.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

আখ্যানের বিপরীতে

আখ্যানের বিপরীতে প্রমিথ রায়হান
সন্ধ্যা হলেই মস্তিষ্কে সিগনাল টের পায়। একা হও, আত্মনিবেদনের সময় এসেছে- পরদিনের যে অনিবার্য যজ্ঞ; তার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করো। দহন অন্তর্গত। স্কুল থেকে বিকালে বাড়ি ফিরে এসে গোসলে ঢুকে যাওয়া। বেরিয়ে এসে কফি, ঘর গোছগাছ। রাতেরবেলায় খেতে বসে মায়ের সাথে গল্প করা। প্রিয়তম ম্যাম হয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের সামলায় অপরূপ সাবলীলতায়; প্রেশারের ওষুধটা শেষ হয়ে এলো কিনা তার দেখভাল- কখনো কখনো স্মৃতিকাতরতা পেয়ে বসে। তখন গল্পের সময় দীর্ঘায়িত হয়- শেষটা হয় মায়ের অনুশোচনাজনিত কান্নায়। প্রথম প্রথম নিজেকে সামলাতে বুক ছিঁড়ে আসতো। অভিজ্ঞতা অভ্যস্ততার অনাকাঙ্ক্ষিত ঋজুতা দাবী করে। জগতের চাহিদার সম্ভার ব্যাপক। স্থৈর্য্যকে শক্তিরূপে চিহ্নিত করে প্রতিকূলতাকে সামাল দিয়ে স্বাস্থ্যকর থাকতে পারবার ভারসাম্য রক্ষা- আত্মসমালোচনাহীন সমাজের সাপেক্ষে চাওয়াটা কষ্টকল্পনা। ঘুমানোর সময়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে মাঝেমাঝে ভাবে- যুদ্ধ সে একটা করে যাচ্ছে; তবে সবার আগে নিজের সাথে।

মায়ের মতোই বাংলার টিচার হয়েছে। মা যদিও কলেজে পড়াতো। কিন্তু কমনীয়তার পাশাপাশি কাঠিন্যের আশ্রয়ও নিতে হয় সময়ে সময়ে। পাঠ্যপুস্তকের চাপে ভারাক্রান্ত ছেলেমেয়েগুলোকে বুঝতে চেষ্টা করে- ইন্দ্রিয়সমূহের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে সৌকর্যরহিত হয়ে যাবার দশায় চলে গেছে- ছাপার অক্ষরে সৌন্দর্য আবিষ্কারের কথা কল্পনাতেই আসেনা; তার সাধ্যে যতোটুকু কুলায়- চেষ্টা করে অবলোকন উৎসারিত অনুভবের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে। রাতে সামনাসামনি বসে মাঝেমাঝে মা ডেকে ওঠে ‘ফাহিমা’। ডেকেই চুপ করে যায়। ইতস্তত করে। সে বাদবাকি যা বুঝবার অন্তর্গত ইঙ্গিতময়তায় বুঝে নেয়। বাতাস তখন আড়ষ্ট। জানালার গ্রিলগুলোতে ধুলা জমে।

‘তোমাকে আর কতোবার বলবো? আমার এখনই দরকার। দুই মাসের মধ্যে ব্যবসাটা শুরু করতে না পারলে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়বে। সবাইকে বলে রাখছি।’ রাশেদ ক্রমশই ডেসপারেট হয়ে যাচ্ছিলো। ফাহিমা বিস্মিত যতোটা হয়েছিলো- তার চাইতেও বেশী হয়েছিলো সংকল্পবদ্ধ। পরিবর্তনটা দৃশ্যমান এই সত্যের চাইতেও অচেতন মনে এই অনুভূতিটা বেশী প্রখর হয়েছিলো যে পরিবর্তনটার ভিত অটুট। দুই মাসের অন্তঃসত্তা ছিলো, ক্লিনিক থেকে ফিরে তিনদিন নিজের ভেতরে গুম হয়ে রইলো। নিজের সাথে বোঝাপড়াটা যেনো এলোমেলো না হয়। রাশেদকে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলো। ফ্ল্যাটটা নিজের নামে লিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে যাকে রীতিমতো উন্মত্ত দেখেছিলো- তাকেই দেখলো কালক্ষেপণ না করে রাজি হয়ে যেতে। ডিভোর্সপেপারে সই করতে করতে রিলকের উক্তি মনে পড়ে গিয়েছিলো। ফাহিমাকে রাশেদ প্রাইভেটে ইংরেজী পড়াতে গিয়ে একদিন শোনায়- The only journey is the one within. চেনাজানা আরো গাঢ় হয়ে এলে- Love consists of this: two solitudes that meet, protect and greet each other.

আয়নার দিকে তাকালে প্রায়ই হাসি আসে। কালো রঙের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে গোটা শৈশবটা কাটিয়ে দিয়েছিলো। কী লাঞ্চনা! কী লাঞ্চনা! একান্নবর্তী পরিবারে অনাহূতের মতো চারিদিকে ঘুরে বেড়াতো। স্মৃতিটা এখনো মনে আছে- তখন কলেজে পড়ে। গায়ের রঙ নিয়ে গালমন্দ করা একটি চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দিতে বাইরে বেরিয়েছিলো; পরিকল্পনা ছিলো হাঁটতে হাঁটতে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলবে, তারপরে চলে যাবে নিকটবর্তী পুকুরঘাটে। ভরদুপুর, মাথার ওপরে সূর্য চোখ রাঙ্গাচ্ছে, ওই সময়টায় পুকুরঘাটে কেউ বসেনা। দ্রুতগতিতে গেট খুলে বেরিয়ে যাবে- ফকিরের মুখোমুখি হয়ে গেলো। পার্শ্ববর্তী বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলো। তার দিকে তাকিয়ে সমগ্রটুকু দেখে নিলোনা- পড়ে নিলো। বিষণ্ণ হাসি হেসে বললো- “কেবল ঈশ্বরে জানে কালোর সৌন্দর্য। মানুষে জানলে আমারে দরকার পড়তোনা।” ফাহিমা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কান্নার স্বরূপটা যেনো কেউ আত্মস্থ করে তাকে শক্তিতে পরিণত করলো। আড়ালে থেকে সাহস যোগালো। জানালো- পীড়নের স্টিয়ারিং অন্যের হাতে; অন্তর্গত শক্তিতে বাঁচতে চাইলে সমৃদ্ধি নিজের। দগ্ধ হও, পড়ে যাও; ওঠো, আত্মরূপের ওপরে আস্থা রেখে চোখে চোখ রাখো- করায়ত্ত করতে চাইবার ফাঁদে পড়বেনা, সূর্যের শেষ আলোতে স্পন্দনের রেখাটুকু চিনে নেবে। অস্তমিত মানেই মৃত নয়; পরম্পরাকে গতিশীল মানলে জানবে- দর্শন ও প্রকৃতিকে চিনতে হলে ইগোকে ছেড়ে আসতে হয়। অথর্বের কাছে যা কৌতুককর, সবলের কাছে তাই পাথেয়।

পরশুদিন ইমরান এসেছিলো। সহজাত চাপল্যে। স্কুল শেষে সন্ধ্যাবেলা দেখা করলো। দূরে হাঁটতে গেলো। কোনকিছু নিয়ে বিস্তৃত আলাপে যেতে পারেনা ইদানিং। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়।

দূর থেকে বাতির আবছা আলো দৃশ্যমান হয়। ইমরান প্রগলভ হয়ে ওঠে।

“আর কতোদিন আমারে ঝুলায়ে রাখবা?”

এই প্রশ্নের জবাবে উপযুক্ত কী কথা বলে ওঠা যায়? ফাহিমা নিরুত্তর থাকে।  

চোখদুটো বন্ধ করে রাখতে চেয়েছিলো। ট্রমা, উদ্বেগ, বর্তমানচ্যুত মন- বিচারবোধের পথে প্রবেশের সুযোগ নেই। সময়টা সহজ হতে পারতো। ইমরান ক্রমশ অধৈর্য্য হয়ে উঠছে অনুভব করে নিজেকে অনুপযুক্ত বলে মনে হতে থাকলো।

নিজের ঘরে খাতাপত্র নিয়ে বসেছে। কয়েকদিন ধরে জ্বরে বেশ ভুগলো। সামনে রেজাল্ট, পরীক্ষার খাতা দ্রুত দেখে জমা দিতে হবে। কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা খাতায় যাচ্ছেতাই লিখে রেখেছে। ধৈর্য্য রাখতে পারা মুশকিল। ভাবলো- তার ভালোবাসার মাঝে কি কোন ব্যবধান রয়ে গেছে? জ্বালা ধরে এমন কোন উপাদান? গতিমুখের ব্যাপারে সে কখনো নিশ্চিত হতে পারেনা কেনো? পরিবর্তনশীলতার স্থিরতায় আস্থা রাখতে চায়; কিন্তু ঘুরপাক খায় নিরন্তর অন্তর্দ্বন্দ্বে। সন্তান হয়না বলে মাকে বাবা ছেড়ে গেলো বিয়ের দুই বছর পরে। একাকীত্ব ঘোচাতে তাকে দত্তক নিয়েছিলো মা। বেশ পরে জেনেছিলো পুরো ঘটনাটা। ততোমধ্যে যে কোন সত্যের জন্যে প্রস্তুত থাকাটা শিখে নিতে হয়েছে। পরিপার্শ্ব থেকে পাওয়া অনাদর, অবহেলা; মাথায় হাত রেখে সঙ্গ দেবে এমন স্পর্শের অনিশ্চয়তা- গোলযোগটা কি সেখানেই বেঁধেছিলো? নৈর্ব্যক্তিক চোখে মানুষকে দেখতে শেখা আর মানুষের প্রতি সাধারণ বিবেচনায় অবিশ্বাসের পার্থক্যের যে বিপদসীমা- হিরোইজমের প্রশ্ন এখানে আসতে পারেনা। আস্থাভাজনের ভরসা শক্তি দেয় বলে বিশ্বাস করে; কিন্তু হাতটা চিনতে ভুল করলে? অথবা নিকটে থেকেও যদি দেখতে না পায় তবে? ফাহিমা উঠে দাঁড়ায়। জর্জরিত। ডাইনিঙে এসে দাঁড়ায় শ্লথ গতিতে। পানি খেতে খেতে পিপাসার তীব্রতাটুকু অনুভব করে। ইমরানের অবিবেচক মনোভাব পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে । তাকে শুধু নিজের প্রয়োজনের কথা বোঝাতে চায়। বোঝাপড়ার বিষয়টায় এক ধরণের মীমাংসায় আসতে হবে। যন্ত্রণাদায়ক কোন পরিণতি যদি অপেক্ষমান হয় হোক। আগুনে বারবার ঝাঁপ দেওয়ার মূঢ়তাকে নির্ভরতার নামে গ্লোরিফাই করা চলেনা। ডাইনিং রুম থেকে দক্ষিণে এগোলে বারান্দা। সেখানে যেতে যেতে দেখে- সামনের ঘরের দরজা খোলা। ফ্যান ঘুরছে। একগোছা চুলের কিছু অংশ বাতাসে উড়ছে। পাশ ফিরে শুলে মুখের একদিক দেখা যায়। শায়িত শরীরে প্রেরণার ভাষা দীপ্যমান। ফাহিমা ঘরে ঢোকে।

আখ্যানের বিপরীতে
প্রমিথ রায়হান

মন্তব্য

BLOGGER: 2
  1. "আখ্যানের বিপরীতে" গল্পটিতে শুধু একটি জীবন নয়, শুধু তার অপ্রাপ্তি নয়, বরং ফাহিমার মস্তিষ্কের ভিতরে চলছে যে জীবন, সেটাকেও দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. মোঃ তাইজুল ইসলাম১৫ জুলাই, ২০২২ এ ২:৪৪ PM

    এ গল্প যেন সত্যিই আখ্যানের বিপরীতে পাঠ৷ মনোহর লাগল

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: আখ্যানের বিপরীতে
আখ্যানের বিপরীতে
বিন্দু। বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিন। বাঙলাদেশ থেকে অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjddnL5wF34E1fxu5jrlS1i9A9c7HhC_Lbe9gUyi9Ca6ujgauS5xX7Qdibl1L4JtAHXyY-8pIGmbcjHtp3NlW9BXO5SPYno_9Fh5Ew6En54u2AUXXoi7CnDt8QivYLTidaw0Ta3Fl8VdaKbBvGgsXbt84Dv9tcPdHv4uNzX6tTSS7jv4X1-0lugFFfz/w320-h180/%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%97-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%A6.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjddnL5wF34E1fxu5jrlS1i9A9c7HhC_Lbe9gUyi9Ca6ujgauS5xX7Qdibl1L4JtAHXyY-8pIGmbcjHtp3NlW9BXO5SPYno_9Fh5Ew6En54u2AUXXoi7CnDt8QivYLTidaw0Ta3Fl8VdaKbBvGgsXbt84Dv9tcPdHv4uNzX6tTSS7jv4X1-0lugFFfz/s72-w320-c-h180/%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%97-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%A6.jpg
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2022/07/Pramith-Raihan-story.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2022/07/Pramith-Raihan-story.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy