সৈয়দ সাখাওয়াৎ : নির্জনতায় বসে যিনি লিখেন সময়ের গান
হাসনাত শোয়েব
হাসনাত শোয়েব
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎকে নিয়ে লেখা আমার জন্য একটু কঠিনই। কবিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। তার কবিতা লেখার জার্নি এবং অলিগলির সঙ্গেও আমার কিঞ্চিৎ পরিচিতি আছে। অসংখ্যবার তার সঙ্গে কবিতা নিয়ে আড্ডা হয়েছে। কবিতা নিয়ে নিজেদের ভাবনা, দর্শন এবং এর প্রয়োগ নিয়েও বহু তর্ক বির্তক হয়েছে।
সময়কাল কিংবা বয়স বিবেচনায় সৈয়দ সাখাওয়াৎ আমার অগ্রজ কবি। আমি কবিতা লেখার অনেক আগে থেকেই উনি কব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য ‘প্রতিষ্ঠিত’ কথাটি শুনে উনি রাগ করতে পারেন। আমরা প্রতিষ্ঠিত অর্থে যা বুঝি ওনি মোটেই তা নন। খ্যাতি কিংবা নিজেকে চেনানোর জন্য কবিদের সাধারণ যে আকুতি সৈয়দ সাখাওয়াৎ তার থেকে অনেকটা দূরেই অবস্থান করেন। আমার ধারণা এসব দেখে তিনি হয়তো মুচকি মুচকি হাসেনও।
কবিতা নিয়ে সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর ভাবনা এবং আমার ভাবনা যে অভিন্ন তা কিন্তু না। আমি যে অর্থে কবিতা লিখতে চাই, তার সঙ্গেও এর আপাত অমিল রয়েছে। সৈয়দ সাখাওয়াৎ কবি হিসেবে মোটেই লক্ষ্যহীন নন। মানে আর্ট ফর আর্ট সেক বলতে যা বুঝি তিনি তা নন। কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তিনি একটি লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান। কবিতায় নিজের সময় এবং বাস্তবতাকে ধরতে চান তিনি। অর্থাৎ নিজের সময়ের যত ক্লেদ তার সবটাকে তিনি কবিতা দিয়ে মোকাবেলা করতে চান তিনি। আমার ধারণা কবিতায় এই পথটা বেশ কঠিন। এই ধরনের কবিতা দ্রুত উন্মোচিত হয়ে পড়তে পারে, অর্থও সীমায়িত হয়ে যায় এবং কবিতা হিসেবেও উত্তীর্ণ হওয়া বেশ কঠিন একটি কাজ। অনেক সময় এই ধরনের কবিতা স্লোগান সর্বস্বও হয়ে পড়তে পারে। সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর মুন্সিয়ানা মূলত এখানেই। সমসাময়িক সমস্যাকে বিষয়বস্তু হিসেবে এনেও তার কবিতা আশ্চর্যজনকভাবে উত্তীর্ণ। অন্তত আমার কাব্য বোধের বিবেচনায় তো বটেই। আমি হয়তো তার মতো করে লিখি না। আমাদের কবিতার অবস্থান উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। তবু সৈয়দ সাখাওয়াৎ আমার পছন্দের কবি। কারণ শেষ পর্যন্ত তার বেশিরভাগ কবিতা সব উদ্দেশ্য বিধেয় ছাপিয়ে আমার কাছে কবিতা হয়ে উঠছে। সমসাময়িক হওয়ার পরও তার কবিতার চিরন্তন একটা আভা আছে। যা আমাকে বারবার তার কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনে।
তিনি যখন লিখেন,
পুড়ে কয়লা হলে সব মুখই এক হয়ে যায়/ মাছিদের উল্লাস হয়, শোকবার্তা লেখা হয়।
কিংবা,
শরীর থেকে দূরে, দলবাজ মানুষেরা ইতিহাস গড়ছে/ কোথায় কবে ভিড় ঠেলে পাখি উঠে দাঁড়িয়েছে পায়ের উপর।
এইসব কবিতা মূলত নির্দিষ্ট একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া এবং বোধ থেকেই জন্মেছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেখানেই তা আটকে থাকেনি। আরও বৃহৎ অর্থ নিয়ে এই কবিতাগুলো আমাদের তাড়িত করে।
তবে কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর কবিতা মানেই সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতের বয়ানই কেবল নয়। ব্যক্তিগত সংকট, সম্পর্ক এবং অনুভূতিও যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে ওনার কবিতায় জায়গা পেয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তার ‘হাসপাতাল’ কবিতাটি আমার বিশেষ পছন্দের। এই কবিতাটি নিয়েই সম্ভবত আলাদা করে অনেক কথা লেখা যায়। এই কবিতা ব্যক্তির সংকট ও টানাপোড়েনের সীমা পেরিয়ে ইউনিভার্সাল অর্থ নিয়ে হাজির হয়। যার সঙ্গে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হতে পারি। এই কবিতা যতই এগুতে থাকে কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর ব্যক্তিগত অনুভূতির দেয়ালটুকু খসে পড়তে থাকে এবং ক্রমশ নৈবর্তিক হয়ে উঠে।
উদাসীন, এই গর্তে ডুবে যাচ্ছি মনে হয় আমি-তুমি।শরীরের সবখানে জমে যাচ্ছে বিচিত্র আলাপ।
এই শরীর এখন আর ব্যক্তির শরীর নয়। এর মধ্যে ঢুকে পড়ি আপনি-আমি আমরা সকলেই।
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর কবিতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, তার কবিতা এক জায়গায় আটকে থাকেনি। কবিতায় প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলে নিয়েছেন। ছোট ছোট প্রচুর এক্সপেরিমেন্টও তিনি নিজের কবিতায় করেছেন। সেটি আইডিয়ার জায়গায় যেমন, ভাষার দিক থেকেও।
কবিতার পথে সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর যাত্রাটা দীর্ঘ হলেও, যতটা পঠিত হওয়ার কথা ছিল ততটা তিনি। কবির ব্যক্তিগত নির্জনতা প্রিয় স্বভাব ও আমাদের আবিস্কার অনীহা এর পেছনে বড় কারণ। তবে তাঁকে নিয়ে বিন্দু’র এই আয়োজনের পর নিশ্চিতভাবে আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবেন তিনি। এ সময়ে কবিতার যে মুক্ত স্বর আমাদের প্রয়োজন, তার প্রেক্ষিতে কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ-এর অধিক ছড়িয়ে পড়াও কবিতার জন্য, এই সমাজের জন্য জরুরি। খুব কম কবিতায় এখন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কথা বলে। সংকটের সঙ্গে স্বপ্নের কথাও বলে। তাও কবিতা হিসেবে উত্তীর্ণ হয়ে। সেই বিরল গোষ্ঠীরই একজন সৈয়দ সাখাওয়াৎ। যিনি লিখেছেন,
ওইযে দূরে নক্ষত্রালোকে দুলে ওঠেস্মৃতি-বিস্মৃতির নাম না জানা পাখিদল শঙ্কাডানায়বিস্তীর্ণ পথের ক্লান্তি ওদের চোখে-মুখে পালক ছুঁয়েঐশ্বর্যের রোদগুলো তবুও দুরন্ত।
সুন্দর লেখা
উত্তরমুছুন