্তি হবে না। কবি তার নিজস্ব বাক চিত্রকল্পের স্বমহিমময় প্রয়োগ বৈশিষ্ট্যে আলাদা হয়ে যান। ‘পাখি ও রোদ’ শিরোনামে পর পর তিনটি ঝোঁকে সময়কে গেঁথেছেন নির্মম বৌদ্ধিক স্বাদুজলে জাদুবাস্তবের অবাধ স্বাধীনতার উন্মুক্ত উদ্যানে। পাখিদের ডানা হারাবার গল্পোচ্ছলে পাখিরূপ মানুষের উড়ে যাবার কথা, শেষমেশ মাটির সুঘ্রাণে উজ্জীবিত ফসলের কাছে নতজানু মানুষের গান কবিকে শো্নাতেই হয়। কৃপণা বসুমতীকে ফালা ফালা করে দলন মন্থন না করলে ফসলের ভাঁড়ার শূন্য থেকে যায়। কর্ষিত মাটি কর্ষণযন্ত্রের তীক্ষ্ণফলার দাগে দাগে রক্তাক্ত মাটি, মাটির রক্তরস আমাদের আগামী সন্তানের প্রাণের সুধা। ডানায় রোদ্রের গন্ধ মুছে ফেলা মৃতপাখি আর শস্যদানা, স্রোতস্বিনীর জল পান করতে পারে না। নদী শুকিয়ে গেলেও তার শুষ্ক জলের স্মৃতিচিহ্ন থেকে যায়—কিন্তু মৃতপাখিটির আর দ্বিতীয়বার ডানা হারাবার ভয় থাকে না। একেবারে কঠিন কঠোর বাস্তবের প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে এই কবি মানব জীবনচক্রের খোলস উন্মোচন করতে করতে আমাদের মৃতপাখিটির নিথর ডানার সামনে নিয়ে এসেছেন। ধোঁয়াহীন হৃদয় পোড়া বিষাদের বন্যায় পাখি এবং রোদজন্মের চকিত ইশারা কবিতায় থেকে যায় ‘উষ্ণতার সোনালি জ্বরে’।
এই কাব্যগ্রন্থের অন্তিম কবিতাটি একেবারে টানা গদ্যে লেখা— ‘দৃশ্যান্তর বার্তায় চোখ বুলিয়ে দেখি’। আসলে একজন শক্তিমান কবি বারবার নিজেকে বদলান, লেখার স্টাইল থেকে লেখার ধরন, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পৌঁছানোর ভাঙা গড়ার খেলায় নিজেকে সতত প্রায়োজনিক ও সময়োপযোগী করে রাখেন। উল্লেখ্য, এই কাব্যগন্থের প্রতিটি কবিতাই বিষয় এবং প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্যে একটি থেকে অন্যটিকে ছাড়িয়ে গেছে। দৃশ্যান্তর বার্তায় খাবারের সুগন্ধে পাক খেয়ে ওঠা পাকস্থলির মোচড়প্রজাত আঁকুপাঁকু ব্যস্ত-ত্রস্ততা। এরপর ঘুমের প্রশান্তিময় অনিবার্যতা আর শেষ ঝোঁকে—
আশ্চর্য সবাই বেড়িয়ে আসছে, চারিদিকে শ্মশানে মড়া পোড়ানোর উৎসব উৎসব দেখতে।মাংসের পোড়া গন্ধ নিশ্চয়ই ক্ষুধার কাছে অতিশয়োক্তির। আমরা মাংস পোড়ারউৎসবে জড়িয়ে পড়ি, কেননা আজ আমাদের কোনো কাজ-কারবার নাই। মাংসের ভাগনিয়ে কয়েক দফা দাঙ্গা হলে আমরা যে যার লোকালয়ে ফিরে আসি।আপাতত ইঁদুর মারা কলে কিছুটা পনির মাখি। যদিও এ’শব্দ আমাদের কাছে নতুন !পনিরের সুঘ্রাণ ছড়ালে আমাদের শিশুরা শাঁ শাঁ করে ছুটে আসে। আর ঢুকে পড়ে এক-একটা কলের ভেতর বিস্ফারিত চোখে।তারপর, দৃশ্যান্তর বার্তা আমাদের শিশুদের ছবি ছাপে। ওদের পশ্চাতে তখনো লালাঝরে ! (৩)
এইভাবে দৃশ্য বদলের ছবি দেখাতে দেখাতে কবি যে কখন আমাদের নিজেদেরকেই সেই দৃশ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন, সঙ্গে সঙ্গে না বুঝলেও পরে বুঝি আর হাসিতে সম্মতি ভাসিয়ে রেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাই অন্য আর একটি দৃশ্যে। ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’-এ সময় এবং সমাজের খন্ডিত চলৎ-চিত্র আসলে কবির মেধা আর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। ‘রাত্রি’ যেমন কালোচাদরে ঢেকে রাখা জীবনচর্যার অনিবার্য অঙ্গীভূত এক সময়ের অধ্যায়, এর বিপরীতে ‘দিন’ সর্বসমক্ষে অন্যের কাছে নিজেকে কত বেশি ভালো দেখানোর ছল চাতুরিময় আয়োজন সাধার ক্ষেত্র। একজন প্রকৃত মানুষ আলো এবং অন্ধকারের ভাবনা চিন্তা, কাজকর্মের সামূহিক যোগফলের তুলাদণ্ডে বিচার্য ফলাফলের নির্যাস। কবি প্রকারান্তরে আমাদের সময় এবং সমাজের মনুষ্য পদবাচ্যের রাত্রির আলাপন কিছু খন্ড চিত্র এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় রাখতে চেয়েছেন। ঠিক নিজের মুখকে আয়নার সামনে দাঁড় করানোর অছিলায়।
‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’ (২০১৭) কাব্যগ্রন্থটি কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।এই কাব্যগ্রন্থের নামপত্র থেকেই বোঝা যায় সময়ের নিদাঘপ্রপাত অথবা ঝড়ের তুলকালাম শেষে অবশিষ্ট যা কিছু টিকে থাকে তারই এক বাঙময় শব্দভেদী উচ্চারণ দিয়ে এই কাব্যগ্রন্থের শরীর-বয়ন করেছেন।
আমাকে শেখাও গান, ঊষারতি ! ফসলের বাগানে বাগানে যোনিমুখ চিনেআমিও পথ হেঁটেছি তারাদের সাথে। একটা উন্মাদ সন্ধ্যা ছিল সেদিনআর সাথে ছিল বানভাসি আসক্তির জ্বলজ্বলে অনুভূতি- উড়ছিলো।বলো ? আর কীইবা চেয়েছিলো-কতটুকুইবা চায় শরীরের ঘামসিক্তরোমকূপ। সপ্তর্ষির তারা গুণে গুণে আমি হয়ে গেলাম বিকল্প কালপুরুষ ! (৪)
‘বিকল্প কালপুরুষ’ হয়ে যাওয়া কবি, ঝড় শেষে পথহারা দিকভ্রান্ত মানুষকে পথ দেখাতে চান। যদি তিনি কিছুটা হলেও পথের হদিস দিতে পারেন তবেই তো কবির কবি-জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠবে। শোকতাপবিজড়িত মানুষের ‘দো-পল কা জিন্দেগি’ একপলের জন্য ধ্রুবতারা আলোকদ্যুতি দিয়ে অন্ধকার সরাতে পারার অনুধ্যানে কবিমনের আশাবাদী কাব্য-প্রজ্ঞা— ‘এই যে মানুষ, মুখ তুলে দ্যাখো-অইখানে খেলা করে রোদের আঙুল’।
পাতাচূর্ণ উড়ে যাওয়ার মতো জীবনের সাথে সংপৃক্ত জীবনের ডালপালা একটা একটা করে উড়ে যায়। মায়ের জঠর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো করে নিয়তই আমরা সময়ের গ্রন্থি ছিঁড়ে, শরীরের গ্রন্থি ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভ্যেস জন্মসূত্রেই বোধহয় পেয়ে গেছি। তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ, বয়সের সাথে সাথে মাথার চুল ঝরে পড়া, স্বপ্নের নীলদাগ মুখের বলিরেখা স্পষ্ট করে দেয়, তেমনি জৈবনিক নানা কর্মক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে বৃক্ষের সবুজ সতেজ পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ার মতো জীবনবৃক্ষের সমস্ত পাতা একদিন বিকৃত হয়ে ঝরে পড়ে। প্রাকৃতিক চরম অনিবার্য বাস্তবতার সাবধানী বাণী কবির ‘স্বীকারোক্তি ১’-এ স্পষ্টভাষ হয়েছে—
তারপর, স্নান শরীরে আলাদা শোকের মৃদু টানমধ্যযাম পার করছে নগর, সতর্ক হেঁটে যান।
‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে খুব সচেতনভাবে কবি মৃত্যুচেতনার শব্দবীজ অক্ষরে অক্ষরে বুনে দিয়েছেন। একজন সফল কবির মগ্নচৈতন্যে নানাবিধ চেতনার বহুবর্ণিল রামধনু রঙ খেলা করে। এই কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থেই আমরা সচেতনভাবে নিয়তিতাড়িত মৃত্যুরূপ জীবনের পূর্ণতার ছায়া দেখে একযোগে অবাক ও বিস্মিত হই। প্রথম থেকেই এই কবি নিজের কাব্যদর্শন সম্পর্কে ভীষণভাবে ওয়াকিবহাল। কাব্যবোধির বেদিমূলে কতবেশি নিজেকে সংপৃক্ত রাখলে এইরকম প্রত্যয়ী জীবনবোধ একজন কবি আয়ত্ব করতে পারেন—তা অবশ্যই কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কাব্য-দর্শনে প্রাঞ্জল সম্পন্ন-সুন্দর অভীজ্ঞা প্রতিভাত হয়। আমাদের এই আধুনিক সময়ে দেখা যায় যে সমস্ত কবি-শিল্পীরা কাব্য কবিতার সৃজন জগতে আসছেন—তারা সময়ের ধারাপাতে সময়ের অনেক আগে থেকেই প্রাজ্ঞ। বলা যেতে পারে তারা এই জগতে অনেকেই আসছেন— যারা দ্যুতিময় আরাম আয়াসের চাকুরিজীবিকা জীবনের হাতছানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাব্যসাধনার এই জগৎটিকে বেছে নিয়েছেন। তারা রীতিমতো চাকুরী পাওয়ার সুলভ জগতের পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাত্তীর্ণ। অনেকেই আছেন যারা যে বয়সে চাকুরীর পড়াশোনা করে স্বাভাবিক আয়াসের জীবন নিতে পারতেন— তারা সে বয়সে কবিতার মত সৃজন-সরস্বতীর আরাধনা করছেন। এটা খুব সুখের কথা। এখনকার কবি সাহিত্যিক কেবলমাত্র ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভাকে হাতিয়ার করে কাব্যজগতে ঝাঁপাচ্ছেন না। তারা রীতিমতো দেশি-বিদেশি সাহিত্যকে ভালোবেসে পড়াশোনা করেই তবে নিজের ভাষা সাহিত্যের মানোন্নয়নের অভিলাষে নিজেদের জড়াচ্ছেন। আর তারই এক উৎকৃষ্ট ফলশ্রুতি কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ। নিজে সম্পূর্ণ আধুনিক-বিজ্ঞানমনস্ক তথা বিজ্ঞানের সফল ছাত্র। একজন বৈজ্ঞানিকের নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে এসময়ের আধুনিক বাংলা কবিতার স্নায়ুতে ভরে দিচ্ছেন বিজ্ঞান-নিষ্ঠ-প্রবাহ । অবশ্যই বাংলা কবিতা এদের কাঁধে ভর দিয়ে সফলতার চূড়ান্ত শিখরে উঠতে চায়। এদের হাতে বাংলা কাব্যসাহিত্য মুক্তির আলোয় নির্ভীক পক্ষ উন্মীলন করতে চায়। ‘বন্ধুরা হারিয়ে গেলে’ নামাঙ্কিত কবিতায় কবির বোধ-দীপ্তি আপামর কাব্য-পাঠকের নজর কাড়ে—
বন্ধুরা হারিয়ে গেলে, শীতরাতে জ্যাকেটের স্মৃতি মনে পড়েহারিয়ে গেলে সম্ভাব্য বন্ধুদের কাছে যেতে ভয় করে শুধুঠাণ্ডা খাবারের মতো স্মৃতির ভেতর খেলা করে যায়-মৃত্যু…আশ্চর্য ফুল কখনো, কখনো দুরন্ত ট্রেন-সংঘর্ষ জীর্ণতবু সবিনয়ে বলি, এ’ভোরলগ্ন কথার ভার একা লাগেকখনো মৃত্যুর কাছে নেমে এলে অর্ধশত সকাল ও রাতবলিরেখা মুছে দিতে এসো-বলো আমি সৈয়দ সাখাওয়াৎ। (৫)
যে জীবন ভোরলগ্ন, যে জীবন প্রকৃতির ক্রোড়লগ্ন সেই জীবনের কাছাকাছি এই কবির প্রীতিঘনঅনুভব ঘুরে ফিরে এসেছে। কবি নিজেই একটি কাব্যের উৎসর্গপত্রের শুরুতে উল্লেখ করেন ‘এই ভোরলগ্ন জীবনে’-র কথা দিয়ে। ‘ভোরলগ্ন জীবন’ অর্থাৎ যে জীবনে ভোর লেগে থাকবে, যে জীবনে ভোরের আনুষঙ্গিক কুয়াশা লেগে থাকবে, যে জীবনে প্রকৃতির সমস্ত বিভাব অনুভাব লেগে থাকবে— গ্রাম জীবনের পুকুর পদ্ম-শালুকের প্রস্ফুটিত ফুলের মাথাতোলা হাওয়াদ্বারি থাকবে। ‘‘সবুজ বৃক্ষছায়ায় অথবা সমুদ্রতীর, গ্রামে / একটা নিবিড় জলে, ডুব দেওয়া সন্ধ্যার মতো--/ তাই খুঁজি দৃশ্যালোক, যেখানে তুমি-ই উৎসব/ এই নবজন্ম, তুমি শোনো বিষাদের বিটোফেন।/’’ এই নবজন্ম আস্বাদিত জীবনের কাছাকাছি আমাদের এই কবি থাকতে চান—আর পাঠককেও রাখতে চান। নিভৃতচারী কবি নির্জনতা পছন্দ করেন। অন্যলোক থেকে নেমে আসা কিছু কথা কিছু অনুভবের বাঙময় প্রকাশ করেন। কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিহিলের বনে’ (২০২১) –তেও সেই কবির হৃদয়কুসুমাঞ্জলি ছড়ানো রয়েছে—
উনুনের মতো জ্বলে— কোনদিন নেমে আসে সন্ধ্যাগল্প ফুরিয়েছে কবে— রয়েছে শুকনো রজনীগন্ধানাগরিক কোলাহলে ফুরিয়েছে হৃদয়ের গানকে যেন নিয়েছে কেড়ে অনাগত সুরের সাম্পান। (৬)
প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরীক্ষাপ্রবণ মন নিয়ে এই কবিকে আমরা সর্বদা ভ্রামণিক হতে দেখি। এর আগে পর্যন্ত যে কাব্যগ্রন্থগুলি আমরা পড়েছি তাতে বিবিধ প্রাকরণিক এবং বিষয়গত স্বতঃস্ফূর্ত পরীক্ষাপ্রিয় মানসিকতা দেখেছি। বহু ব্যবহারে দামি অলঙ্কার ক্ষয়ে যায় কিন্তু কাব্যসৃজনীকলার ক্ষেত্রে তা আরো ক্ষুরধার আরো জুতসই ও ঘাতসহ হয়ে ওঠে। কবিকে বার বার তার চেনা চৌহদ্দি থেকে কাব্যরস এবং কাব্যোপাদান সংগ্রহ করে নিতে হয়। মানবশরীরে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হলে শরীরে যে নতুন উন্মাদনার সৃষ্টি হয়, আমাদের এই সময়ের কবিদের কাছ থেকে সেই নতুন বেগবতী নতুন রক্তপ্রবাহস্রোতের কাব্যিকতা আমরা নিত্য নিত্য পাচ্ছি। পরিবেশ থেকে তুলে নেওয়া নতুন নতুন শব্দ, চিত্রকল্প অনুভূতির হাজারও চোরাস্রোতের দিকে উন্মুখ থেকে কবিরা সেগুলিকে তাদের নবসৃজিত কাব্যোদেহাঙ্গে প্রযুক্তকরণে কাব্যে আসছে নতুন জলধিকম্পন। এটা আমাদের এই সময়ের কাব্যপাঠকের কাছে চরম প্রাপ্তি। সৈয়দ সাখাওয়াৎ যেমন গদ্য কবিতায় সিদ্ধহস্ত তেমনি পয়ার মিত্রাক্ষরেও সমানভাবে পারদর্শী। আজকাল অনেকেই মনে করেন গদ্যকবিতা লেখা খুব সহজ, লিখে দিলেই হলো। ব্যাপারটি ঠিক এইরকম নয়। একজন কবিকে গদ্যের ঢঙে কবিতা লিখতে গেলে তাকে সবার আগে মিত্রাক্ষরে অসামান্য দখল থাকতে হবে। তবেই তিনি সার্থকভাবে গদ্যের ভেতরে বহমান কবিতার ছন্দকেই শুধু নয় ভাবগঙ্গাতেও ফোটাতে পারবেন নতুন নতুন কাব্য-পারিজাত। সৈয়দ সাখাওয়াৎ ছন্দের সেই পরীক্ষায় অনেক আগেই উত্তীর্ণ। ‘নিহিলের বনে’ কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই মিত্রাক্ষর, নয়তো বা সনেটীয় ঢঙে লেখা। আর এই কারণেই আমাদের এই প্রিয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা একা একাই বেড়ে যায়। কবি অনুভব করেন আমাদের বাংলা এবং বাঙালির পয়ার ত্রিপদী মিত্রাক্ষরের কান— প্রাচীন, মধ্যযুগের পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য শুনে শুনে প্রায় জন্মগতভাবেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে আছি এই পয়ার ত্রিপদী, পাঁচালির ছন্দে। আধুনিক সময়ে ছন্দের নব নব প্রয়োগ এবং গ্রহণসৌকর্যে গদ্যের কড়া হাতুড়ির নিনাদপ্রঘ্রাণে ডগমগ, কিন্তু অদ্ভুতভাবে খেয়াল করা যাচ্ছে যে গত শূন্য দশক বা তার আগে থেকে আমাদের কবি সাহিত্যিকেরা আবার পয়ার মিত্রাক্ষরের দিকেই ঝুঁকছেন, তবে তার দেহে থাকছে আধুনিক সময়ের জড়ুলচিহ্ন । আমাদের এই কবিকেও দেখছি, সেইদিকে মুখ ফেরাতে—
জেনেছি নক্ষত্রদিন চলে যায় বৃষ্টির আশায়যেখানে যাবে না কেউ রয়ে যাবে আষাঢ়ের ঘরেজলের আবাসগুলো সূর্যগর্ভে লীন হয়ে যায়আশার আলোরা জ্বলে আকাঙ্ক্ষার সুউচ্ছ শিখরেঅথবা পড়েছে ছায়া দীর্ঘদিন— চিরচেনা পথেযে’পথে নেমেছে জল পাহাড় ভাসিয়ে নদীবুকেসেখানে মরুর মতো পাতা ঝরে যায় তীব্র শীতেআকাশ আগুন হয়— মৃতলোকে —- আলোক অসুখেঅন্তহীন পথে—- ঘুরে ঘুরে ছায়াহীন সংকটেদুঃখ ও বেদনায় ভেঙে পড়ার আহ মুহুর্তেশুনেছি পাথরসারি ভেঙে পড়ে পথের নিকটেছায়াগুলো নদী হয় জলের আগমনের শর্তে। (৭)
সৈয়দ সাখাওয়াৎ একজন আদ্যোপান্ত কবি। পেশা যাই থাক, প্রবল নেশার মতো কবিতচর্চা তাঁকে সব সময় পেয়েই থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সাময়িক পত্র, লিটল ম্যগাজিনের তিনি নিয়মিত লেখক। জানা যায়—একসময় ‘পদাতিক’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদনাকর্মের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ‘বিন্দু’সহ প্রভৃতি অনলাইন এবং ছাপা পত্র-পত্রিকা / সাহিত্যপত্রে নিয়মিত লেখেন। সাহিত্যের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা অসামান্য এবং লিটল ম্যাগাজিনেই তিনি লেখেন, লিটল ম্যাগাজিনকেই আশ্রয় করেই তার যশ, নাম-ডাক খ্যাতি প্রতিপত্তি। বড়ো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ধার তিনি ধারেন না। বলা যেতে পারে এই পৌরুষ প্রবৃত্তির জন্যই আম-পাঠকের কাছে খুব কাছের কবি হয়ে উঠেছেন তিনি। বাংলা ভাষাভাষী যে কোনো বাংলারই তিনি এই মুহুর্তে তিনি আদরের কবি, একজন আলোচ্যমান কবি। তাঁর কবিতায় ক্ষোভ আছে, তাঁর কবিতায় প্রতিবাদ আছে, তাঁর কবিতায় সোজাসাপটা বজ্রকঠিন ঝঙ্কার আছে— নেই কোন আপস। ধলাকে ধলা আর কালাকে কালা বলার সাহস আজকের এই ‘ভেতরে ভেতরে বাঘ হয়ে যাওয়া মানুষ’-এর সমাজেও তাঁকে মিশে থাকতে হচ্ছে। সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে কাব্য-গাঁয়ের নির্মল মেঠোপথে নতুন সুরের তালাসে কবি এখনও গভীর—নিমগ্ন।
তথ্যসূত্র :
১। ‘লিখে রেখো ইতিহাস’, ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, কাঠপেন্সিল, ১৭৯/৩ (তৃতীয় তল), ফকিরের পুর, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃ- ৭
২। ‘মেঘ, আমার প্রতিবেশি’, ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, কাঠপেন্সিল, ১৭৯/৩ (তৃতীয় তল), ফকিরের পুর, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃ- ৮
৩। ‘দৃশ্যান্তর বার্তায় চোখ বুলিয়ে’, ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, কাঠপেন্সিল, ১৭৯/৩ (তৃতীয় তল), ফকিরের পুর, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃ- ৪৮
৪। ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’, ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, বাঙময় প্রকাশনা, কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃ- ১০
৫। ‘বন্ধুরা হারিয়ে গেলে’, ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, বাঙময় প্রকাশনা, কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃ- ৫২
৬।‘আমার কল্পনা ছিল’, (কবিতা সংখ্যা ৬), ‘নিহিলের বনে’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, প্রকাশক : রাশেদুন্নবী সবুজ, বাঙময়, কুড়িগ্রাম, পরিবেশক : ঘাসফুল প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা ২০২১, পৃ- ১২
৭। ‘জেনেছি নক্ষত্রদিন চলে যায়’, (কবিতা সংখ্যা ১৯), ‘নিহিলের বনে’, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, প্রকাশক : রাশেদুন্নবী সবুজ, বাঙময়, কুড়িগ্রাম, পরিবেশক : ঘাসফুল প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা ২০২১, পৃ- ২৫
ভালো বিশ্লেষণ। ------(ফেরদৌস লিপি)
উত্তরমুছুন