ভূত
অমিতরূপ চক্রবর্তী
অমিতরূপ চক্রবর্তী
রমেন আচার্যির ভূতে ধরার গল্পটা চারপাশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে, মনে হবে এই অঞ্চলটা বড় বড় গাঢ় পাইনের বনে ঢাকা পড়ে গেছে। ধূসর নীলাভ কুয়াশা দিনভর বাতাসের পিঠে চড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই মনুষ্যহীন তুষারপাত হচ্ছে। ডোবা, পুকুরের জল আর জল নেই যেন আয়নার কাচ। লম্বা লম্বা রাস্তাগুলো যেন ঘড়িয়ালের পিছল পিঠ।
আক্রমই প্রথম ভূতের থিয়োরিটা খাড়া করে এবং নিমেষেই সেটা একটা সার্বজনীন মতবাদ হয়ে ওঠে। হাটে, টিনের চালা দেওয়া গুবরে চা-দোকান, মুদিখানার বারোয়ারি বেঞ্চ, বয়সের গোটা ওঠা অশ্বথ গাছের নীচে দেয়ালমুক্ত সেলুনে আক্রমের ভূতের থিয়োরি মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। তারপর সেই ভূত হানা দিল সবার ঘরের অন্দরে। খোলা জানালার কাছে চুলা জ্বালিয়ে ভাত- তরকারি রাঁধার সময়, গোয়ালঘর পেরিয়ে, পঞ্চজবা গাছ পেরিয়ে যখন ছোট শৌচ করতে যাবার প্রয়োজন হল বা ঢালু পাট খেতে গিয়ে ভৌমিক বাড়ির কলেজে-পড়া ছোট মেয়ে অতসীর তার প্রেমিক সুখময়ের সঙ্গে দেখা করার আগে বুক ঢিবঢিব করা শুরু করল বা নীলকমল বৈরাগীর খঞ্জ মা বারান্দায় বসে ষাট পাওয়ারের আলোর মধ্যে হাতের পেয়ারা ডালের লাঠি উঁচিয়ে ভূত তাড়াতে আরম্ভ করল এবং ফোঁকলা মুখে অজস্র গালিগালাজ দিতে লাগল, তখন আক্রমের ভূতের থিয়োরি এই অঞ্চলে একটা গুরুতর মতবাদ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল।
নারায়ন পুজো সেরে রমেন আচার্যি মূল রাস্তা দিয়ে না এসে ভুট্টার খেতের পাশে ছেঁড়া শাড়ির পাড়ের মতো যে রাস্তা, যার ওপর হুমড়ি খেয়ে আছে অশুচি সব বাঁশঝাড়, সেই রাস্তা দিয়ে কেন বাড়িতে আসতে গেল, কেনই বা তখন ধুতিটাকে খুলে শুধু গামছা পড়ে সাইকেল চালাতে গেল- সে প্রশ্নের উত্তর এলাকার কারও কাছে নেই। রমেন আচার্যির বডিটা পাওয়া যায় ওই ভুট্টাখেতের ধারেই। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছিল বলে ভুট্টাখেতে বেশ ছপছপে জল জমে আছে, সেই জলের মধ্যে রমেন আচার্যির হোৎকা, নাদুসনুদুস নরম বডিটা উপুর হয়ে পড়েছিল। গামছা ভিজে সপসপে হয়ে পাছার সঙ্গে লেপে ছিল। ফলে তার আড়াল সত্তেও রমেন আচার্যির কালো দানাদার হাঁড়ির মতো পাছার তাল জোড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মরা সাপের মতো পৈতেটা লেপ্টে ছিল রমেনের সোহাগী পিঠে। সাইকেলটা রমেনের পাশেই। হ্যান্ডেল দুটো আকাশের দিকে। সামনের চাকাটা কেতরে আছে।
থানা থেকে পুলিশ এসে ডায়রি বানিয়ে ডেডবডি সৎকারের জন্য বলে গেল। গা- গেরামে আকছার এমন মৃত্যু হয়। বাজ পড়ে মরা, সাপে কেটে মরা, বমি- পায়খানা হয়ে মরা, সবেরই কি ময়নাতদন্ত হয়? না হওয়া যুতসই? সুতরাং তাই থানার ইনভেস্টিগেটিং অফিসার একটি নাকে নোলক-পড়া রোদোজ্জ্বল দিনে দাঁড়িয়ে প্যান্টের কোমর টেনে ওপরে ওঠাতে ওঠাতে চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষজনদের উদ্দেশে বললেন ‘মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন নেই। বডিটা তাড়াতাড়ি পুড়িয়ে ফেলুন।‘
চা দোকানের আঁশ তোলা কাঠের বেঞ্চে বসে ফুঁ দিয়ে গরম চা খেতে খেতে গোস্বামী হড়হড় করে হাসল। বলল ‘পুলিশ পুলিশের মতো ভাবে। হার্ট অ্যাটাক ওদের বই- পুস্তকের কথা। মনে নেই, ওই যে একবার দাসদের কুয়োয় একটা মেয়েছেলে পড়ল, পুলিশ এসে কুয়োয় না নেমেই উঁকি দিয়ে বলল ‘সুইসাইড’। আরে কুয়োয় না নামলে কি বোঝা যায় আসল ঘটনাটা কী? ও তো ছিল দাসপট্টির নচ্ছার মাগিটা! ওকে নিশ্চয়ই কেউ ঠেলে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল। শুনতাম ফষ্টিনষ্টি করে ও লোকের কাছ থেকে টাকা চুষত।‘
গোস্বামীর চেহারাটা অনেকটা হাড়গিলে মুরগির মতো। তার ধূপকাঠির ব্যবসা। দুই ছেলেকে নিয়ে নিজে বাড়িতে কাঁচা ধূপ তৈরি করে, তারপর সপ্তাহে তিনদিন তিনটি হাটে ফেরি করে। গোস্বামীর স্ত্রী বহুদিন আগে জন্ডিসে ভুগে মারা গিয়েছে। দেয়ালে কাত হয়ে থাকা একটি সাদাকালো ধুলিমলিন ছবি ছাড়া আর কোনো ছাপ এখন নেই তার নিজের সংসারে। বেঁচে থাকতে সে ঢেঁকিশাক তুলে আশেপাশের বাড়িতে ফেরি করত। কাঁচা সুপারি দিয়ে মৌজ করে পান খেত। স্বামীকে সুপুরিকাটার জাঁতি দিয়ে পেটাত।
গাল-কাটা টেঁরা সুবল গোস্বামীর পাশে বসেই চা শেষ করে বাঁ হাতের তালুতে ঘষে ঘষে খৈনি বানাচ্ছিল। খৈনি বানানোর জন্য সুবলের বাঁ হাতের তালুর কররেখা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খৈনি ডলা শেষ করে তিনবার তাতে থাপ্পড় দিয়ে একটিপ খৈনি হাড়গিলে গোস্বামীর হাতে দিয়ে বলল ‘তোমার কথা কী? রমেন আচার্যিকে কে মারল?’
গোস্বামী বুড়িয়ে যাওয়া সাদা- গোলাপি জিভ দিয়ে থুথুতে জবুথুবু হওয়া খৈনির তালটাকে মাড়ির গা ঘেষে ঠিক ঠিক জায়গায় বসিয়ে একবার থুথু ফেলে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল ‘আক্রমের কথাই ঠিক। রমেন আচার্যিকে অশৌচে পেয়েছিল। হারামজাদারা দু- একটা বুলি শিখেই মাতবরি করে। পুজো- আচ্চা অতো সোজা? শালারা জানে কিছু?
আক্রমের একটা চাটাইয়ের বেড়া দেওয়া তিন কেবিনওলা ধাবা আছে বড় রাস্তার পাশে। একটা খাটিয়া সারা দিন পাতা থাকে বাইরে দারুণ রোদের মধ্যেও। আর একটা ময়লা, তেলচিটে খাটে বসে আক্রম খদ্দের না থাকলে পেঁয়াজ কাটে। রসুনের খোসা ছাড়ায়। এক পায়ে খাঁটো একটা মেয়েছেলে খাটে এই ধাবায়। খদ্দের এলে গরম খাবার আক্রম নিজে বানিয়ে দেয়। কাউন্টার বলতে ভেতরে তিন থাক দেওয়া একটা টেবিল। যার বাইরে একটা ঠাণ্ডা পানীয়ের গরম বিজ্ঞাপন। গরম এই কারণেই যে, যে সুন্দরী মুখ উঁচু করে ঠাণ্ডা পানীয় খাচ্ছে, তার স্তনের খাঁজ দেখা যাচ্ছে। আনোয়ার বলে বদমাইশ ছেলেটি, যে লরিতে নদী থেকে বালি ওঠাতে যায়, ও দুটি স্তনের বোঁটার জায়গায় পেরেক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফুটো বানিয়েছে।
আক্রমের টেবিলের ভেতরে তিন থাকে থাকে রামের বোতল, কড়া ভুটান মদ, একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বিলাতি মদ আর মাথায় রাংতার টুপি পরানো বিয়ারের বোতল। অনেক খদ্দের মদ বা বিয়ার খাবার জন্যেই আসে। এইসব খদ্দেরদের জন্য একটা স্পেশাল ঘুগনি বানায় আক্রম। ঝালে শিসাতে থাকে খদ্দেররা। চোখ দিয়ে জল গড়ায়। আক্রমকে দেখতে পেলে জলাকার চোখ নিয়েই হাসে। আক্রম বোঝে খদ্দেররা খুশি।
এই আনোয়ার একদিন একটা কাণ্ড করেছিল। আক্রমের দোকানের পেছনেই একটা ডোবা। সেদিকে শিলপাটার মতো করে একটা বড় পাথর ফেলা। সেখানে বসেই পায়ে খাঁটো মেয়েছেলেটা বাসন মাজে, চাল ধোয়। কাটা মুরগির পালক ছাড়ায়। মুরগির গলাটা অবশ্য কচ করে কেটে দেয় আক্রম। তারপর দাবড়াতে থাকা ধরটা মেয়েছেলেটার হাতে দেয়। ও-ই তারপর গলা চেপে ধরে দাবড়ানি থামিয়ে মুরগিটার গা থেকে ছাল- পালক খসিয়ে কেটে ধুয়ে ফেলে। আগে আক্রম মুরগির নলি লক্ষ্য করে দাঁ ওঠালেই মেয়েছেলেটা চোখ বুজত। এখন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে।
মেয়েছেলেটা ডোবার পাশে সেই পাথরটায় বাসন রেখে ধুচ্ছিল। ডোবার ওপারে বাড়ি আছে। বাড়ির কলাগাছের ছায়া শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও দিকটায়। আনোয়ার করেছিল কি, ডোবা ঘুরে ওই পাশটায় গিয়ে, ঠিক যেখানে মেয়েছেলেটা বসে বসে বাসন ধুচ্ছিল, ঠিক তার সই সই দাঁড়িয়ে নুনু দেখিয়ে দেখিয়ে পেচ্ছাপ করেছিল। মেয়েছেলেটা সেটা দেখেই বাসন ধোয়া ফেলে উঠে এসে আক্রমকে সব বলে দিয়েছিল। আনোয়ারকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরেছিল আক্রম। আগুনের মতো গনগনে হয়ে ওঠা গালে হাত বুলোতে বুলোতে অদ্ভুত বিস্ময়ে আক্রমের দিকে তাকিয়েছিল আনোয়ার। তারপর থেকে ও আর আক্রমের ধাবায় আসেনি। আর এখন তো ও আর এদেশেই থাকে না। অনেকদূরে, আক্রমের কল্পনারও বাইরে কোন এক জায়গায় কাজ করতে গেছে। তাও নাই-নাই করে চার বছর হতে চলল। আনোয়ারের ফুটো-করা স্তন নিয়ে সেই সুন্দরী এখনো আক্রমের ক্যাশ টেবিলের বাইরে নিশ্চিন্তে ঠাণ্ডা পানীয় খেয়ে যাচ্ছে।
ফিকে বেগুনি বেগুনি ধোঁওয়ার মতো বিকেলে অফিসবাড়ির চৌকিদার সুলেমান খাটিয়ায় বসে চুপ করে মদ আর চানা ভাজা খাচ্ছিল। রমেনের শ্রাদ্ধকর্ম হয়ে গিয়ে প্রায় দশ দিন পেরিয়ে গেছে। সুলেমান রাস্তার দিকে চোখ রেখে কয়েকটা চানা মুখে ছুড়ে দিয়ে বলল ‘আক্রমভাই, আমার মনে হয়, রমেন ঠাকুরকে কোনো মেয়ে ভূতে মেরেছে।‘
আক্রম খাটে বসে গামছা থাই অবধি তুলে আদা কাটছিল। বলল ‘কী করে জানলি?’
সুলেমান কেমন একটা বাদামি বাদামি চোখে আক্রমের দিকে চেয়ে থেকে বলল ‘মানুষটা ধুতি খুলে গামছা পড়বে কেন?’
-‘ধুতি পরে সাইকেল চালাতে তো অসুবিধেই হয়। চাকার স্পোকে বা চেনে লেগে ধুতি ছিঁড়তেও পারে। সে জন্য ধুতি পাল্টে গামছা পরেছিল।‘
-‘উঁহু, ধুতি ছিল বাঁশঝাড়ে। পরিষ্কার ফনফনে ধুতি। নিচু কয়েকটা কঞ্চিতে ঝোলান।‘
-‘এতেই প্রমাণ হয় রমেন ঠাকুরকে মেয়ে ভূতে মেরেছে?’
-‘ভূত নয় আক্রমভাই, মেয়ে জ্বিন, ওদের শরীরের খাই থাকে। ডবকা মেয়েলোকের চেহারা ধরে রমেন ঠাকুরকে ধরেছিল। রমেন ঠাকুরের ধুতি খুলে নিয়েছিল, তারপর রমেন ঠাকুরকে নিয়ে শোবার আগে গা থেকে যখন ফুল- চন্দনের গন্ধ পায়, পৈতের ছ্যাঁকা লাগে, তখন রাগে রমেন ঠাকুরের ঘাড় মটকে পালায়।‘
-‘তোর যত বাল-ছালের কথা।রমেন ঠাকুর যে কারো সঙ্গে শুতে যাবে কেন? ওর ঘরে বউ আছে না?’
-‘ওরকম বউ থাকলে সবাই যার-তার সঙ্গে শোবে। বারো মাস হাঁপানি আর ছুঁচিবাইপনা। এক ট্রিপ মারলে ও-ও নিজে দশবার চান করবে, রমেন ঠাকুরকেও চান করাবে। বিছানার চাদর পাল্টাবে। তুমি কি মনে কর, রমেন ঠাকুর এইসব জিনিস ঠিকঠাক পেত বউয়ের কাছ থেকে? পুরুষ মানুষের একটা ক্ষিদে আছে না?’
আক্রম এরপর কিছু বলে না। চুপচাপ আদা কাটতে থাকে। রমেন ঠাকুরকে যে ভূতে মেরেছে, এ কথা আক্রম মনে- প্রাণে বিশ্বাস করে। ভুট্টাখেতের পাশে যে রাস্তা দিয়ে রমেন ঠাকুর সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল, তা যে অশৌচ রাস্তা, সেটা সবাই জানে। ওই রাস্তায় রাতে কুকুর- বেড়ালও যায় না। রমেন ঠাকুরের মুখ দিয়ে সাদা সাদা গ্যাঁজলা বেরিয়ে চিবুকের কাছে এসে শুকিয়ে ছিল। অশৌচ সাক্ষাতেই এটা হওয়া সম্ভব। মেয়ে ভূত, জ্বিন-টিন এসব কিছু না।
আক্রম কী একটা টের পেতেই তাকিয়ে দেখল, প্রায় হাত তিনেক দূরে পায়ে খাঁটো মেয়েছেলেটা আঁচলে গরম চায়ের গ্লাস ধরে তীক্ষ্ণ মুখে সুলেমান আর তার কথাবার্তা শুনছে। মেয়েছেলেটার ছিপছিপে গড়ন। পেটের নাভি দেখে মনে হবে শুকিয়ে যাওয়া কিসমিস। গলা, হাতের চামড়া ধারালো টিনের মতো। কাঁচি দিয়ে কাটা কাগজের মতো পাতলা, ছাই ছাই ঠোঁট। অ্যাতোক্ষণ ভূতের কথা বলার জন্যই হয়তো- বা আক্রমের গা- টা কেমন শিরশিরিয়ে উঠল।
প্রায় তখনই একটি মাল বোঝাই ভোঁতা মুখের লরি গজরাতে গজরাতে কেমন নির্বোধের মতো পাকা রাস্তা দিয়ে কোথাও চলে গেল।
২.
পূব পাড়ার শচীনের একটা প্রচলিত নাম আছে। নামটি হল ‘ছ্যাপচাটুয়া’। অর্থাৎ থুথু ফেলে আবার চেটে খেয়েছে। এই নামকরণের কারণ হল, শচীন ছোটবেলায় নাকি মানুষের ছ্যাপ বা থুথু চেটে খেয়ে নিত। কথিত আছে, ব্যাপারটি রীতিমতো উত্তেজনাপূর্ণ একটি জনপ্রিয় খেলায় পরিণত হয়েছিল। হয়তো কয়েকজন এক সঙ্গে হয়ে শচীনকে ডেকে নিয়ে বলত ‘পয়সা দেব, ছ্যাপ চাট দেখি, কেমন পারিস!’ বলেই ওই দলের সবাই মাটিতে, ধুলোয়, ঘাস- পাথরে ছ্যাপ বা থুথু ফেলত আর লিকলিকে শচীন এক অদ্ভুত প্রাণির মতো হামাগুড়ি দিয়ে সেই থুথু চাটতে চাটতে হাঁফিয়ে পড়ত। কখনো প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠে শচীনকে নিয়ে রীতিমতো গোল হয়ে দুনিয়ার মানুষ দাঁড়িয়ে থুথু ফেলে মজা উপভোগ করত। কয়েকজন তো সেখানে আবার এন্ট্রি ফি নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। শচীনের বাবা অন্যের জমিতে হাল দিত। ছেলের এই কাণ্ডকীর্তি শুনে জুতো পেটা করার জন্য শচীনের পেছনে ছুটতে গিয়ে একদিন গাই বাঁধার দড়িতে আটকে, আছাড় খেয়ে পড়ে মারা গেল। শচীনের বয়েস তখন বারো। এই দোষে ইস্কুল থেকেও রাস্ট্রিকেট করা হয়েছিল শচীনকে।
তারপর বহু দিন, বহু ঋতু, বহু মরশুম পেরিয়ে গেছে। শচীন লায়েক হয়েছে। নিজের জমিতে পানের ব্যবসা শুরু করেছে। পুরোনো মানুষ মুছে গিয়ে নতুন নতুন মানুষের আমদানি হয়েছে চারপাশে। তবে ওই যে, জন্ম- মৃত্যুর অতীত এক ভূতের মতোই শচীনের সেই নামটা মানুষের ভাঁজে ভাঁজে, দোকানের দেওয়ালের পেছনে, চক্রবর্তী হোটেলের মাথায় যে গনেশের মূর্তি, যাতে চক্রবর্তীরা রোজ দোকান খোলার পর ধুনো দেয়- সেই গজাননের পেছনে ঝুলের মধ্যে, অন্ধকার মাঠের জোনাকির মধ্যে, এখনো রয়ে গেছে।
পদমতী পান ভাণ্ডরের সামনে শচীনের দেখা পাওয়া যায় ঠিক সন্ধের মুখে মুখে। যখন সব দোকানের বিত্তবান, নিম্নবিত্ত বা হতদরিদ্র আলোগুলি জ্বলে উঠে কেউ হাতের পেশীর সাহায্যে, কেউ অনুরোধ করে গায়ে পাখার বাতাস দিতে দিতে অথবা কেউ পায়ে ধরে কাকুতি- মিনতি করে চ্যাপ্টা, আঠালো অন্ধকারটাকে তাড়িয়ে দিতে থাকে। শচীন আসে সদ্য চান করে, গায়ে- বগলে পাউডার ছড়িয়ে। সোজা সোজা চুলগুলোকে শচীন যতোই তেল দিয়ে কাবু করে মাথার খুলির সঙ্গেঁ সাঁটিয়ে আচড়াক না কেন, পদমতী পান ভাণ্ডারে আসতে আসতে ওর চুলগুলো আবার লম্বা ঘাসের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পদমতী পান ভাণ্ডারে এসে প্রথমেই শচীন গাল ভরা একটি সরস পান খায়। পিচকিরির মতো করে কয়েকবার পিক ফেলে। তারপর যেন জীবনে ফিরে আসে। লাল, ভেজা টুকটুকে ঠোঁট নিয়ে দেশ- কাল, দুনিয়াদারির চালচিত্র নিয়ে কথা বলে।
গোস্বামীকে আসতে দেখেই শচীন চেঁচিয়ে বলে ‘চুতমারানি মামু, যাও কোথায়?’
অন্য কেউ এ কথা বললে গোস্বামীর তর্জনীর ইশারায় চারপাশে প্রলয় এসে যেত। বক্তাটি শচীন বলেই তেমন কিছু ঘটল না বা ঘটে না। কারণ গোস্বামী মাঝে মাঝেই প্রয়োজন পড়লে শচীনের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। তাই শচীনের ব্যাপারটা আলাদা।
ছাড়ার পাত্র গোস্বামীও নয়। সে বলে ‘দুস শালা, ছ্যাপচাটুয়া!’
পদমতী পান ভাণ্ডারের সামনে সিমেন্টের ঢালাই থেকে মাটিতে হেলে থাকা একটি কাঠের বেঞ্চ। শচীন হাত ধরে সেখানে টেনে বসায় গোস্বামীকে, নিজেও বসে।
-‘ভূত তাড়াতে পার নাকি শুনলাম!’
শচীনের কথায় একটা বদ রসিকতার গন্ধ পেয়ে গোস্বামী চোখ দুটো ছোট ছোট করে মুখের ভাঁজ পড়া চামড়া টান করে সময় গোনে।
-কী চুতমারানি মামু, ভূত তাড়াতে পার?
-‘কাকে ভূতে ধরল? তোমাকে?’
শচীন চোখ সরু করে গোস্বামীর মুখে খানিকটা জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলল ‘কেন তোমাকে ধরে না? নিশুতি রাতে? যখন ঘুম আসে না, বাঞ্ছার ঘরে যখন ভূতের শব্দ পাও?
-‘দুস শালা, ছ্যাপচাটুয়া!’
-‘তোমাকে বুড়ো ভাবলে কী হবে, তুমি একখানা যন্ত্র! কী যে শালা তুমি কীর্তন কর, তা তো আমি জানি। গলার রগ ফুলিয়ে হরিনাম ধরো আর শালা তোমার দৃষ্টি তো থাকে মেয়েমানুষগুলোর তলপেটে আর পাছায়! রাতে সেসব মনে করে দাঁড়ায় না তোমার? দাঁড়ায় তো ঠিকই, কী করে ওই ভূত তাড়াও? বাঞ্ছার বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মার নাকি?’
-‘দুস শালা, ছ্যাপচাটুয়া!’
বলল বটে গোস্বামী, কিন্তু মনের ভেতরে একদলা লাল রক্ত এসে জমাট বাঁধল। খুব তো মিথ্যে বলেনি ছ্যাপচাটুয়া শচীন। মাঝে মাঝে রাতে অদ্ভুত গরম বোধ হয় এখনো। রাতের কালো বাতাসে কী সব ফুলের গন্ধ চিৎকার করে ছোটে। আর মেলায় যে দোকানিরা পাম্পার দিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অবাক করে লাল- নীল- হলদে সব নেতিয়ে থাকা, চিপসে থাকা সাপবেলুন লকলকে করে ফুলিয়ে দেয়, সেভাবেই যেন তার জিনিসটিও মুতের গন্ধ ভরা লুঙ্গির ভেতর থেকে সোঁ সোঁ করে বেড়ে উঠে আকাশ সমান হয়ে যেতে থাকে। তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। ম্যাড়মেড়ে একটা শরীরের কথা মনে পড়ে। স্বাদ ফুরিয়ে যাওয়া মাংসের কথা মনে পড়ে। বড় সাঙ্ঘাতিক এই ভূত। আত্মার যেন টুঁটি চেপে ধরে। দিশেহারার মতো লাগে। তখন মনে হয়, ম্যাড়মেড়ে হোক, মাংস যতোই বিস্বাদ হোক, ছিল তো, ছিল তো একটা আশ্রয়। মাথা- মনের এই ভয়ঙ্কর ভূতকে নামিয়ে রাখার মতো একটা সম্পুট। শান্ত থাকার মতো একটা ঠাণ্ডা চন্দনের প্রলেপ। লণ্ঠনের আলোয় একটা পানপাতার মতো সরল মুখ সে-ই তো প্রথম দেখেছিল। কত যুগ আগের কথা। তখন এই যে অ্যাতো বাড়িঘর, দালানকোঠা, ঝকঝক করে জ্বলা বিজলি আলো, এই যে সব পয়সা কামিয়ে এক একটা কোলাব্যাঙ হয়ে ওঠা মানুষ, কোথায় ছিল তারা? সন্ধ্যেয় শাঁখে ফুঁ পড়তে না পড়তেই শেয়ালের ডাক শোনা যেত। ভূতের চোখের মতো দূরে দূরে কাশ আর কাঁধ সমান উঁচু জংগলের ফাঁকফোকর দিয়ে চোখে পড়ত কেরোসিনের আলো, তখন যেন এই ভূত ছিল না। এমন বেয়াদপ অত্যাচার ছিল না। জীবন ছিল দীঘির জলের মতো শীতল, গভীর।
বাঞ্ছার ঘরে উঁকিও দিয়েছে সে। না দিয়ে উপায় ছিল না। মাটিতে নামানো কুপির ভূতুড়ে আলোয় দুটো মানুষের মাখামাখি দেখতে দেখতে তার সাপবেলুনের মতো লম্বা হয়ে যাওয়া জিনিসটা ফাটিয়ে ভেতরের সব পিচ্ছিল শিরা, পুঁজ, রক্ত বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইত যেন। হরিনাম, আকাশের ফালি চাঁদ, জ্যোৎস্নার ধুলো-জমা রাস্তা বা রাতের সর্বতাপহন্তারক শতহস্তের বাতাসও এই ভূতকে ছুঁতে পারে না। তাদের এই ল্যাজে- গোবরে অবস্থা দেখে ভূতটা যেন আরও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
গোস্বামী ভাবে তার এই গায়ে ধস-আসা বয়সে এসব কী উপদ্রব! ছেলেরা সমর্থ হয়েছে। এখন ওদের সংসার করার সময়। হরিদাস চাটুজ্জে মশাই যেমন হরিসভায় বলেন ‘মায়ার সংসার! মায়া ছিন্ন করতে হয়! মনে বৈরাগ্য আনতে হয়! হরিনামে ডুব দিতে হয়। কিন্তু সে বড় কঠিন সাধনা! কামকে হরিপ্রেমে ঢালতে না পারলে কীসের আর হরিসাধনা?’
-‘কী ভাব চুতমারানি বুড়ো?’ শচীন বলল।
-‘দুর, ছ্যাপচাটুয়া! তা তোমার ভূত কি পুরুষ না মেয়েলোক?’
শচীন ছুঁচোর মতো চোখ পিটপিট করে বলল ‘তোমারও যা, আমারও তাই! তোমার বাঞ্ছার ডবকা বউ আর আমার এক কমবয়েসি ছোকরি।‘
শচীনের এই কথায় গোস্বামী থরথরিয়ে কেঁপে উঠল যেন। মনে হল, শচীনের এই কথা এই সন্ধ্যের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ফচকে কোনো ভূত সুন্দর ফ্রেমে বাঁধিয়ে গবেট আর মাথামোটা বাঞ্ছার কানে পৌঁছে দিচ্ছে! বাঞ্ছার হাতে ঝকঝক করছে একটি কুড়ুল। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ ভিড় করেছে তার বাড়িতে, যেখানে মাথা-ফাঁক-হওয়া তার নিথর হাড়গিলে দেহটা পড়ে আছে। ছেলেদুটো মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে তার বউয়ের মতোই রোগা, যত্নহীন পেয়ারা গাছটার নীচে।
হায় হরি!
৩.
দোকান বন্ধ করে পাট খেতে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগে না সুখময়ের। এই ব্যাপারটায় খুব ঝুঁকি আছে। পাট খেত তো নামেই পাট খেত। আসলে এখন সেটা ডোবার মতো নিচু জমি। জমিটা মোদকদের। জমি থেকে উত্তরে তাকালে মোদকদের দোতলার আলো, বারান্দার জালি দেখা যায়। ওখান থেকে কেউ এ দিকটায় নজর দিলে সহজেই দেখতে পাবে, পাটখেতের নাবাল জমিটায় একটা মনুষ্যমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। সুখময়দের সারের ব্যবসা। বেশ ছড়িয়ে পড়া ব্যবসা। আশেপাশের অনেক ছোট দোকানি তাদের কাছ থেকে মাল নেয়। তাছাড়া ওদের একটা অর্গানিক ফার্মও আছে। সেখান থেকে টেম্পো, ট্রাক্টার করে বোঝাই বোঝাই গোবর সার নানা জায়গায় যায়।
প্রতি বছর বসন্ত পূর্ণিমায় তাদের পারিবারিক রাধাকৃষ্ণের পুজো এ এলাকায় নাম করা। সুখময়ের প্রপিতামহের আমল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে। শোনা যায়, সুখময়ের প্রপিতামহ একদিন ভোর রাতে নূপুরের নিক্কণ শুনতে পান। তখন এইসব জায়গায় বিদ্যুত আসেনি। বাসরাস্তাও তৈরি হয়নি। ধানিজমির মাঝে পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে কয়েক মাইল এগিয়ে বাস ধরতে হত। সুখময়ের প্রপিতামহ হাতে কুপি নিয়ে দরজার আগল খুলে বেরোন। বাড়িতে ধান- পাটের গোলাঘর ছিল। গোয়াল ছিল। পেটের টানে অনেকেই চুরি- ছ্যাঁচড়ামিতে হাত পাকিয়েছিল। সেদিন বসন্ত পূর্ণিমা আসতে ক’দিন বাকি আছে। বাড়ির গোয়ালের পেছনদিকে কয়েকটা গাছে হলুদ ফুলের বন্যা এসেছে। কেমন যেন মনখারাপ-করা গন্ধ সেসব ফুলের। নিকোনো উঠোনে ফিকে জ্যোৎস্না পড়েছে। ‘কে, কে কী করে’ বলে তিনি নাকি হাঁক দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি নাকি চকিতে দেখতে পান গলায় শুভ্র মালা আর নীলাম্বরি ঘাগরা পরা এক ছায়ামূর্তি যেন ছুটে দেউড়ির দিকে বেরিয়ে গেল। তারপরেই তিনি আশ্চর্ষ একটি গন্ধ পান এবং তাঁর বহু পুরোনো হাঁটু আর কোমরের শূলযন্ত্রণা উধাও হয়ে যায়। বেলা বাড়তে গোয়ালের পরিচারক কালিপদ একটি ময়ূরপুচ্ছ উঠোনে তুলসীমঞ্চের কাছে কুড়িয়ে পায়। তারপরেই সেই বসন্ত পূর্ণিমায় সুখময়ের প্রপিতামহ কয়েকদিনের মধ্যে সেই তুলসীমঞ্চের পাশে মন্দির ও রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করে শুরু করেন এই পুজো। দূর দূর গ্রামের কোনো বাড়িতে টানা তিনদিন উনুন ধরানো হয়নি। শোনা যায়, সেই পুজোর অঞ্জলিপুষ্প মাথায় ঠেকিয়ে, প্রসাদ খেয়ে বহু লোকের কঠিন কঠিন অসুখ-বিসুখ সেরে গিয়েছিল।
সুখময়ের বাবা দিনের দ্বিতীয়ার্ধে দোকানদারি করে সন্ধে ছ’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর দোকান বন্ধ হওয়া অবধি সুখময় দোকানদারি সামলায়। এইসময় দোকানের গুমোট পরিবেশটা কেটে যায়। পাতলা একটা আড্ডাও জমে দোকানের সামনে। সব-ই সুখময়ের বন্ধু ছেলে-ছোকরার দল। হাতে বড় বড় মোবাইল। সেই মোবাইলে হিন্দি গান বাজতে থাকে নয়তো ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচ চলতে থাকে। এইসময় একবার তারের ঝুলুনিতে গরম চা আসে। দোকানের কর্মচারীরা নির্ভার হয়ে একটু চা খায়।
গা-গঞ্জের বাজার বেশি রাত অবধি চলে না। সাড়ে সাতটা কি আটটা বাজতে না বাজতেই বাজার আলো নিভিয়ে ভূতুড়ে হয়ে যায়। একেকটা দোকানের কোলাপসিবল সাটার টেনে, দোল খেয়ে নামানোর সময় বাজ পড়ার মতো আওয়াজ হয়। দোকান বন্ধ করার পর সুখময় বাইকের আলো জ্বালিয়ে চওড়া রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এসে একটা মাটির রাস্তায় ঢুকে পড়ে। রাস্তার একপাশে ঘন গাছ-জংগলের সারি, অন্য পাশে খাবলা খাবলা মাটি তোলা চাষের জমি। এই রাস্তাটি কিছুদূর এগিয়ে ঢালু হয়ে ওই পাট খেতে নেমে গেছে।
পাট খেতের অনেকটা আগে বাইক দাঁড় করিয়ে আলো নিভিয়ে দেয় সুখময়। বাকি রাস্তা সে পায়ে হেঁটে এসে পাট খেতের মধ্যে নেমে পড়ে। পাট খেতে দু’ দিকে বহুদূর অবধি চাষের জমি। বাকি দু’দিকে হালকা গাছপালা, মধ্যে মধ্যে বাড়িঘর। সেদিক থেকেও একটা আবছা রাস্তা এসেছে পাটখেতের ধারে। এই রাস্তা দিয়েই অতসী আসে।
এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে ভাল লাগে না সুখময়ের। মোদকদের দোতলার আলো যেন চোখ বোজা কাপালিক। চোখ খুলে তাকালেই সুখময় ভষ্ম হয়ে যাবে। তাছাড়া হালকা গাছপালাগুলিও যেন কেমন গা ছমছমে। উত্তেজনায় সিগারেট খায় সুখময়।
অতসী অ্যাতো পা টিপে টিপে আসে যে ওকেও ভূতের মতোই লাগে। বেশিরভাগ দিনই ও গায়ে সাদা ওড়না জড়িয়ে আসে। গায়ের কামিজও থাকে হালকা রঙের। পাট খেতে পৌঁছেই ও ছটফট করতে থাকে।
সময় নষ্ট করে না সুখময়ও। দু-একটা মামুলি, এলেবেলে কথার পরেই সে অতসীর মাথার পেছনে যেখানে চুলের গোড়া বেরিয়েছে, সেখানে হাত রাখে। কাচের গ্লাস ফেটে যাবার মতো করে নড়ে ওঠে অতসী। সুখময় কোনো কথা বলে না, যেন কোনো কথারই প্রয়োজন নেই এখন-এমনভাবে অতসীর উরুসন্ধিতে অন্য হাতটা গুঁজে দেয়। অতসী ‘ইসসস’ করে একটা শব্দ করে দুই উরু দিয়ে সুখময়ের কবজিটা চেপে ধরে। দু’দিকের চাষের জমিতে অজস্র জোনাকি জ্বলে-নিভে উড়তে থাকে। বহুদূরে অদৃশ্য পাকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে যায়। যথেচ্ছভাবে অতসীর ঊরুসন্ধি ঘষে তারপর কামিজের ওপর দিয়েই অতসীর জাম্বুরার মতো স্তন দুটো চেপে ধরে সুখময়।
৪
উদাস হাইওয়ের যে জায়গাটি থেকে পাট খেতের সম্পূর্ণটা নজরে আসে, কোনো কোনোদিন সেখানে দুটো হালকা, উড়ন্ত ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সুলেমান আর আক্রম। সুলেমান বলে ‘আক্রমভাই, ওই দ্যাখো মানুষকে কেমন ভূতে ধরেছে।‘
সিগারেটে জোরে টান দেয় আক্রম। ‘ভৌমিক বাড়ির ছোট মেয়েটা না?’
‘বাইরে ও ভৌমিকদের ছোট মেয়ে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও এখন আসলে মেয়ে জ্বিন। দেখছ না কেমন চারপাশে আগুন জ্বলছে।‘
-‘কলেজে-পড়া মেয়ের কাণ্ড দ্যাখো।‘
-‘আগুনের তাপ পাও না আক্রমভাই?’
-‘কী?’
-‘জ্বিনেরা যেখানে থাকে, সেখানে আগুন জ্বলে। এখানেও জ্বলছে। সেই আগুনের তাপ পাও না?’
আক্রম যেন সুলেমানের কথার খেইটা ধরতে পারে না বরং কেন যেন একদলা বিরক্তি জমে যায় তার বুকে। আক্রম সিগারেটের শেষাংস কালো রাতের গায়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে ‘আবার তোর বাল-ছালের কথা! সারাদিন ক’ছিলিম গাঁজা টানিস?’
‘তুমি সুখী মানুষ আক্রমভাই, তাই আগুনের তাপ টের পাও না। শরীরে এখনো হাতির শক্তি তোমার। মনে শান্তি। ভরা সংসার, গোয়াল। তোমার মতো সুখী মানুষদের ভূত ভয় পায় আক্রমভাই।‘
-‘তোরও তো বউ-বাচ্ছা আছে, থাকিস না কেন ওদের সাথে?’
-‘ভাল লাগে না আক্রমভাই। কুকুর কেমন মুখ নিচু জল চেটে খায় দেখেছ? সংসারে গেলেও আমার তাই মনে হয়। তারচেয়ে এই বেশ আছি। সকাল-বিকাল কোনোরকমে অফিসে কাটাই, তারপর ছুটি। কোথায়, কত ভূতে ধরবে আমায় ধরুক।‘
উদাস হাইওয়ের অন্ধকারে রোগা লিকলিকে চেহারার সুলেমানের মুখটা ভাল করে দেখতে পায় না আক্রম। চোখ ফিরিয়ে সে আবার পাট খেতে নিয়ে যায়। পাট খেতের ডোবায় একটি সাদা পরি কী কারণে যেন কুঁকড়ে-মুকড়ে যাচ্ছে।
-‘দশ মিনিট ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাক আক্রমভাই। কোনো শব্দ কোরো না।‘
-‘কেন, তুই কী করবি?’
-‘’তুমি সুখী মানুষ আক্রমভাই, তাই আগুনের তাপ টের পাচ্ছ না। আমি পাচ্ছি। জ্বিনের এই আগুনকে গা থেকে নামাতে হবে।‘ বলে ঝোপের ধারে বসে পড়ল সুলেমান।
দূর থেকে একটা ডাম্পার আসছিল। তার নিরীহ আলোয় দেখা যাচ্ছিল কত দিনের না-কাচা নোংরা, চিপকুস প্যান্ট নামিয়ে ঝোপের ধারে বসে পড়া সুলেমানকে। আক্রম কিছু না বলে একটা পা দিয়ে লাথি মারল ওকে। কোনো শব্দ না তুলেই সুলেমান বোধহয় ঝোপঝাড় ভেঙে নিচু রুক্ষ জমিটায় গড়িয়ে পড়ল।
আক্রম ফিসফিস করে বলল ‘হারামজাদা।‘
তবে আজ সঙ্গে আক্রম নেই। পাট খেত থেকে একটু দূরে জমির খাবলা খাবলা মাটির ভেতরে বুকে ভর দিয়ে শুয়ে আছে সুলেমান। আকাশে শিশুদের দোলনার মতো চাঁদ, ছড়ানো-ছিটানো তারা। মোদকদের বারান্দার যে আলোর আভা এখানে ফিকে হয়ে ছড়িয়ে আছে, তাতে সুলেমানকে লাগছে একটা কাঁকড়াবিছের মতো।
রোমে আচমকা টান পড়তেই অতসী ‘উঃ’ করে উঠল।
-‘কি? ব্যথা লাগে?’ কেমন একটা গলায় বলল সুখময়।
-‘তোমার কি মনে হয়, ব্যথা লাগবে না?’
-‘আমার পাল্লায় পড়লে সোনা এরচেয়ে অনেক বেশি ব্যথা তোমাকে সহ্য করতে হবে।‘
-‘সেটা তোমার ভাল লাগে?’
-‘এতেই তো মজা সোনা, তোমাকে ন্যাংটো করে দুরমুচ করতে পারার মতো আর মজা কীসে? কোমরের গিঁটটা আলগা কর।‘
-‘আর না, অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। বাড়িতে খোঁজ পড়বে।‘
-‘আর, আর একটু। আমি শুধু হাতটা ঢোকাবো।‘
জমির খাবলা খাবলা মাটির মধ্যে শুয়ে কোমরটা একটু ওপরের দিকে ঘুরিয়ে প্যান্টের জিপার খুলে ক্রমশ কঠিন হতে থাকা একটা মোটা রাবার দণ্ডকে আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে উঠতে দিয়েছে সুলেমান। ওর মাথার মধ্যে এখন শুধুই অসাড় একটা চাপ। ভূতে- পাওয়া দুটো মানুষের কথাবার্তা শুনতে শুনতে রাবার দণ্ডটা এক হাতের মধ্যে বের করে আনে ও। যত সময় যায়, ওর মন-মাথায়, হাতের পাঁচটি আঙুলে কলহাস্য করতে করতে সব জ্বিনেরা ঢুকে পড়ে যেন। মানুষ খুন করতে ইচ্ছে করে। খাবলা খাবলা মাটির দলাগুলো চিবিয়ে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করে। উড্ডীন রবার দণ্ডের গায়ে হাতের আঙুলগুলো প্রবল হয়ে ওঠে। অ্যাতো প্রবল, যেন হাই স্পিডে ঘোরা সিলিংফ্যানের পাখা- যা প্রায় দেখাই যায় না। সুখময়ের বাইকটি যখন আবার দূরে আলো জ্বালিয়ে ফিরে যাচ্ছে, তখন খাবলে খাবলে তোলা মাটির গায়ে গড়িয়ে পড়েছে সুলেমানের ফিকে জ্যোৎস্নার মতো বীর্য, আর ভূত পরিত্যক্ত একটা দেহের মতোই সুলেমানের রোগা শরীরটা আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে আছে।
মন্তব্য