নিহিলের বনে: সামান্য আলোচনা মাত্র
দেবব্রত রায়
দেবব্রত রায়
কবিতা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে ভারতবর্ষ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের পোস্টমর্ডান কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ কবি-সাহিত্যিক প্রভাত চৌধুরী তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যা জানিয়েছিলেন আমি তার সঙ্গে একশো শতাংশ সহমত। কবিতা কী,এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,একজন কবি যা লেখেন তাই-ই কবিতা। কথাটা অবশ্য অন্যভাবেও বলা যায়,কবিতা হলো সেই পরম সৃষ্টি, যা শুধুমাত্র একজন কবিই লেখেন। তবে কবিতারও কিছু শর্ত থাকে । ডোবার জলের মতন নির্দিষ্ট এক জায়গায় থমকে থাকলে কবিতার শরীরেও পচন ধরে এবং মৃত্যু বা, হাইপোথায়রয়েডিজম অনিবার্য হয়ে পড়ে।
বাংলায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে বিশ শতকের প্রথম দুটো যুগ ধরে যাঁরা কবিতা লিখেছেন তাঁরা প্রায় অনেকেই রবীন্দ্রনাথের শৈলীতে লিখতে গিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথেই হারিয়ে গেছিলেন। যদিও খাঁটি ঘি-দুধের মতো কবিতার মৌলিকত্ব খুঁজতে যাওয়াটা একেবারেই অনর্থক এবং তা যুক্তিগ্রাহ্যও নয়।তবে একজন কবি যদি,আরেকজন কবির দ্বৈত বা,একেবারেই জেরক্স কপি হয়ে ওঠেন তাহলে, অবশ্যই সেটা তাঁর ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হবে। প্রথমত,একজন কবির জন্য যেটা খুবই জরুরি সেটা হলো তাঁর নিজস্ব একটা সিগনেচার তৈরি করা যাতে পাঠকমহল সেই কবিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে পারেন। যেমন আমরা রবীন্দ্রপরবর্তী দশকে পেয়েছিলাম জীবনানন্দকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ ( জন্ম: ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট)-এর মোট ছেচল্লিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত সংকলন, নিহিলের বনে পড়লাম। একজন কবিতার পাঠক হিসেবে দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করছি, বাংলা কবিতার পাঠক শুধুমাত্র, বইটার এই চৌম্বকীয় নামের জাদুতেই প্রাথমিকভাবে মেসমেরাইজ হয়ে পড়বেন।
ব্যাকরণগতভাবে নিহিল শব্দের কোনো আক্ষরিক অর্থ না-থাকলেও মাত্র,সামান্য তিনটে অক্ষরের একটা ওয়েভ-ফ্রিকোয়েন্সিই যেন পাঠককে কল্পনার এক চূড়ান্ত মিনারে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। আর এই আকর্ষণ থেকেই পাঠকমহল বইটা পড়ার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠবেন বলেই আমার মনে হয়েছে। আসলে নিহিল কি একটা ইউটোপিয়া? যার অবস্থান হয়তো কবির মনোজগৎ অথবা, বাস্তবের মাটি। কবি আসলে দ্বন্দ্বময় এক জীবনের কথা যেন এখানে বলতে চেয়েছেন, যা হয়তো বা, প্রেম অথবা, অপ্রেমের একটা অসম লড়াইয়ের ময়দান ।
কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ তাঁর কবিতাকে কোনো শিরোনামের ফ্রেমে আঁটকে রাখতে চাননি। তিনি সেগুলোকে ক্রমিকনম্বর অনুযায়ী সাজিয়ে পাঠকের সামনে প্রেজেন্ট করেছেন এবং কবিতার বিভিন্ন পংক্তির বিশেষ নির্বাচিত শব্দগুলোকে তাঁর বিশ্বাস আর, ভালোবাসার রঙে রঙিণ করে পাঠককে যেন একটা নির্দিষ্ট মেসেজ দিতে চেয়েছেন। যাইহোক বইটা পড়ে যে-সব কবিতাগুলো আমার বেশ ভালো লাগলো তার কয়েকটা লাইন এখানে নম্বর অনুযায়ীই তুলে ধরলাম,যেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা না করলেও, আশা রাখি পাঠকমহলে দীর্ঘসময় ধরে উল্লিখিত কবিতাগুলো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
১) আমি যেন শিকারির রাইফেল... ভেঙে পড়ছি জীবন থেকে প্রতিনিয়ত।এক নম্বর কবিতাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, শিকারির রাইফেলে আসলে কোনো সময়ের জন্যই স্বাধীন নয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে শিকারির নির্দেশ মেনেই চলতে হয় । ঠিক এইভাবেই কবি তাঁর প্রতিটা কবিতায় একের পর এক মনন ও বাস্তব জগতের প্রেম ও অপ্রেমের এক দ্বন্দ্ব বুনে গিয়েছেন।যেমন :৩) যে ব্যথা নেশার মতো তাকে কেন ভুল নামে ডাকো৪) কবির হৃদয় জানে---শেলবেঁধা ব্যথার গৌরব৫) কেন না পাখির ডাক শুনে জেগে উঠে...আমরা পরস্পরের দিকে হেঁটে যাব...(মনে হয়,লাইনটা এখানে শেষ হলেই যেন আরও ভালো হতো)৭) হয়তো বা নিহিলের বনে দু-এক ফোঁটা আঙুলের কিছুটা জল...জিহ্বা ফাটে---তৃষ্ণা মেটেনি কোনো কালেই১৭) তোমাকে আবিষ্কার করি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যেনএত এত বিপরীত মত লুডু খেলছে এখনো...নিহিলের বনে তবু সেইসব দিন পড়ে থাকেরেশম ফোটার মতো সন্ধ্যা এখনো কাউকে ডাকে
কবি নিহিলের বন সম্পর্কে এখানে তাঁর পাঠকদের জন্য একটা পরিস্কার মেসেজ দিয়েছেন, নিহিলের বনে... রেশম ফোটার মতো সন্ধ্যা এখনো কাউকে ডাকে।
অর্থাৎ নিহিলের বন এমন একটা জায়গা,যেখানে জীবনের সমস্ত পবিত্রতা,সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে।যদিও এক থেকে ছেচল্লিশ, এইসমস্ত কবিতাগুলোর মধ্যে আমি সেরকমভাবে বিনির্মানের পেস খুঁজে পাইনি তবে, যা পেয়েছি তা হলো গভীর-এক অনুভবের ছোঁয়া। ভাষায় জীবনানন্দীয় প্রভাব এবং প্রেরণা থাকলেও কবির ভাবনায় কবিতাগুলো আমাকে প্রথম প্রেমের নাচ এবং এক অদ্ভুত স্নানগন্ধে ভরিয়ে তুলেছে।
মন্তব্য