কবিতা নিয়ে কথা
কাজী শোয়েব শাবাব
কাজী শোয়েব শাবাব
সৈয়দ সাখাওয়াৎ। ব্যাক্তিগতভাবে পরিচয় ছিল না। কদিন আগে খুঁজে নিয়ে যুক্ত হয়েছি ফেসবুকে। 'বিন্দু' তাকে নিয়ে সংখ্যা করার ঘোষণা দেয়। পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। পড়ছি। তার 'পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে' সামনে খুলে রেখে লিখছি। গদ্য লেখার ক্ষেত্রে আমি ভীষণ কৃপণ। 'বিন্দু' লেখার তাগাদা না দিলে লেখাই হতো না হয়তো। এই বইয়ের ৫টা কবিতা নিয়ে ছোট্ট করে আলোচনায় যাচ্ছি এখন—
১.
আমাদের পাশের বাড়িটা সনাতনীদের। দু'বাড়ির মাঝে একটা ধানের জমি। ধান কাটা হলে নাড়া (ধান গাছের কাণ্ডের কিয়দংশ) রয়ে যেত জমিতে। ছোটবেলা ওখানে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলতাম। সন্ধ্যায় একইসঙ্গে আজান ও শঙ্খধ্বনি কানে এলে যার যার মতো ঘরে ফিরতে হতো। সময় পেলে ও বাড়িতে গেছি বহুদিন। পূজার ঘরে ঠাকুরের বেদির পাশে দুধসাদা একটা শঙ্খ থাকত। সুযোগ পেলে কানে চেপে ধরে শুনেছি— বহুদূর থেকে আসা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। সমুদ্র তখনো বাস্তবে দেখা হয়নি। কখনো মনে হতো টেলিভিশনে দেখা ও শোনা সাগরের বাতাস ও নোনা জলের মিশ্রণে উৎপন্ন একটা রহস্যঘন শব্দ। নিজে নিজে মুখে সেই আওয়াজ তোলার চেষ্টা করলে পারতাম। আনন্দ হতো এই ভেবে যে, কণ্ঠে ধারণ করা যায় সমুদ্রের আবহ। সৈয়দ সাখাওয়াৎ সেই স্মৃতিই স্মরণ করিয়ে দিলেন তার 'আর সেইসব গল্প আমরা খোলস কানে এঁটে শুনতে থাকি' নামের কবিতায়। আমরা স্বভাবতই নিজেদের জীবনে ঘটা ঘটনা, অভিজ্ঞতা, ভালোলাগা, কষ্ট পাওয়া বা কোনো স্মৃতির সঙ্গে লেখা, ছবি, গান, দৃশ্য বা যেকোনো কিছুর মিল খুঁজে পেলে মুগ্ধ হই। ভালো লাগে। এই রিলেট করার ব্যাপারটা কবি এখানে করেছেন, অন্তত আমার সঙ্গে। কবিতার প্রথমার্ধ কম টানলেও দ্বিতীয়ার্ধ বড্ড স্মৃতিজাগানিয়া।
২.
'প্রেম মাস্তানা' কবিতার নাম ভালো লাগেনি। কিন্তু কবিতার কিছু অংশ ভালোই। সুইসাইড নোট লিখেও যে মানুষটা মরে যেতে পারল না তার চিন্তায় চেপে বসা ব্যর্থ মৃত্যুর গ্লানি আর বিবিধ হতাশা। পাগলামি বলে কিছু হয়; তবে পাগল কেউ নয়। যে যার মতো নিজের একটা জগৎ বা স্পেসে যাপন করে তার সময়— আমরা তাদের যেভাবেই দেখি ও ভাবি না কেন। কবিতার শেষের দুটা লাইন আলাদাভাবে ভালো লাগছে। কবিতা কিন্তু 'আহা! লোকটা বোকা!' ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। পরে আর অতিকথন না হলেই ভালো হতো। বিশেষ করে 'চাবিগুচ্ছ ছুঁড়ে দিয়েছে কেউ জলে' কবিতার ধারাবাহিকতায় পরম্পরাবর্জিত, আরোপিত।
৩.
'ভুলে যাবো বলে সমর্পিত হই' কবিতায় আসি। কবিতাটা কবির স্বগতোক্তির মতো। ব্যক্তিগত জীবন আছে অথবা খুব কাছের কেউ। তিন খণ্ডে বিভক্ত কবিতার প্রথম খণ্ডের দুটা লাইন এমন— 'পাশ ফিরে থাকা মানুষগুলো জানে না শোক ও প্রাপ্তির ইতিহাস সমান্তরাল। কাছে আসার মুহূর্ত থেকে জানা হয়ে যায়, কাছে থাকা আর হবে না।' এমন বাস্তবতার ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে উপলব্ধি ও শব্দের যুৎসই ব্যবহার ভালো লেগেছে। সূক্ষ্ম অর্থে মিলন তো বিচ্ছেদেরই পূর্বধাপ। যা ঘটবে তা আগেই দেখে ফেলা— এই কবিতাকে পাঠকের হৃদয়ের কাছে নিয়ে আসে।
দ্বিতীয় খণ্ডে, একদিকে শহরে নামা বৃষ্টিকে কবির শৈল্পিক দৃষ্টিতে দেখা, বিপরীতে কাছে থাকা মানুষটার নিরস, নির্লিপ্ত ভাবে ব্যক্ত 'এ আর এমন কী'। তেতো বাস্তবতাও তাকে এমন নির্লিপ্ত করে তুলেছে হয়তো। তবে কথোপকথনে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর (চিন্তায়) দুজনের পাশাপাশি অবস্থান এবং অবশেষে ভাবনার অমিল ও কবির মোহভঙ্গ। তৃতীয় খণ্ড ব্যথাতুর স্মৃতিচারণ ও অভিমান নিয়ে শেষ হলেও তেমন আগ্রহ ধরে রাখতে পারলো না।
৪.
'পাহাড়ের কোল থেকে উড়ে যাওয়া পাতারা' শুরুতে দারুণ! পাহাড় থেকে উড়ন্ত পাতাদের ঝাঁপ— বাতাসে গা ভাসিয়ে নির্ভার হতে চাওয়া আর নিজের ছায়াকে অথৈ জল ভেবে হরিণশাবকের ডুব দেবার প্রবণতা ও দৃশ্য ভাবনায় ভাসতে থাকে। ছায়াকে অথৈ জল ভাবার বিষয় কল্পনা করলে আনন্দ লাগে। মনে হয় এভাবেও তাহলে ভাবা যায়। কবিদের বহুকৌণিক দৃষ্টি থাকে। বৈচিত্র্য এখানেই।
'পরিযায়ী পাখিদের ডানায় বিকল্প রোদ উড়ে যায় মৌসুম খুঁজেমৃত্যুর শীতল চোখও ফাঁকি দ্যায়, ঝাঁপিয়ে পড়ার অমোঘ নেশা!'
লাইন দুটাতে পরিকল্পিত চিন্তার কাজ আছে, তবে 'বিকল্প' শব্দটা রোদের সঙ্গে ঠিক যাচ্ছে না। রোদের সৌন্দর্য, উড়ে যাওয়া, পরিযায়ী পাখি— সবকিছুকে কেমন ফিকে করে দিচ্ছে। শব্দের সুষ্ঠু ব্যবহারে আরও সচেতনতা আশা করতেই পারি।
কবিতার দ্বিতীয়ার্ধ পড়ে মনে হয়েছে যান্ত্রিক ও জোর করে ব্যবহৃত। ধারাবাহিকতাকে আহত করেছে। একেবারে শেষের দিকে গিয়ে আবার সুন্দরভাবে শেষ হয়েছে।
৫.
'হই অশরীরী' কবিতাটা ভালোই লাগল। নির্জন সন্ধ্যার মতো মৃত্যু নেমে আসার উপমাটা অনুভব করা যায় (যদিও প্রকৃত মৃত্যুর স্বাদ এখনো পাইনি)। পরে আবার বলছেন, 'যেন ম্লান কোনো সন্ধ্যা ধাতব স্বাদযুক্ত'। এখানে কেন যেন রক্তের স্বাদ মনে পড়ে। পরবর্তীতে 'নরোম কোনো আঁধারে হারিয়ে যেতে যেতে, হই অশরীরী ' এই পঙক্তিতে একটা বিচ্ছিন্ন যতিচিহ্নের মতো একা হতে হতে পেলব অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া— এক অর্থে নিজেকে স্থানান্তরিত করে নতুন এক আশ্রয় খোঁজা। অশরীরী সত্তার নৈর্ব্যক্তিক জীবনে মনে মনে নির্ভার হয়ে ওঠেন কবি।
রাত বাড়ছে, ঘুম পাচ্ছে। বাকি লেখাগুলো আমাকে জাগিয়ে রেখে লিখিয়ে নিতে পারলো না অথবা সব লেখা নিয়ে লেখাও হয় না। সব কথা, কথা দিয়েও বোঝানো যায় না। আজ এ পর্যন্তই।
আহা ছলাৎছল ভাষা
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর হয়েছে কবি।
উত্তরমুছুন