জীবন, বিষন্ন রোদের ডানা : অবোধ পাঠকের আত্মদর্শন
কৌশিক সেন
কৌশিক সেন
এমন করেই তো শরীর প্রয়োগ করতে হয় পদ্যখাতায়। ঢং ঢং করে বেজে যায় প্রতিটি পিরিয়ড শুরু ও শেষের ঘণ্টা! দেখতে দেখতে কখন যে স্কুল ছুটি হয়ে যায়, বুঝতেই পারিনি! শরীরের ডাঙায় ডাঙায় মেঘশব্দ। পরস্পর হেঁটে চলে গ্যাছি, ভেতরে ছায়ার শরীর শুধুই অকারণ কথা বলেছে বিষ প্রহরের সাথে… কবিও সহপথিক হন বিষণ্ণ পাঠকের। বিপন্ন পাঠকেরও! আলোকিত বিন্দুগুলি জুড়ে জুড়ে জীবনের রত্নমালিকা রচিত হয়!
রাতের গায়ে গায়ে আঁশ দাগ। মৎস্যগন্ধী এই বেদনার বিস্তার। গিনি মোহরের মতো ছড়িয়ে পড়েছে কলমের ইতিউতি। বুকপকেট থেকে বের করে কান পাতি, শুনি-কোথাও বন কোথাও সাগরের মতো ভীষণ হিংসার স্বর-ভয়ঙ্কর গান নেই, কেবল নীরবতা-ভেতরে মর্মে মরণ নিজের সেসব কথার ছায়ারা এখন লেগে আছে হাতের ভেতর…
তারাদের ছায়াপথ অনুসরণ করে মুগ্ধ পাঠক। পাড় করে মৃত্যুবৎ শতাব্দী, রামধনু জোছনায় ভিজে যায় চেতনা, কেউ কেউ চোখ রাখে নিয়ত প্রবহমান হাতের রেখায়... এত উপভোগ্য কবির সহযাত্রা! কবিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনায়াসেই অতিবাহিত করা যায় দত্যি দানোর দিন, মেঘের জাদুকরী ডানার আড়ালে লুকিয়ে রাখা যায় মারণ যন্ত্রণার সুবাস!
অদৃষ্টপূর্ব এই যাত্রাপথ! বিষন্নতার গর্ভগৃহ থেকে শোনা যায় রঙিন ব্যথার ফানুসের আমন্ত্রণলিপি। অ্যালবামের পাতা থেকে নিভৃতে ছিঁড়ে নিতে মন চায় সাবেকী মানিক্যপেটিকা। কবির সাথে হাত লাগাই মুক্তসন্ধানে। প্রশ্নের ঘর্ষণে প্রশ্ন উথলে ওঠে, শরীরে বিষবাস্প নিয়ে উড়বে কী করে এ দীর্ঘ বায়ুপথ!
অশ্বশ্রেণী দাড়িয়ে আছে অমোঘ সমরাঙ্গণে। কলমই চালিকাশক্তি, কলমই হাতিয়ার। বিস্মৃত প্রায় যুগ থেকে পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে দেয় জীবনের স্বপ্নঘোর, জ্বেলে দেয় আদিমতম বনফায়ার। তবু কার হাতে তুলে দেবো ব্যথাতুর চোখের জলজ বস্তুভার! এমনই প্রশ্নাতীত ছিল কি গান্ডিবধারী যোদ্ধার জিজ্ঞাসা! সারথী রথ থামাও, পাঞ্চজন্য ভস্ম হোক অন্ধকারে, আগে পূর্ণ করো এই অমোঘ প্রশ্নাধিকার!
কর্ষনে রচিত হয় জনস্রোত, জনশ্রুতিও। মন্ত্রচ্চারণে জেগে ওঠে ইরা পিঙ্গলা সুষুম্না! ব্যাজস্তুতি ছেড়ে জীবন উদযাপনের কাল যেন! সূর্য়ের গাঢ় আবরণ যেন জ্বালিয়ে দিয়েছে এ’মনভূমি, কবি দেখান, মৃত চড়াইয়ের ছায়া দেখে বুঝে যায় এ’ইতিহাসকাল। ধূলো উড়িয়ে ছুটে চলে অশ্বারোহী সৈন্যদল। বিষাক্ত বল্লমের ঝনঝনানি তে কেপে ওঠে জীবন। পৃখিবীর দেহ ভেদ করে চলে যায় বর্শা এফোঁড়-ওফোঁড়..
আরও ঘন সন্নিবদ্ধ হয় এই জীবন, আরও রোমাঞ্চকর, কিছুটা মায়াবী। বেদনার চন্দন গাত্রে নেমে আসে নিমীলিত সন্ধ্যারাগ। কবির বৃক্ষশরীর দেখি, নিয়ত বৃন্ত থেকে ঝরে পড়ছে পাতা, রক্তাক্ত শরীর কাটছে তীব্র কুঠার হাতে কারা ছুটে আসে! তবে যে পল্লবিত কিশলয় চোখ মেলেছিল এই অমোঘ পদ্য খাতায়, কি হবে তাদের!
ধৈর্য ধরুন, বিদগ্ধ পাঠক। অস্তাচলে মিশে যাক জীবনের মেলাঙ্কলি। শুনছেন না, কবির আকুতি, “কোথায় আর এসে দাঁড়াতে পারি পরস্পর?” চিনতে পারেন, কবিকে! স্পর্শ করুন বহু পরিচিত এই যন্ত্রণাগাথা!
অবশেষে অর্গল খুলে যায় কলমের, আবেগেরও। হ্যাঁ, এই অনাল গ্রন্থিমেঘ, এই নির্বিরোধী প্লাবন, একান্তই শরীরসঞ্জাত। লবণাক্ত পান্ডুলিপি থেকে উঠে আসা পাঠকের গ্রাসে গ্রাসে অকপট নৈবেদ্য। এখন সব আছে, নদীর কাছে ,নিজের কাছে বলার মতো/ শুধু মিথ্যের বেসাতি ঘরগুলো দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বল কলাবতী...
এখন দেহের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে সমস্ত শহরের রাস্তা। শরীরের মধ্যভাগ থেকে মাথা তোলে আলোর কালকাসুন্দি। প্রস্ফুটিত হয় বাহারী অক্ষরে। নির্ভেজাল বিষের শরীর, বুকে হেঁটে চলে যাচ্ছে বহুদূর…দীর্ঘ ছায়ার সারি জানে না… হ্যাঁ কবি, স্পষ্ট এ দৃশ্য, এই শরীরী যাত্রায় আমিও তো আপনারই সহযাত্রী!
নদীতে নেমেছ কখনও। জীবনের আবডালে রেখে এসেছো অলিখিত হাইফেন! প্রবাহ তো শুধু জলস্পর্শে নয়, প্রবাহ লেগে থাকে, ব্যথিত হৃদয়ের পাঁজরে। মৃত নদীর বুকজুড়ে শুধু পড়ে থাকে নুড়ি ও বালিঝড়! মুগ্ধ পাঠক কুড়িয়ে নেয় হারিয়ে যাওয়া আশরাফী, চোদ্দো আনার দূর্মল্য জীবন!
জীবনের প্রতি এই গভীর বিশ্বাসের ভার তো আপনাকেই বইতে হবে কবি। কোথায় কবে হারিয়েছে মার্বেলস্মৃতি আজো মনে পড়ে শুধু/ কেন হারিয়ে যায়, ব্যথার শ্রেণীমন্ত্রে লেখা হয় কোন পাঠ/ কেউ জানে না, জানে শুধু উদভ্রান্ত পথের তীব্র চোখজোড়া…
এ আঁধার রাত পাড় হতে হতে ঈষৎ স্পষ্ট এ শরীর, দৃশ্যান্তরে পলক ফেলে পল্লব, কালসীমানা শেষ হলে দেখি, এই ত্বক সরীসৃপ সদৃশ, এই শিরা উপশিরায় যে শোণিতধারা প্রবাহিত হয়েছে, সকলই উষ্ণতা হারিয়েছে কালক্রমে। কবিও কি এমনই কোনও ক্রাইসিস পিরিয়ডকে ইশারা করলেন তবে!
বাতিঘরে দপদপ শিখা। শরীরসঞ্জাত সবটাই নিভুনিভু। দাহ্যতা কম্পমান। কত আর মরে যাবো? কোথাও কি কমে গেছে পৃথিবীর গতি? কেবল জলের শরীর থেকে উঠে আসা প্লাবনধ্বণি শুনি / শুকনো মরুর মতো ঝাঁ ঝাঁ রোদের আগুনে পুড়ছি তবুও! স্তন ঝুলে পড়া কুকুরি আর ব্যর্থ ময়ূরীর ভেতর কোনও প্রভেদ দেখিনা আর!
এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ বড় একলা, বড় নিঃসঙ্গ – কবি, পাঠক সকলেই। হাত ধরাধরি হেঁটে গেছি, এতপথ, তবুও মোড়ে মোড়ে কোনো সহমর্মী উচ্চারণ নেই, চৌরাহায় কোনো শঙ্খধ্বনি শোনা যায়নি আজও। উৎসব করে বরণমাল্যে আমন্ত্রণ জানাননি কোনও ধূসর জগতের নিভৃত বিম্ববতী। এমনই কি হয় কবির যাত্রাপথ, পাঠকের নিবিড় পাঠক্ষেত্র!
দেবীশরীর স্পষ্ট হয় ক্রমে। প্রেম ও পুণ্য,সময়ের খাঁজে খাঁজে লেখা হয় সেসব দুঃস্বপ্ন। বিষ বাষ্পের শহর থেকে অশ্রুবার্তা ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দুরান্তরে। প্রত্নখননে উঠে আসে কামনা কুসুম, অমোঘ নশ্বরতা, জ্যোৎস্নাচন্দনে স্নান সেরে ওঠে চোখের অক্ষরমালা।
এ এক হারিয়ে যাওয়া গল্পগুচ্ছগান। অপ্রকাশিত সন্ধ্যার স্বরলিপি, দেহজাত উষ্ণকুসুমজল। মৃত নদীর বেদ মন্ত্র শুনতে শুনতে ধ্যানমগ্ন হয় পাঠক। ধ্যানমগ্ন ঋষির ঘরে বাস্তুহারা/ কিছু মায়া বুঝিবা এখনো রয়ে গ্যাছে-পৌরাণিক গৃহকোণে…
জীবন তো এমনই এক সান্ধ্যগানের পংক্তিমালা। প্রস্তরীভুত চোখে অশ্রুর আভাস। তাই নস্বরতার কাছে কোনও আক্ষেপ নেই কবির, পাঠকেরও। নিবিড় ক্লেদ অন্ধকারে ঢেকে রাখা না লেখা জীবনযন্ত্রণা। অক্ষরে, অশ্রুতে পাঠক মুগ্ধ হয়ে পাঠ করে অশ্রুতপূর্ব হীরকপংক্তিগুলি। নিয়নের আলোয় রচিত হয় অলৌকিক নক্ষত্রমন্ডল।
কোনও এক কাচের পাহাড়ের ওপর ভর করে এই কাব্যযাত্রা। আলোর উৎস থেকে নেমে আসে ঝিরিঝিরি পানিপ্রপাত। নক্ষত্রের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কবির জীবনচর্যা। এতো নিছকই কাব্য প্রবাহ নয়, মনের ঐশ্বর্য্য রাশি নয়, নিশ্চিতভাবে শরিরসঞ্জাত।
একি স্বেদ, রক্ত, বীর্য যাদের উৎপত্তি আবেগে, আঘাতে, আলোকসম্পাতে! জীবনের বিধুরতা সংলগ্ন করে এক ঐশ্বরিক উদ্ভাস। কবি ও পাঠকের। মোহ ও তারল্যের! অশ্রু ও আত্মার! এক অপরিচিত কবিকে পাঠক খুঁজে পায় তার বিক্ষুব্ধ, জীবন বিদ্ধস্ত চেতনায়। তবে এখানেই কি কবিজন্মের স্বার্থকতা। কি বলেন কবি!
- কবিতা: জীবন, বিষন্ন রোদের ডানা
- কবি: সৈয়দ সাখাওয়াৎ
- প্রকাশ: https://www.charbak.com/?p=719
- প্রকাশকাল: ১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬
মন্তব্য