নিজেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছা হয় মাঝে মাঝে। এ কেমন বোধ আমার? এ কেমন মর্মযাতনা? তাহলে কী আস্থা নাই নিজের ওপর। ‘নিজ’ কী নির্মীত হয়নি আমার নাকি ‘নিজ’ তৈরি হতে হতে হারিয়ে গেছে। না তাই বা হবে কেন? ‘আপন অস্তিত’¡ বলতে একটা কিছু আছে তো। এর জন্যই তো অগণিত মানুষের ভীড়ে আমার মাথাটিও থাকে। আমি নির্মিত হই নানাভাবে। আমাকে তৈরি করে আশেপাশের নানাকিছু।
তাহলে কেন আমাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাই আমি? আমার চাওয়া-পাওয়া তো কেবল আমার ওপরই নির্ভর করে না। আমি জড়িয়ে আছি হাজারো ‘আমি’র সাথে। এগুলো মিলে তৈরি করে এক শৃঙ্খল। ইচ্ছা করলেই বের হওয়া যায় না এ শৃঙ্খল থেকে। না, এভাবে বললে কিছুটা ফাঁক থেকে যায়। নিজেকে একবারে শেষ করে ফেলার নানান উপায় আছে। তবে এ তো স্বাভাবিক কিছু নয়। এ চূড়ান্ত পরিণতি কতোজন পারে নিতে? তার ওপর এর সাথে জড়িয়ে আছে মনস্তাত্বিক জটিলতার নানা হিসাব-নিকাশ।
যখন দন্দ্ব লাগে ভেতরের সাথে বাহিরের, তখন অসহায় লাগে। কিন্তু এ দ্বন্দ্ব তো অপরিহার্য। এ থেকে বাাঁচার পথ নাই। নিজের মতো করে হবে না তো কিছু। আর এখন যে বহুমাত্রিক বাস্তবতার সাথে নিত্য বসবাস তার সাথে লেগে থাকাও কঠিন আবার ছেড়েও দেয়া সম্ভব নয়। এর সাথেই থাকতে হবে। আকাশের চাঁদ দেখে যেমন মন মুগ্ধ হবে, তেমনি মন বিক্ষুব্ধ হবে মানুষের কটু কথার তীব্র বাণে। তাহলে এই তো কথা দাঁড়ালো যে নিয়ত প্রতিকূলতা ঠেলে এগিয়ে যেতে হবে। তাই নানান কিছুর সাথে ধাক্কা লাগবে। শুধু কি তাই, দ্বন্দ্ব কী লাগে না নিজের সাথে নিজের? নিজেকে কী তখন মনে হয় না ছিঁড়ে ফেলতে? নিজস্বতার এক কলুষতাযুক্ত দিক প্রকাশিত হয়ে গেলে নিজেকে আর কতোদূর ধরে রাখা যায়?
বাইরের সাথে দ্বন্দ্বের চেয়ে ‘আপনার’ সাথে দ্বন্দ্বের প্রাবল্যই যেন বেশি। বাইরের সাথে সমস্যা হলে তো বন্ধন সাময়িকভাবে ছিন্ন করা যায় কষ্ট হলেও। কিন্তু নিজের সাথে বন্ধন ছিন্ন করার উপায় কী? সম্ভব কী আসলে এমনতরো কোনো প্রচেষ্টা? কীভাবে ভুলি নিজেকে, কীভাবে অস্বীকার করি নিজের অস্তিত্বকে?
আমার ভেতরে আামার নিত্য বসবাসকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগই হয়তো নাই। আমার ঘুম আমার জাগরণ আমার চলা আমার থামা- আমিময় এক জগতের বাসিন্দা কে নয়। সমষ্টির সাথে মিশে থাকলে এক ‘আমি’ মাথা উঁচিয়ে থাকে।
তবু কেন মাঝে মাঝে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলতে চাই? কেন সরে যেতে চাই চলতি পথ থেকে? এটা কী তাহলে একারণেই যে, নিজের কাছে পরাজিত হয়ে যাই। নিজেকে আর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি না। এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী থাকতে পারে? আমার চারপাশ তখন আর আমার থাকে না। আমার ভেতর আর বাহিরের মধ্যের দ্বান্দ্বিকতা আমাকে নিয়ে যায় আমার থেকে দূরে। আমি তুমি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই। তখন না থাকে কোনো যৌক্তিক বোধ না থাকে আবেগের পরম্পরা। তীব্র পুঁজিবাদী সমাজের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমি আবার মিশে যেতে থাকি পণ্যায়নের গোলক ধাঁধাঁয়। এই জগত আমাকে আমার থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করতে করতে আরও ভয়ংকর একা করে দেয়। আমি হারিয়ে যাই এক ঘুমঘোর জগতে। পণ্যসভ্যতা আমাকে পরাজিত ভাবতে শেখায়। উঁচু নিচুর ব্যবধান শেখায়। আমার জগৎ যে সীমাবদ্ধ তা চিন্তার গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। আর এই চিন্তা বিধ্বংসী হয়ে ওঠলে নিজেকে ছিঁড়ে ফেলার বোধ আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে।
তবু ইচ্ছা হলেই কী করা যায় এমনতরো কিছু? পারা যায় না ‘সহস্র বন্ধন’ এর কারণে আর পারা যায় না নিজের কারণেও। নিজেকে নিজের প্রতিবিম্বে প্রতিস্থাপন করে দেখি এ কোন আমি। এ কোন অচেনা রূপ আমার। এ কোন অপরিচিতের মুখোমুখি আমি। আমার চাঁদ-তারা দেখার দিন কোথায় হারোলো? আমার অরণ্যবিলাসী মন কোথায় হারালো? কোথায় হারালো গোলাপ-গ্লাডিওলাসের যুগলে মন ডুবিয়ে রাখার দিন? এ আমি কোন আমি? আমাকে মিলাতে পারি না আমার সাথে। যে বাস্তবতা আমাকে ঘিরে আছে, মনে হয় এমন আমি চাইনি কখনো।
মনের ভেতর চলতে থাকা গুঞ্জণ আমাকে ব্যস্ত রাখে। আমার অতীত, বর্তমান গুলিয়ে যায়। অনাগত ভবিষ্যতের তো আর কথাই আসে না। আমার ভেতরের আমি ক্রমশ এলোমেলো হতে থাকি। মনে হয় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। এই সঞ্চরমান জগতে আমি যেন কেউ নই। আমার ভেতর -বাহির, আমার দেখা, না-দেখা মিলেমিশে একাকার হতে থাকে।
মনেরে আজ কহো যে
শামসুল কিবরিয়া
শামসুল কিবরিয়া
মুক্তগদ্য বিকশিত হচ্ছে বুঝতে পারছি! চমৎকার
উত্তরমুছুন