বিনবিনে একটা শব্দ উঠছে। একটানা। যেন একই সুর থেমে থেমে গুনগুন করছে কেউ। যেন বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে কেউ। তবে, একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, মন্ত্র নয়। ছড়া। বাঁ হাতের কড়ে আঙুল বাতাসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বহুলপ্রচলিত একটা ছড়া বিড়বিড় করছে মা। “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা…” মনামামাকে ভাইফোঁটা দিচ্ছে মা। প্রতিবারের ছড়ার সাথে ঘি, কাজল, শ্বেতচন্দন, লাল চন্দনের টিপ পরছে মনামামা।
জানালা দিয়ে দেখছে মিনা।
বারো বছর আগে মৃত মনামামাকে ভাইফোঁটা দিচ্ছে মা।
এই মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিনা। দু’পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে সে। মুখ বাড়িয়ে দেখছে। এখন বোধহয় নভেম্বর। শরৎ যাই যাই করছে। হেমন্ত আসবে কিছুদিনে। কিছু বিরাট সম্ভাবনা কাঁধে নিয়ে। কিংবা হতে পারে এখন শ্রাবণের শেষ। কী একটা যেন, কী একটা যেন গন্ধ ছড়িয়েছে বাতাসে।
যেকোনো একটা মাস হতে পারে। ভরদুপুরে নীল রঙের ঝাঁ ঝাঁ আকাশ দেখে কিছু বোঝা যায় না।
মিনা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, সেটাকে রাস্তা বলা যায় না। এজমালি জমি কেটে আলের মতো উঁচু একটা দাগ। গেল বর্ষার কাদা শুকিয়ে ঝুরো ঝুরো হয়ে গেলে কারা যেন একরাশ খোয়া ফেলে গেছে। জমিটার ওপাশে একটা পাড়া গড়ে উঠছে। দুটো, তিনটে বাড়ি উঠছে। সাদাটে সব বাড়ি। ইঁটের লাল বোঝা যায়না। রক্তশূন্য একেকটা হাড়সর্বস্ব বাড়ি দুপুররোদে ঝিকিয়ে উঠছে। তুলনায় মিনাদের বাড়িটা পুরনো। ইঁটের গায়ে স্লেটরঙের প্রলেপ পড়েছে সদ্য। মাটি মাটি দেখতে লাগে। রাস্তার এপাশে তিনটে জানালা পড়ে। খোয়া কাটা রাস্তা দিয়ে লোক যাতায়াত করে, খোলা জানালা দিয়ে তারা ঘর দেখতে পায়। মিনাও এতক্ষণ খোয়া কাটা রাস্তায় খেলছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে নিজেদের ঘরের ভিতরে চোখ গেল। এগিয়ে এল। খুলে রাখা খয়েরি পাল্লা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল, মনামামা এসেছে। হলদে দেওয়ালের বড় ঘরটা ফাঁকা। দেওয়ালঘড়ির জায়গাটাও ফাঁকা। সেখানে আরও একটু হালকা হলদে রঙের বৃত্ত তৈরি হয়ে আছে আর ফাঁকা মেঝেতে প্রদীপ জ্বালল মা। পুষ্পপত্র সামনে রাখল মা। মনামামাকে ভাইফোঁটা দিচ্ছে মা।
মিনার শরীরটা প্যাঁকাটির মতো। গায়ের রং শরতের রোদ্দুরের মতো। ডান চোখের চেয়ে বাঁ চোখ সামান্য বড়। মিনা কী এক অসুখে ভোগে। মাঝে মাঝে খেলতে যায়, মাঝে মাঝে ঘুমোয়, ঘুমোলে ঘুম ভাঙে না দু’দিন। ঘুম ভাঙলে জীবন থেকে দুই দিনের স্মৃতি উধাও।
তবুও মিনা হাসে। থেকে থেকেই হাসে। বড়রা বকে। বলে, ‘বোকা নাকি তুই? বোকারা কথায় কথায় খলবল করে হাসে’। মিনা তা শুনে দু’দিন হাসি কমিয়ে দেয়। তৃতীয় দিনে ফের হাসে।
মিনার কালো রঙের স্কার্ট, নগ্ন পা, মাটিতে মাখামাখি। এতক্ষণ চটি খুলে খেলছিল ব’লে। যেরকম কাদা-মাটি মেখে জালে উঠে এসেছিল মনামামা। তবে, মা বলেছিল ওটা কাদা-মাটি নয়। পাঁক। জল থেকে বেঁচে ফিরতে চেয়ে পাঁক কামড়ে ধরেছিল মনামামা। পাঁক-জল-কাদা, কোনটা কী, আজকাল গুলিয়ে যায় তার।
কালীবাড়ির মেলার মতো ভিড় হয়েছিল পাড়ায়। যেন কারোর আসার কথা। যেন এখুনি আসবে কোনও তারকা। তারকাদের নানারকম ভাগ থাকে। স্টার, সুপারস্টার, মেগাস্টার। মিনা জানে। কিন্তু, সেদিন এরকম কেউ এল না। সবজেটে ত্রিপলে মুড়ে মনামামা এল। লোকজনের ভিড়ের চাপে সিঁড়ির নিচে মনামামার হারকিউলিস সাইকেলটা হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। মিনা ভেবেছিল, মনামামা দেখতে পেলে খুব বকতো।
প্রণাম করার জন্য ডেকে নিয়েছিল মা। পা দুটো যেন বরফ। আর বুকটা যেন ইঁটের পাঁজা। ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিউরে উঠছিল মিনা। আজকাল সে ভাবে, ইঁট না বরফের চ্যাঁই, কোনটা হয়ে গিয়েছিল মনামামা। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। দু’দিন ঘুম ভাঙে না।
এখন মনামামাকে ঘরের ভিতরে ফোঁটা দিচ্ছে মা।
মাঝখানের জানালার গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে রাখে মিনা। দু’হাতে মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখে গ্রিলের কিছুটা অংশ। গ্রিলে কবে যেন লালচে খয়েরি প্রলেপ দিয়েছিল বাবা। এখন ঝুরো ঝুরো জং ধরে, হাত লাল হয়, একটা ঝাঁঝালো সোঁদা গন্ধ টের পায়।
মাঝের জানালা দিয়ে শুধু ঘর নয়, ওপাশের ঘর, এপাশের সিঁড়ির অনেকটা দেখা যায়। মিনা জানালা দিয়ে ঘর দেখবে বলেই এত বড়ো জানালা বানিয়েছিল বাবা। কিংবা, হয়তো ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে ঘর বড়ো মনে হয়, জানতো বাবা।
যেমনভাবে এখন ফোঁটা নিচ্ছে মনামামা, মিনা জানে, আচার-বিধি শেষ হলেই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসবে মা। তারপরে ঘুম না ভাঙার অসুখ একে একে সব খাবে। আলো খাবে, ছাদের আকাশ খাবে, পশ্চিমমুখো দরজা খাবে, উত্তরের জানালা খাবে, পেয়ারা আর নয়নতারা গাছ খাবে, তুলসিমঞ্চও খাবে। অসুখ যেন জলে ডুবতে থাকা দৈত্য। তার যেন বড় বাঁচার তাগিদ। সে আর পাঁক-জল-কাদা-মাটি কিছুই মানে না। সবকিছু কামড়ে ধরে। খেতে খেতে তার পেট ফুলে যায়। তবু সে খায়। বাঁচতে চেয়ে খায়। খেতে খেতে গেরস্থালি শ্মশান হয়ে যায়। নাকভাঙা লক্ষ্মী মূর্তি হাতে নিয়ে মা হেঁটে চলে যায়। কিছু দূর, বহুদূর, আরও কত দূরে যাওয়া যায় ভাবতে বসে মা। আর একে একে সমস্ত আসবাব চলে যাওয়া বাড়িতে হলদে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে একা বসে থাকে মনামামা। খাটের পায়ার দাগসমেত, ঘর-বসতের স্মৃতি নিয়ে ফাঁকা মেঝেয় একা বসেই থাকে মনামামা।
***
খুব জোরালো আলোর নিচে হয়তো আর একটু পরে ঘুম ভাঙবে মিনার। ঘুম ভাঙলে একটা চিৎকারের রোল উঠবে। মিনা জানে। সে দেখবে একের পর এক মুখোশের যাতায়াত। লম্বা করিডোর পেরিয়ে তাদের ব্যস্ত চলাফেরার শব্দ। কোমর থেকে পায়ের পাতা আর সচল হবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আলোচনা। ‘এভাবে কতদিন আর থাকবে’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে কেউ। কারোর কথার মাঝে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নার শব্দ পাওয়া যাবে। কেউ কেউ অযথাই মুখের উপরে ঝুঁকে পড়বে। কেউ কেউ বলবে, ‘জ্ঞান ফিরবে কবে?’
চোদ্দ বছরের মিনাকে দেখতে পেয়ে মিনার এসবে ভ্রুক্ষেপমাত্র থাকবে না। চোদ্দ বছরের মিনা তখন খোয়া কাটা রাস্তায় চটি খুলে খেলছে। খেলতে খেলতে ডানপাশে, নিজের বাড়ির মাঝের জানালায় উঁকি দিয়ে ঘর দেখছে। খয়েরি পাল্লায় একটা টিকটিকি এগিয়ে আসতে আসতে তীব্র টিকটিক শব্দে দেওয়াল বেয়ে দ্রুত ছাদে উঠে গেছে। আজ কাক বসেনি ছাদে। একটাও শালিক নেই আজ। দুপুর-বিকেলের ধুপ-ছায়া আলোয় বারো বছর আগে মৃত মনামামাকে ভাইফোঁটা দিচ্ছে মা। ফাঁকা ঘর, ধু ধু মেঝে থেকে মায়ের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় মিনা। বারো বছর ধরে মনামামা মেঝেয় বসে আছে, বারো বছর আগে ছেড়ে আসা মৃত বাড়িতে এবারে ঢুকবে সে…
জানালা
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সুন্দর গল্প পড়লাম৷ শুভকামনা
উত্তরমুছুনবাহ্ বেশ লাগলো
উত্তরমুছুন