.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

নিহিলের বনে একটি শূন্যতার উপাখ্যান

নিহিলের বনে একটি শূন্যতার উপাখ্যান  অসীম নন্দন

নিহিলের বনে একটি শূন্যতার উপাখ্যান 
অসীম নন্দন


কবিতার বিষয়ে কথা বলতে গেলে; প্রথমেই আমার রবিঠাকুরের একটা বহুল জনপ্রিয় উক্তির কথা মনে পড়ে। উক্তিটা আমি এখানে হুবহু উল্লেখ করতে চাচ্ছি না। তবে মোটাদাগে বললে রবিঠাকুর বুঝিয়েছিলেন, কবিতা আসলে ফুলের মতন একটা ব্যাপার। ফুলের সৌরভ যেমন অনুভবের ব্যাপার, বোঝার ব্যাপার নয়। তেমনি কবিতাও তাই। চলতি হিসেবে এই যুগে কবিতা সম্পর্কে এমন ধারণা এখনও প্রচলিত আছে। এই কথাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না। তবে রবিঠাকুরের সেই রোমান্টিক যুগের অবসান তো অনেক আগেই ঘটে গেছে। সেই সাথে জীবনানন্দ দাশের স্যাড-রোমান্টিজমের সময়ও এখন ফুরিয়েছে। তাই এই আধুনিক যুগে, মাইক্রোম্যাকানিক্সের সময়ে আমরা বলতে পারি, কবিতায় বোঝারও অনেক ব্যাপার থাকে। দৃশ্যকাব্য আর ব্যথার ফিরিস্তি থেকে কবিতা এই উত্তরাধুনিক সময়ে হয়ে উঠেছে বিচিত্র একরকম মোচড়ের মতন। কবিতায় ঢুকে যাচ্ছে বিভৎস সব ইতিহাসের ইঙ্গিত। ঢুকে যাচ্ছে মিথ এবং দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি।

কবিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে নিজেকে বোদ্ধা হিসেবে কিছুটা বিপর্যস্ত লাগে; ভীত-সন্ত্রস্ত আরকি! মানে যে-কেউ তো বলেই ফেলতে পারে, তুমি কবিতার কী বোঝো হে? আর এমন বিব্রতকর প্রশ্নে হয়তো প্রশ্নকর্তা বিব্রত না হইলেও, আমার কিছুটা বিরক্তি-মিশ্রিত বিব্রত অবস্থা হতে পারে! যাক, সেটা কথা নয়। আমি বলছিলাম কবিতায় মোচড়ের কথা। সেই মোচড়কে মাথায় রেখে এখন বাঙ্ময় থেকে ২০২১ সালে প্রকাশিত কবি সৈয়দ সাখাওয়াত'র লিখিত কবিতার বই 'নিহিলের বনে' বিষয়ে কয়েকটা কথা লিখতে চাচ্ছি। 

নিহিল কথাটা এসেছে মূলত ল্যাটিন শব্দ থেকে। যার মানে শূণ্য। নিহিলিজম নামক দার্শনিক মতবাদে আমরা নিহিলের ধারণা পাই। সেই দিক থেকে যদি বলি, কবিতার বইয়ের কনটেক্সট এবং নামের দিক থেকে কবি আদতে একটি শূন্যতার জঙ্গল হয়তো সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। যে শূণ্যতা মূলত দুঃখের ফিরিস্তি। এই কথা বললে হয়তো তেমন বেশি কিছু ভুল বা বাড়িয়ে বলা হয় না। কবিতায় দুঃখ-গাঁথার কথা যুগে যুগে বলা হয়েছে, মানে কবিতায় শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে আমরা এই স্যাড রোমান্টিজম দেখে এসেছি। সেই দিক থেকে এই কনটেক্সটের কবিতা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। 

কবিতায় যে-সকল রস পাওয়া যায়, তাকে ৮ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে শৃঙ্গার রস অন্যতম। এখন এই রস আবার দুই রকমের হয়। মানে প্রেম থেকে তো মানুষ আসলে দুই রকমের অনুভূতি পেয়ে থাকে। সুখের এবং দুঃখের অনুভূতি। প্রেমিকাকে না পাওয়ার দুঃখ থেকে যে ধরনের শৃঙ্গার রসের কবিতা সৃষ্টি হয়, তাকে বলা হয় বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার রস। আর 'নিহিলের বনে' কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো মূলত এই ধরনের শৃঙ্গার রস থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কবিতাগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লেখা 'প্রিয় মেহেরুন' থেকেই আমরা ধারণা করতে পারি, কবি তার 'প্রিয় মেহেরুন'কে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন এই দুঃখ-গাঁথার কাব্য। মোট ৪৬ খানা কবিতা এবং একটি উৎসর্গপত্রের কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই 'নিহিলের বনে' নামক দুঃখ-গাঁথা। এছাড়া এই কবিতাগুলোতে যে বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার রস রয়েছে, তার ধারণা আমরা প্রথম কবিতা পাঠের পরই বুঝতে পারি। প্রথম কবিতাটি শুরু হয়েছে এরকম ভাবে, "আমাকে করেছ পর, বাজিয়েছ আপন সানাই/ নদীর গহিন স্বর ভুল নাম থেকে হয় উচ্চারিত/ আমি যেন শিকারির রাইফেলে দ্যাখা নীল গাই/ ভেঙে পড়ছি বিষাদে জীবন থেকে প্রতিনিয়ত"।                         
            
প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেলে, যেভাবে দুঃখ করে প্রেমিক, সেভাবেই অভিমানে ভেঙে পড়ছে কবির শব্দমালা। অনুভূতিটা অনেকটা ওল্ড-স্কুলের মতন। পরবর্তী কবিতাগুলো পাঠ করলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে শব্দে গাঁথা শোকগুলো তীব্র হতে থাকে। তবে আত্মোপলব্ধির কোনো সুর প্রেমিকের শোকে বেজে ওঠে না। সমাজের বাস্তবতার থেকে দূরে, বৈশ্বিক সকল সংকটের বাইরে, পৃথিবীর পঙ্কিলতার উর্ধ্বে গিয়ে প্রেমিক কবি বারবার কেবলই মনোটোনিক হয়ে উঠেছেন। যেন পৃথিবীতে প্রেমিকা হারানোর দুঃখ ছাড়া প্রেমিকের আর কোনো দুঃখ নেই। সমাজের যে বিভৎস স্বার্থপরতা, তা প্রেমিককে স্পর্শ করতে পারেনি। মানুষের হাহাকার, যুদ্ধের দামামা, বিকারগ্রস্ত মানবসভ্যতা ইত্যাদি পৃথিবীর যাবতীয় হাজারো সংকট যেন কবির কল্পনার জগতকে একটুও টলাতে পারেনি। পৃথিবীর বাস্তবতা প্রেমিককে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, কেবল স্বপ্নালোকের বিষাদময় অনুভূতি তাকে বিদ্ধ করেছে। কবি যেন নিমগ্ন ভাবে লিখে গেছেন ব্যক্তিগত শোক-গ্রন্থ।

শব্দচয়নের দিক থেকে কবি বারবার বাংলার প্রকৃতির কাছে ফিরে গিয়েছেন। শব্দে গেঁথে ছবি এঁকেছেন বাংলার নির্মল জল-হাওয়ার প্রকৃতিকে। বলেছেন বিচ্যুত প্রেমিকের শোকের কথা। ছন্দের দিক থেকে জীবনানন্দীয় ঢঙে কখনো অক্ষরবৃত্ত আবার কখনো গদ্য-ছন্দকে ব্যবহার করেছেন কবি। নিহিলের বনে'র ৩২ নম্বর কবিতায় যেমন আমরা এরকম কিছু কথা পাঠ করতে পারি। "আমাকে ছুঁয়েছে ঢেউ মাটি ও মেঘের উচ্চতায়/ দিয়েছে শোকের দিন, আয়ু ছাড়া আর কিছু নাই"। বিরহী প্রেমিকের উচ্চকিত শোক শব্দের মধ্য দিয়ে এখানে বর্ষা ঝরাচ্ছে। 

স্বপ্নালোকে নিমজ্জমান এই কাব্যিক দুনিয়াতে, কবিতা প্রেমিকের কাছে কেবলই অভিমানের সুর। কবিতা কেবলই প্রেমিক-হৃদয়ের শোকের ভাষা। কবিতা যেন স্বপ্নগ্রস্ত আশা। যেন প্রেমিক এখনও নিহিলের বনে, এই শূণ্যপুরে দিনবদলের স্বপ্নই দেখছেন ও প্রেমিকার পথ চেয়ে বসে আছেন। আর এইরকম বিষাদগ্রস্ত শব্দমালায় গাঁথা কবিতাগুলোর মধ্য দিয়েই 'নিহিলের বনে'র সমাপ্তির দিকে গিয়েছেন কবি। বইয়ের ৪১ নম্বর কবিতাতেও আমরা এরকম সুরই পেয়ে থাকি। "আমাদের স্বপ্ন তবু- ছুঁতে চায় দূরের মাস্তুল/ ঘুমন্ত রাতের পর, সোনারং আলোকের ভোর"।   
 
কবিতার বিষয়ে কথা যখন শুরু করেছিলাম, তখন কবিতায় একধরনের মোচড়ের কথা বলেছিলাম। মানে কবিতা পাঠের পর পাঠক হয়তো একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠবেন, কবিতার ইঙ্গিতটাকে উপলব্ধি করতে চাইবেন। আর পাঠক সেই ইঙ্গিত হৃদয়ঙ্গম করতে গিয়ে হয়তো দেখবেন, প্রচলিত বিশ্বাস তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়ছে। সহজ কথায় ডাবল মিনিংয়ে পাঠকের বুদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করবে কবিতা। 

নিহিলের বনে'র ব্যাপারটা এরকম কিছু নয়। এই কবিতার বই সহজ-সরল ভাষায় প্রেমিক-হৃদয়ের অশ্রুভেজা শব্দের স্বপ্নগ্রস্ত উপাখ্যান। বিচ্যুত প্রেমিকের গভীর শোকের সরল বহিঃপ্রকাশ। ভালোবাসার মানুষ হারালে মানুষ যে দুঃখ পায়, প্রেমিকা চলে গেলে তরুণ-প্রেমিক যে-রকম মোহগ্রস্ত শোকে ভস্মীভূত হয়ে যায়, পৃথিবীর প্রতি যেরকম বিতৃষ্ণার জন্ম হয়, যেন বুকের ভিতর সকল কিছু শূণ্য অথচ বুকের উপর হিমালয়ের মতন অভিমানের ভর, সেই-সব অনুভূতিরই সহজ প্রকাশ এই 'নিহিলের বনে'। বইয়ের সর্বশেষ কবিতার কিছুটা কোটেশন করে আমি আমার আলোচনা শেষ করতে চাইছি। কবি'র শেষ-কথাকেই আমি আপাতত আমারো শেষ-কথা হিসেবেই উপস্থাপন করছি। "এমনতর সকাল যেন কখনো ফিরে না আসে/ মূদ্রার এপিঠ থেকে ওপিঠে-- বদলে যাচ্ছে যারা/ হিংস্র মুখ, রক্তাক্ত আঙুলের সাথে ঝুলে থাকে--/ বিষাদের পাথরেরা--ফোলা চোখের থির জলেরা/ এখানে জমছে শুধু, হৃদয়ের বানভাসি জল/ থামুক এবার এই বিষময় কঙ্কালের নাচ"।

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: নিহিলের বনে একটি শূন্যতার উপাখ্যান
নিহিলের বনে একটি শূন্যতার উপাখ্যান
বিন্দু। সৈয়দ সাখাওয়াৎ সংখ্যা। প্রবন্ধ: অসীম নন্দন
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjX3addWD6q6GdtY_ept3tKVKClhbwvMdxDIwFNpdhPRb5pqL9rzZhWmLe0kSaMZq3HXuxLOBo9MoQLrVfUFlCFvgBOCVZyuH_bOSH4cJn_qsFYAovjwA0dNzFNOi9MJ_XL9R_qNrXlxCPxOW8NXgmbCnndWsnFF4s-fzIUezN1V0UrMLmXaf6Q4ooa/w320-h180/%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A7%9F%E0%A6%A6-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%8E.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjX3addWD6q6GdtY_ept3tKVKClhbwvMdxDIwFNpdhPRb5pqL9rzZhWmLe0kSaMZq3HXuxLOBo9MoQLrVfUFlCFvgBOCVZyuH_bOSH4cJn_qsFYAovjwA0dNzFNOi9MJ_XL9R_qNrXlxCPxOW8NXgmbCnndWsnFF4s-fzIUezN1V0UrMLmXaf6Q4ooa/s72-w320-c-h180/%E0%A6%85%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A7%9F%E0%A6%A6-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%8E.jpg
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2022/09/asim-nandan.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2022/09/asim-nandan.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy