চট্টগ্রাম কলেজে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয় মহসিন জামালের সাথে। ডাকনাম পাপ্পু। পাপ্পুর সাথে মাঝে মাঝে মেতে উঠতাম দাবা খেলায়। তবে কখনও তার সাথে দাবায় জিতেছি কিনা মনে পড়ে না। পরে পাপ্পু জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় অনেক দূর এগিয়েছিল। পাপ্পুর বাসা ছিল আগ্রাবাদের মোল্লাপাড়া। প্রায় সময়ই পাপ্পু আমার বাসায় এলেও ছুটির দিনে মাঝে মাঝে আমিও চলে যেতাম হেঁটে হেঁটে সেই মোল্লাপাড়ার বাসায়। পাপ্পুর বিপ্লবী বড়ভাই আড় চোখে দেখে নিতাম। কিন্তু কখনও সাহস করে আলাপ করিনি। তবে সেই বড় ভাইয়ের সংগ্রহের একটি বই চে গুয়েভারার “ডাক দিয়ে যাই” আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। অনুবাদকের নাম জানি না, কিন্তু সেই দিন থেকে আমি যেন বিপ্লবের মোহন মন্ত্রে দীক্ষিত হলাম। জানার চেষ্টা করতে লাগলাম সোভিয়েত বিপ্লব এবং চিন বিপ্লবের কথা, জানতে শুরু করলাম ফিদেল এবং চে’র বিপ্লবের গাথা। এই বই থেকে জেনেছিলাম, কিউবা বিপ্লব সফল হবার পরে একদিন ফিদেল জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে ইকনমিস্ট কেউ আছে কিনা। আর, চে কানে শুনেছিলেন “কমিউনিস্ট আছে কিনা”। সাথে সাথেই মুচকি হেসে ফিদেল তাঁকে বলেছিলেন, “বেশ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব তবে তুমিই নাও”। দায়িত্ব নেবার পর, চে’র প্রথম প্রশ্ন ছিল “আমাদের টাকা কোথায় কোথায় আছে?” জবাবে যখন জানতে পারলেন যে কিউবার প্রাৎ সব অর্থই মার্কিন দেশে গচ্ছিত রয়েছে, তখন তিনি তাৎক্ষণিক নির্দেশে সব টাকা ফেরত আনতে বলেন। আদেশ শুনে ব্যাংক কর্মকর্তারা পেছনে হাসাহাসি করলেও কার্যকর করতে বাধ্য হন। আর টাকা ফেরত আনার কয়েকদিন পরেই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, তখন সকলেই একবাক্যে চে’র উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতে বাধ্য হন। এছাড়াও বিপ্লব চলাকালীন আরও নানান তথ্যে এই বইটিকে আমার খুব মূল্যবান মনে হয়েছিল। এ সময়ে আরেকটি বই আমাকে মারাত্মকভাবে আলোড়িত করেছিল— ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল।
ইংরেজি টেক্সট বইয়ের বিখ্যাত কবিতাগুলো এবং গল্পগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। আমাদের কলেজে নতুন এক শিক্ষক এসে যোগ দিলেন—অজিত স্যার। স্যারের কবিতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুনতাম মুগ্ধ হয়ে। একদিন জানতে পারলাম আমাদের কয়েকজন বন্ধু অজিত স্যারের বাসায় ইংরেজি পড়তে যায়। আমারও সখ হলো স্যারের কাছে গিয়ে দ্য প্যাট্রিয়ট কিংবা Sands of Dee কিংবা ড্যাফোডিলস সম্পর্কে বিশদ জেনে নেবো। আবার মাদার ইন ম্যানভিল সম্পর্কেও জানার বড় ইচ্ছে জেগেছিল। পিতৃদেবের অনুমতি মিললে অজিত স্যারের বাসার ঠিকানা জেনে সাথে দেখা করলাম। আমাদের পাশের গলিতেই টিনশেড বেড়ার ঘরের সামনে চিকন বারান্দায় লম্বা টুল বিছানো রয়েছে। আমাকে পরদিন সন্ধ্যা থেকে যেতে বললেন। প্রথম দিনের কথা মনে আছে এখনও। আমি দিয়ে দরজায় টোকা দিতে স্যার বেরিয়ে এসে বললেন “অ, এসেছো? বসো।” আমি বসতে না বসতেই স্যার ভেতরে চলে গেলেন। মিনিট খানেক পরে ফিরে এসে আমাকে তিন পৃষ্ঠার একটা হাতে লেখা নোট দিয়ে বললেন “এটা তুলে নাও”। এর পরপরই স্যার অন্দরমহলে তিরোহিত হলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নোটটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। নোটটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দ্য প্যাট্রিয়ট কবিতার বিশ্লেষণ তাতে বিবৃত আছে বটে। কিন্তু আমি তো নোট মুখস্ত করতে স্যারের বাড়ি আসিনি! বসে বসে ভাবতে লাগলাম, “এই নোট লইয়া কি করিব!” অগত্যা বসে বসে তা পাঠ করলাম, কিন্তু লিখে নিলাম না। তারপর, পাঠ্যবই খুলে কবিতাটি পড়ে স্যারের লেখার সাথে মিলিয়ে নিতে থাকলাম। একসময় স্যার এসে বললেন “লেখা শেষ হয়েছে?” আমি বললাম, স্যার আমি তো লিখিনি। আমি তো আপনার কাছ থেকে নোট নিতে আসিনি। স্যারের চোখ যেন কপালে উঠল। এমন কথা স্যার মনে হয় কস্মিনকালেও শোনেননি। বললেন “তো কি জন্যে এসেছো?” আমি একটু ম্লান বিব্রত ভঙ্গিতে বললাম, কবিতা বুঝতে এসেছি। এর গঠন, লেখার প্রক্রিয়া এবং পেছনের কাহিনী বুঝতে চাই।” স্যার এবার বসে পড়লেন। তারপর বললেন “বেশ। তাহলে তুমি একটু দেরি করে এসো। আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ। সবাই চলে গেলে তোমাকে নিয়ে বসবো।” পরদিন থেকে শুরু হলো এক ভিন্নতর পাঠ। স্যারও মনে হলো আমাকে পেয়ে মনের বন্ধ জানালাগুলো খুলে কবিতা ও গল্পের ব্যাখ্যায় মেতে উঠলেন। প্রায় মাস দুয়েক স্যারের বাসায় টানা গিয়েছি। কিন্তু স্যার আমাকে মনে রেখেছেন আজীবন।
ওদিকে, এইচ এস সি পরীক্ষা প্রায় সমাগত — মাস খানেক বাকি। এমন সময় একদিন জানতে পারি, আমাদের প্রায় সব বন্ধুই ইংরেজির জন্যে দাদু’র কাছে পড়ে। আমি বাবার সাথে আলাপ করে বন্ধুদের জানালাম, আমিও দাদুর কাছে পড়তে চাই। ওরা বললো, কাল সকালে দশটার দিকে চলে আয়, আমরা তখন ওখানে থাকব। ঠিকানা জেনে চলে যাই মোমিন রোডের বাড়িটিতে। দেখি পুরনো টিন ছাউনির বেড়ার ঘর। তেমন আলোকিত নয়। একটা খাটের উপর হাঁটু মুড়ে বসে আছেন অনেক বয়স্ক শীর্ণদেহ এক সৌম পুরুষ। চোখ দুটো ছিল উজ্জ্বল, দীপ্তিময়। দাদুর সামনে টেবিল ও টুলে বলে আছে আমারই বেশ ক’জন সহপাঠী। আমি ঢোকার সাথে সাথে বন্ধুদের মধ্যে সাড়া পড়ায় দাদু খাতা থেকে দৃষ্টি উত্তোলন করে আমাকে আগাগোড়া অবলোকন করলেন। তারপর প্রশ্ন, “কি চাই?” আমি বললাম “আমি পড়তে চাই”। দাদু বললেন “তা পড়গে না, আমার এখানে কেন এসেছিস?” বললাম, আপনার কাছে পড়তে চাই। দাদু বললেন আমার এখানে জায়গা নেই। আমি বললাম, আমি একটা টুল নিয়ে আসব।
দাদু বললেন টুল রাখার জায়গা নেই। আমি বললাম আমি জায়গা করে নেব। দাদু বললেন “এহ্, পরীক্ষার বাকি আছে একমাস, এখন আমার কাছে পড়তে এসেছে। পরে খারাপ করলে আমার দোষ দেবে”। এই বলে দাদু কিছুটা বিরক্ত হয়ে নিজের কাজে মন দিলেন, মানে আমার সহপাঠীদের একটু আহে পরীক্ষা নেওয়া খাতাগুলো দেখছিলেন। দেখতে দেখতে ওদের বকছিলেনও। ট্রান্সলেশন ও কমপ্রিহেনশন পরীক্ষায় প্রায় সবাই ভুল করেছে। হঠাৎ কি মনে করে আমাকে বললেন “দেখি, তুই কেমন পারিস?” বলে আমারে সেই কমপ্রিহেনশন ও ট্রান্সলেশন করতে দিলেন। আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা করে দাদুর দিকে এগিয়ে দিলে দাদু দেখলেন, আমি সম্পূর্ণ শুদ্ধ উত্তর দিয়েছি। ভাগ্য ভাল যে তেমন কোন ভুল হয়নি। দাদু আমার উত্তরপত্র দেখে অন্যদের উদ্দেশ্য বললেন, ও আমার কাছে না পড়েই পেরেছে, আর তোরা আমার কাছে পড়েও পারলি না। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর পড়া লাগবে না, যা বাড়ি যা। আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, না দাদু আমাকে আপনার এখানে ছাত্র করে নিতেই হবে। এবার দাদু হেসে বললেন, যা যা, যখন খুশি আসিস, তোকে পড়াব। তার পরদিন থেকে প্রায় প্রতিদিন দাদুর বাসায় যেতাম এবং যতক্ষণ ইচ্ছা থেকে টেস্ট পেপার সমাধান করতাম। দাদু ফাঁকে ফাঁকে আমার ভুল ত্রুটি শুধরে দিতেন। এর মধ্যে জানতে পারি দাদুর স্ত্রী বেলা দি আমার মায়ের স্কুলে শিক্ষিকা ছিলেন। আরও জানতে পারি দাদু অর্থাৎ বিনোদ বিহারী চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অসীম সাহসী যোদ্ধা, সূর্যসেনের সহযোদ্ধা, যার শরীরে এখনও সেই অগ্নিযুগের গুলি লাগার চিহ্ন বিদ্যমান। দাদুর কাছে তাঁর গুলি লাগার কাহিনী যেমন শুনেছিলাম, তেমনি সূর্যসেন ও তাঁদের সেই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের রোম খাড়া করা সব কাহিনীও শুনেছি অল্পবিস্তর। দাদুর কাছে পড়ার জন্যে আমার কোন নির্দিষ্ট সময় ছিল না। আমার ইচ্ছেমতো যেতাম। গিয়ে টেস্ট পেপার সমাধান করতে থাকতাম। দাদুও আমার পারফরমেন্স বেশ তুষ্ট মনে হতো। আমার প্রতি এই স্নেহ ও পক্ষপাতমূলক ভালবাসা আমি তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টের পেয়েছি। আমার পরে আমার ছোটবোন লীনা এবং তারপরে ছোটভাই জিয়াও দাদুর কাছে পড়েছে। ছাত্রত্বের গণ্ডী ছাড়িয়ে কবে আমি দাদুর সাথে এমন ঘনিষ্ট পড়েছিলাম টেরই পাইনি। ছাত্রজীবন শেষ করে পেশাজীবন শুরুর পরেও আমি নিয়মিত দাদুর সাথে দেখা করে আসতাম। শতবর্ষী বুড়োর আমাকে মনে আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে উল্টো প্রশ্ন করতেন, “কবিতা লেখা চলছে তো? জিয়া কোথায় আছে রে?”
যাই হোক, ইংরেজি শিক্ষা বেশ ভালভাবেই চলছিলো। বাংলা নিয়ে আমি তেমন ভাবিত ছিলাম না। কারণ, ওটা তো আমি বানিয়ে বানিয়েই লিখে ফেলবো। কিন্তু একদিন আব্বা ডেকে বললেন, তোদের বাংলার অধ্যাপক তাহের সাহেবের বাসায় গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে দেখা করবি। আমি বললাম, আমার বাংলা পড়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু শোনে কে! আব্বা বললেন, তাহের সাহেব আমার বন্ধু মানুষ। তুই ওনার কাছে সকালে যাবি। অগত্যা শুরু হলো তাহের স্যারের কাছে বাংলা পাঠ। স্যার আমাকে নোট দিতে চাইলেন। আমি নিতে রাজি হলাম না। বললাম, আমি টেস্ট পেপার সমাধান করবো, অথবা, স্যার আমাকে পড়া দিলে সেই মতো পড়া করবো। স্যার আমাকে কোনদিন চিঠি লিখতে দিতেন, কোনদিন রচনা লিখতে দিতেন। আমি মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে দিতাম দীর্ঘ সব চিঠি কিংবা রচনা। লেখার ফাঁকে ফাঁকে ‘কবি বলেছেন’ বলে উদ্ধৃত করতাম নানা মনগড়া কবিতার পংক্তি। এভাবে বেশ চলছিল। স্যারও আমার পড়ালেখায় বেশ খুশি। একদিন চেপে ধরলেন, “এই যে ‘কবি বলেছেন’ বলে যে কবিতাগুলো দিচ্ছ, তা কবিটা কে তার নাম তো দিচ্ছ না? এটা কি কবি জিললুর রহমান?” আমি মাথা নীচু করে মৌনং সম্মতি স্বরূপ বসে রইলাম। ভেতরে ভেতরে স্যার যে মুচকি হেসেছেন, তা টের পাইনি। তবে তিরষ্কৃতও হইনি। স্যার আমাকে নিয়মিত রচনা বা চিঠি বা ভাব সম্প্রসারণ ইত্যাদি লিখতে দিয়ে চলে যেতেন চকবাজার। সেখানে আমার আব্বার সাথে দেখা হতো। দুজনেই বাজার করতে ভালবাসতেন। একদিন আব্বা আমার সামনে আম্মাকে বললেন, তাহের সাহেব বাজারে হঠাৎ আমাকে বললেন, আপনার ছেলেকে বাংলায় অনার্স পড়ান। ওর বাংলার হাতটা খুব ভাল। আম্মা হেসে জিজ্ঞেস করলেন, তা তুমি কি বললে? বাবা বললেন, আমি বলেছি, ছেলে যা পড়তে চায় পড়বে, আমার কোন আপত্তি থাকবে না। আব্বার আপত্তি ছিল না বটে, কিন্তু আব্বা আম্মা দুজনেই আমার ভেতরে রোপন করে দিয়েছিলেন অন্য পেশার স্বপ্ন। তবে, বাংলা আমি অনেক পড়েছি। আমার পছন্দ মতো পড়েছি। ব্যাকরণ থেকে ভাষাতত্ত্ব, তৎসম থেকে তদ্ভব, প্রকৃত থেকে অবহট্ট — কতো রকমের তত্ত্ব তথ্যই না পড়ার চেষ্টা করেছি। চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য থেকে অনুবাদ কাব্য, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ — এসব কিছুই আমি পড়েছি বাংলায়। তবু আমি বাংলায় পড়িনি।
১৩-৩-২২ রাত ৮:৪৫ ইস্কাটন মোড় ঢাকা
কোরাকাগজের খেরোখাতা (পর্ব ২২)
জিললুর রহমান
জিললুর রহমান
নিয়মিত পড়ি৷ লেখক ও সম্পাদক বানান নিয়ে যত্নশীল হোন৷ ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন