আমাকে ধরেছে উৎপল রোগে : আহা তাঁর এমন দারুণ সব কবিতা— কবিতার ঘোর— আমাকে গাঢ় নেশার দিকে টেনে নিয়ে যায়। বুঁদ হওয়া নেশার ভেতর কবিতারা যেন নারী হয়ে ওঠে : বাইজির মতো নাচে, সেয়ানা প্রেমিকার মতো প্রেমিকের ওপর ছড়ি ঘোরায় কিংবা মাতৃস্নেহে ভরিয়ে তোলে মন।
জলে ডুবে মানুষের চোখ যেমন জলান্ধ হয়, তেমনি উৎপলের কবিতা সমুদ্রে ডুবে আমিও হয়েছি কবিতান্ধ! চারপাশে কিছু নেই— কিচ্ছু নেই আর— কবিতার স্বর ও সুর ছাড়া...
যেন আমার প্রাণ-দেহ-মন বেঁচে আছে কেবল তাঁর কবিতা খেয়ে! কবিতা খাদ্যরূপে পরিপাক হচ্ছে, রেচন হচ্ছে। হৃৎপিণ্ড থেকে সমগ্র শরীরব্যাপী রক্ত নয়, কবিতা প্রবাহিত হচ্ছে; কবিতাই যেন অক্সিজেন! আর আমি কোনও একজন হিম ঋতব্রত থাকছি না, ক্রমেই উৎপল হয়ে উঠছি। আমার ভেতরে বাইরে চারিদিকে কেবল উৎপল উৎপল গন্ধ... লোকে আমাকে চিনতে পারছে না। এমনকি প্রেমিকারা চুমু খেয়ে জিভে ঠোঁটে আমার কোনও স্বাদ পাচ্ছে না। ওরাও নাকি ক্রমশ উৎপলের কবিতা হয়ে উঠছে আর কবিতারা প্রেমিকা। এই ফষ্টিনষ্টি খেলায়— কবিতা-প্রেমিকা, প্রেমিকা-কবিতা সব একাকার হয়ে যাচ্ছে... তারপর এই রোগ ক্রমেই বিছিয়ে পড়ছে একজন থেকে আরেকজনে...
আর উৎপলের অপূর্ব সব কবিতার ভিড়ে, প্রিয় কবিতা বাছাবাছির জার্নিতে— আমি ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’, ‘পুরী সিরিজ’, ‘আবার পুরী সিরিজ’, ‘লোচনদাস কারিগর’, ‘খণ্ডবৈচিত্রের দিন’, ‘সুখ দুঃখের সাথী’ ইত্যাদি পেরিয়ে থামব না থামব না করেও থেমে যাচ্ছি— থামতে হচ্ছে ‘সলমা-জরির কাজ’ এর কাছে এসে। আহা এই ‘সলমা-জরির কাজ’— যেন অবধারিতভাবেই আমার এইখানে থেমে যাওয়া...
সলমা-জরির কাজ ৭বন্ধু, তোমার হাতের উপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা-বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।
আহা! এই শান্ত স্নিগ্ধ ঝর্ণা জলের মতো গড়িয়ে যাওয়া, হৃদয়কে ছুঁয়ে যাওয়া! খুব সাধারণ হয়েও কত গভীর গর্ভের দিকে ছুটে যাওয়া! অথবা কিছুই জানি না, কী এক প্রবল আকর্ষণ শক্তি রয়েছে এর ভেতর। এজন্যই তাঁর এত এত চমৎকার কবিতার পরও মনে হয়, কেবল এই একটি কবিতা দিয়েই অনেক পাঠকের পক্ষে তাঁকে মনে রাখা সম্ভব!
অথবা অন্ধীর গানের কথাই ধরা যাক—
অন্ধীর গানলাল পিঁপড়ে কালো পিঁপড়ে গায়ে জল ঝরছে স্নানের শেষে গামছাচেপা জল পড়ছে তাদের সারে উঠোনে ছিল কাপড় মেলা তুলতে গিয়ে তাকিয়েছিলাম একলহমা গ্রহণ-লাগা সূর্যপানে অন্ধ হল দু-চোখ আমার কাঙাল কানি মাগীর ভাগ্যে ছিল এ-সব লেখা বাঁশবাগানে কে চলেছ চুপিসারে চোর নাকি গো নাকি আমার চোরাই নাগর নাকি লাল পিঁপড়ে কালো পিঁপড়ে।
আহা! উৎপলের এই বলা, আমাদের মগজে ও হৃদয়ে দৃশ্যমান করে তোলে এক অমোঘ গ্রহণ লাগাকে, আমরাও দেখি লাল পিঁপড়ে ও কালো পিঁপড়ে হয়ে যায়— কাঙাল কানি মাগী ও চোরাই নাগর; আর তাদের চারপাশে বিছিয়ে থাকা মোলায়েম বিছানার মতো বাঁশবাগান...
কিংবা রাক্ষসের কাছেই আসা যাক—
রাক্ষসসেদিন সুরেন ব্যানার্জি রোডে নির্জনতার সঙ্গে দেখা হল।তাকে বলি এই তো তোমারই ঠিকানালেখা চিঠি, ডাকে দেব,তুমি মনপড়া জানো নাকি? এলে কোন্ ট্রেনে?আসলে ও নির্জনতা নয়। ফুটপাথে কেনা শান্ত, নতুন চিরুনি।দাঁতে এক স্ত্রীলোকের দীর্ঘ, কালো চুল লেগে আছে।
উৎপলের এ সমস্ত কবিতার রাক্ষসেরা আমাকে গিলেছে, আমিও ওদের গিলেছি আপন অভ্যন্তরে... আর এই গেলাগেলি স্বভাবে আমার হয়েছে ভীষণ ভয়ানক এ-ই রোগ। যাকে বলে, উৎপল রোগ : ভেতরে উৎপল উৎপল গন্ধ...
উৎপলকে নিয়ে লেখা বড় ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনউৎপল রোগ : ভেতরে উৎপল উৎপল গন্ধ... ভালো লেখা।
উত্তরমুছুন