স্মৃতি ও নিয়তিতাড়িত দহনের নিবিষ্ট সংলাপ
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবনের কোনো এক ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত ভোরে চারদেওয়ালের গণ্ডি পার হয়ে এক উন্মাদ খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ায়। দু'হাতের তালুর মধ্যে এনে দেখতে চায় তার আগামীর বিচরণ। এমন এক মানুষের সঙ্গে কবিও আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। চারদেওয়াল তাকেই বা কবে আটকে রাখতে পেরেছে! জীবন অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে কখনও কখনও এই উন্মাদের মধ্যে আমরা কবিকে দেখতে পাই —--- “সে যেন এক উন্মাদ — অযথা পৃথিবী ভালোবেসে — / একা পাড়ি দিয়েছিলো তিতকুটে তামাকের বন / এইসব অকারণ ভাবনার সন্ধ্যায় — অবকাশে / জেনেছি — মানুষ আসে — নিয়তি চুমু খাবে যখন / অথচ সেই সকল চিরজাগরূক মিথ্যে-গ্লানি / তোমার আঁধার ঘন বিছানায় দাঁড়ানো জিরাফ / অথবা সঘন মৃত্যু — কাছাকাছি সমগ্র জীবনী — / পড়ে থাকে ইশারায় ও শব্দে — যেন বা ইতিকাফ।”
চারপাশের শুকনো মুখ দেখে মনে হয় অন্ধকার কতটা গভীর, পাশাপাশি এটাও অনুভূত হয় ভেজা শরীরের ভাঁজে কি পরিমাণ দাহ লুকিয়ে থাকে। তাৎক্ষণিক দৃষ্টিতে কিছু কিছু ভুল আমাদের চোখে বড় হয়ে ধরা পড়ে এবং তার সংশোধনের মধ্যেই কি নিহিত থাকে জীবনের সম্পূর্ণতা? কিন্তু এটাও ঠিক কেউ কেউ এভাবেই জীবন সংশোধন করে জীবনের পথ চলে। সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে কবি এসব দেখেন। ভঙ্গি বদলাতে গিয়ে কবির আরও বেশি বেশি করে মনে পড়ে যায় উৎসবহীন ম্লান চোখ। কবিকে কখনও নিয়ে গেছে ডানে আবার কখনও বামে, স্বস্তি পাননি কোথাও। পোশাকি ভদ্রলোক এই গল্প শহরে ফেরি করে যা পাগলের অজানা নয় —----- “এতসব শুষ্ক মুখ দেখে মনে পড়ে অন্ধকারে --- / ভেজা শরীরের ভাঁজে কতটা দাহ লুকিয়ে থাকে / জীবন—ভণ্ডুল হয়ে গ্যাছে এই শীত-কারাগারে / ভেবেছি, ফ্ল্যাপের পাশে — যেমন থাকে মঞ্চনাটকে / একজন শ্রুতিধর, ভুলগুলো যে শুধরে দ্যায় / অনায়াসে পার্ট সারে, উতরে যায় দিনের মতো / ওইরকম জীবন চেয়ে—কেউ একা গান গায় / এবং ফেরারি মনে— লিখে রাখে সম্ভাবনা যতো। / ভঙ্গি বদলাবো বলে —- এইসব চেতনার স্কুলে / যতো ভাবি আরো বেশি মনে পড়ে হায় অবেলায় / উৎসবহীন ম্লান চোখের জলধরা আড়ালে / কয়েকটি বিষাদের বিষ জমে ফোঁটায় ফোঁটায় / অথচ মুখের সারি—আমাকে নিয়ে গিয়েছে ডানে / কখনো বামে—সরল বা উঁচুনিচু পথের বাঁকে / স্বস্তি মিলেনি কোথাও—এ কথা পাগলটিও জানে / শহর ফেরি করেছে এ'গল্প —— পোশাকি ভদ্রলোকে।”
সাখাওয়াৎ -এর কবিতায় ‘স্মৃতি’ শব্দটি যে সব জায়গায় আছে তা কিন্তু নয়। কিন্তু যেখানেই দেখতে পাই সেখানেই যেন এক নতুন দুয়ারের উন্মোচন ঘটে —-- “কোনোদিন যদি দেখা হয়ে যায় অচেনা শহরে / জেনো, স্মৃতি তাকে দিয়ে চলে গ্যাছে অপার্থিব মুক্তি” আবার “আজো স্মৃতি প্রতিধ্বনিময় / রাতের ট্রেনের শব্দ, যেমন ক্রমশয্যায় দূরে / সেসব সঙ্কেত জানি — কত মর্মে উপস্থিত হয়।” ঠিক একইভাবে ‘নিয়তি’ শব্দটি। শব্দটির নিজস্ব চরিত্রের হাত ধরেই যেন কবি তাকে তাঁর কবিতায় নিয়ে আসেন —--- “জেনেছি — মানুষ আসে — নিয়তি চুমু খাবে যখন / অথচ সেই সকল চিরজাগরূক মিথ্যে-গ্লানি / তোমার আঁধার ঘন বিছানায় দাঁড়ানো জিরাফ / অথবা সঘন মৃত্যু — কাছাকাছি সমগ্র জীবনী — / পড়ে থাকে ইশারায় ও শব্দে — যেন বা ইতিকাফ।” আরও একটি কবিতায় দেখতে পাই “ফিরে যেতে হবে ঘরে —- / এমন আলস্যভরা সন্ধ্যা, হয়তো হবে নিয়তি / তখন প্রবল চোখে নির্বচনের ভাষাই রবে / মানুষের ব্যস্ততার ভিড়ে, ছুটে যাবে বাস-ট্রেন / জীবনের প্রান্ত থেকে বয়সের ভাষা থেকে যাবে / রুপালি জলের তীরে বলবো কে কে ভালো আছেন / অথচ দণ্ডকারণ্যে গোধূলির সূর্য ডুবে যাচ্ছে / প্রবল প্রবল জ্বরে এখনো পাণ্ডুলিপি পুড়ছে।”
কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ একজায়গায় বলেছেন, “কবিতা কী এ জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় কবিতা অনেকরকম।” অনেকেই কবিতা লিখেছেন এবং তাদের প্রকাশও ভিন্ন ভিন্ন, আর সেটাই তো স্বাভাবিক। অনেকেই মনে করেন কবি তাঁর কবিতা দিয়ে সমাজের যাবতীয় কালিমা দূরীভূত করেন এবং তাদের কাছে কবি তখন একজন সমাজসংস্কারক। কেউ মনে করেন, কবিতা রসের উৎসার আবার অনেকেই ভাবেন কবিতা বুদ্ধির প্রকাশ। তাহলে কবির মন এমনই এক রঙের আধার যেখানে আমরা অগণন রঙের প্রকাশ দেখতে পাই। এতসব কথা একটা কারণেই বলা, কবির মনের ভেতর ভাবনাটি কিরূপে ধরা দেবে তা কবি নিজেও জানেন না। তাই কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ -এর “নিহিলের বনে” কাব্যগ্রন্থটির দিকে যখন তাকাই তখন দেখতে পাই ছেচল্লিশটি কবিতাই শিরোনামহীন। উৎসর্গ কবিতাটিতেই ( এই ভোরলগ্ন জীবনে ) চোখ মন দুটোই আটকে যায়। কবি তার কবিতায় এমন এক চিত্রকল্প তৈরি করেন যা পৃথিবী থেকে কোনো দূর গ্রহের পরিবেশের সমগোত্রীয় নয়। আমাদেরই প্রাত্যহিকতার মধ্যে নিহিত এক বাতাবরণ যার মধ্যে একবার ডুব দিলে দীর্ঘসময় নিমজ্জিত থাকতে সাধ হয়। কিন্তু এরই পাশাপাশি কবি আশঙ্কিতও, যে আশঙ্কার দ্বারা আমরাও নিয়ত তাড়িত হই —--- “সবুজ বৃক্ষছায়ায় অথবা সমুদ্রতীর, গ্রামে / একটা নিবিড় জলে, ডুব দেওয়া সন্ধ্যার মতো --- / তাই খুঁজি দৃশ্যলোক, যেখানে তুমি-ই উৎসব / এই নবজন্ম, তুমি শোনো বিষাদের বিটোফেন। / শহর নজরবন্দী হলে আর কোথায় উড়বে বলো / বরং এ উৎসবে এসো বাঁচি সকলের মতো — ভবিষ্যতের পূর্ণ নেশায় / প্রথম পাখির মতো অথবা উড়ন্ত সাদা হাঁস।”
“আকাশ আক্রান্ত রোগীদের উদাস হওয়া ভঙ্গির মতন” বললেই চোখের সামনে এক প্রাণহীন অস্তিত্বের ছবি ভেসে ওঠে। কবি আকাশকেই কেন বেছে নিলেন এই সময়ের প্রাণহীনতাকে বোঝাতে —-- এই প্রশ্নও মনে উঠে আসে। আসলে আকাশের যে বিশাল ব্যাপ্তি তার হাত ধরে অনায়াসে প্রকাশ করা যায় আজকের সময়ের ইতিবাচক মানুষের মনোজগতের ছবি। শুধু তাই নয় এই বদল লোকচক্ষুর অন্তরালে নয়, প্রকাশ্যে সকলের চোখের সামনে, ঠিক যেমন ভাবে আকাশ সকলের চোখের ওপর জলের মতো স্পষ্ট হয়ে লেগে থাকে —-- “কা'র ভরসায় ডেকেছিলে অনাহুত মেঘেদের সম্মিলন / আকাশ আক্রান্ত রোগীদের উদাস হওয়া ভঙ্গির মতন / যারা হেঁটে চলে যায় ধীরে — পাশ কাটিয়ে আস্থাহীন শরীরে / গ্রীষ্মের মেঘের ভীড়ে — পোড়া সময়ের রক্তক্ষরণ ডিঙিয়ে / এইসব অপারগ জল স্থিতিহীন সূক্ষ্ম গাছের পাতায় / ঝরে পড়ে — জল ডিঙানোর কালে ভাবে এই পরাধীনতায় / ক্রমশ নদী যায় সমুদ্র কল্পনায় - রোগাক্রান্ত ভিনদেশে / বরং আলাদা হবে, বহু আকাশের, বহু রোগ ভালোবেসে / এই ভেবে ডুব দ্যায় জলে-ডুবুরির সফল ডুব সাঁতারে / মানুষেরা চলে যায় দূরে — বিকেলের শেষ আলো-অন্ধকারে।” পোড়া সময়ের রক্তক্ষরণ পার হয়ে অপারগ জল স্থিতিহীন সূক্ষ্ম গাছের পাতায় ঝরে পড়ে এবং জল ডিঙানোর সময়ে ভাবে এই পরাধীনতায় নদী যায় সমুদ্র কল্পনায় রোগাক্রান্ত ভীনদেশে, বরং মনে হয় বহু আকাশের বহু রোগ ভালোবেসে অর্থাৎ এই সমাজভুক্ত মানুষের মননের সঙ্গে এক অদ্ভুত সম্পৃক্ততায় মিলেমিশে এক অন্যফল কবি আশা করেন।
কবির তো কোনো দেশ হয় না তাই কবি কোন দেশের মানুষ সে সম্পর্কে অবগত হয়ে আমরা তাঁর কবিতার গতিপথ ঠিক করা কখনও উচিত নয়। তবুও কবির তো একটা জন্মগ্রাম থাকে আর তার কবিতায় এসে ছায়া ফেলে তার গ্রাম, চারপাশের মানুষজন কিন্তু সেই গ্রাম তার নির্দিষ্ট সীমান্ত পার হয়ে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ব্যপ্ত হয়ে পড়ে। তাই আমরা তার কবিতায় দেখতে পাই পৃথিবী নামক দেশটির একটা ছবি —--- “এমনতর সকাল কখনো যেন ফিরে না আসে / মুদ্রার এপিঠ থেকে ওপিঠে—বদলে যাচ্ছে যারা / হিংস্র মুখ, রক্তাক্ত আঙুলের সাথে ঝুলে থাকে — / বিষাদের পাথরেরা— ফোলা চোখের খির জলেরা / এখানে জমছে শুধু, হৃদয়ের বানভাসি জল / থামুক এবার এই বিষময় কঙ্কালের নাচ / পরসিয়া নাও থেকে আসুক ফুলগন্ধ সুবাস / একটা নিশ্চিন্ত দিন, শীতে পাক উষ্ণতার আঁচ / জানি, এসবই স্বপ্ন — যখন তুমি ভাঙছো পূজা / মানুষের মানচিত্র কাটো, আরো কাটো সমনাম / দেবতা আধার কেটে — করছো দিগ্বিদিক উল্লাস / ধর্মের জিরাফে দ্যাখো— হন্তারক রোদ উপাখ্যান / এমনতর সকাল কখনো যেন ফিরে না আসে / ফলকের বন্দী হয়ে, মানুষের দীর্ঘ নিশ্বাসে!”
কবি সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষা ব্যাপারে ভীষণভাবেই চিন্তিত। তিনি এক নতুন সকালের অপেক্ষায় দিন গোনেন। তাই সেই ভয়ঙ্কর সকাল যা মানুষকে দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত করে তা তিনি কখনও চান না। পাশাপাশি সেই সমস্ত মানুষ যাদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হয় তাদের বিরুদ্ধে কবির বিষোদগার। তরুণ সমাজের বর্তমান অবস্থানও কবিকে চিন্তিত রাখে। কিন্তু কবিরা তো হাল ছাড়ার পাত্র নন। তাই সাখাওয়াৎ -এর কবিতায় আমরা শেষমেশ খুঁজে পাই এক নতুন আলোর ইঙ্গিত যা আমাদের পথের পাথেয় —-- “একেকটা হত্যাযজ্ঞ, মানুষ পশুর ভীমরতি। / তুমি মানে বারেবারে তোমার জন্যই ঘরছাড়া / বিপ্লব আকাঙ্ক্ষা বুকে বহু তারুণ্যের বিস্মরণ / পথে মুষ্টিবদ্ধ হাত, দরোজায় মৃদু কড়া নাড়া / সহস্র স্লোগান মুখে, নিশ্চুপ দূরত্বে জনগণ। / তবু বলি বারবার, ওই নামে হোক মৃত্যুগান / সহজ দুপুর থেকে আলস্যভাঙা শব্দের ঝড় / ধনুকের ছিলা হোক, পাহাড়ের মতো টানটান / বিপরীত বসবাস থেকে ছুটে আসা বুলেটের স্বর।” তাই সাখাওয়াৎ-এর কবিতায় অশান্ত পৃথিবীর ছবির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পরিবর্তিত অবস্থান যা সভ্যতাপ্রিয় প্রাণের কাছে এক অশান্তির বার্তা। কিন্তু কবির সজাগ দৃষ্টি কবিতায় যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয় তা আমাদের মুগ্ধ করে। মানুষের হাত ধরে সাখাওয়াৎ নিয়ে যান যেন সেই অন্য এক লোকে যেখানে তার কবিতা কিছু শব্দ আর বাক্যের সমষ্টিমাত্র শুধু নয়, তাঁর কবিতা আমাদের কাছে সেই জীবনীশক্তি যা আমাদের কালের হাওয়ায় নতুন দুই ডানা সংযোজনে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়।
কবির হাতে আর এক কবির আলোচনা--ইতিহাস হয়ে র'বে সময়ের ধারাপাতে। দুই কবিকেই কুর্নিশ, শারদ শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুন