এ জার্নি উইথ ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’
রাফাতুল আরাফাত
রাফাতুল আরাফাত
বেশ কিছুদিন ধরে কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতার বই 'পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে' সাথে ঘুরছি। সামনে কোনো জটলা দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ছি, মাইকের আওয়াজ পেলে রাজনৈতিক সমাবেশ ভেবে ঢুকে যাচ্ছি। সার্কাসে ঘোড়ার পায়ের শব্দকে নাচের মুদ্রা ভেবে দৌড়াচ্ছি। এমন নানা ঘটনার পর আমাদের, মানে আমার আর সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতাগুলোর তীব্র ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ি। এ ঘুম চৈত্রের ভাত ঘুমের মতো, মাতালের মতো আসে, ভেঙে গেলে চারপাশ শূণ্য হয়ে যায়।
'পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে' আমার কাছে কাঁচা ঘুমে দেখা স্বপ্নের মতো। জীবনে খুব কাছ ঘেঁষে চলে যাওয়া কোনো বিষণ্ণ আলপথ, প্রচণ্ড নষ্টালজিক। মনে হবে- এইতো সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলাম এই পথ দিয়ে। হুট করে কোনো নতুন অচেনা পথে সময়ের মাত্রা পরিবর্তন করে ফেলার মতো ব্যাপার। নতুন মাত্রায় হয়তো নিউটন আপেল গাছে সুইসাইড করেছেন - প্রেমিকারা দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলাম হয়ে দুলছেন। যেখানে সত্যের মতো অসত্য আমাদের গন্ধম গাছের নীচে আটকে রাখবে- পথ ভুলে আমরা নরকে চলে যাবো - আর সবাই শব্দ করে গাইতে থাকবো, ফেয়ারওয়েল এঞ্জেলিনা, আওয়ার কুইন..
এ কবিতাগুলোর সাথে ভাসা যায়, ছুঁতে গেলে মনে হয় এইমাত্র ঘুম ভেঙে উঠলাম। ঘুমের পর আমরা আবার ক্লান্ত জীবনের একঘেয়ে শব্দ শুনতে থাকি, এক ফাঁকে হয়তো আবার একটু ঘুমিয়ে নেয়া যায়।
সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতা বলছে-
আমাকে শেখাও গান, ঊষারতি! ফসলের বাগানে বাগানে যোনিমুখ চিনেআমিও পথ হেঁটেছি তারাদের সাথে। একটা উন্মাদ সন্ধ্যা ছিল সেদিনআর সাথে ছিলো বানভাসী আসক্তির জ্বলজ্বলে অনুভূতি-উড়ছিলো
এ পঙক্তিগুলো মুহূর্তেই সাইরেন হয়ে উঠে। আমরা দৌড়াতে থাকি প্রচণ্ড উন্মাদনায় যেনো কোথাও হতে তারা খসে পড়ছে, তাকে ছুঁতে হবে বা কোথাও কোনো শিশু কান্নায় ঘোরগ্রস্থ করে রেখেছে সমস্ত মহল্লা, আমাদের তাকে থামাতে হবে।
আমরা কান্নার মুখোমুখি দাঁড়াই। সুররিয়েল কান্নাগুলো ভাষা বদলে সৈয়দ সাখাওয়াত এর কবিতা হয়ে যায়। বলতে থাকে -
পাখিটা দ্বিখন্ডিত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আমাদের অন্ত্রে অস্ত্রে..
তোমার নখের উপর গড়িয়ে পড়া জল দ্যাখে আমার চোখের কথা মনে পড়ে যায়
কান্না কোনো পরিত্যক্ত স্টেশন যেখান থেকে অনেক দিন আগে ছেড়ে গেছে শেষ ট্রেন। শেষ ট্রেনের চলে যাবার মতো দীর্ঘ পথ দিয়ে আমরা দেখি সরষে ফুল, তার পাশে কিছু কুকুর জটলা পাকিয়ে শব্দ করছে। শব্দগুলো করুণ। শব্দগুলো কি কবিতা? আমার প্রশ্নে সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতা খিলখিল করে হাসে। বলে- শব্দগুলো আমার ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকা।
প্রেমিকারা ছেড়ে গেলে হয়তো কবিতা হয়ে উঠতে পারে, যেমন -
ঢোলপাপড়ি ফুল বলে তোমাদের স্মৃতিতে কোনো শব্দ নেই, জানি; কেবল আমার স্মৃতিতে ঘুমায় গাঢ় সবুজাভ সরু পাতার কলেবরে একটি আধাভাঙা গাছ, মাঝে লেমন ইয়েলো প্রেম নিয়ে।এরকম বহুবর্ণময় স্মৃতির ভেতর বেহিসাবি প্রেম ঢুকে গেলে আমার তখন মনে পড়ে সহসা তোমার চুলের কাছে তোমার চোখের সিল্কি রূপ।
ওহ গড! আমরা বিরক্ত হয়ে পড়ছি। বিরক্তি মেটাফোর শেখায়। আমরা তত্ত্ব বুঝি না। আমরা বুঝি, আমাদের এই বিরক্তি লং ডিসটেন্স প্রেমে অনেক দিন দেখা না হবার মতো ব্যাপার। আমরা নিজেদের কমলালেবু বলে গালাগাল করি। আমাদের বেহুদা বিরক্তির ভেতর জীবনবাবু ঢুকে পড়েন বহিরাগত হিসেবে। সৈয়দ শাখাওয়াত এর কবিতা উনাকে শেখান - জীবনবাবু আপনি কমলালেবুর মতো দু'পাশে চাপা! আমি জানি, চাপা জিনিস গ্লোবের মতো ঘুরতে পারেন না, তাকে ঘুরাতে হয় ফিজিক্সের সূত্র মেনে। তাহলে আমরা তত্ত্বের কাছে মার খেয়ে যাবো? আমি রেগে আলোচনা থেকে বেরিয়ে যাই!
কবিতার সুবিধা বোধহয় এই - এখানে নিজের সাথে বাহাস করা যায়। ইন্টারনাল কনফ্লিক্ট যখন তুঙ্গে, তখন নিজেকে নিজে গালি দিয়ে আলোচনা থেকে উঠে আসা যায়!
আমরা শহরে হারানোর চেষ্টায় মন্ত্র জপি। নানান কায়দায় এর আগে অনেকে শহরের যান্ত্রিক লাইটের সাথে মিশে গেছেন বলে মিথ প্রচলিত আছে। আমরা আড়াল খুঁজি। কবিতায় আড়াল জরুরি। কবিতা রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে উঠলে আমাদের যন্ত্রণা হয়। বাতাসে মাইকের মতো বিকট আওয়াজে ভাসে-
দূর্বল করেছে ক্ষমা: কেননা ক্ষমাটাই ইতিহাস পৃথিবীর।
আমরা পৃথিবী থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য মুছে ফেলতে চাই। আমরা আড়াল হতে চাই।
কবিতা স্মৃতির প্যারালাল। মেমোরি লেন। সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতার এক পাতা দেখিয়ে একবার বলছিলাম, শৈশবে এখানে বসে আমি ঘুড়ি বানিয়েছি। এখানে বসে স্কুলের অঙ্কের মাস্টারদের গালাগাল করেছি, স্কুল পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যেখানে মার খেয়েছিলাম, সেখানে মলম লাগিয়েছি। কবিতা আমাকে শোনায় -
ভূগোল পাঠের নিরানন্দ ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এলে একদিন আমাদের জানা হয়ে যায় পৃথিবীর পুরো মানচিত্র। আমরা নিমেষেই এঁকে ফেলতে পারি মহাসাগর, মহাদেশ, গভীর-অগভীর নদী বা গভীর অরণ্য আর রত্নভান্ডার। অবশ্য ভূগোল পাঠ, কখনো আকর্ষণীয় হয়ে উঠতো, যখনই বালিকাদের ছাপা কামিজে মানচিত্র আঁকতে চাইতাম । বালিকাদের চোখ তখন গভীর, দীর্ঘতম নদী। চুল এক গভীর অরণ্য। পাহাড়ের চিত্রও কোনোদিন এঁকে ফেলতাম।
কবিতায় তত্ত্বের চেয়ে জরুরি জিনিস ইলিমেন্ট। কবিতাগুলোকে আমার মনে হয়েছে- মাল্টিলেয়ার ইলিমেন্ট এমন ভাবে সাজানো যেনো দূর পাহাড়ের কোনো টেম্পেল থেকে ঘন্টার আওয়াজ পাহাড়ে ধাক্কা লেগে পাহাড়ী কিশোরীর ঘরে ঢুকে পড়ছে। মনে হয়েছে - কোনো ফিটাস মাতৃ জঠরে খুব আরামে ঘুমাচ্ছে, তাকে জাগানো যাবে না। কবিতাগুলো বলছে - "আমাদের মাছগুলো সীমানা পেরিয়ে গেলে, জানিস আমার তখন তোর কথা মনে পড়ে। স্মৃতিতে তখন সরীসৃপ খেলা করে।" আমি তখন বিবর্তনবাদের ইতিহাস রেখে খুঁজতে থাকি, এস্থেটিসিজম কেমন করে আমাদের দিনগুলোতে শীতের মতো ছডিয়ে পড়েছে।
বারকয়েক, না বারকয়েক নয়, আমার সবসময় মনে হয়েছে সৈয়দ সাখাওয়াৎ এর কবিতা নৈরাজ্য পছন্দ করে। কবিতা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠে ভাষার নৈরাজ্যে। আমি অবাক হয়ে দেখি, ছিড়ে ফেলা ক্যানভাস কেমন করে শিল্প হয়ে উঠে আরও তুমুল যৌবন নিয়ে - যেনো কোনো রাশিয়ান যুবতী সদ্য স্নান সেড়ে বেরুলো আর তার পায়ের ছাপ ফ্লোরের উপর গ্রাফিতি করে দিচ্ছে। কবিতা বলে-
এইযে তোমরা, আমাদের শরীরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছো; ভেসে যাচ্ছো এ কাইন্ড অফ বাটারফ্লাই।
এই বইয়ের কবিতাগুলো ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে রূপকথার গল্প শুনার মতো ব্যাপার। আবিষ্কারের উত্তেজনা থাকে, শেষে পৌঁছে গেলে আফসোস হয়, গল্প শেষ হয়ে যাবার আফসোস।
মন্তব্য