কবিতায় ‘ভীষণ নিজের মত’ কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ
আইরিন সুলতানা
‘এখানে রাত্রির কাছে মাথা নত গাছেদের সারি’ – এই পংক্তি দিয়েই সৈয়দ সাখাওয়াতের কাব্যজগতের সাথে পরিচয় ঘটে আমার। ‘লিখে রেখো ইতিহাস’ কবিতার শুরু হয় ওই কথামালায়। কবিতাটি কবে লেখা জানি না। তবে যে কাব্যগ্রন্থের পাতায় কবিতাটির কালো হরফগুলো বসে আছে তা মলাটবদ্ধ হয়েছিল ২০১৩ সালে। ’খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ কাব্যগ্রন্থটি সৈয়দ সাখাওয়াতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। আমার সৈয়দ সাখাওয়াৎ পাঠ এই দিয়েই শুরু হল।
কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পাতায় মমতা লেপ্টে আছে। মমতা ছাড়া কি শব্দের মালা গেঁথে কবিতা হয়? এই মমতার পর খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপে আর কী থাকতে পারে যা চুপটি করে ভাবাবে? চিন্তায় হাতুড়ি পেটাবে? উপলব্ধিকে অসীম করবে?
সূচিপত্র জানালো একচল্লিশখানা কবিতা রয়েছে এই আলাপে। কবিতার শিরোনামই আদ্যোপান্ত কবিতা পুষে রাখে গভীরে। কবিতারা গদ্যের মত বলে ওঠে। কবিতারা পদ্যের আকারে ভাঁজ খোলে।
‘ইদানীং আমার ফেরার পথে মেঘের সাথে দেখা হয়’ – এই কথামালা পড়তে গিয়ে পাঠক থামবে। উৎসুক হবে ফেরার পথে মেঘের দিকে তাকাতে। পাঠক চাইবে ক্লান্তি, অভিমান সব মেঘের কাছে জমা দিতে।
’বন্ধু বলে কেউ আমাকে ডাকেনি আজ’; কবিতার শিরোনামে মন কেমন করা আফসোস মাখা। তবু আকাঙ্খা চাপা পড়েনি। এইসব অনুভূতিতে ভেসে পাঠক পুরো কবিতা পড়বে কয়েকবার করে। ’জল ছাড়া ভেঙ্গে পড়ার আর কোনো শব্দ শোনা যায় না’, টুকে রাখার মত এই পংক্তি যেন অতল দর্শন। নাকি সবারই বুকের বেদনা?
মানুষের মনও তো পাখির মত। ব্যথা পেলে ভিজে জবুথুবু হয়ে যায়। মানুষও তখন ডানা ভাঙ্গা পাখি হয়ে ওঠে। সে দুঃখ জাগানিয়া তিন পর্বের কবিতা ’পাখি ও রোদ’।
‘তোমার চোখ এত লাল কেন’ – নির্মলেন্দু গুণের এই লাইনটি এতটাই কিংবদন্তি যে এরপর লাল চোখ নিয়ে কিছু লেখা সত্যিই মুশকিল মনে হয়। কিন্তু কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ ঠিক লিখলেন।তার কবিতা ’লাল চোখ’ কাওসার নামে কোনো এক বন্ধুর জন্য লেখা। এখানেও কাঙ্খাবাঞ্ছার কথা আছে, যাতনা আছে। তবু এই কবিতা ভীষণ স্বতন্ত্র। এই কবিতা ভীষণভাবে পাঠকের ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে। পাঠকও তার কোনো এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগে কাওসার-ভাবনা খুঁজে পাবে।
কবিতায় ব্যথা বারবার আলেখ্য হয়ে ওঠে। সেই ব্যথাকে কত কত ভাবে ছুঁয়ে এসেছেন সৈয়দ সাখাওয়াৎ। ’অযাচিত’ অণুকাব্যে ’বুঝি শালিক ডেকে গেছে ভুল করে, প্রেমে নয় কান্নায়’ না ভোলার মত কথামালা।
’অসমাপ্ত রোদের গল্প’ কবিতা জুড়ে একটি চিঠি পড়ে ফেলার অনুভূতি হবে পাঠকের। এটি যেন ভীষণ অভিমানী গল্পের ভেতরের কবিতা। কিংবা কবিতার ভেতরের গল্প।
ছিপছিপে গড়নের ’জেগে আছে’ কবিতাটি আন্দাজ করি প্রজন্ম চত্বর নিয়ে সবার মেতে থাকার দিনগুলোতে লেখা। কবিতাটি পড়লে মনে হয় চোখ মেলে সত্যিই জাগ্রত যুথবদ্ধতা দেখছি।
‘ভাতের মাড়ের গন্ধে ঘুমন্ত চোখের পাতা থেকে বেড়িয়ে আসে নেড়ি কুকুর’; কি দুর্ধর্ষ একটি কথা! কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ’দৃশ্যান্তর বার্তায় চোখ বুলিয়ে দেখি’ শুরুই হয়েছে ওই কথা দিয়ে। এর আগের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনের কোনে যে হুতাশ ছিল সেখানটায় ভীষণ একটা ধাক্কা দেয় কবিতার এই কথা। ভাবনার জগতকে ছারখার করে দিতে পারে এই কবিতা।
বিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ তার প্রিয় লেখকদের কথা বলেছিলেন। অত অত ঋদ্ধ লেখকের লেখা নিশ্চয়ই তাকে প্রাণ দেয়। তবু সৈয়দ সাখাওয়াৎ তার কবিতাই তার মতই থাকতে পেরেছেন। তার কবিতা কবিতার শরীরে লেখা, আবার গল্পের অবয়বেও লেখা। দীর্ঘ কথামালা লিখেছেন। আবার অণুকাব্যে দ্রবীভূত করেছেন পাঠককে। কখনও কখনও ছন্দমিল আছে, তবে সেখানে ভীষণ সজাগ থেকে ছন্দ মেলানোর জোরাজুরি নেই। কথায় কথায় যেমন করে কথা মিলে যায়, তেমনই। কবিতায় জমে যাওয়া এবং গলে যাওয়া অনুভূতিবোধ আছে; কখনো চঞ্চলতা। পাঠক নিজের একাকীত্বে এই কাব্যগ্রন্থটির মাঝে নিজেকে ওলটপালট করে খুঁজে পাবেন।
মন্তব্য