.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ

কবিতার বিষয় বিবেচনার ক্ষেত্রে কবির মনোজগোৎ ও ক্রিয়াশীল চেতনায় ব্যবহারিক শিল্পরুচির অবয়ব বিবেচনায় উঠে আসে। কবিতার আঙ্গিকের অনুসৃত পথ ও কবির হৃদয় নিসৃত ভাষা, শিল্পসম্মত ভাবে উপস্থাপনের বিশেষত্বের ইতিহাস। বলতে সন্দেহ নেই, শিল্পের ভাষা ও বিষয়বস্তু একমুখী না, নানা ঘটনা ও বন্দনার সাথে আলোচনা-সমালোচনায় তা পরিবর্তিত হয়। এমনকি তার সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনা কবিকে গভীর ও বিস্তৃতভাবে প্রভাবিত করে। তবে নানা কাব্য-কবিতার গঠনগত ভাষা এবং বিষয় কিন্তু আপাত-দৃষ্টিতে মুখচোরা ঘটনা-মিশ্রিত স্বরপ্রক্ষেপণ-ভঙ্গি দ্বারা বিবেচিত হয় না, বরং জীবনের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান গতিশীল সৌন্দর্য ইঙ্গিতের মায়াজাল কিংবা স্থবির-কালে রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর থেকে রাজনৈতিক ঘটনা-প্রবাহ ঘিরে তৈরি হয় কবিতার আবহ। কিন্তু কবিতা রাষ্ট্রকাঠামোর কোন বন্দি চেতনা নয়। কবিতার শব্দ সর্বদাই স্বাধীন। কিন্তু জাতিসত্তাগত সাংস্কৃতিক বলয়ের ঘেরাটোপের বাহ্যিক রূপ ও পরিস্থিতির অনুভূতি প্রকাশ। শব্দের নিজস্ব ব্যঞ্জনায় উৎসারণ হয় কবিতার চারিত্রিক উন্মাদনা। উপলব্ধির নিশ্বাস নির্মাণ দৃশ্যমান না হলেও, কিন্তু অনুভবযোগ্য কতিপয় বোধের স্বরুপ প্রকাশ ঘটে। তবে কবির ব্যক্তিগত ধারণা ও অভিজ্ঞতার বাস্তব সম্মিলন, আপাতভাবে কবিতার শিল্পরূপ বলা যায়। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সময় উপযোগী ভাবনায় চিহ্নিত করার কাজ কবিতার পরিচিত সীমানা ভেঙে নতুনত্বের স্বপ্ন উদ্ভাবন করে।

সাহিত্যে গুরুত্ব পায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানারূপ দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সাহিত্যের ধারাবাহিকতা কী এবং কেনই বা তা চেতনায় রাখতে হয়, সেই বিষয়টির বহতা কিছুটা বোঝা দরকার। ভারতচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বা মোহিতলাল মজুমদার কিম্বা তিরিশ-উত্তর কবিরাও একেকজনের কাব্যশক্তি একেক রকম বলয়-আঙ্গিকের বিশেষত্ব উপস্থাপন হয়, কবি-সাহিত্যিক-সমালোচকদের বিবেচনায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন-ভিন্ন সময় পরিবর্তনের সাথে-সাথে রাজনৈতিক আবহে তাঁরা নিজেদের কবিতা-সম্ভারের দিক পরিবর্তন করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির চলন পরিবর্তনের কারণ, জাতীয় রাজনীতির পীড়াযুক্ত ঘটনাবলি ও জীবনদর্শন বিভিন্ন সময়ে গুরুত্ব পায়। কবিতার অন্তর্গত প্রকাশভঙ্গি ও প্রকরণ, মধ্যবিত্তের সংকট যুগ-যন্ত্রণায় শিল্পসম্মতভাবে কবিতার মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই শিল্পসম্মত অনুভূতির জগৎকে দৃষ্টিভঙ্গিগত ভাবে প্রকাশভঙ্গিতে উপস্থাপনের কারণ শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে কিছু কথা লিখবো বলে। কিন্তু এখানে বলে রাখা ভালো, শঙ্খ ঘোষের কবিতার দার্শনিক সমাধানের সিদ্ধান্তমূলক অস্তিত্ব না খুঁজে, বরং পাঠকের সরল ভাবনার অনুভবকে যোগাযোগে আনয়ন করাই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। শঙ্খ ঘোষ [৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ - ২১ এপ্রিল ২০২১] বাংলাসাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি ও সাহিত্য-সমালোচক। তাছাও তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিশেষভাবে পরিচিত। তবে বাংলাকাব্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশ আজও যেমন আলোচনায় আছে, তেমনি শঙ্খ ঘোষের সাহিত্য-সম্ভার চিরন্তন দৃষ্টিগোচর হয়। সম্ভবত তিনিই সচেতনভাবে কবিতার বিষয় থেকে শুরু করে বোধের দিকেই পাঠককে মনোযোগী করেন। ফলে তাঁর কবিতার বিষয়, ভাষা শৈলী, সমকালীন রাজনীতি ও আধুনিক কবিতার অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষ ভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিচ্ছিন্নভাবে সমাজের মধ্যেও জাতিগত অস্থিরতা প্রকট হয়ে ওঠে। তাইতো ব্যক্তিগত ব্যথাবেদনা থেকে সমাজের পীড়াযুক্ত ঘটনা ও  সামষ্টিক বিরহ সময়ে-সময়ে কবির দৃষ্টিতে সহজেই উঠে আসে। কবির পর্যবেক্ষণ তাঁর সাহিত্য-রচনায় গুরুত্ব পায়। তাই স্মরণে আসে মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্রের রচিত স্মরণীয় লাইনটি- ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়!’ শত শত বছর আগে সমাজের নানা অবনতির চিত্র ভারতচন্দ্রের দৃষ্টি এড়ায়নি। ঠিক তেমনি কিন্তু শঙ্খ ঘোষ বুঝেছিলেন। তাই মানুষের দুঃখকে নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেন- ‘এইভাবে হতে থাকে ক্রমাগত/কেউ মারে কেউ মার খায়/ভিতরে সবাই খুব স্বাভাবিক কথা বলে/জ্ঞানদান করে’। প্রশ্ন হতে পারে এখানে জ্ঞানদানকে  শঙ্খ ঘোষ ছোট করে দেখেছেন। বিষয়টি মোটেও তেমন না, জ্ঞানদান এখানে  প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সমাজের বৈষম্যমূলক দিকটি প্রতিবাদে কাব্যিক ও শৈল্পিক ভাবে শব্দের আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন।

শঙ্খ ঘোষের কবিতা সর্বদা সজাগ সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত এবং তার সাথে সমাজের যে কোনও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদ ব্যঙ্গাত্মক ভাষার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। দরিদ্র সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক যন্ত্রণার সঙ্গী হিসেবে শঙ্খ ঘোষের কবিতার শব্দ বহমান। সমাজের প্রতিটি অংশে অসাম্য, মানুষের জাগ্রত দায়বোধ ও ন্যায়সংগত দাবির প্রতি তিনি মনোযোগী ছিলেন। শঙ্খ ঘোষ তিরিশ উত্তর জীবনানন্দ দাশের কাব্যশৈলী বা আবহও গ্রহণ করেননি। তবে তাঁর মননে বিষ্ণু দের মার্ক্সবাদী চেতনা সঙ্গ দিলেও, তাকে কিন্তু সরাসরি বিষ্ণু দের উত্তরসূরি হিসেবে উল্লেখ বলা যায় না। এমনকি তাঁর সাহিত্য জগৎ নিজস্ব চৈতন্যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখায়। আবার বুদ্ধদেব বসুর ইউরোপ শাসিত বা ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণপ্রিয় আধুনিক কাব্যসর কিন্তু গ্রহণ করেননি। বরং কবিতাকে স্বপ্নযাত্রায় গণমানুষের হাহাকারকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য চর্চা এবং জীবনযাপনের মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক সত্তা। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল দেশ ভাগের প্রায় নয় বছর পরে ১৯৫৬ সালে। বইটি প্রকাশের পর পাঠককে বিশেষভাবে তাঁর কবিতার প্রতি আগ্রহী করে। কিন্তু তিনি বেড়ে উঠেছেন ব্রিটিশ শাসনের উত্তাল সময়ের মধ্যে। বিশেষ করে ইংরেজ শাসন অবসানের শেষ দিকের দিনগুলো বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ও সামাজিক নানা আন্দোলন তাকে প্রভাবিত করেছিল। এমনকি বাস্তবতার পাশাপাশি অলৌকিক সত্তাকেও শঙ্খ ঘোষ কবিতার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হলে ওই সময়ে অনেকেই তখন ‘বাবরের প্রার্থনা’র কবিতাগুলোকে গুরুত্বসহকারে পঠন-পাঠনের বিবেচনায় রাখতেন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটি জীবনের এক নিবিড় অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ঘটনা-প্রবাহ, যার প্রতিটি পঙক্তি ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং মনে হয় প্রতিটি শব্দই যেন প্রয়োজনীয়। এটা কোন বিচ্ছিন্নতা নয়, সময়ের আবহে কারণে বলা যায়, হৃদয়-ইতিহাসের পরম্পরা। কিন্তু তবে কি শঙ্খ ঘোষের কবিত্বের প্রধানতম পরিচয় ‘বাবরের প্রার্থনা’র কবিতা-সম্ভার! এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের মূল্যায়নের মাপকাঠি এমন হলে হয়তো ভুল হবে। শঙ্খ ঘোষ কি এতোটুকুতেই নিঃশেষ হয়ে যান! আমার তো মনে হয়, তিনি দিনদিন ক্রমাগত কাব্য-কবিতা বিবেচনার ক্ষেত্রে উপস্থিতিই থেকে গেছেন। পক্ষান্তরে, তাঁর সাহিত্য-জগৎ সত্যসুন্দরে আলোচিত হয়ে আছে। কিন্তু আজও তো স্মরণে আসে আন্দ্রেই তারকোভস্কির কিছু কথা- ‘আমরা একে অন্যের শক্তিকে হয় অবমূল্যায়ন করি নয়তো অতি মূল্যায়ন করি। খুব কম মানুষ আছে যার অন্যের সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারে। এটা একটা বিশেষ গুণ। উঁচু মাপের মহৎ মানুষেরাই তা পারে’। এখানে শঙ্খ ঘোষের অতি মূল্যায়নের কোনো কারণই নেই, তবে অবমূল্যায়নের তেমন কোনো দিকও তো খুঁজে পাই না। সরলভাবে বলতে গেলে তাঁর সাহিত্য-সম্ভার পূর্বসুরিদের ধারাবাহিকতায় পরিব্যাপ্ত ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করে। তাই তো পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ [১৯৮০] কাব্যগ্রন্থের ‘উৎসর্গ’ কবিতাটি স্বপ্নে-পাওয়া ঘটনার আবহে লেখা। যার বোধ স্বপ্ন থেকে শুরু। স্বপ্নের মধ্যেই ধাবিত মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি ও আকাঙ্ক্ষা-অনুভূতির দৃশ্যমান ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদান। কাজেই স্বপ্নের আবরণে গতানুগতিক ঘটনা ডিঙিয়ে সময়ের অনুভব সৃষ্টি করে। মনে পড়ে- ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে/নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ’। অতি চেনা শব্দকে কবিতার সংযোগে স্থাপন করে প্রকাশের পরিমিতি বোধ গাঢ় করেছেন। তাঁর কবিতা পড়লে জড়তা আসে না, বরং চিন্তাকে প্রোজ্জ্বল করে তোলে। তাইতো ‘তক্ষক’ কবিতার কিছু পঙক্তি দৃষ্টান্তে উঠে আসে- ‘তোমার কোনো মিথ্যা নেই তোমার কোনো সত্য নেই/কেবল দংশন/তোমার কোনো ভিত্তি নেই তোমার কোনো শীর্ষ নেই/কেবল তক্ষক...।’ এখানে মহাভারতের ‘তক্ষক’ স্মৃতির অন্তহীন রহস্যে ভরে। কিন্তু ‘তক্ষক’ শব্দটির প্রয়োগ প্রতীকী ভাবে বা ব্যাঙ্গার্থ আশ্রয়ে, কবিতার শব্দে বহন করে চলে দুঃখ-বেদনা। একই সঙ্গে কবিতায় ব্যক্তিগত ও সামাজিক হৃদয়ের দ্রোহ প্রকাশ পায়। প্রতীয়মান হয় কবিতার ভাবের বিচিত্র সম্পর্ক-সংহতি। রহস্যের ঐক্য তৈরি করে এবং সেইসাথে পাঠককে কবিতার চিরন্তন পথে ধাবিত করে। চিন্তার অন্তর্গত বিরোধিতার মধ্যে সাবলীলভাবে শঙ্খ ঘোষ বলে ওঠেন- ’জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন/কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?’। কবিতায় জলের অস্তিত্ব কোন এক পরিণাম ডেকে আনে। কিন্তু এই জল কোথায় এবং কীভাবে কবিতায় অনিবার্য হয়ে ওঠে? তার কী সঠিক কোন দিক খুঁজে পায়? এমন ঘটনার প্রকৃত সুরাহা পায় কী? তবে যন্ত্রণা আর বেদনার ভার এসে জাগে বোধে। ব্যক্তিগত আর্তির বাহিরে কবিতার পরিমিতি-উচ্ছ্বাস বিস্তৃত হয়। কিন্তু বুঝি, কবিতা একধরনের শব্দের আচ্ছন্নতা। তবে কেউ কেউ শব্দ আর বোধে নিজ কবিত্বের দ্বারা সমাজ-ঐতিহ্যের সাথে একটা সংযোগ তৈরি করেন। তেমনভাবে রবীন্দ্রনাথ কিম্বা জীবনানন্দ দাশের কথা বলা যায়, তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মকে এখনো তাদের সাহিত্য-সম্ভারের সাথে যোগাযোগে রেখেছেন। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ স্বভাবকবির মতো ভাষা-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য-সমূহ পর্যবেক্ষণ রেখে, কাব্যভাষা তৈরিতে দুর্দান্ত নানা বিষয়কে সহজেই তাঁর কবিতায় উপস্থাপন করেন।

প্রসঙ্গক্রমে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু-উপলব্ধি, অনন্ত বিরহদহন, আমরা দেখতে পাই তাঁর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ‘মৃত্যু’ কবিতাটির বোধ প্রকাশে, যেখানে তিনি মৃত্যুকে আলো-আঁধারের মতো অবলীলায় হৃদয়ের অভিঘাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন- ‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে/ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।/সংসারে বিদায় দিতে, আঁখি ছলছলি/জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি/দুই ভুজে’। যেন শব্দগুলো থেকে জীবনের বাস্তব অভিঘাত ধেয়ে ওঠে। তবে প্রায় যাপনসত্যের ভেতর বিয়োগ-বেদনা বহমান। কিন্তু ঠিক অন্যভাবে শঙ্খ ঘোষ বলেন- ‘আমি কি মৃত্যুর চেয়ে ছোট হয়ে ছিলাম সেদিন?/আমি কি সৃষ্টির দিকে দুয়ার রাখিনি খুলে কাল?/ছিল না কি শষ্পদল আঙুলে আঙুলে? তবে কেন/হীনতম অপব্যয়ে ফেলে রেখে গেছ এইখানে?’। অদ্ভুত ব্যপার হলো শঙ্খ ঘোষ এখানে মৃত্যুর প্রভাবটা দীপ্যমান করেননি, বরং মৃত্যু’কে কিছুটা পাত্তা দিলেন সেদিন, এমনটা মনে হয়। তবে মৃত্যুর অনন্ত স্বপ্নযাত্রা ও আনন্দ কবিতার বিষয়ের সঙ্গে অন্তর্লীন করে।

এমনকি কবিতাকে দুর্বোধ্যতায় প্রচ্ছন্ন না করে, অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে সমাজ ও সাধারণ মানুষের দুঃখ, প্রেম, দৈনন্দিন-সম্পর্ক, নিসর্গ-বোধ সহজ ভাষায় কবিতায় বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন। তবে সামাজিক-রাজনৈতিক চলমান ঘটনা প্রবাহ এবং ভাষা ও সংস্কৃতির সত্যরূপকেই সর্বদাই প্রধান্য দিয়েছেন। সেহেতু, তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় অকপটে বলেছেন- ‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার’। সমাজের নিকট দায়বদ্ধতার কথা, এই লাইনটির মধ্য দিয়ে প্রতিটি কবিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। চিরকালই অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষ অত্যাচারিত হয়, তাদের রক্তে সর্বদাই নিত্যদিনের মুখচোরা গল্প রচিত হয়। সাধারণ নিপীড়িত মানুষের পক্ষে তাঁর কবিতার শব্দগুলো প্রতিবাদী, সংবেদনশীল ও শুরু থেকে সোচ্চার থেকেছে। এমনকি স্মরণে আসে, ১৯৫১ সালে কুচবিহারে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া ষোল বছরের সেই ছোট এক কিশোরীর কথা। তাঁর নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ ‘যমুনাবতী’ কবিতাটি লিখেছিলেন। এই কবিতাটি পুলিশের আধিপত্যকামী মনোভাবের বিরুদ্ধে, মর্মবেদনার প্রতিধ্বনি ও রক্তের হাহাকারকে জাগ্রত করে। তাই সবসময়েই শঙ্খ ঘোষ গণমানুষের প্রতিনিধি। শোষণ-নিপীড়ন ও বিরাজমান অপরাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপক্ষে প্রতিবাদে প্রচ্ছন্ন ভাবে তাঁর কবিতা চিরকাল সাধারণ মানুষের প্রেরণা। ফলে তিনি ভেদাভেদ ভুলে সকল গোত্রের মানুষের পক্ষে সরলভাবে কথা বলেন- ‘আমার ধর্মও নেই আমার অধর্ম নেই কোনো/আমার মৃত্যুর কথা যদি কেউ দূর থেকে শোনো/জেনো- এ আমার মাটি এ কাল আমার দেশকাল’। অস্পষ্টতা নয় কিন্তু স্বঃতপ্রণোদিত নিজস্ব অনুভ‚তির আয়োজন।

তাই শঙ্খ ঘোষের কবিতা যে সকল বর্ণনাত্মক উপাদান আছে, তা সময় উপলব্ধির নির্যাস মাত্র না। বরং মানুষের সম্পর্কের ভেতর একটা অন্তর্ময় জমাট বাঁধা হৃদয়ের ভাষা প্রকাশের বৈশিষ্ট্য। এমনকি বর্ণনাত্মকরীতি তাঁর উপলব্ধির ভাষা এবং কবিতার বোধকে যেমন সহজ-সরল ভাবে উপস্থাপন করে, তেমনি পাঠকের চৈতন্যকে সমৃদ্ধি করে।

গণমানুষের প্রতিনিধি কবি শঙ্খ ঘোষ
চঞ্চল নাঈম

মন্তব্য

BLOGGER: 3
  1. বাংলা কবিতা ও গদ্যের গুরু শঙ্খ ঘোষ। বিষয়ের সম্ভাব্য সমস্ত দিকেই তাঁর গদ্যের সহজ স্রোত আমাকে বিস্মিত করে। তাঁর কবিতা সমুদ্রের নীচের দিকের স্থির ও গভীর জলের মতোই পাঠক হৃদয়ে নিজেকে বিস্তার করে রাখে। স্ব-সময়কে ছেঁকে তুলে ধরে চিরসময়ের বহমানতায়। এমনই এই কবিকে নিয়ে, তাঁর কবিতাকে নিয়ে আপনার এই গদ্য প্রচেষ্টা খুব ভালো লাগলো পড়ে।

    উত্তরমুছুন
  2. শঙ্খ ঘোষ নিয়ে দারুণ লিখেছেন কবি চঞ্চল নাঈম।

    উত্তরমুছুন
  3. শঙ্খ ঘোষ নিয়ে দারুণ লিখেছেন কবি চঞ্চল নাঈম।

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,305,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ
শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে প্রবন্ধ
বিন্দু। বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিন। কবি শঙ্খ ঘোষ / প্রবন্ধ
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEiTnYxLt-82tJ5XyJPUTcZ1gucB72iAJMB4bd8eVoOMMVCzVl_EQQcE-xXjvK91hox4Mn4iHIYXAZE99en9hMqgjB1nt6Lx8CGMt0M5ioCbmsUkUXFCJZ4-pVLrwmS_e20rXzFwNrCrXWaDdQHtIVP2OBKpydo8cuqO_QBfEpw2jtBqpNJkGLKkhwK5=s320
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEiTnYxLt-82tJ5XyJPUTcZ1gucB72iAJMB4bd8eVoOMMVCzVl_EQQcE-xXjvK91hox4Mn4iHIYXAZE99en9hMqgjB1nt6Lx8CGMt0M5ioCbmsUkUXFCJZ4-pVLrwmS_e20rXzFwNrCrXWaDdQHtIVP2OBKpydo8cuqO_QBfEpw2jtBqpNJkGLKkhwK5=s72-c
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2022/02/Shankha-Ghosh.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2022/02/Shankha-Ghosh.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy